পর্ব ৬
সাত ভাই চম্পা
বেশ কয়েকদিন যাবৎ মনে হচ্ছে কী যেন একটা মিস করছি, কী যেন একটা নেই। কিন্তু কী যে নেই? কী নেই? আসলে ঝামেলা এখানেই। আমাদের জীবনে আছের চেয়ে নেই-এর সংখ্যাই বেশি। তাই যখন কী নেই সেটা খুঁজতে শুরু করি তখন খেই হারিয়ে ফেলি। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, অনেক দিন দিদি ফোন করেনি। প্রায়ই ও সময়ে-অসময়ে ফোন করে, বিশেষ করে যখন লেকচার থাকে। অনেক সময় মনে হয় যেন ইচ্ছে করেই এ সময় ফোন করে। ঘোরের মধ্যে এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নিজেকে চিমটি কাটব। একটু একটু করে ফিরে যাব সেই ছোটবেলায়।
—অভি, বাবা ওঠ!
ঘুমের ঘোরে অভির কানে ভেসে আসে বাবার গলা। লেপের ভেতর থেকেই কোন রকমে ও উত্তর দেয়, এই তো উঠছি। আরেকটু ঘুমিয়ে নিই।
কিছুক্ষণ পরে আবার বাবার ডাক, বাবা, ওঠ। দিদি তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে। ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে।
শীতের সকাল। ১৯৭৩ বা ১৯৭৪ সাল। তরার ব্রিজ তখনও তৈরি হয়নি, কাজ চলছে। ফেরি করে নদী পার হতে হয়। এসময় ফেরিঘাট চলে যায় ব্রিজের গোড়ায়, বাড়ি থেকে অনেক দূরে। দুবছরও হয়নি যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এখানে বধ্যভূমিতে প্রচুর মানুষ মারা গেছে। এখনও নাকি রাতে গলাকাটা ভূতেরা নেচে বেড়ায়। অভি তখন জানত না মরা ভূত নয়, জীবন্ত মানুষের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই বাবা নিজে বা ওরা ফেরিঘাট পর্যন্ত দিদিকে এগিয়ে দিত। তারপর বাস, মানিকগঞ্জ, কলেজ। এই সাতসকালে নদী পার হলে আর ভয় নেই। হাফ প্যান্ট আর শার্টের উপর চাদর মুড়ি দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে ও আর রতন হাঁটতে থাকে দিদির সাথে। সেসব দিনে ব্রাশ আর পেস্টের সাথে সাথে ওরা নিমের ডাল, খেজুরের ডাল, আম পাতা বা শুধু তেল লবণ দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতেও হাঁটতে পারত ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
অভিরা ছিল সাত ভাই আর এক বোন, সাত ভাই চম্পা। সবাই সে নামেই ডাকত। যদিও জীবনে কখনওই ওরা একসাথে হয়নি, তবুও ভাবতেই ভাল লাগত ওরা সাত ভাই এক বোন। সুবোধদা মানে ওর বড়দা অনেক আগেই ইন্ডিয়া চলে গেছে। ২০১৪ সালে মুম্বাইতে দেখা হয়, তখনই জানতে পারে দাদা শেষবার দেশে গিয়েছিল ১৯৬১ সালে, অভির জন্মের তিন-চার বছর আগে। স্বপনদা দেশ ছাড়ে অভির বয়স যখন ছয় মাস। তাই কাগজে-কলমে সাত ভাই এক বোন হলেও বড়জোর ছয় ভাই এক বোনকে একসাথে দেখা গেছে কোনও এক সময়। তবে সেটা অভির বুদ্ধি হওয়ার আগে।
আমাদের এলাকায় হিন্দু পরিবারে বড় ভাইদের দাদা আর বড় বোনদের দিদি বলে ডাকে। মুসলিম পরিবারে ওদের ডাকে ভাই বা ভাইয়া আর আপা বা আপু বলে। ছোট ভাইবোনদের নাম ধরেই ডাকে। আমাদের বাড়িতেও সেভাবেই ডাকা হত। দিদি ছিল চার ভাই, মানে সুবোধদা, সুধীরদা, স্বপনদা আর তপনদার পরে। দিদির পরে কল্যাণ, রতন আর অভি। এখানে ঘটে ছন্দে পতন। কল্যাণ আর রতন দিদিকে নাম ধরে বা ‘ওই’ বলে ডাকত, আর ওদের দেখাদেখি অভিও ওদের দুজনকে আর সেই সাথে কাকাতো বোন চন্দনাকেও নাম ধরেই ডাকত। এ নিয়ে বাড়িতে অশান্তির শেষ ছিল না। যতটা না বাবা মা, তার চেয়ে বেশি পাড়াপড়শিরা এ নিয়ে সব সময়ই একথা-সেকথা বলত। তবে কে শোনে কার কথা। পরে অভি অবশ্য কল্যাণ দাকে দাদা আর রতন দিদিকে দিদি বলে ডাকতে শুরু করে। অভিকে রতন আর চন্দনা তখন উল্টো দাদা বলে ডাকতে শুরু করলে মহা অশান্তি দেখা দেয়, ও হাতের কাছে যা আছে তাই নিয়ে ওদের পেছনে ছুটতে থাকে। দিদি অন্যদের নাম ধরে ডাকলেও অভিকে ডাকত ভাই বলে। একমাত্র দিদিই ওকে ভাই বলে ডাকত।
সুধীরদা ছিল অন্যদের চেয়ে বেশ বড়। এরপর স্বপনদা, তপনদা, দিদি, কল্যাণদা আর রতন ছিল পিঠাপিঠি, মানে ওদের মধ্যে গ্যাপ ছিল দেড় দুই বছরের। অভির জন্ম বেশ পরে। রতনের সাথে অভির পার্থক্য বছর পাঁচ ছয়ের। তাই অন্যেরা যখন এক সাথে একই স্কুলে পড়াশুনা করত, অভি সব সময় একা একাই স্কুলে যেত। ও যখন ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয় তখন রতন টেস্ট পরীক্ষা দিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
যুদ্ধের আগে দিদি সাধারণত ওর বয়সী মেয়েদের সাথে খেলাধুলা করত। তাছাড়া সারাদিন স্কুল, প্রাইভেট এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে ওদের দেখা হত কম। অভি ব্যস্ত থাকত নিজের সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে বিভিন্ন খেলাধুলা নিয়ে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ওদের বিশাল পরিবার বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়েছিটিয়ে বাস করতে শুরু করে বিভিন্ন গ্রামে। দিদি, অভি ছিল একসাথে। তখন যেহেতু স্কুল-কলেজ ছিল না, ছিল না পাড়ার খেলার সাথিরা, তাই ওরা নিজেরাই খেলাধুলা করত। খেলাধুলা মানে পুতুলখেলা। কলার ডগা, মাটি এসব দিয়ে বিভিন্ন পুতুল তৈরি করে খেলা। এসব জিনিস অভির কখনওই খুব একটা ভাল আসত না, তাই দিদি ওকে পুতুলের চোখ লাগাতে সাহায্য করত। যুদ্ধের মাঝামাঝি একবার ওরা যেখানে থাকত, মানে বৈলতলায় রাজাকাররা আসে। ফলে এর পরেই দিদি, রঞ্জিতদা, কল্যাণদা আর চন্দনাকে ইন্ডিয়া পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নৌকার খোলে বসে ওরা কলকাতা রওনা হয়। যতদিন পর্যন্ত না কলকাতা থেকে ওদের পৌঁছনোর খবর এসেছিল, বাড়িতে সে কী দুশ্চিন্তা!
