পর্ব ১৭
জানার মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান
অনেক দিন পরে স্বপনদা ফোন করল। আমি অফিস থেকে ফেরার পথে দোকানে ঢুকেছি। জানতে চাইল ক্রিস্টিনা কেমন আছে। ওর হার্ট সংক্রান্ত কিছু সমস্যা ছিল। তখন স্বপনদার কাছে জানতে চাইছিলাম। ভাগ্যিস দোকানে ছিলাম। তাই বললাম পরে ফোন করব। আসলে ক্রিস্টিনার সমস্যার কথা ভুলেই গেছিলাম। মাঝে এক-আধ বার অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওষুধ খাচ্ছে কিনা, ডাক্তার দেখিয়েছে কিনা জানতে চেয়েছিলাম। তবে আমি নিজে যেমন ইন্টারোগেশন পছন্দ করি না, ছেলেমেয়েরাও না। ওরা যখন ছোট ছিল সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম ডাক্তারের কাছে। এখন ওদের নিজেদের হাত-পা গজিয়েছে, তাই আমার কাঁধের দরকার তেমন নেই। তবুও স্বপনদাকে কল করার আগে ক্রিস্টিনাকে কল দিলাম। যা ভেবেছিলাম— পাওয়া যাবে না, হয় ভোকালে ক্লাসে, নয়তো এয়ারফোনে কান বন্ধ।
স্বপনদাকে ফোন করে তাই বললাম ক্রিস্টিনা অনেক দিন তেমন কোনও অনুযোগ করেনি। মনে হয় ভালই আছে। এই আমার এক সমস্যা। কেউ কিছু না বললে জিজ্ঞেস করা হয় না। যাহোক, স্বপনদা তখন একটু অবাক করে দিয়েই বলল— শোন যে জন্য তোকে ফোন করা। সুধীরদাকে নিয়ে তোর লেখাটা পড়ছিলাম। ওখানে কিছু কথা ঠিক ও রকম নয়।
এবার আমার অবাক হবার পালা। প্রথমত স্বপনদা যে লেখাগুলো পড়ে সেটাই ভাবিনি। বিশেষ করে এত বড় লেখা। দ্বিতীয়ত স্বপনদা দেশ ছেড়ে চলে গেছে আমার জন্মের পর পর। লেখাটা পুরোটাই এর পরের কাহিনি। তাই একটু অবাক হলাম।
—শোন ওই যে তুই লিখেছিস ডাকাতরা তোকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল, কথাটা ঠিক নয়।
—দেখ, আমার বয়স তখন ছয় মাস। ওটা পুরোটাই অন্যের মুখে শোনা। মা, দিদি, তপনদা, কল্যাণদা, রতন সবাই তো এটাই বলত।
—আসলে ঘটনাটা এরকম নয়। ডাকাতরা প্রথমে জ্যাঠামশাইয়ের ঘরে ঢুকে। ওখানে লোহার সিন্দুকে থাকত সব টাকাপয়সা, সোনাদানা। আর চাবি থাকত বাবার কাছে, আমাদের ঘরে। জ্যাঠামশাই অবশ্য বাবার কথা বলেনি। ওরা তখন দরজা ভেঙে আমাদের ঘরে ঢুকে। বাবা-মা’কে ভয় দেখাতে থাকে। তুই শুয়েছিলি বিছানায়। ওরা চাবির খোঁজে তোষক উল্টাতে শুরু করে। আমার মনে হয়েছিল তুই তোষকের নীচে চাপা পড়ে যাবি। তাই ডাকাতদের বলেছিলাম। ওরা সরে গেলে আমি তোকে কোলে তুলে নিয়েছিলাম। তাছাড়া আমাদের সবার বই আমি গুছিয়ে রাখতাম। চাবির খোঁজে ওরা বই এলোমেলো করতে শুরু করলে ওদের বইয়ে হাত দিতে না করেছিলাম।
—তাহলে যে সবাই বলত আমাকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল?
