সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্ম মজেছে রকমারি মিষ্টিতে। শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্য হারিয়ে অবহেলায় পড়ে আছে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি শোভানগরের ছানার জিলিপি। মালদা শহরের অনতিদূরের সমৃদ্ধ মৈথিল গ্রাম শোভানগরের মিষ্টি একসময় দাপিয়ে রাজত্ব করেছে সারা জেলা জুড়ে। এমনকি জেলার বাইরের অতিথিদের কাছেও মাটির হাঁড়িতে করে পৌঁছে গেছে এই মিষ্টি। এখন কোনওমতে টিমটিম করে টিকে রয়েছে চার-পাঁচটি দোকান।
ছানার জিলাপি পাওয়া যায় সর্বত্র। কিন্তু কোথায় ছিল শোভানগরে ছানার জিলিপির বিশিষ্টতা? শিক্ষক মলয়কুমার ঝা বলেন, ‘নয়ের দশকে শোভানগর টিচার্স ট্রেনিং কলেজে পড়তাম। সেই সময় থেকে এই মিষ্টি টানা খেয়ে এসেছি। একেবারে রসে জবজবে নয়, আবার পুরোপুরি শুকনোও নয়। রস এবং মিষ্টির একটা ভারসাম্য এই ছানার জিলিপিতে থাকত। অদ্ভুত টাটকা একটা স্বাদ। অনেক জায়গার ছানার জিলিপি খেয়েছি কেউ সেই স্বাদটা আনতে পারেনি।’
শোভানগরের পুরনো বাসিন্দা রিনিতা ঝা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে বুদ্ধু ঠাকুরের দোকানের ছানার জিলিপি খেয়ে বড় হয়েছি। ছানার জিলিপি আর তার রস দিয়ে টাটকা পাঁউরুটি— এই খাবারের স্বাদ ভোলার নয়। পরবর্তীতে দাদুর দুই ছেলে আলাদা দোকান করে। তার মধ্যে বড়ছেলে বিশ্বনাথ ঝা কিছুটা স্বাদ আনতে পেরেছিলেন, কিন্তু ছোটছেলে নিতাই ঝা তার ধারেকাছে যেতে পারেননি।’
মালদার গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও মিষ্টান্ন বিশেষজ্ঞ সৌমেন্দু রায়ের মতে, শোভানগরের ছানার জিলিপির সবচেয়ে পুরনো কারিগর বুদ্ধু ঠাকুর অথবা বুদ্ধু ঝা। তাঁর দুই ছেলেও এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর এক নাতির বাকশক্তি ছিল না। পুরনো খরিদ্দাররা এখনও দোকানে তক্তপোষের ওপর বসে থাকা এই শব্দহীন শিশুটিকে মনে করতে পারেন। সত্তর বছরেরও বেশি সময় চলছে বুদ্ধু ঝা-র দোকান। ২০১৫ সাল নাগাদ নাতিরা দোকানটি বন্ধ করে দেন। শোভানগর প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের গায়ে শোভানগর হাটের মধ্যে মালদা-মানিকচক রাজ্য সড়কের ধারে এই সাবেক দোকানটির অবস্থান ছিল। মাথায় টালির চালওয়ালা দোকানটিতে কোনও সাইনবোর্ড ছিল না। তবু আলাদাভাবে এর কোনও বিজ্ঞাপন করতে হয়নি। এখন শোভানগর স্ট্যান্ডে চার-পাঁচটি নতুন মিষ্টির দোকান ছানার জিলিপি বানাচ্ছে বটে। কিন্তু স্বাদে ও গুণমানে সেই পুরনো দোকানটি ধারেপাশে তারা কেউ যেতে পারছে না— এমনই মত স্থানীয় বাসিন্দাদের।
সাতের দশকের শোভানগর বি টি কলেজের ছাত্র সত্তরোর্ধ্ব আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, ‘২৫ পয়সা দাম দিয়ে জিলিপি খাওয়া আরম্ভ করেছিলাম। ৯০ পয়সা পর্যন্ত মনে আছে। ছুটিতে যখন বুলবুলচণ্ডীতে নিজের বাড়িতে ফিরতাম, মাটির হাঁড়িতে করে নিয়ে আসতাম ছানার জিলিপি। এখন সব কথা আর মনেও পড়ে না।’
মাটির ভাঁড়ে শোভানগরের ছানার জিলিপি আর তাতে দড়ি বেঁধে স্ট্যান্ড থেকে ফেরার বাস ধরা— এই ছবি আজ হারিয়ে গেছে বাস্তব থেকে। তবুও বাংলা সাহিত্যে তা অমর। সুপ্রিয় চৌধুরীর গল্প ‘আড়কাঠি’-তে আছে সেই দৃশ্য— শোভানগর স্ট্যান্ড থেকে একটি বাচ্চা মেয়েকে বাবা-মার থেকে আলাদা করে বিক্রি করে দেওয়া হবে। সেই মুহূর্তে কান্না থামানোর জন্য তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়— ‘কী খাবি বল?’, মুহূর্ত না ভেবে সে আঙুল দেখায় ছানার জিলিপির দিকে। বাসের সিটে বসে কোলে ছানার জিলিপির হাঁড়ি নিয়ে অপলকে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে আধখাওয়া ছানার জিলিপির গড়িয়ে পড়া মিষ্টি রস ভিজিয়ে দিচ্ছে গায়ের জামা… তাতে এসে মিশছে নোনতা চোখের জল। আনন্দ আর বেদনায় মাখামাখি এই ছবি আজ হারিয়ে গেছে ঘষা কাচের আড়ালে। আর হারানোর পথে এগিয়ে চলেছে শোভানগরের ছানার জিলিপি।
Purono diner kotha mone pore gelo….
পুরোনো প্রসিদ্ধ মিষ্টি গুলো এইভাবে লেখার অক্ষরে প্রাণ ফিরে পাক
Chanar jilepi ekta oitijha