স্বাধীনতার পরপরই দিদি স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়। ওর অনেক স্কুলের বন্ধুরা আমাদের বাড়িতে আসত, অনেকের সাথেই পারিবারিক বন্ধুত্ব ছিল। এদের একজন জাবরার ভুঁইয়া পাড়ার কুসুম আপা। পরে ওদের সাথে আমাদের পারিবারিক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, বিশেষ করে কুসুম আপার ছোটভাই রকিবের সাথে। দিদির বরাবরই ইচ্ছে ছিল ডাক্তারি পড়ার, তবে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। কলেজে কী এক ঝামেলায় পড়াশুনা অনেক দিন বন্ধ থাকে। ঠিক কী ঘটেছিল জানা নেই, তবে দিদি খুব আপসেট হয়েছিল। বাবা-মা আমরা সবাই সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি পাশে দাঁড়াতে। ও বসে থাকার পাত্র ছিল না। তাই এই অনিচ্ছাকৃত গ্যাপের সময় ও একের পর এক অনেকগুলো কোর্স শেষ করে। এর মধ্যে ছিল পিটিআই, গ্রামীণ চিকিৎসক, সেলাই, টাইপ, শর্ট হ্যান্ড, রান্না ইত্যাদি। এসব করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে ওকে থাকতে হত বাড়ির বাইরে। পিটিআই ট্রেনিং নেয় ও মানিকগঞ্জে বাড়ি থেকেই আর পল্লি চিকিৎসকের ট্রেনিং সাটুরিয়ায়। উথুলিতে ছিল কিছু দিন। ছিল করটিয়া শাদাদত কলেজের হোস্টেলে। আমার মনে হয় আমাদের বাড়িতে দিদির সবচেয়ে বেশি ডিপ্লোমা ছিল। এরপরে করটিয়া শাহাদত কলেজ থেকে জীববিদ্যায় বিএসসি পাশ করে উথুলি গার্লস হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করে। তবে সেটা মনে হয় অভি মস্কো আসার পরে। শিক্ষকতা করাকালীন বিএড কমপ্লিট করে আর দূর শিক্ষণের মাধ্যমে এমএসসি শেষ করে। বিভিন্ন ধরনের সেলাই অবশ্য মা’র কাজ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। মা খুব ভাল সেলাই করতেন, রান্না করতেন। কে জানে সব মায়েরাই এমন কি না। দিদি, বৌদিরাও অনেক কিছুই খুব ভাল করত, তবে ছোটবেলার কথা মনে হলে সেলাই, রান্না এসব ক্ষেত্রে মাকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে হয়।
আমাদের বৃহৎ পরিবারে ছিল বারো ভাই আর পাঁচ বোন। বড়দি, সন্ধ্যাদি আর আরতিদির বিয়ে অনেক আগেই হয়েছিল, অন্তত অভি সেটা মনে করতে পারে না। পরে শুনেছে সন্ধ্যাদি আর আরতিদির বিয়ে হয়েছিল একই দিনে। আসলে ওদের বাড়ি ছিল বেশ কনজারভেটিভ। বিশেষ করে মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে। যার ফলে অন্য বোনেরা, এমনকি চন্দনাও খুব বেশি পড়াশুনা করেনি। সেক্ষেত্রে দিদি ছিল ব্যতিক্রম। সেটা মা’র কারণে। মা নিজেও ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়াশুনা করেছিলেন, তাই দিদি পড়াশুনা করুক সেটা খুব করেই চাইতেন। এমনকি সুধীরদার বিয়ের পরে বউদি যখন ম্যাট্রিক পাশ করে আমাদের বাড়ি আসে, কাকাদের আপত্তি সত্ত্বেও বউদিকে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে বলেন। কেউ কিছু বললে মায়ের এককথা, ‘আমার মেয়ে, আমার বউমা, তারা কী করবে না করবে সেটা আমার ব্যাপার। তারা পড়াশুনা করবে।’ বাবার পূর্ণ সমর্থন ছিল মা’র কাজে। কাকা বা জ্যাঠা মনে মনে মেনে না নিলেও বাবার বিরুদ্ধে যেতেন না, তাছাড়া এসবের পরেও তারা দিদি ও বউদিকে খুব ভালবাসতেন। বউদি হয়ে উঠেছিল বাড়ির মেয়ে। বউদি আর রঞ্জিতদা একই সাথে পড়াশুনা করায় সুবিধা হয়েছিল, অন্তত বউদির কলেজে যাওয়ার ব্যাপারে আমাদের চিন্তা করতে হত না। বউদি বাংলায় মাস্টার্স করে জাবরা গার্লস হাইস্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। যখন একে একে আমরা অনেকেই বাইরে চলে যাই দিদি আর বউদি হয়ে ওঠে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
