ঢাকার ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় একতলা ছোট্ট একটি বাড়িতে থাকতেন ছোটখাটো চেহারার ফুরফুরে স্বভাবের স্বর্ণবর্ণের শুভ্রবসনা অনিন্দ্যকান্তি সদাহাস্যমুখী এক বৃদ্ধা নারী। একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে তাঁর মুখের হাসিটি নির্বাপিত। তিনি বাড়িটিতে সম্পূর্ণ একা। নিজের হাতে রান্না করতে পছন্দ করেন। চারিদিকে অশান্তির আগুন। তার মাঝে তিনি নিশ্চল বসে। আত্মীয়স্বজন বন্ধু দেশবাসী আপামর মানুষের কথা ভেবে রান্না খাবারও মুখে রোচে না। আতঙ্কে তাঁর মনপ্রাণ নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। কিন্তু না। নিস্তেজ হয়ে নিরুদ্যম বসে থাকা তাঁর প্রকৃতিবিরুদ্ধ। ২৬ মার্চ কারফিউ উঠে গেলেই তিনি বেরিয়ে পড়লেন। আশপাশের বাড়িতে ঢুকে তাদের খোঁজখবর নিলেন। শেখ মুজিবের বাড়ি জনমনুষ্যহীন। কারও কোনও সাড়াশব্দ পেলেন। না। বাড়ির ভিতর থেকে জিনিসপত্র টেনে বের করে ট্রাকে ওঠাচ্ছে আর্মির জওয়ানরা। মুখে গালিগালাজের ভাষা। করুণ মুখে বিষণ্ণ হৃদয়ে ফিরে এলেন ঘরে। মনে মনে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করার ফন্দি খুঁজে ফেরেন। অশান্ত, উত্তাল হৃদয়। বয়সের ভার জমেছে দেহে। কিন্তু মনে নয়। সংকল্পে দৃঢ় হলেন। বীরযোদ্ধাদের জন্য খাবার সংগ্রহ করে পাঠাবেন স্থির করলেন। মারাত্মক বিপদের ঝুঁকি নিয়ে, প্রাণের পরোয়া না করে শুরু করলেন কাজ। অকুতোভয় এই নারী আমাদের বাংলা মায়ের অসামান্য সস্তান। তিনি বঙ্গবালা বেগম সুফিয়া কামাল। আমৃত্যু নিজেকে নিপীড়িত মানবাত্মার সেবাকর্মে সঁপে দিয়েছিলেন। শান্তির সপক্ষে পদযাত্রায় সামিল হয়েছেন জীবনভর। তাঁকে হারিয়ে বঙ্গবাসীর হৃদয় ব্যথিত হয়েছিল ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর।
১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন, বাংলা ১০ আষাঢ় ১৩১৭ বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদে মাতামহ সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনের গৃহে জন্ম। মাতামহ নিজের হাতে মুখে মধু দিয়ে নাম রেখেছিলেন সুফিয়া খাতুন। আদর করে সকলে ডাকত হাসনাবানু বা হাসুবানু বলে। তাঁর জন্মের সময়কাল সম্পর্কে তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘আমরা জন্মেছিলাম পৃথিবীর এক আশ্চর্যময় রূপায়ণের কালে। প্রথম মহাযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন, মুসলিম রেনেসাঁর পুনরুত্থান, রাশিয়ান বিপ্লব, বিজ্ঞান জগতের নতুন নতুন আবিষ্কার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নবরূপ সূচনা, এসবের শুরু থেকে যে আভাসের মধ্যে শৈশব কেটেছে তারই আদর্শ আমাদের মনে ছাপ রেখেছে সুগভীর করে। স্বাধীনতা চাই, শান্তি চাই, সাম্য চাই, এই বাণী তখনকার আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হত।’ এই বাণী উচ্চারণে সদা উতরোল ছিল তাঁর কণ্ঠ তাই বরাবর।
ঐশ্বর্যের সমারোহের মধ্যে কেটেছে সুফিয়ার শিশুকাল। শায়েস্তাবাদ পরিবারের ‘অন্দরমহলে তখন পুরোপুরি মোগলাই আদব-কায়দা, হাল-চাল, শিক্ষা-সংস্কৃতি। বাইরে ইঙ্গ-বঙ্গ ফ্যাশন, কেতাদুরস্ত হাল-চাল।’ সুফিয়ার মামার বাড়ির পরিবেশ। কিন্তু এমন পরিবেশে বড় হলেও শিশু সুফিয়ার মনে ছিল গভীর রাখা। তাঁর পিতা সাধক দরবেশের পথ অনুসরণ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ত্রিপুরা জেলার শিলাউর গ্রামের আবদুল বারী, বি. এল. ছিলেন তাঁর পিতা। তিনি সুপণ্ডিত মানুষ ছিলেন। সুফিয়ার ভাইয়ের বয়স তখন সাড়ে তিন বছর আর শিশু সুফিয়া মাত্র সাত মাসের— এমন সময় বারী সাহেব নিখোঁজ হয়ে যান। তাই অত ঐশ্বর্যের মাঝেও সুফিয়ার মা সৈয়দা সাবেরা খাতুন ছিলেন রিক্তা, দুখিনী, তাঁর না-বলা ব্যথা শিশু সুফিয়ার বুঝতে বাকি ছিল না। সেই বেদনাই পরবর্তীকালে তাঁকে ‘দুঃস্থ মানবমনের সংস্পর্শে আসার প্রেরণা দেয়।’
