Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ঐতিহ্য খোয়াতে বসেছে শোভানগরের ছানার জিলিপি

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্ম মজেছে রকমারি মিষ্টিতে। শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য হারিয়ে অবহেলায় পড়ে আছে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি শোভানগরের ছানার জিলিপি। মালদা শহরের অনতিদূরের সমৃদ্ধ মৈথিল গ্রাম শোভানগরের মিষ্টি একসময় দাপিয়ে রাজত্ব করেছে সারা জেলা জুড়ে। এমনকি জেলার বাইরের অতিথিদের কাছেও মাটির হাঁড়িতে করে পৌঁছে গেছে এই মিষ্টি। এখন কোনওমতে টিমটিম করে টিকে রয়েছে চার-পাঁচটি দোকান।

ছানার জিলাপি পাওয়া যায় সর্বত্র। কিন্তু কোথায় ছিল শোভানগরে ছানার জিলিপির বিশিষ্টতা? শিক্ষক মলয়কুমার ঝা বলেন, ‘নয়ের দশকে শোভানগর টিচার্স ট্রেনিং কলেজে পড়তাম। সেই সময় থেকে এই মিষ্টি টানা খেয়ে এসেছি। একেবারে রসে জবজবে নয়, আবার পুরোপুরি শুকনোও নয়। রস এবং মিষ্টির একটা ভারসাম্য এই ছানার জিলিপিতে থাকত। অদ্ভুত টাটকা একটা স্বাদ। অনেক জায়গার ছানার জিলিপি খেয়েছি কেউ সেই স্বাদটা আনতে পারেনি।’

শোভানগরের পুরনো বাসিন্দা রিনিতা ঝা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে বুদ্ধু ঠাকুরের দোকানের ছানার জিলিপি খেয়ে বড় হয়েছি। ছানার জিলিপি আর তার রস দিয়ে টাটকা পাঁউরুটি— এই খাবারের স্বাদ ভোলার নয়। পরবর্তীতে দাদুর দুই ছেলে আলাদা দোকান করে। তার মধ্যে বড়ছেলে বিশ্বনাথ ঝা কিছুটা স্বাদ আনতে পেরেছিলেন, কিন্তু ছোটছেলে নিতাই ঝা তার ধারেকাছে যেতে পারেননি।’

রস এবং মিষ্টির একটা ভারসাম্য এই ছানার জিলিপিতে থাকত।

মালদার গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও মিষ্টান্ন বিশেষজ্ঞ সৌমেন্দু রায়ের মতে, শোভানগরের ছানার জিলিপির সবচেয়ে পুরনো কারিগর বুদ্ধু ঠাকুর অথবা বুদ্ধু ঝা। তাঁর দুই ছেলেও এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর এক নাতির বাকশক্তি ছিল না। পুরনো খরিদ্দাররা এখনও দোকানে তক্তপোষের ওপর বসে থাকা এই শব্দহীন শিশুটিকে মনে করতে পারেন। সত্তর বছরেরও বেশি সময় চলছে বুদ্ধু ঝা-র দোকান। ২০১৫ সাল নাগাদ নাতিরা দোকানটি বন্ধ করে দেন। শোভানগর প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের গায়ে শোভানগর হাটের মধ্যে মালদা-মানিকচক রাজ্য সড়কের ধারে এই সাবেক দোকানটির অবস্থান ছিল। মাথায় টালির চালওয়ালা দোকানটিতে কোনও সাইনবোর্ড ছিল না। তবু আলাদাভাবে এর কোনও বিজ্ঞাপন করতে হয়নি। এখন শোভানগর স্ট্যান্ডে চার-পাঁচটি নতুন মিষ্টির দোকান ছানার জিলিপি বানাচ্ছে বটে। কিন্তু স্বাদে ও গুণমানে সেই পুরনো দোকানটি ধারেপাশে তারা কেউ যেতে পারছে না— এমনই মত স্থানীয় বাসিন্দাদের।

Advertisement

সাতের দশকের শোভানগর বি টি কলেজের ছাত্র সত্তরোর্ধ্ব আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, ‘২৫ পয়সা দাম দিয়ে জিলিপি খাওয়া আরম্ভ করেছিলাম। ৯০ পয়সা পর্যন্ত মনে আছে। ছুটিতে যখন বুলবুলচণ্ডীতে নিজের বাড়িতে ফিরতাম, মাটির হাঁড়িতে করে নিয়ে আসতাম ছানার জিলিপি। এখন সব কথা আর মনেও পড়ে না।’