দিদিকে নিয়ে শুধু একটাই সমস্যা ছিল বাবা-মা’র আর তা হল দিদি বিয়ে বসবে না বলে ঠিক করে। এ নিয়ে বাবা-মা’র দুঃখ ছিল, তবে কোনও চাপ ছিল না। কেন, কখন দিদি এ সিদ্ধান্ত নেয় অভির জানা নেই, ও জন্মের পর থেকেই শুনে আসছে দিদি বিয়ে বসবে না। এ নিয়ে কাকা, জ্যাঠারা কথা বলার চেষ্টা করতেন, পাড়া-প্রতিবেশীরা বা আমাদের বন্ধুরাও। তবে মাকে বললে মা সোজাসাপ্টা বলে দিতেন অন্যদের এ ব্যাপারে নাক না গলাতে। বাবাকে বলার সাহস কেউ পেত না। দিদিকে সর্বতোভাবে সমর্থন করলেও মনে মনে বাবা-মা কষ্ট পেতেন, শত হলেও আমরা সমাজের বাইরে নই। তাছাড়া এর ফলে তপনদা অনেকদিন পর্যন্ত বিয়ে করেনি। বাড়িতে একটা অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, কী বাবা-মা, কী ভাইবোনেরা অভিদের কেউই অন্যদের মতামতের খুব একটা তোয়াক্কা করত না, তবে এখানে হয়তো অনেকদিন পর্যন্ত ওরা, বিশেষ করে তপনদা তার বন্ধুদের বা সমাজের মতামতকে পাত্তা দিয়েছে। অভির ধারণা, ১৯৭৭ সালে ওদের একান্নবর্তী পরিবার ভিন্ন হওয়ার পেছনে এ ব্যাপারটাও কাজ করেছে। ও কখনও দিদিকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেনি। কিছুদিন আগে কথাপ্রসঙ্গে দিদি নিজেই একথা বলে।
কথা হচ্ছিল মাছ ধরা নিয়ে। ওদের একটা ডাঙ্গা (ডাঙা বলতে যদিও স্থল বোঝায়, ওদের এলাকায় খোলা মাঠে, মানে চকে পুকুরকে এ নামে ডাকে। এলাকায় কয়েকটা ডাঙ্গা ছিল) ছিল, যেখান থেকে মাঝেমধ্যে বিশাল বিশাল মাছ ধরা হত। এছাড়া রংখোলার সাথেই যে ডোবা ছিল, সেখানেও প্রচুর মাছ থাকত। বাড়ির ও পাড়ার ছেলেমেয়েরা বড়শি দিয়ে সেখানে মাছ ধরত। অভি কখনও বড়শি দিয়ে মাছ ধরেনি। এমনকি ছেলেমেয়েরা ছোট থাকতে গুলিয়া যখন ওদের নিয়ে ভোলগায় যেত মাছ ধরতে, তখনও যেত না। আর তার কারণ প্রতিমা মাসি বা পতু মাসি, মানে বড়দির মেয়ে, বড়শি ফেলতে গিয়ে পিঠে বড়শি বিঁধিয়ে ফেলেছিল। অভি নিজে এটা দেখেছিল নাকি শুধু শুনেছিল সেটা ঠিক বলতে পারবে না। তবে ওই দৃশ্যই অভিকে বড়শি দিয়ে মাছ ধরা থেকে চিরদিনের জন্য বিরত রাখে। একদিন টেলিফোনে দিদির সাথে এ নিয়ে কথা বললে দিদি নিজে থেকেই বলল যে পতু মাসির বর মারা গেলে মাসি খুব কান্নাকাটি করেছিল আর বিয়ে বসলেই বর মরে যাবে এই ভয় দিদিকে পেয়ে বসে। তখনই ও সিদ্ধান্ত নেয় জীবনে বিয়ে বসবে না। অভি এ নিয়ে কথা বাড়ায়নি, দিদিও এ ব্যাপারে কোনও দিন আর কিছু বলেনি। বাড়িতে এ নিয়ে ভিন্ন ধারণা ছিল।
দেশে মায়ের দিক থেকে ওদের তেমন বেশি আত্মীয়স্বজন ছিল না। হাতেগোনা যে ক’জন ছিলেন তাদের একজন আমাদের বড় মামা, মা’র জ্যাঠাতো ভাই, মায়েদের জেনারেশনে সবচেয়ে বড়। উনি থাকতেন মির্জাপুরে, সেখানেই চাকরি করতেন। অভিদের যেমন স্বপনদা, তপনদা, দিদি, কল্যাণদা আর রতন ছিল পিঠাপিঠি, ওদের তেমনি কল্যাণীদি, বাবলুদা, ঝুনুদি আর রুনুদি পিঠাপিঠি। ফলে এদের সবার মধ্যে ছিল খুব ঘনিষ্ঠতা। অনেকের ধারণা, বাবলুদা আর দিদি পরস্পরকে পছন্দ করত, ঠিক তেমনি তপনদা আর রুনুদি। আর এখানেই সব জট পাকিয়ে যায়। একে তো মামাতো পিসতুতো ভাইবোন, তার ওপর জোড়া প্রেম। ফলে স্থবিরতা তৈরি হয় আর কেউই মুখ খুলে নিজেদের ভাল লাগা বা মন্দ লাগার কথা বলে না। বাবা-মাও পাত্রী দেখে বিয়ে-থা’র খুব একটা পক্ষে ছিলেন না, তাঁদের কথা, নিজেরা পছন্দ করুক, আমরা বিয়ে দেব। কিন্তু কেউই যখন বলছে না, তাই বাড়িতে বিয়ে-থা বন্ধ হয়ে যায়। অভি ছুটিতে দেশে গিয়ে বাবাকে বলেছিল দুটো বিয়ের ব্যাপারে, বাবার আপত্তি ছিল না, কিন্তু উদ্যোগও ছিল না। পরে তপনদা রুনুদিকে বিয়ে করে, দিদি বিয়ে বসে না, ওদিকে বাবলুদাও বিয়ে-থা করেনি। আমাদের সমাজ যেহেতু নিজের কাজ করার চেয়ে অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোই বেশি প্রয়োজনীয় মনে করে, তাই মুখের ওপর কেউ কিছু না বললেও কানাঘুষা যে এ নিয়ে ছিল, সেটা বলাই বাহুল্য।
