পর্ব ১৪
ছবি তোলা
আমার সেই অর্থে পেশা বলে কিছু নেই আছে নেশা— তা সে ফিজিক্স হোক, ফটোগ্রাফি হোক, লেখালেখি হোক বা বই পড়া হোক। আসলে মানুষ যখন তার কাজ থেকে শুধু জীবিকা অর্জন করে না, কাজটাকে উপভোগ করে তখন সেটা আর পেশা থাকে না, হয় নেশা বা হবি। আমার ছবি তোলার শুরু ১৯৮৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে আসার পর থেকে, তবে সেটা সিরিয়াসলি করতে শুরু করি ২০০৫ সাল থেকে যখন দুবনার ফটোগ্রাফারদের সঙ্গে আলাপ হয়, একসঙ্গে মিলে ক্লাব করি, শুরু হয় নিয়মিত ছবি নিয়ে আড্ডা, প্রদর্শনী ইত্যাদি। ফলে মাঝেমধ্যে নতুন ক্যামেরা, নতুন লেন্স এসব কিনতে হয়, শুরু হয় এসব টেস্ট করার কাজ। কিছুদিন আগে এরকম একটা লেন্স কিনলাম— হেলিওস ৪০। এর মূল বৈশিষ্ট্য খুব ভাল বকেহ আর বকেহ ভাল আসে যদি ডায়াফ্রাম সম্পূর্ণ খোলা থাকে। তবে খারাপ দিক হল যেহেতু এটা শতভাগ মেকানিক্যাল তাই ফোকাস করা অসম্ভব না হলেও কষ্টসাধ্য। এটা খুবই বিরক্তিকর মানুষের ছবি তোলার সময়, কেননা মডেল রেডি হয়ে অপেক্ষা করছে আর আমি ফোকাস করার চেষ্টা করছি। ছবি তোলার জন্য এর চেয়ে বাজে অবস্থা আর নেই। যাই হোক, যদিও আমি মানুষের ছবি খুব একটা তুলি না, তারপরেও এই লেন্সের জন্য লোক খুঁজে বেড়াই কে রাজি হবে পোজ দিতে যদিও ভাল ছবির গ্যারান্টি নেই বললেই চলে। আজ এমন এক ফটোসেশনের কথাই বলব।
আগস্টের মাঝামাঝি এক সন্ধ্যায় ভোলগার তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাসার দিকে ফিরছিলাম, হঠাৎ কে যেন পাশ থেকে ডাকল:
—প্রিভিয়েত বিজন। কেমন আছ?
—ভাল। তুমি?
—ভাল আছি।
আমি তখন এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলাম টেলিফোনে তাই আর কিছু না বলে এগিয়ে গেলাম। আসলে আমি তখনও ঠিক মনে করতে পারছিলাম না কার সঙ্গে কথা বললাম। আমার এমন প্রায়ই হয়, কারও সঙ্গে দেখা হল, কথা হল, তারপর মনে করতে শুরু করি লোকটা কে? তবে দু-পা এগিয়েই মনে পড়ল এটা মারিনা। ও এমনিতে আর্কিটেক্ট। ছবি তোলে। সেখানেই পরিচয়। আসলে ওকে চিনি সেই ২০০৭ থেকে। আমাদের প্রথম ছবি প্রদর্শনীতে ওর ছবি ছিল, তুলেছিল ঝেনিয়া। পরে আলাপ ‘অব্রাজ’-এ— আমার দ্বিতীয় ফটো ক্লাবে। দ্বিতীয় কারণ, ওখানে আমি পরে যেতে শুরু করি। প্রথমটা ‘ফোকাস’— সেটা আমাদের নিজেদের হাতে তৈরি ২০০৬ সালে। বেশ কয়েকবার ওর ছবি তুলেছি। শেষ দেখা বছর তিনেক আগে। ওর কাছ থেকে একটা লেন্স কিনেছিলাম। যখনই ওকে মনে করতে পারলাম বন্ধুর সঙ্গে কথা না শেষ না করেই এগিয়ে গেলাম ওর দিকে।
—মারিনা, তুমি কবে এলে?
ও বিয়ে করে ভারনেঝ চলে গেছিল বেশ কয়েক বছর আগে। তাই মাঝে কোনও যোগাযোগ ছিল না।
—তা বছর খানেক হবে।
—বলো কি? ওখানকার পাট শেষ?