—আসলে ঘরে তখন প্রচণ্ড হইচই। ওদের হাতে মশাল। তাই সবাই ওরকম ভেবেছিল। আমি কাউকে এ নিয়ে কিছু বলিনি।
—তাই তো দেখছি।
—তাছাড়া সবার ধারণা আমি ভয় পেয়ে ইন্ডিয়া চলে আসি। ওটা ঠিক নয়। আসলে আমি অনেকটা হাবাগোবা টাইপের ছিলাম। কী হতে পারে সে ধারণা ছিল না। তাই ভয় ছিল না। আসলে তখন এক এক করে আমাদের কোলকাতায় পাঠাচ্ছিল লেখাপড়া করতে। ভাগুদা, দীপুদা চলে গেছে। শ্যামলদা রাজি হয়নি। তাছাড়া ডাকাতির পর পুলিশের জেরা শুরু হয়। আমি বলতে শুরু করি কে কেমন দেখতে ছিল। এতে হয়তো বাড়ির লোকেরা প্রমাদ গণে আবার কোনও সমস্যায় পড়ি কিনা। আমাকে যখন জিজ্ঞেস করল কোলকাতা যাব কিনা পড়াশুনা করতে, আমি রাজি হয়ে গেলাম।
—তাই!
—তাছাড়া তখন তো ভাবিনি আর দেশে ফিরব না। আমি তখন ছোট। পাসপোর্ট বা কোনও ডকুমেন্ট ছিল না। কাকা রেখে আসে। এরপর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হল। যাতায়াত কঠিন হয়ে গেল। আমার কোনও ডকুমেন্ট নেই। এরপর আর জি কর। নকশাল। না নাগরিকত্ব না কিছু। ফলে সরকারি চাকরি ছাড়তে হল। কারণ যখন পাসপোর্ট নিতে চাইলাম তখন ডকুমেন্ট দরকার। ডকুমেন্ট ছাড়া কীভাবে সরকারি চাকরি পেলাম সেই প্রশ্ন আসতে পারে। ইতিমধ্যে আমি বিয়ে করেছি। তোর বউদির ভারতীয় নাগরিকত্ব ছিল। আমি ওই সূত্র ধরে ভারতীয় নাগরিকত্ব পেলাম।
আমি মনে মনে বললাম আমিও বইয়ের লেজ ধরেই রুশ নাগরিকত্বের বৈতরণী পার হয়েছি। ইস, বউয়ের লেজ? কখনও তো খুঁজে দেখা হয়নি। এবার দেখতে হবে।
রুশরা বলে শত বর্ষ বাঁচি, শত বর্ষ শিখি। হ্যাঁ, নিজে যখন ৬০ ছুঁই ছুঁই তখন নিজের সম্পর্কে নতুন তথ্য জানলাম। এটা ঘটেছিল আমার বয়স যখন মাত্র ৬ মাস। নিশ্চয়ই এর আগেও কিছু না কিছু ঘটেছিল, কম করে হলেও জন্ম নিয়েছিলাম (যদিও তাতে আমার কোনও ক্রেডিট ছিল না), হয়তো ইতিমধ্য এক-আধটা দাঁত উঠেছিল, হয়তোবা বসতেও শিখেছিলাম। তবে ওসব সবাই করে। শুধুমাত্র বিশেষ ভাগ্যবানরা ডাকাতের হাত থেকে নিজেকে ছিনিয়ে আনতে পারেন, ঠিক যেমন ব্যারন মুনচাউসেন নিজে নিজেকে ডোবা থেকে টেনে তুলতে পারে। এভাবেই জীবনের সবচেয়ে পুরানো ও অন্যতম প্রধান একটা মিথ তাসের ঘরের মত ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কিন্তু এরকম ঘটনা জীবনে প্রথম নয়।
কসমোলজির ওপর আমার গবেষণা শুরু হয় অনেকটা কাকতালীয়ভাবে। আমি যখন সাবজেক্ট চেঞ্জ করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে ফিজিক্সে চলে আসি তখন এই সাবজেক্টে বাংলাদেশের ছাত্র বলতে আর কেউ ছিল না। সবাই চাইত ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে। অর্থের মত না হলেও অর্থনীতির বেশ কদর ছিল। পদার্থবিজ্ঞান, গণিত— এসব ছিল দুর্ভাগাদের জন্য, যারা সাবজেক্ট চেঞ্জ করতে না পেরে এখানেই থেকে গেছে। তবে একসময় অনেক বাংলাদেশি সুনামের সঙ্গে এখানে পড়াশুনা করেছে। এখন একমাত্র জেরিনা আপা বাদে সবাই পিএইচ.ডি করছেন। আমি যখন প্রথম বর্ষে অমলদা তখন পিএইচ.ডি থিসিস ডিফেন্ড করেন। দেশে ফেরার কয়েকদিন আগে কার সঙ্গে কাজ করা যায় সেটা জানতে চাই। তাঁর পরামর্শেই কাজ শুরু করি ইউরি পেত্রোভিচ রিবাকভের অধীনে। কাজ করি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আইনস্টাইন-ডি ব্রগ্লি-ব্যোম কনসেপ্টের ওপর। এ বিষয়ে মাস্টার্স করি। কিন্তু পিএইচ.