মা’র উদ্যোগে বাড়িতে গানবাজনার রেওয়াজ ছিল। আমাদের বাড়ি ছিল উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। মাঝে জ্যাঠা মশাই, আমাদের আর কাকার শোবার ঘর— এটা ভেতর বাড়ি আর বাহির বাড়ির মধ্যে টানা অঘোষিত রেখা। ভেতরে রান্নাঘর, বড় ঘর, ভোগের ঘর, ছোট গুদাম। বাইরে বড় গুদাম কাম সুতার দোকান, কাছারি ঘর, রাখালদের ঘর, গোয়ালঘর এসব। তবে ভেতর বাড়ি আর বাহির বাড়ির সীমান্তরেখা ছিল প্রতীকী। শুধুমাত্র একেবারে অপরিচিত লোকজনদের ক্ষেত্রে এটা কাজ করত। গ্রামের পরিচিত লোকজন নির্দ্বিধায় এ সীমা অতিক্রম করত। এককথায় বাড়ির পরিবেশ ছিল খোলামেলা। নিয়মিত গানবাজনার আসর বসত। বিভিন্ন সময়ে আকালী রাজবংশী, অবিনাশ চক্রবর্তী, কালিপদ ভৌমিক আমাদের গান শেখাতেন। তবলায় সঙ্গত করতেন রমেশদা। গান শিখত দিদি আর রতন। আমিও একটু একটু শিখতাম, তবে আমাকে দেখে বন্ধুরা হেঁড়ে গলায় চিৎকার করা শুরু করলে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এটা মনে হাতেগোনা দু-একটা ঘটনার একটা যখন অন্যের মতামত আমাকে প্রভাবিত করেছে। রঞ্জিতদা, কল্যাণদা আর আমি তবলা বাজাতাম।
মায়াবন বিহারিনী হরিণী
গহন স্বপন সঞ্চারিনী
কেন তারে ধরিবারে করি পণ
অকারণ
মায়াবন বিহারিনী।
এটা ছিল দিদির শেখা গানগুলোর মধ্যে অন্যতম। আকালী মাস্টারমশাই এ গান শিখাতেন। অবিনাশ মাস্টারমশাই শেখাতেন—
মধুর আমার মায়ের হাসি
চাঁদের মুখে ঝরে
মাকে মনে পড়ে আমার
মাকে মনে পড়ে।
আমার ছোটবেলায় দিদির আরেকটা প্রিয় গান ছিল—
আমার ছোট্ট ভাইটি মায়ায় ভরা মুখটি
লেখাপড়া শিখে তুমি অনেক বড় হবে
ধন্য ছেলে বলবে তোমায় তখন জেনো সবে।
তবে শেষপর্যন্ত একমাত্র রতন ছাড়া গানটা কেউই আর ধরে রাখেনি। রতন বলতে গেলে গানটাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছে।
১৯৮৩ সালে অভি রাশিয়া চলে আসার পর বাড়ির সবার সাথে নিত্যদিনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। মাসে একবার করে লেখা হত। কারণটা এই চিঠি লিখে তার উত্তর পেতে পেতে মিনিমাম এক মাস লেগে যেত। বাবা, মা, তপনদা, দিদি, রতন, ভ্রমর সবাই ওকে লিখত। মাঝেমধ্যে থাকত সুধীরদা, রঞ্জিতদা আর বাবলুদার চিঠি। ও নিজেও সবাইকে আলাদা আলাদা করে দু-কলম হলেও লিখত। ছাত্রজীবনে দু-বার (১৯৮৭ ও ১৯৮৯) দেশে গেলেও অভি মূলত ব্যস্ত থাকত বন্ধুদের আর বিভিন্ন সংগঠন নিয়ে। তাছাড়া বাড়িতেও সবাই ছিল কাজে ব্যস্ত। বন্ধুরা আসত দেখা করতে। সব মিলিয়ে নিজেদের খুব একটা প্রাণখুলে কথা বলা আর হয়ে উঠত না। টুকটাক প্রশ্নোত্তর, রাশিয়ার পরিবেশ, খাবারদাবার, পড়াশুনা, বন্ধুবান্ধব এসব নিয়ে। আর প্রতিবারই, যখন মস্কো ফেরার সময় হয়ে আসত তার দু-তিন দিন আগে থেকে শুরু হত রাত জেগে ছোটবেলার স্মৃতিচারণ। ছোটবেলায় কে কী করত, অভি কেমন জ্বালাত সবাইকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে গেলে।
দেশে থাকতে অভি খুব একটা সিনেমা দেখতে যেত না। বন্ধুদের কেউ কেউ খুব পছন্দ করত সিনেমা দেখতে। তরার বালুচরে কত সিনেমার শ্যুটিং যে হয়েছে। সত্তর আর আশির দশকের নায়ক-নায়িকারা এসেছেন শ্যুটিং করতে। গ্রামের লোকজন দল বেঁধে গেছেন দেখার জন্য। অভির কোনও দিনই মনে হয়নি ওখানে যাবার কথা। হয় বই পড়ত, নয়তো খেলত। এমনকি ১৯৭৪ সালে তরা ব্রিজ হওয়ার আগে কয়েক বার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদিক দিয়ে যাতায়াত করেছেন (তখন ঢাকা-আরিচা রোড ছিল রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের সাথে ঢাকার যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা), ফেরির জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে তরা ঘাটে। গ্রামের মানুষ জলস্রোতের মত ছুটে গেছেন তাঁকে দেখতে, কিন্তু অভির কখনও মনে হয়নি সেখানে যাওয়ার