সুফিয়ার বিয়ে হয় মাত্র বারো বছর বয়সে সৈয়দ নেহাল হোসেন-এর সঙ্গে। তিনি ‘তরুণ’ নামে একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সুফিয়া ইতিমধ্যেই লুকিয়ে লুকিয়ে ‘লেখা লেখা খেলার’ নেশার স্বাদ পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রোকেয়ার লেখা পড়েছেন। স্বামীর ইচ্ছায় ‘তরুণ’ পত্রিকায় ছাপা হল তাঁর প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধূ’। হিন্দু-মুসলমান সকলে সে লেখার প্রশংসা করে আরও লেখার জন্য তাগিদ দিলেন। কিন্তু শায়েস্তাবাদের বাড়িতে বসেই সে লেখা পড়ে তাঁর বড় মামা রেগে আগুন হয়ে গেলেন। সুফিয়াকে শহর থেকে শায়েস্তাবাদে নিয়ে গেলেন। সুফিয়ার স্বামীকে তিরস্কার করলেন। তারপর তিনি যখন ছয়মাসের জন্য কলকাতা চলে গেলেন সুফিয়া আবার শহরে ফিরে লেখা শুরু করলেন। সমাজসেবামূলক কাজেরও হাতেখড়ি হয় সে সময়ে। মহাত্মা গান্ধীর হাতে তুলে দিয়েছেন আপন হাতে কাটা সুতো। স্বদেশী ভাবনায় দীক্ষার সেই সময় বড় গৌরবের, আনন্দের। সুফিয়া সে গৌরবময় সময়কালের সন্তান।
মাত্র সাত মাস বয়সে দুর্ভাগ্যের সূচনা ঘটেছিল। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুফিয়ার জীবনের অন্ধকারময় পর্ব। ১৯৩২-এ তাঁর স্বামী নেহাল হোসেন কালব্যাধি ক্ষয়রোগে মারা গেলেন। একুশ বছর বয়সে ছ’বছরের শিশুকন্যা নিয়ে সুফিয়া বৈধব্য বরণ করে নিলেন। কলকাতা কর্পোরেশনে সামান্য মাইনের চাকরি নিতে হল। সাত বছর ধরে নিরন্তর সংগ্রাম করতে করতে স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ল। এসময় সাহিত্য জগতের কয়েকজন শুভানুধ্যায়ীর ব্যবস্থামত তিনি প্রগতিশীল সাহিত্যিক কামালউদ্দীন খান-এর সঙ্গে দ্বিতীয়বার পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন। সে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। অসুস্থ কনের অনুপস্থিতিতে বরের বিয়ে পড়ানো হল। বিয়ের পর বরকে নিয়ে তাঁর সুহৃদবর্গ শয্যাশায়ী কনের কাছে গেলেন। অসামান্যদের জীবনেই এমন ঘটনা ঘটে। কামালউদ্দিন খানের ঔদার্যে সুফিয়া সেদিন পুনর্জীবন লাভ করেন বলা চলে। সুফিয়ার নামের সঙ্গে তাঁর নাম তাই চিরজীবনের মত গাঁথা হয়ে যায়— সুফিয়া খাতুন হন সুফিয়া কামাল।
সুফিয়া জীবনে বঞ্চিত যেমন হয়েছেন, পেয়েছেনও অনেক। রবীন্দ্রনাথ-এর স্নেহাশিস লাভে ধন্য হয়েছেন। নজরুল-এর নাতনি পদে অভিষিক্ত হয়েছেন। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের আদরের ‘ফুলকবি’ হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে একসঙ্গে লোকহিতকর কাজ করার সুযোগ লাভ করেছেন। সুফিয়ার জীবন ধন্য।
সাহিত্যক্ষেত্রে সুফিয়ার অবদান সামান্য নয়। তিনি চোদ্দোখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কেয়ার কাঁটা’ পনেরোটি গল্পের সংকলন— বিজয়িনী, দু’ধারা, সত্যিকার, বিড়ম্বিত, মধ্যবিত্ত প্রভৃতি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’। অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে ‘মায়াকাজল’, ‘মন ও জীবন’, ‘উদাত্ত পৃথিবী’, ‘দীওয়ান’, ‘মৃক্তিকার ঘ্রাণ’, ‘প্রশস্তি ও প্রার্থনা’, ‘অভিযাত্রিক’, ‘মোর যাদুদের সমাধি পরে’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