ডি-র থিসিসের ওপর কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারি সমস্যাটা খুব জটিল। পাশাপাশি অন্য কোনও বিষয়ে কাজ না করলে সময় মত থিসিস ডিফেন্ড করা হবে না। আমার ইচ্ছে ছিল সুপার সিমেট্রির ওপর কাজ করার। কিন্তু ইউরি পেত্রোভিচ বললেন তাঁর এক ক্লাসমেট কসমোলজির ওপর কাজ করছেন। তাঁর অনেক দিনের ইচ্ছে কিছু জয়েন্ট ওয়ার্ক করার। আমি যদি চাই তাঁর সেই বন্ধু গিওর্গি নিকোলায়েভিচ শিকিনের সঙ্গে কাজ করতে পারি। এভাবে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই আমার কসমলোজির জগতে প্রবেশ। পরে আমি এই বিষয়ের ওপর পিএইচ.ডি এবং ডিএসসি থিসিস ডিফেন্ড করি। কাজের শুরু থেকে সব সময়ই মনে একটা সন্দেহ ছিল, কী যেন একটা মিস করছি। কোথায় যেন একটা ভুল আছে। কিন্তু যতবারই শিকিনকে বলেছি তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন। ২০১০ সালে আমার এখানে একজন প্রফেসর আসেন কাজ করতে। একদিন কথায় কথায় বললেন— বিজন, চলো, এই প্রবলেমটা নিয়ে কাজ করি।
এই বলেই একটা পেপার হাতে ধরিয়ে দিলেন। একটু দেখেই বললাম— এখানে কিছু ভুল আছে।
—কেন? এ নিয়ে অনেকের অনেক কাজ আছে। আমার নিজের পেপার আছে। ভুল কেন?
—গাণিতিক কিছু অসামঞ্জস্য।
তারপর কোনও কথা না বাড়িয়ে নিজেই ক্যালকুলেশন করে তাঁর হাতে দিলাম। উনি একদিন সময় নিলেন। পরের দিন বললেন— তুমি যে সমীকরণের কথা বলছ, সেটা প্রথম দুই সমীকরণের লাইনিয়ার কম্বিনেশন।
—হ্যাঁ, এর মানে যদি প্রথম দুটো সমীকরণের ডান দিকে কোনও পরিবর্তন আনা হয়, সেটা এই তৃতীয় সমীকরণের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই করতে হবে।
যাহোক, উনি বললেন, এই বিষয়ে তাঁর ও তাঁর বন্ধুদের অনেকগুলো পেপার। তাই তিনি কোনও চেঞ্জ না করেই সেটা প্রকাশ করবেন। আমি তাঁর মঙ্গলকামনা করলাম। কয়েকদিন পরে তিনি সেই পেপার গ্রহণের চিঠি দেখালেন। আমি বললাম— দেখুন, পুশকিন বা রবীন্দ্রনাথ যদি ছন্দ ঠিক রেখেও ভুল রুশ বা বাংলায় লিখতেন, সেটা কি গ্রহণযোগ্য হত? গণিত পদার্থবিদ্যার ভাষা। এখানে যদি ভুল থাকে আর সেটা যদি আপনি জানেন— তাহলে এ ধরনের পেপার প্রকাশ করা ন্যায়সঙ্গত নয়।
যাই হোক, এই ঘটনার পরে আমি ভাবতে শুরু করলাম কেন এমন হয়? আসলে প্রায় প্রতিটি বিষয়ে প্রাথমিক কাজগুলো হয় যতদূর সম্ভব সহজ উদাহরণ ব্যবহার করে। কসমোলজির প্রথম দিকের কাজে মূলত ভ্যাকিউম আর আদর্শ তরল ব্যবহার করা হত। ফলে অনেক শর্ত অটোম্যাটিক্যালি ফিট হত। কিন্তু যখনই আমরা জটিল কোনও পদার্থ ব্যবহার করি আগের সেই শর্তগুলো তাৎক্ষণিকভাবে পূরণ হয় না, সে জন্য নতুন কোনও শর্ত আরোপ করতে হয়। অর্থাৎ সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাধানের জন্য আমাদের সমীকরণের দুদিকটাই একই সঙ্গে বদলাতে হবে। আইনস্টাইনের সমীকরণের বিশেষত্ব এই যে, সেখানে পদার্থ যেমন স্থান-কালকে বিবর্তিত করে, স্থান-কালের বিবর্তন তেমনই পদার্থের অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়। এর আমি নিজের পুরনো কাজগুলো নতুন করে দেখতে শুরু করলাম, দেখলাম আমাদের আগের কাজ ভুল না হলেও তার উপসংহারগুলো আংশিকভাবে সত্য। সঠিক ফলের জন্য অন্যান্য সমীকরণ ব্যবহার করতে হবে যা সিস্টেমের ওপর বিভিন্ন বাধানিষেধ আরোপ করে। শিকিনকে এটা বলায় তিনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন।
—তাহলে কি আমি সারা জীবন যা করে এলাম সব ভুল?
