পর্ব ২
ভেজাল রক্ত
ফটোগ্রাফির প্রতি আমার আগ্রহ অনেক আগে থেকেই। সত্তরের দশকের প্রথম দিকে, কল্যাণদা যখন মানিকগঞ্জ সরকারি বালক বিদ্যালয়ে পড়ত, তখন প্রাইজ বন্ড খেলত। মাঝেমধ্যে পুরস্কার পেত। এভাবেই ও একবার একটা আগফা ক্যামেরা পায়। সেটা দিয়েই হাতেখড়ি ছবি তোলার, যদিও দেশে এটা ছিল শুধুই ক্ষণিকের শখ।
১৯৮৩ সালে মস্কো আসার আগে আজাহার ভাই বুলগেরিয়া থেকে আনা ফেদ ক্যামেরা আমার হাতে ধরিয়ে দেন সেটা ঠিক করার জন্য। রাশান ক্যামেরা বলে দেশে সারানোর ব্যবস্থা ছিল না, যদিও সমস্যা ছিল খুবই মাইনর। মস্কো আসার কয়েকদিনের মধ্যেই সচল ক্যামেরা হাতে আসে। শুরু হয় ছবি তোলা। পরের বছর নির্মাণ কাজে অংশ নিয়ে একটা জেনিথ ১১ ক্যামেরা কিনি। প্রথম দিকে আশপাশের বনবাদাড়, পাখি ও শহরের পাশাপাশি বন্ধুদের ছবি তুলতাম আর রাত জেগে চলত সব সেই নেগেটিভ প্রসেস, ছবি প্রিন্ট এসব কাজ। ধীরে ধীরে যোগ হতে থাকে বিভিন্ন ধরনের লেন্স, ফিল্টার ইত্যাদি আর দেখতে দেখতে বই পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফটোগ্রাফিও পরিণত হয় অন্যতম প্রধান হবিতে। এরপর আসে জেনিথ ১৯ ক্যামেরা ১৯৮৯ সালে, যা ২০০৬ পর্যন্ত বেশ ভাল সার্ভিস দিয়েছে। এখন ও আমার বাসায় পেনশনে আছে।
যদিও দুবনায় মুভ করি ১৯৯৪ সালে, ২০০৫ পর্যন্ত স্থানীয় ফটোগ্রাফারদের সঙ্গে পরিচয় ছিল না। হঠাৎ ওদের সঙ্গে আলাপ আর ২০০৬ সালে কয়েকজন মিলে ‘ফোকাস’ নামে এক ফটো ক্লাব গঠন, যা এখনও কাজ করছে। ইতিমধ্যে ভোলগার বাম পাড়ে ‘অব্রাজ’ নামের ক্লাবের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ি। ফটোগ্রাফি আমার কখনও ওইভাবে শেখা হয়নি। সাধারণত আর্টিস্টদের অ্যালবাম কিনতাম আর সেসব দেখে ছবি তুলতাম। এমনকি ছবির কম্পোজিশনের মূল নীতিমালাও জানতাম না। পরে ফটো ক্লাবে গিয়েই বিভিন্ন নিয়মের কথা জানতে পারি, যদিও না জেনেই আগে অনেকটা সেভাবেই ছবি তুলতাম।
২০০৫ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত দুবনা, ট্রিয়েস্ট, বুখারেস্ট, মস্কো, ঢাকা-সহ বিভিন্ন জায়গায় দশটা সোলো এগজিবিশন হয়েছে, এছাড়া ‘ফোকাস’ আর ‘অব্রাজ’-এর সঙ্গে ছিল অসংখ্য কালেক্টিভ এগজিবিশন। ২০১২ সালে যখন বাংলাদেশের ওপর দুবনায় শ’দেড়েক ছবির এক প্রদর্শনী করি তখন এক কলিগ কাম সাংবাদিক তাতিয়ানা কিছু প্রশ্ন করেন। তিনি বাচ্চাদের নিয়ে ‘জীবন্ত টুপি’ নামে এক ম্যাগাজিন প্রকাশ করতেন। সেই প্রশ্নগুলি বা সঠিকভাবে বলতে গেলে একটা প্রশ্ন আমার পরবর্তী ফটো তোলার ক্ষেত্রে বেশ প্রভাব ফেলে।