কথা। অভি জীবনে প্রথম যাঁকে উৎসাহ নিয়ে দেখতে যায় তিনি আমেরিক্যান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান। তিনি ১৯৮৮ সালে মস্কো এসেছিলেন। যখন স্কুলে পড়ত একদিন মানিকগঞ্জ গেল রতনের সাথে (ওকে বাবা একা যেতে দিতেন না)। ওখানে ওর এক বন্ধুর সাথে দেখা, ফলে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। বাড়ি ফিরলে দিদি বলল, তোরা নিশ্চয়ই সিনিমা দেখেছিস, নইলে এত দেরি করলি কেন। অভি কিছুই বলেনি, তবে এরপর দেশে আর সিনেমা দেখেনি (শুধু একবারই সিনেমায় গেছিল, তাও মা’র সাথে। মানিকগঞ্জে টাউন সিনেমা হলে (যদি ভুল না হয়, এটা শহরের একমাত্র সিনেমা হল ছিল বাসস্ট্যান্ডে তৃপ্তি সিনেমা হল হওয়ার আগে পর্যন্ত। তৃপ্তি সিনেমা হলে ওর কখনওই যাওয়া হয়নি) ‘ছুটির ঘণ্টা’ দেখার জন্য। এ নিয়ে দিদি খুব মনখারাপ করেছিল, কারণ ও ঠাট্টা করে কথাটা বলেছিল, আর অভি সিরিয়াসলি ব্যাপারটা নিয়েছিল।
মানুষ সব সময়ই মনে করে পাশের আর ঘনিষ্ঠ মানুষদের সাথে যেকোনও সময়ই কথা বলতে পারবে। ফলে দেখা যায় পাড়াপড়শিদের সাথে যত কথা বলা হয়, বাড়ির মানুষের সাথে তত কথা বলা হয় না। এ যেন মক্কার মানুষের হ্বজ না পাওয়ার মত। পরবর্তীতে ১৯৯১ ও ১৯৯৭ সালে দেশে গেলেও বিভিন্ন কারণে কথাবার্তা তেমন একটা হয়নি। ১৯৯১ সালে অভি যখন দেশে যায় তার কয়েকদিন আগেই বাবা মারা যান। ফলে বাড়িতে ছিল শোকের ছায়া। সব কথাবার্তাই ছিল বাবাকে ঘিরে। কথায় বারবার ফিরে আসছিল বাবার কথা, ছোটবেলার কথা। নিজেদের কথা তখন পর্দার আড়ালে চলে যায়। ১৯৯৭ সালে দেশে ছিল মাত্র কয়েকদিন, তাও নানা ব্যস্ততায়। আর বরাবর যেটা হয়, অভি দেশে যায় বাড়ির সবার সাথে দেখা করতে, গল্পগুজব করতে, আর সবাই ব্যস্ত হয়ে ওঠে ওকে খাইয়েদাইয়ে মোটা তাজা করার কাজে। এ এক বিশাল সমস্যা।
দীর্ঘ গ্যাপের পরে পরবর্তীতে বাড়ি ফেরা হয় ২০১১ সালে, চোদ্দো বছর পরে। অভি এই চোদ্দো বছরকে বলে রামের বনবাস। এর মধ্যে অবশ্য বাড়িতে সেলফোন চলে এসেছে, ফলে মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হত, যদিও চিঠি লেখা ততদিনে অনেক আগেই শিকেয় উঠেছে। ফোনে অবশ্য কথা তেমন হত না, কারণ তখনও এটা ছিল বেশ ব্যয়বহুল আর ঠিক কী যে বলবে সেটাও জানা ছিল না। অনেক দিন কথা না বলায় একধরনের গ্যাপ তৈরি হয়, হয়তো মানসিক গ্যাপও। তবে ২০১১ সালে দেশে যাওয়ার পরে সেটা কমে আসে। ইতিমধ্যে সুধীরদা, বউদি মারা গেছে, রঞ্জিতদাও। এক সময়ে যে বাড়িতে গেলে মনে হত, বাড়ি তো নয়, যেন বাজার, এখন সেখানে লোক নেই। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের হয়েছে, ফলে কাজে লোক পর্যন্ত পাওয়া যায় না। তাই লোক মাত্র তিন জন (দিদি, রতন আর রতনের বউ মুন্না) হলেও কাজের শেষ নেই। ভোর পাঁচটায় দিন শুরু হয় দুয়ার ঝাঁট দিয়ে যা শেষ হয় গভীর রাতে।
এখন অভি অবশ্য আগের মত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বা পার্টি অফিসে গিয়ে সময় কাটায় না। দলীয় রাজনীতি থেকে ও অনেক আগেই দূরে সরে গেছে, তাছাড়া মানুষের কোলাহলও ও আর তেমন পছন্দ করে না। সময় কাটে কালীগঙ্গার তীরে বা দক্ষিণ চকে হেঁটে বেড়িয়ে আর ছবি তুলে। দিদি সকালে রান্না করে চলে যায় স্কুলে, আসতে আসতে সন্ধ্যা। আবার অভির জন্য রান্না। অভি অনেক আগে থেকেই এক পদ দিয়ে খেয়ে অভ্যস্ত, কিন্তু দিদি কথা শোনে না। ফলে দেশে যাওয়া মানেই হাড্ডির উপর বাড়তি কয়েক কেজি মাংসের প্রলেপ পড়া আর এজন্যে প্রাণের হাঁসফাঁস করা। এভাবেই কেটে যায় সময়। চলে আসে ফিরে আসার সময়। আবার না বলা কথার এক পাহাড় দাঁড়িয়ে থাকে ওদের মধ্যে। এভাবেই আসবে ২০১৪ আর ২০১৬, যখন অভি আবার দেশে যাবে, তবে অল্প সময়ের জন্যে। প্রতিবারই দেশে গেলে দিদি বলবে ‘ভাই, তোর জন্যে এই টাকাগুলো রাখা আছে। তোর ইচ্ছেমত জিনিসপত্র কিনে নিস।’ অভি উত্তরে বলবে, ‘ওটা রতনকে দে। আমি তো জানি না, কোথায় কী কিনতে হবে। ওই কিনে দেবে।’