—না। সেটা আংশিক সত্য। সুখের খবর যে সেটা আমরা নিজেরাই ধরতে পেরেছি। আমাদের কাজই তো ক্রমশ উৎকর্ষতা লাভ করা।
কিন্তু তিনি খুব একটা খুশি হয়েছিলেন বলে মনে হয় না। আসলে প্রতিটি মানুষ, তিনি ধার্মিকই হোন আর বিজ্ঞানীই হোন, এক পর্যায়ে নিজের কাজের সত্যতায় বিশ্বাস করেন। যদিও বিজ্ঞানী জানেন এ সত্য সাময়িক, তাকে নতুন প্রশ্ন করে নতুন উত্তর বের করতে হবে তারপরেও তিনি যে কোনও ভুলের ওপর ভিত্তি করে বা আমাদের এক্ষেত্রে কিছু জিনিস এড়িয়ে যাওয়ায় একটা উপসংহারে এসেছিলেন সেজন্য নিজেকে অপরাধী মনে করছিলেন। তাই অনেক দিন কোনও কিছুকে সত্য বলে জেনে হঠাৎ যদি জানতে পারি সেটা ঠিক নয় তাহলে সেটা অনেকেই গ্রহণ করতে পারে না। এটা অনেকটা কেউ আজীবন কাউকে বাবা-মা জেনে এসেছে, পরে এক সময় শুনল সে আসলে দত্তক সন্তান।
স্বপনদা দেশ ছেড়ে চলে যায় আমার ছয় মাস বয়সে। তাই তখন আমাদের কথা হয়নি। শুধু গল্পে শুনেছি। প্রথমবার আমাদের দেখা হয় ১৯৬৯ সালে আমরা কোলকাতা বেড়াতে গেলে। ও তখন আর জি করে পড়ে, হস্টেলে থাকে। তাছাড়া আমিও খুব ছোট তাই সে সময়ে আমাদের তেমন কোনও কথা হয়েছে বলে মনে পড়ে না। শুধু ছবি দেখে বুঝি তখন দেখা হয়েছিল। এরপর আমি কোলকাতা যাই ১৯৭২ সালে। স্বপনদা তখন নকশালের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। পলাতক। মা যেখানেই কোনও খবর পান সেখানে ছুটে জান। সেই সঙ্গে আমি। অন্য দিকে বহরমপুরে আমার মাসতুতো ভাইও একই পথের পথিক। আর দুই বোনের এই নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। আমরা নিজেরা সাত ভাই এক বোন। মাসিমার চার ছেলে চার মেয়ে। কিন্তু যতদিন ওরা উধাও ছিল, সারা বাড়ি জুড়ে যেন ওদের অস্তিত্ব ছিল আরও অনেক বেশি করে। তাই দেখা না হলেও স্বপনদা সব সময়ই আমাদের চিন্তায় ছিল। আর আমার কাছে যতটা না ছিল বাস্তবে, তার চেয়ে বেশি গল্পে। মনে আছে মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’ অথবা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব পশ্চিম’ পড়ে বার বার মনে হত স্বপনদা আর দিবসদার কথা।
এরপরে ১৯৮৯ সালে যখন মাস্টার্স শেষ করে দেশে ফিরি তখন কোলকাতা যাই বাবার সঙ্গে। স্বপনদা তখন বিয়ে করেছে যদিও থাকে আর জি কর-এর হস্টেলে। কখনও কখনও ওখানেও থেকেছি। তবে সে সময় অনেক কথা হত ওর রুমমেটদের সঙ্গে যারা ফটোগ্রাফি করতেন। আসলে অনেক বড় হয়ে ভাইবোনদের সঙ্গে পরিচয় হলে সেটা অন্য রকমের হয়। যদিও দীপুদার সঙ্গে কথা বললে দেশের অনেকের কথাই জিজ্ঞেস করে, স্বপনদা সেটা করে না। আসলে আমাদের কমন স্মৃতি খুব কম। আর মানুষের কথা বলার মূল বিষয় কমন স্মৃতি, কমন ইন্টারেস্ট বা কমন মূল্যবোধ। যদিও আমি সব সময়ই চেষ্টা করেছি বাবা-মার ছোটবেলার কথা জানতে, স্বপনদাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হয়নি। জিজ্ঞেস করা হয়নি ওর রাজনৈতিক জীবনের কথা। এমনকি ১৯৯৭ সালে পুনায় রিলেটিভিটির ওপর এক কনফারেন্সে যোগ দেবার সময় বা ২০১৪ সালে ভারতের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভিজিটের সময় দেখা হলেও এসব নিয়ে কোনও কথা হয়নি।