আসলে আমরা যখন পড়াশুনা করি তখন তার পেছনে সঠিক কোনও লক্ষ্য থাকে, যেমন কেউ ডাক্তার হতে চায়, কেউ বা ইঞ্জিনিয়ার অথবা অন্য কোনও বিশেষজ্ঞ। কিন্তু হবি তো শখের জিনিস, সেটা মানুষ করে আনন্দের জন্য। কিছু না ভেবে। তাই তাতিয়ানা আমাকে যখন জিজ্ঞেস করল, আমি কেন ছবি তুলি, স্বাভাবিকভাবেই একটু চমকে উঠলাম। তবে তাতিয়ানা নিজেও যেহেতু ফটোগ্রাফার আর ও ইন্টারভিউ নিচ্ছে বাচ্চাদের কাছে একটা মেসেজ পৌঁছে দিতে তাই একেবারে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। একটু সময় নিয়ে বললাম,
—আমি মস্কোয় প্রথম ছবি তুলতে শুরু করি। তখন ভাবতাম যে একদিন আমি এদেশ থেকে চলে যাব। দেশে গিয়ে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের মস্কোর জীবনের ছবি দেখাব। তখন সেটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু দেশে ফেরা হল না, অথচ এসব ছবি এখন দেখে আমি আমার বন্ধুদের কথা ভাবি, ভাবি সেই সময়ের কথা। তাছাড়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার ছবি তোলার বিষয় বদলেছে। আগে যা তুলতে ভাল লাগত এখন তা তুলি না। তাই এদিক থেকে বলতে গেলে আমি ছবি তুলি আজকের আমিকে ভবিষ্যতে কোনও এক সময়ে দেখার জন্য।
—শত হলেও আমি দেশ থেকে অনেক দূরে থাকি, তাই চাই বা না চাই অনেক সময় নিজেকে খুব একাকী মনে হয়। ব্যাপারটা এমন নয় যে এখানে আমার কেউ নেই, তবে সব কিছুর পরেও অনেক কিছুই মিস করি যেটা ঠিক তোমাদের সঙ্গে গল্প করে পাব না। আবার দেশে ফিরলে এখানকার জীবনের অনেক কিছুই পেতাম না এটাও কিন্তু ঠিক। এরকম সময় ক্যামেরা আমার সাথি হয়। আমি ওকে কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ি প্রকৃতির সঙ্গে কথা বলতে। তাই বলতে পার আমি ছবি তুলি একাকীত্ব থেকে মুক্তি পেতে।
—মস্কোয় যখন লোকজনের ভিড়ে খুব হাঁপিয়ে উঠতাম তখন কখনও যেতাম পাশের বনে, কখনও মস্কোর সেন্টারে আরবাত স্ট্রিটে। ভাবছ আরবাতে কেন? সেখানে সব সময়ই লোকে লোকারণ্য, অথচ তুমি কাউকে চেনো না, কেউ তোমাকে চেনে না। এ যেন জনারণ্যে হারিয়ে যাওয়া। এখন আমাদের মাঝেমধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়, প্রচুর পরিচিত লোকজন থাকে। এসব অনুষ্ঠানে আমি যখন হাঁপিয়ে উঠি, শুরু করি ছবি তুলতে। কেউ আমাকে তখন বিরক্ত করে না। তাই বলতে পারো আমি ছবি তুলি সব ছেড়ে একাকী হতে, নিজের মধ্যে হারিয়ে যেতে।
—আমি যখন দুবনায় আসি তখন প্রথম এগারো বছর শুধু নিজের কাজ আর ছেলেমেয়েদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। আমি সেই ছোটবেলা থেকেই ক্লাব, ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে অভ্যস্ত। তাই সেটাও মিস করতাম তখন। এই ছবিকে কেন্দ্র করেই তোমাদের সঙ্গে পরিচয়, নতুন করে নিজের বলয়ে ফিরে যাওয়া।