শোভানগরের ছানার জিলিপির সবচেয়ে পুরনো কারিগর বুদ্ধু ঠাকুর।

মাটির ভাঁড়ে শোভানগরের ছানার জিলিপি আর তাতে দড়ি বেঁধে স্ট্যান্ড থেকে ফেরার বাস ধরা— এই ছবি আজ হারিয়ে গেছে বাস্তব থেকে। তবুও বাংলা সাহিত্যে তা অমর। সুপ্রিয় চৌধুরীর গল্প ‘আড়কাঠি’-তে আছে সেই দৃশ্য— শোভানগর স্ট্যান্ড থেকে একটি বাচ্চা মেয়েকে বাবা-মার থেকে আলাদা করে বিক্রি করে দেওয়া হবে। সেই মুহূর্তে কান্না থামানোর জন্য তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়— ‘কী খাবি বল?’, মুহূর্ত না ভেবে সে আঙুল দেখায় ছানার জিলিপির দিকে। বাসের সিটে বসে কোলে ছানার জিলিপির হাঁড়ি নিয়ে অপলকে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে আধখাওয়া ছানার জিলিপির গড়িয়ে পড়া মিষ্টি রস ভিজিয়ে দিচ্ছে গায়ের জামা… তাতে এসে মিশছে নোনতা চোখের জল। আনন্দ আর বেদনায় মাখামাখি এই ছবি আজ হারিয়ে গেছে ঘষা কাচের আড়ালে। আর হারানোর পথে এগিয়ে চলেছে শোভানগরের ছানার জিলিপি।

চিত্র: লেখক

3 Responses

  1. পুরোনো প্রসিদ্ধ মিষ্টি গুলো এইভাবে লেখার অক্ষরে প্রাণ ফিরে পাক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × four =

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আমার স্মৃতিতে ঋত্বিককুমার ঘটক

দুটো‌ জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম তাঁর।‌ এক, তিনি কথা বলার সময় আত্মমগ্ন‌ থাকতেন। কারও দিকে‌ তাকিয়ে‌ কথা বলতেন না। তাকাতেন‌ হয় সুদূরে, আর নয়তো‌ চোখ বুজে‌ কথা বলতেন। আর দ্বিতীয় যা, তা হল‌ ঋত্বিকের চোখ। এত উজ্জ্বল আর‌ মরমী, এক-ই সঙ্গে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত আর লুব্ধক নক্ষত্রের মতো দীপ্ত, তা আর কারও মধ্যে দেখিনি। সত্যজিৎ-মৃণালের মধ্যেও না, যদিও ঘটনাচক্রে ওই দু’জনের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল অনেক বেশি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঋত্বিক ঘটক ও বাংলাদেশ

ঋত্বিক ঘটকের জীবনের প্রথম বাইশ বছর (১৯২৫-১৯৪৭) কেটেছে মূলত পূর্ব-বাংলায়, যা এখনকার বাংলাদেশ। তাঁর জন্ম ঢাকার ২,ঋষিকেশ দাস রোডের ঝুলন বাড়িতে। ১৯৪৭, অর্থাৎ দেশভাগ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি মূলত পূর্ব-বাংলায় কাটান। আমরা দেখব, পূর্ব-বাংলা যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, সে-দেশ, সে-ভূমির প্রভাব তদনুরূপ ঋত্বিকেরও পড়েছিল তাঁর চলচ্চিত্রে।

Read More »
মণিকর্ণিকা রায়

অনুগল্প: অর্জন

অসহায় বৃদ্ধের খাওয়া হয়ে গেলে মাঝেমাঝে গল্পও করত ওঁর সাথে। আদিত্য লক্ষ্য করেছিল এই ব্যাপারটা যেন তার মনে একটা বদল আনছে— যেন রোজ তার শরীর-মন জুড়ে সঞ্চালিত হচ্ছে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি। যেন সে সত্যিই মানুষ হয়ে উঠছে।

Read More »
মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনানন্দ দাশের সময়চেতনা: পুরাণ, প্রকৃতি ও আধুনিক নিঃসঙ্গতার নন্দনতত্ত্ব

পৌরাণিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিগত সময়চেতনা তাঁকে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে এক স্থায়ী ও ব্যতিক্রমী মহাকবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শিল্পকর্ম আমাদের শেখায়— দ্রুত ধাবমান জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে চলতে, নীরবতার গভীরে কান পাততে এবং প্রতিটি ক্ষণিকের মাঝে অনন্তের ইশারাকে খুঁজে পেতে। তাঁর সাহিত্য ভবিষ্যতের প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের জন্য আধুনিকতার এক অমূল্য পাঠ হয়ে থাকবে, যা মানুষের জীবনকে শিল্প ও প্রকৃতির একাত্মতায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং প্রমাণ করে দেয়— কাব্যই চূড়ান্ত আশ্রয়, যখন সমস্ত পথ ফুরিয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে?

Read More »