বছর দুয়েক আগে স্বপনদা ওর এক বন্ধু কৃষ্ণলাল সরকারের কথা বলে। আমার লেখা মনে হয় ওঁকে পড়তে দিত। পরে ফেসবুকে আলাপ। কৃষ্ণলালদা তাঁর ‘দাবানল’ আমাকে পড়তে দেন। এটাই আমার পড়া প্রথম বই যার লেখক নকশাল আন্দোলনের ভেতর থেকে সব কিছু দেখেছেন আর সেই অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন। আবারও সেখানে কেন যেন মনে হয় স্বপনদার দেখা পাই। অবশ্য সেটা হয়তো আমার মনের ভুল। এভাবেই আমাদের সঙ্গে সেই সময় যাঁরা নকশাল করতেন বা স্বপনদার বন্ধু ছিলেন তাঁদের অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়। তাদের একজন ছিলেন অধৃষ্যদা। এরপর আলাপ হয় দিলীপদার সঙ্গে, দিলীপ ব্যানার্জি— বিখ্যাত ফটোগ্রাফার। সে গল্প অন্য কোথাও।
বিজ্ঞানী সত্যসন্ধানী। মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে সত্যের সন্ধান পাওয়া যায় না। যেহেতু নতুন নতুন তথ্য আমাদের নতুন সত্যের মুখোমুখি করে, অনেক মিথ্যা তাই যতটা না আমাদের সত্য জানার অনীহা তার চেয়ে বেশি সঠিক তথ্যের অভাব। তবে একজন বিজ্ঞানী ভুল স্বীকার করতে দ্বিধা বোধ করেন না। এক পরিস্থিতিতে যেটা সঠিক বলে মনে হয় ভিন্ন পরিস্থিতিতে সেটা ভুল হতেই পারে। আসলে এই পরিস্থিতির ভিন্নতা সাধারণ সমস্যাকে বিশেষ সমস্যার রূপ দেয়। নতুন তথ্য বা জ্ঞান তাই শুধু সমস্যার সমাধানই দেয় না, নতুন সমস্যাও তৈরি করে।
এক সময় মনে হত শুধুমাত্র বিখ্যাত সব মানুষের জীবনই বিভিন্ন মিথ দিয়ে ঘেরা। এখন দেখা গেল আমার মত একজন মানুষও একটা মিথ বা মিথ্যা ধারণার ওপর এতদিন বেঁচে ছিল। সবচেয়ে বড় কথা হল, এটা শুধু আমার একার নয়, বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজবে, বিভিন্ন লেখায় আমাকে ডাকাতদের পুড়িয়ে মারার চেষ্টা আর তাদের হাত থেকে স্বপনদার আমাকে রক্ষা করার গল্প বলেছি। এখন দেখা গেল ঘটনা ঠিক হলেও তাঁর ইন্টারপ্রিটেশনে ভুল ছিল। পুড়ে নয়, তোষক চাপা পড়ে মরার সম্ভাবনা ছিল। আগুনে পুড়ে নাকি লেপ-তোষকের নীচে দম বন্ধ হয়ে মরা ভাল সেটা বলতে পারব না, আর সে বয়সে এসব বোঝার বুদ্ধি ছিল বলে মনে হয় না— তবে শেষমেশ যেটা হয়েছে সে অবস্থায় সেটাই শ্রেষ্ঠ আউটকাম— বেঁচে থাকা আর প্রায় ষাট বছর পরে সত্য জানা। পদার্থবিদ— যার কাজই সত্যের অনুসন্ধান— তার কাছে এর চেয়ে ভাল খবর আর কী হতে পারে?
[দুবনা, ০৫ মে ২০২৩]
চিত্র: লেখক
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ২
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৩
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৪
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৫
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৬
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৭
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৮
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৯
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১০
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১১
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১২
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৩
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৪
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৫
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৬