কবি সুফিয়ার কবিপ্রতিভা প্রবাহিত হয়েছিল বিভিন্ন ধারায়। একটি নমুনা দেওয়া যাক। কবিতার নাম ‘লুমুম্বার আফ্রিকা’। তিনি লিখলেন—
‘এ বিপুল বিশ্বারণ্যে লুমুম্বার শোণিত প্রবাহ
ছড়াইল দীপ্তিময় পাবক প্রদাহ—
জাগরণ! মানবাধিকারবোধ জ্বালা
শহীদের কণ্ঠে রাজে শোণিতাক্ত অপরাজিতার
. নীল মালা।
আফ্রিকার রাত্রি শেষ। দিগন্তে প্রদীপ্ত সূর্যকর
অগ্নিবাহু মেলে দিয়ে উদ্ভাসিয়া তুলিছে প্রহর।’
চির-প্রতিবাদী এই নারী অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু রেখেছেন আমৃত্যু। লিখেছিলেন— ‘শহীদ শোণিতে রাঙায়ে আঁচল/ নারীও শোধিছে মাটির দেনা।’
শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজকর্ম ক্ষেত্রে সুফিয়া নিজগুণে স্থান করে নিয়েছিলেন। দেশের সংকটকালে দেশবাসীর সকল ডাকে তিনি অকুণ্ঠচিত্তে সাড়া দিয়েছেন। দ্বিধা, সংশয় তাঁকে থমকে দাঁড়াতে দেয়নি। জীবনব্যাপী বহু সম্মান, পুরস্কার, উপাধি তিনি পেয়েছেন। তিনি সুসন্তানের জননী। মুক্তিসংগ্রামে তাঁর দুই কন্যা মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাকর্মে নিরন্তর লিপ্ত থেকেছেন। নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভাববার সময়ও তাঁদের ছিল না। দুই পুত্রও একাজে পিছিয়ে থাকেননি। সাংবাদিক ও কবি পুত্রদ্বয় তাঁদের মায়ের গুণী সন্তান।
নিজের জীবন বিপন্ন জেনেও কবি সুফিয়া, আজন্ম প্রতিবাদী সুফিয়া গোপনে খাদ্যসংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঠিয়েছেন। তিনি জানতেন না, মুক্তিযোদ্ধারা ছদ্মবেশে তাঁর বাড়ির বাইরে তাঁকে পাহারা দিতেন। তাই আর্মি জওয়ানরা তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা করা সত্ত্বেও সফল হয়নি। তাঁর মত শ্রদ্ধাত্মার কেশাগ্রও তারা স্পর্শ করতে পারেনি। পুণ্যাত্মার জয় বলা যায় একে!
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। লালছোপ লাগা সাদা শাড়ি পরিহিতা বেগম সুফিয়া কামালের কণ্ঠ শোনা গেল টেলিভিশনে: ‘আজ বাংলাদেশ স্বাধীন, আজ আমরা গৌরবময় স্বাধীন বাংলার নাগরিক।’ উচ্ছ্বাসবিহীন নিরানন্দ সে স্বর। তাঁর শ্বেতশুভ্র শাড়ি লাল রক্তে কলঙ্কিত। রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছিলেন গুলিবিদ্ধ তরুণী দেহ। ছুটে গিয়ে তাকে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন আর্ত-জননী সুফিয়া। তাই শুভ্রবসনে রক্তের ছোপ। হৃদয়ে বেদনার শোণিত-স্রোত। আনন্দ ঝরবে কেমন করে কণ্ঠে! দর্শক সেদিন বিস্মিত হয়েছিলেন। পরে জানা গিয়েছিল করুণ সে কাহিনি। বেগম সুফিয়া কামাল সেদিন খুশিতে উদ্বেল হতে পারেননি। বেদনাবিহ্বল তাঁর মনে সেদিন শান্তি ছিল না। অসামান্যা এই নারী সারাজীবন প্রতিটি কর্মে তার পরিচয় রেখে গেছেন।
৮৯ বছর বয়সে বাংলা মায়ের কোল ত্যাগ করে চলে গেছেন বেগম সুফিয়া কামাল। সুদীর্ঘ সময়ে রচে গেছেন গৌরবময় ইতিহাস। চলার পথে রেখে গেছেন চরণচিহ্ন যাতে সেপথে পরবর্তীরা অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে পারে। তাঁর আলোকসম আত্মার প্রতি জানাই, তাঁরই ভাষায়, শ্রদ্ধাঞ্জলি:
‘বিপুলা পৃথিবী, অগাধ আলোক, বৈভব অফুরান
মুক্ত বায়ুতে আয়ু বাড়াইয়া আমাদের সন্তান
ধর্মে কর্মে উদার মর্মে সেবা সাম্যের গানে
বেঁচে ওঠে যেন মানুষের মতো— এই আশা নিয়ে প্রাণে
চির কল্যাণকর
কর্মের পথে অবহিত চিতে হয়েছে অগ্রসর
মাতৃস্বরূপা কল্যাণী নারী সার্থক নাম তার
স্মরণের ক্ষণে ঘনায় নয়নে তপ্ত অশ্রুধার।’
. [আলোর ঝরণা ]