মনে হয় তখন থেকেই আমার ছবি তোলা একটা দিক, একটা লক্ষ্য খুঁজে পায়। আর তখন থেকেই শুধু তোলার জন্য ছবি তোলার দিন শেষ হয়ে যায়, তার পেছনে নিজের অজান্তেই কিছু লক্ষ্য, কিছু উদ্দেশ্য যোগ হতে থাকে। আর সেটাকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রায়ই ‘ফোকাস’ আর ‘অব্রাজ’-এ আমরা বিভিন্ন রকম ওয়ার্কশপের আয়োজন করি। কখনও সেটা ক্লাবেই করি, কখনও কোথাও আউটিংয়ে যাই। এরকম এক আউটিংয়ের গল্পই আজ বলব।
ফটো ক্লাব ‘অব্রাজ’ থেকে আমরা প্রায়ই যাই ছবি শিকারে। কয়েকটা গাড়ি ক্যামেরা, ট্রিপড, খাবারদাবারে বোঝাই করে সারা দিনের জন্য বেরিয়ে পড়ি। আগে থেকেই লোকেশন ঠিক করা হয়। অনেক সময় কেউ কেউ কয়েক দিনের জন্য বেরিয়ে পড়ে। আমি সাধারণত যাই এক দিনের ট্রিপে।
আগে থেকেই ঠিক করা হয় ফটোর সাবজেক্ট, মানে কী ধরনের ছবি তুলতে যাচ্ছি। ল্যান্ডস্কেপ হলে এক লোকেশন, পোরট্রেট হলে অন্য লোকেশন। ল্যান্ডস্কেপের জন্য সাধারণত যাই অনেক দূরে, মেদ্ভেদিৎসা নামে এক নদীর ধারে। আর সেটা করি বসন্তে যখন সবে বরফ গলতে শুরু করেছে অথবা হেমন্তে, যখন লাল-হলুদ-সবুজ রঙের হোলি খেলায় মেতে উঠেছে প্রকৃতি। বসন্তে কখনও মেঠোপথে চলতে গিয়ে গাড়ি কাদায় আটকে যায়। কখনও বনের ভেতর দেখা মেলে বন্য শূকর, ভালুক, হরিণ ইত্যাদি বুনো প্রাণীদের ঘোরাফেরার চিহ্ন। আবার কখনও যাই ধ্বংসপ্রায় গির্জার সন্ধানে। এক কথায় আমরা শুধু ছবির খোঁজেই নয় যাই অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে।
সেবার আমরা গেলাম তপারক নামে এক গ্রামে। দুবনা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। এ পথেই গাড়ি যায় পার্শ্ববর্তী শহর কিম্রি। কিম্রি অবশ্য পুরনো শহর। জারের আমলে কিম্রির চর্মশিল্প বেশ খ্যাতি লাভ করে। সোভিয়েত আমলেও রমরমা ছিল। আধুনিক রাশিয়ায় অনেক ছোট ছোট শহরের মতই কিম্রি ধ্বংস হতে চলছিল। তবে ইদানীং আবার নতুন করে সেখানে জীবন ফিরে আসছে বলে মনে হয়। দুবনা থেকে কিম্রি যাওয়ার পথে ডান দিকে মোড় নিয়ে ভোলগার দিকে চলে গেলেই এই তপারক। ছোট্ট গ্রাম। বলা চলে দুবনা ও মস্কোবাসীদের সামার হাউস। সারা বছর খুব একটা কেউ থাকে না। মূলত গ্রীষ্মে ফ্যামিলি নিয়ে চলে আসে ভোলগার তীরে সময় কাটাতে। তবে ভোলগা যে খুব কাছে তাও নয়, প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে বা মেঠোপথে গাড়ি চালিয়ে সেখানে যেতে হয়। তবে সুন্দর, প্রায় জনবিহীন প্রকৃতি এই কষ্টটা উসুল করে দেয়। ভোলগার অন্য পাড়ে রাতমিনোর গির্জা। রাতমিনো দুবনার সবচেয়ে পূর্ব প্রান্ত। এখানে দুবনা নদী এসে পড়ছে ভোলগায়। এক সময় রাতমিনোয় ছিল আস্তাবল, ট্যাক্সের হিসেবনিকেশের পাল্লায় পড়ে এখন সেই আস্তাবল চলে এসেছে তপারকে। এবার সেই তপারকেই আমরা এলাম ছবি তুলতে। উদ্দেশ্য সূর্যের আলোকে ফিল লাইট হিসেবে ব্যবহার করে ফ্ল্যাশ দিয়ে ছবি তোলা। ফ্ল্যাশ লাইট হবে মডেলিং লাইট।