—হ্যাঁ।
—এখন কি এখানেই।
—হ্যাঁ।
—শোনো, আমি একটা নতুন লেন্স কিনেছি— হেলিওস। কি, তুলবে ছবি? সময়, ইচ্ছা আছে?
আসলে ছবি তোলার জন্য সময়ের চেয়েও বেশি দরকার তোলার ইচ্ছা। কারণ কেউ যদি মন থেকে না চায় সে রিল্যাক্স হতে পারে না। তা না হলে ভাল ছবি হয় না।
—বেশ কয়েক বার তোমাকে ফোন করব করব ভেবেছি কিন্তু করা হয়নি। আসলে কাজের চাপ। তবে তোলা যায়। অনেক দিন ছবি তোলা হয় না। শুরু করা দরকার।
—আচ্ছা, দাঁড়াও দেখি তোমার নম্বর আছে কি না।
বেশ কিছুক্ষণ খুঁজেও ওর নম্বর পেলাম না। ওর কাছে ছিল, আমাকে মিস কল দিল। কথা হল কয়েক দিনের মধ্যেই কোথাও যাব।
—আমি হাসপাতালে ভর্তি হব চোখের অপারেশন করাতে। তাই চাইলে আগামী দিন দশেকের মধ্যেই করতে হবে। তুমি চেষ্টা করো এর মধ্যেই সময় বের করতে।
এর মধ্যে মোটামুটি প্ল্যান ঠিক হল কোথায় তুলব। আমি বললাম ভোলগার তীরে আর বনে। ও যোগ করল আরও একটা জায়গা— মস্কো সীর ওখানে ওপেন স্টেডিয়ামে। এরপর আমি কয়েক দিন ভোলগার তীরে আর বনে হেঁটে কিছু লোকেশনের ছবি পাঠালাম যাতে ও আইডিয়া করতে পারে আর সেভাবে ড্রেস চয়েজ করতে পারে। তবে সময় বের করতে পারলাম না। এরপর আমি হাসপাতালে চলে গেলাম। আসলে এই এক বিরাট সমস্যা— সময় প্লাস আবহাওয়া, বিশেষ করে সেপ্টেম্বরে। কারণ এখন রোদ প্রায়ই মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল ১৫ সেপ্টেম্বর বুধবার সকাল ১১টায় ভোলগার তীরে আমরা যাব ছবি তুলতে। আমার ডাক্তারের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল ১০টায়, ভাবলাম হয়ে যাবে। তাছাড়া সকাল থেকে আকাশ মেঘলা। তাই একটু সন্দেহ ছিল। মারিনাকে বললাম ভেবে দেখতে। চাইলে পরে কখনও করা যাবে। তাও মারিনা বলল, এটা টেস্ট তাই রোদ না থাকলেও সমস্যা নেই। আসলে মেঘলা আকাশ ছবি তোলার উপযুক্ত পরিবেশ। তবে যেহেতু আমার প্ল্যান ছিল মূলত হেলিওস ৪০-২ লেন্স ব্যবহার করা আর সেটা খুব সুন্দর বকেহ দেয়, তাই রোদ এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাহোক শেষ পর্যন্ত ঠিক হল ১২.২০ আমরা বিভিন্ন যুদ্ধে আত্মদানকারী সৈনিকদের যে স্মৃতিস্তম্ভ আছে ভোলগার তীরে সেখানে দেখা করব। আমি অপেক্ষা করছি, ওর দেখা নেই। তখন ভাবতে শুরু করলাম আমরা দুজন মাত্র লোক, ছবি তোলার জন্য কথা বলেও রোদের দেখা পাচ্ছি না, সেখানে সারা পৃথিবী শুধু সৌরশক্তির ওপর ভরসা করে চলবে কীভাবে। যাহোক, মিনিট পনেরো পরে মারিনা এল। হাঁটতে হাঁটতে গল্প করতে করতে কিছু ছবি তুললাম। একটু টেনশন ছিল। কারণ যেহেতু প্ল্যান করে আসা তাই নিদেনপক্ষে দু-একটা ছবি যদি মনের মত না হয় তাহলে ঘটনাটা ন্যক্কারজনক হয়। আমার আর কী? আমি তো ছবি তুলেই মজা পাই, হাঁটা হল, গল্প হল, কিন্তু মারিনা যে সেজেগুজে এসেছে, যদি ফল না পায় তাহলে? সবাই তো আর নিষ্কাম কর্মে বিশ্বাস করে না। তবে মডেল নিজে ফটোগ্রাফার হলে সুবিধা আছে, ওরা বোঝে ছবি মানে ক্যামেরায় ক্লিক নয়, অনেক পারিপার্শ্বিকতা। তাই এ নিয়ে কেউ মনখারাপ করে না। তাছাড়া পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়া— তারও একটা পজিটিভ দিক আছে। যাই হোক কিছু ছবি তুললাম। ভাল সময় কাটানোর জন্য একে অন্যকে ধন্যবাদ জানালাম। ওর বেশ কিছু ছবি নাকি পছন্দ হয়েছে। বলল:
—নিজেকে যেন ভিন্ন রূপে দেখলাম। আশা করি আবারও আমরা যাব ছবি তুলতে।
—অবশ্যই। যখন ইচ্ছে জানিয়ো, ওয়েদার ভাল হলেই চলে যাব।
আসলে ছবি— এটা অন্যের চোখে নিজেকে দেখা আর সেটা সব সময়ই নতুন অভিজ্ঞতা। আমরা তো ছবি তুলি শুধুমাত্র কোনও ব্যাকগ্রাউন্ডে মডেলকে ফিক্সড করার জন্য নয়, নিজের দেখাটা, মডেলের সঙ্গে সঙ্গে নিজের মুড ধরে রাখার জন্য। নিজের ভাল লাগাটা ধরে রাখার জন্য। কারণ যা তুলছি সেটা নিজের ভাল না লাগলে সেটা ভাল কিছু হবে না। তবে ভাল হয় যদি যার ছবি তুলছি তার সম্পর্কে আগে থেকেই কিছু জানা থাকে। মনে আছে কয়েক বছর আগে আমাদের একটা প্রোজেক্ট ছিল। ক্লাবে সবাই মিলে যখন আড্ডা দিতাম তখন কেউ কারও কারও বিভিন্ন অবস্থার ছবি তুলত স্মার্টফোনে। আসলে এর মধ্য দিয়ে সেই লোকের কিছু স্বাভাবিক পোজ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেত। প্রতিটি মানুষেরই কিছু না কিছু স্বাভাবিক পোজ থাকে, সেই পোজে সে সবচেয়ে রিল্যাক্সড ফিল করে। তবে প্রায়ই দেখা যেত তাকে যখন নিজের স্বাভাবিক পোজে দাঁড়াতে বা বসতে বলা হত সে সেটা করতে পারত না। অর্থাৎ আমরা নিজেদের অবচেতন মনে যেটা সব সময় করছি সচেতনভাবে সেটা করতে পারি না। এ নিয়েও আমার সুন্দর এক অভিজ্ঞতা হল গত ১৪ সেপ্টেম্বর। ওইদিন ক্লাবে দাশার ছবি তুলল দেমিদ। দীর্ঘ গ্রীষ্মের পর সবাই ক্লাবে ফিরেছে, সবার হাতে ক্যামেরা। তাই আমরা যারা আলো নিয়ন্ত্রণ করছিলাম না তারা দেমিদের কাজের ফাঁকে ফাঁকে শুধুমাত্র উপরের আলোর ওপর নির্ভর করে দাশার ছবি তুলছিলাম আর সেটা তুলছিলাম যখন ও আমাদের পোজ দিচ্ছিল না, অনেক সময় রিল্যাক্সড মুডে ছিল আমাদের কোনও রকম পাত্তা না দিয়ে। এর ফলে বেশ কিছু ভাল ছবি বেরুল যাদের আলোছায়ার দিক থেকে আইডিয়াল বলা না গেলেও মুডের দিক থেকে বেশ ইন্টারেস্টিং বলা চলে।
দুবনা, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২
কভার: ভোলগার তীরে মারিনার সঙ্গে।/ চিত্র: লেখক
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ২
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৩
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৪
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৫
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৬
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৭
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৮
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৯
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১০
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১১
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১২
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৩
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৫