বাড়িতে ছোটবেলার সেই জৌলুস আর নেই। আসলে ১৯৭৭ সালে ভিন্ন হওয়ার পর থেকেই সব দিক থেকেই দেখা যাবে ভাঙনের চিহ্ন। ব্যবসা দেখার কেউ থাকবে না, থাকবে না সেই পুঁজি। তখনও শিল্প আসেনি গ্রামেগঞ্জে, জমির দাম জলের মত। তাছাড়া ছোট কাকা ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার পর জমি দেখাশুনা করার কেউ ছিল না। চারিদিকে অব্যবস্থা। ছেলেমেয়েরা সবাই পড়াশুনা করে নিজেদের মূলত চাকরিজীবী হিসেবে গড়ে তুলেছে। জটিল ব্যবসা দেখার স্কিল তো এমনিতে হয় না? ফলে এক সময়ের যেখানে ছিল গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, জমিজমা, ব্যবসা আর অনেক মানুষজনের আনাগোনা সেই বাড়ি আজ জনশূন্য, অভাব বা দারিদ্র্য না এলেও প্রাচুর্যের ঘাটতি খুব চোখে পড়ে। সবচেয়ে বড়কথা, বাড়ির কেউই এমন অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। নতুন সময়ের যে চ্যালেঞ্জ, যেখানে শিক্ষা দিয়ে নয়, প্রয়োজনে শক্তি বা কুটবুদ্ধি খাঁটিয়ে সামনে চলার পথ করে নিতে হবে এমন মানসিকতায় কেউ বেড়ে ওঠেনি। ফলে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে অনবরত পিছিয়ে গেছে ওরা। এক সময়ের প্রাণোচ্ছল বাড়ি পরিণত হয়েছে ভূতুড়ে বাড়িতে।
২০১১ সালে দেশে যখন যাই সময় কাটে মূলত বাড়িতে শৈশবের খোঁজে, মানে নদীর তীরে আর দখিন চকে ঘুরে ফেলে আসা অতীতের ছবি তোলার চেষ্টা করে। ২০১৪ সালের মূল ট্রিপ ছিল ইন্ডিয়া, তবে বাড়িতেও কিছু সময় কাটে গ্রামের শান্ত পরিবেশে। এর মধ্যে আমাদের গ্রাম অনেক বদলে গেছে, বদলে গেছে লোকজন। এখন অধিকাংশ মানুষ এখানে বহিরাগত, পদ্মার পাড় থেকে আসা। ভিন্ন তাদের ভাষা, ভিন্ন আচার ব্যবহার। ২০১৬ সালে ছিলাম মাত্র ৪ সপ্তাহ। কিছু অফিসিয়াল কাজ বাদে মূলত বাড়িতেই সময় কাটে। দিদি আগের মতই স্কুলে যায়। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে দিদি আর রতন শুরু করে বাড়ির কাজ, এরপর দিদি রান্না করে আমাদের খাইয়ে চলে যায় স্কুলে। ফিরে আবার রান্না। কথা বলার আর সময় হয় না। আরও যে কাজটা দিদি করে, সেটা জোর করে বিছানা থেকে তোলা। ছোটবেলায়ও একই অবস্থা। কোথায় আরাম করে একটু লেপ মুড়ি দিয়ে থাকব, তা নয় ওর বিছানা ঠিক করতে হবে। এখানে আমি বিছানা একেবারেই উঠাই না। কাজকর্ম, পড়াশুনা সব বিছানায়। তাছাড়া রাতে তো আবার ঘুমুতে হবেই, তাই অযথা এসব উঠানোর কী আছে? কিন্তু দিদি মনে করে বিছানা না ওঠালে সব কিছুই যেন বাসি থেকে যায়। বাসি বিছানা ওঠাও, বাসি কাপড় ছাড়ো। ইস, এত সব মানলে কী আর অন্য কিছু করার সময় থাকে?
—ভাই আমি তোর জন্যে কিছু টাকা রেডি করে রেখেছি। কীভাবে নিবি?
—কীভাবে মানে? কোথায় নেব? রতনকে দিয়ে দে। কেনাকাটা যা করার ওই করবে।
—না। সে জন্যে টাকা দিয়েছি ওকে। এটা তোর জন্য। সাথে নিয়ে যাবি।
—আমি বুঝছি না তুই ঠিক কী বলতে চাইছিস?
—আমি তোর জন্য ১০ লাখ টাকা রেডি করে রেখেছি। আমার তো দরকার নেই। তোর এতগুলো ছেলেমেয়ে। নিয়ে যা। কাজে লাগবে।
—নারে। আমার চলে যায়। এ টাকা নিলে এমনিতেই খরচ হয়ে যাবে। তাছাড়া আমি জানি না কী করব আমি এত টাকা দিয়ে।
—সেটা তোরা নিজেরা ঠিক করিস। এটা আমি তোর জন্যে জমিয়ে রেখেছি। নিয়ে যাবি।
—আচ্ছা, আমি মস্কো ফিরে গুলিয়াকে জিজ্ঞেস করি। ও যদি এ টাকার সদ্ব্যবহারের কোনও উপায় দেখাতে পারে, যেমন বাসার কাজে লাগাতে চায় জানাব।
—বাসা ঠিক করা তো ভাল। নিয়ে যা।
—বাসা কিন্তু আমার না। আমাদের ছিল। যখন সমস্যা শুরু হয়, আমি আমার অংশ ওর নামে লিখে দিয়েছি। পরে আবার মনখারাপ করিস না।
—তোর নিজের বাসা নেই?