আমরা যখন তপারক পৌঁছেছি বেলা প্রায় ৪টে। দিন এখন জিরাফের মতই লম্বা, তাই চারটা মানে প্রায় ভরদুপুর। গাড়ি থেকে নামতেই ঢাকঢোল আর সানাই বাজিয়ে এক দঙ্গল মশা আমাদের স্বাগত জানাল। আর ভালবাসার প্রকাশ করল যেখানে পারে সেখানে চুমু দিয়ে। তবে অতিরিক্ত কিছুই ভাল নয়। এক সময় ওদের অতিপ্রেমে আমরাও অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। এর মধ্যেই শুরু হল লোকেশন খোঁজা। এ সময় শুধু মশা নয়, বনে গিজগিজ করে হরেক রকমের বুনো ফল, বিভিন্ন রকমের বেরি— জেম্লিয়ানিকা, চেরনিকা, মালিনা, ইঝেভিকা, কস্তিয়ানিকা, গলুভিকা আরও কত কী! তাই মশা আর লোকেশনের কথা ভুলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল ফল খেতে। এভাবে ফলাহার করে আমি গেলাম নদীর ধারে। আসলে নদী আমাকে সব সময়ই টানে। পাশেই ভোলগা আর সেখানে যাব না তা কি হয়? ওখানে কিছু ছবি তুলে ফিরছি আসল কাজে, হুট করে দুষ্ট মেঘ হিসি করে দিল মাথার ওপর। ভাগ্যিস হালকা জ্যাকেটটা ছিল, তাই কোনও মতে মাথা আর ক্যামেরা বাঁচল। ইতিমধ্যে বন্ধুরা তাঁবু টাঙিয়ে চা-বিস্কুট খেতে শুরু করেছে। বৃষ্টি থামলে পলিনাকে বললাম পোজ দিতে। বাইরে ছবি তোলার এই এক ঝক্কি। আমি জ্যাকেটটা খুলিনি দেখে পলিনা বলল,
—তোমার নিশ্চয়ই ঠান্ডা লাগছে। শত হলেও গরমের দেশের লোক।
ওর কথায় সবাই হেসে উঠলে বললাম,
—না না, এটা আসলে মাল্টিপারপাস জ্যাকেট।
—মানে? সাশার প্রশ্ন।
—এই জ্যাকেট আমাকে ঠান্ডা থেকে রক্ষা করে, বৃষ্টি থেকে বাঁচায় আর মশারির কাজ করে।
—কী লাভ যদি মুখ খোলা থাকে? টিপ্পনী কাটল তানিয়া।
—মশারা কামড়াতে এলে বলি, দ্যাখ আমি বাংলাদেশের মানুষ। ওখানে সব কিছু ফরমালিন দেওয়া। খাবারদাবার দুই নম্বরি। রক্তে ভেজাল। খেয়ে অসুস্থ হবি। পাশের সুন্দর সুন্দর মানুষদের রক্ত খাঁটি আর সুস্বাদু। তোরা বরং ওদের কামড়া আর আমি ছবি তুলি। দেখবি কাল ফেসবুকে তোরা কত শত লাইক পাস।
(দুবনা, ২৪ নভেম্বর ২০২১)
কভার: মেদ্ভেদিৎসায় বসন্ত/ চিত্র: লেখক
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৩
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৪
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৫
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৬
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৭
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৮
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৯
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১০
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১১
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১২
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৩
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৪