—দরকার নেই।
—যদি কোন ঝামেলা হয় তখন?
—দিদি, এত পড়াশুনা করে যদি একটা বাসা ভাড়া আর দুবেলা ভাতের পয়সা যোগাড় করতে না পারি তাহলে এ জীবনের কোনও মানে হয়? যাকগে, এখন এ ব্যাপারে কোনও কথা নয়। গুলিয়া কী বলে জানাব আর তখন দেখা যাবে কীভাবে টাকাটা নেওয়া যায়।
২০১৬ সালে বাড়িতে থাকাকালীন খেয়াল করলাম দিদির খুবই কষ্ট হয় স্কুলে যেতে। বাসে যাতায়াত শরীরে কুলায় না।
—তোর কি চাকরি করাটা খুবই দরকার?
—সময় তো কাটাতে হবে। আর কয়েক মাস, চাইলে তখন পেনশনে যাওয়া যাবে।
—ভেবে দেখ। বুঝতে পারি, যাতায়াত করতে তোর খুব কষ্ট হয়। চাকরি ছেড়ে দিলে সময় কাটবে না। সব ভেবে দেখ, যদি মনে করিস বোর ফিল করবি না তবে রিটায়ার করার কথা ভাবতে পারিস।
—বোর ফিল করার কী আছে? বাড়িতে ওদের নিয়ে সময় কেটে যাবে। তাছাড়া বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়াতে পারব। সময় কাটবেই।
—দেখ, সবার কিন্তু নিজ নিজ রুটিন। রিটায়ার করলে তুই একা করবি, অন্যেরা করবে না। তাদের জীবন চলবে আগের নিয়মে। হয়তো তোর জন্যে ওদের সময়ই থাকবে না। তাই ভেবে দেখ। কেননা একবার স্কুল থেকে চলে এলে এমনকি কলিগরা যদি যেতেও বলে, সেটা কালেভদ্রে। জীবনের সব রুটিনগুলো কিন্তু একেবারে নতুন করে লিখতে হবে।
মস্কো ফিরে গুলিয়ায় সাথে কথা বলে টাকাটা নেওয়া হবে বলে ঠিক করা হল। ঠিক হল দুবনায় যে বাসাটা পড়ে আছে বছর দশেক, সেটা ঠিক করা হবে। এতে করে কতটুকু লাভ হল জানি না, তবে প্রচুর টাকা খরচ হল। আগে সবাই মস্কো থাকত, আমি দুবনা। ছুটির দিন ওরা একসাথে কাটাত মস্কোয়। নতুন ব্যবস্থার ফলে ছেলেমেয়েরা রয়ে গেল মস্কো। অভির একা থাকার স্বাধীনতা চলে গেল। সব মিলে ওদের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন হল।
একটা জিনিস অভি খেয়াল করল দেশে যখন যায় তখন কারও সাথে কথা বলার সময় থাকে না, কিন্তু দেশ থেকে ফিরলেই সবার হাতে অফুরন্ত সময় বেরিয়ে আসে। এবার দিদি প্রায়ই ফোন করতে শুরু করল। অভির মনে পড়ল বেশ কয়েকবছর আগের ঘটনা।
—আপনি বাড়িতে ফোন করেন না? মালেক জিজ্ঞেস করল।
—ঠিক হয়ে ওঠে না। অপেক্ষায় আছি কবে অল্প পয়সায় ফোন করা যাবে।
—তাহলে এই কার্ডটা নিয়ে যান, খুব সস্তায় দেশে কথা বলা যায়।
সমস্যা হল ওই কার্ড কাজ করে মস্কো থেকে। ফলে দুবনা মস্কোর ফোন চার্জ মস্কো ঢাকার চার্জকে দুগুণ ছাড়িয়ে গেল। কথাও হল না। মানে একে অন্যের গলা শুনে সবাই আবেগে এতটাই উদ্বেল যে কথা বলতেই ভুলে গেছে। এখন অবশ্য সে সমস্যা নেই। বিভিন্ন প্রভাইডার ঘুরে ওরা এখন বিনে পয়সায় ফোন করে।
—ভাই কি খালি আজ?
—এই তো রান্না করছি। একটু পরেই খাব।
—কী রান্না করছিস?
—মাংস।
—কীসের মাংস?
—ইস, আরেকটু আগে ফোন করলে জিজ্ঞেস করতে পারতাম। ওদের তো চুল্লিতে বসিয়ে দিয়েছি। এখন যে কী করে জানি?
ওদিকে হাসির শব্দ।
অভির মনে পড়ল ১৯৮৯ সালের কথা। বাবার সাথে বসে গল্প করছে। এক আত্মীয়া জিজ্ঞেস করল, তোমরা ওখানে সব মাংস খাও?
—হ্যাঁ। তাতে কী?
—বড়টাও?
আমি মিথ্যা বলতে পছন্দ করি না। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ট্যাক্ট বলে কিছু জানে না। প্রশ্ন করে উত্তর পাবার জন্য নয়, যাকে প্রশ্ন করছে তাকে অপ্রস্তুত করার জন্য।
—হ্যাঁ!
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেজমার তো মূর্ছা যাবার অবস্থা। বাবা বললেন, দেখ শীতের দেশ। সেখানে ইচ্ছা অনিচ্ছায় অনেক কিছুই খেতে হয়।
কোনও সময় আবার ফোন করে বলবে, ভাই তুই গুলিয়াকে রান্না করতে বললেই তো পারিস।
—কেন? সংসার তো আমাদের দুজনেরই। ও কিছু কাজ করে, আমি কিছু করি। আচ্ছা এই যে সকালে উঠে তুই আর রতন ঘরদোর পরিষ্কার করিস, অনেক সময় রতন ভাত বসায়, রুনুদি না পারলে তপনদা রান্না করে তাতে কি তোদের কোনও অসুবিধা হয়?
—আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে। তাছাড়া আমরা তো তোর মত বিজ্ঞানী না।
—ভাল। বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু আমাদের কাছে তো শুধুই বাবা। তোদের কাছে আমি তো শুধুই ভাই, একইভাবে গুলিয়ার কাছে বর, ছেলেমেয়েদের কাছে বাবা। দেখ, আমার ডিগ্রির জন্য একটা এক্সট্রা টাকা দেয়, কিন্তু আমি যখন ছুটিতে যাই সেই টাকা পাই না। কারণ ছুটিতে আমি একজন সাধারণ মানুষ, ডিগ্রিধারী কেউ নই। বাড়িতেও তাই। এখানে আমি বিজ্ঞানী নই, আর দশজনের মতই কারও বাবা কারও বর। কিছুদিন আগে আমি ছিলাম আমাদের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। আমি নামের আগে ড. লিখতাম না, কারণ সংগঠনের পোস্টের জন্য কাউকে ডিগ্রি করতে হয় না। এ নিয়ে সভাপতি মনোঃক্ষুণ্ণ, কেননা আমার জন্যে সে ড. লিখতে পারছে না। তাই ওসব বাদ দে। কে রান্না করল, কে ঘর পরিষ্কার করল এটা বড়কথা নয়, আসল কথা সেটা পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যে করলেই হল।
—আচ্ছা, আর জিজ্ঞেস করব না। তোর পায়ের কী অবস্থা?
—রুশিরা বলে কবর সব সমান করে দেবে। তাই পা নিয়ে ভাবি না। একদিন এমনিতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
—কী সব অলক্ষুণে কথা যে বলিস?
—দিদি, মৃত্যুটা জীবনের আরেক প্রান্ত, ঠিক জন্মের মতই। এটা তো অস্বাভাবিক কোনও ব্যাপার নয়। সবাই মরছে কিন্তু জীবন থেমে নাই। তাই মৃত্যুকে ভয় পাবার কী আছে? আসল কথা কীভাবে মরা। আমাদের বাড়ির সবাই তো খুব রোগে ভুগে মারা যায়। এটাই আমাকে একটু বিচলিত করে। সম্মানের সাথে মৃত্যুকে বরণ করার নামই জীবন। ভালবাসা শুধু প্রিয় মানুষদের মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচানোই নয়, তাদের সম্মানের সাথে মরতে দেওয়ার নামও ভালবাসা।
দিদির সাথে এরকম অনেক কথাই হত। একসময় দেখা গেল ও মৃত্যুকে নিয়ে আমার হাসিঠাট্টা স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করছে। ইতিমধ্যে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে। পেনশনের টাকা নিয়ে একটু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। স্কুলের ক্লার্ক নাম বানান ভুল করায় আবার সব কিছু নতুন করে করতে হবে। আমার ছাত্র ইউনিয়নের দু-একজন বন্ধু ছিল শিক্ষা বিভাগে। ওদের বলায় কাজটা দ্রুত করে দিল। জীবনে এই প্রথম পরিচিত কাউকে এ ধরনের অনুরোধ করলাম।
ইদানীং দিদি প্রায়ই ফোন করে। বুঝতে পারি অবসর নিয়ে নিজেকে ঠিক খুঁজে পাচ্ছে না। সময় যেন কাটে না। আর যখন মানুষের সময় কাটে না কারণে-অকারণে সে বিরক্ত হয়, আশপাশের লোকজনের প্রতি অভিমান আর অভিযোগ বাড়ে। তবে এখন আর কথা শেষ হয় না। মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় আমি যদি ওকে রিটায়ার করতে না বলতাম এসব সমস্যা হয়তো এড়ানো যেত। দিদি সারা জীবন বিভিন্ন কাজ করে গেছে, নিজের শুধু নয়, অন্যদের জন্যও করেছে সব সময়। রিটায়ার করার পর হঠাৎ যেন নিজেকে অপ্রয়োজনীয় মনে করছে। যতদিন শিক্ষকতা করত, অনেকেই প্রাইভেট পড়তে আসত, যখন চাকরি ছাড়ল, দেখা গেল ছাত্ররা আর পড়তে চাইছে না। কারণ? আজকাল প্রায় সবাই নম্বরের জন্য পড়ে, জ্ঞানের জন্য নয়। তাছাড়া চাকরি করা মানে মাসে মাসে একটা ইনকাম, ইনকাম মানে বাড়ির সবাইকে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে এটাওটা কিনে দেবার স্বাধীনতা।
—ভাই, ওকে মনে আছে তোর? ও গতকাল মারা গেছে। তোর কথা জিজ্ঞেস করত দেখা হলেই।
এ সময় গ্রামের কোন খবরই আমার অজানা ছিল না। কত রকম যে কথা। প্রায়ই রিপিট করত অনেক কথা।
—হাত কাঁপেরে আজকাল। ডাক্তার দেখালাম, তোর ক্লাসমেট ছিল কলেজে। তোর কথা বলল।
—তাই? ওষুধপত্র দিল?
—দিল। কাজ করতে না করেছে। আচ্ছা তুই বল, কাজ না করে থাকব কীভাবে?
—দিদি, বাবা, মা, সুধীরদা যখন অসুস্থ ছিল তুই, রতন দুজনে মিলে ওদের দেখাশুনা করেছিস। আজ যদি তুই ঘরে পড়ে যাস রতনের অবস্থা কী হবে ভেবে দেখেছিস? কাজ করার কী দরকার? হাতকে রেস্ট দে।
আবার হঠাৎ কী মনে হল, ফোন করে বলবে, ভাই তুই অ্যালকোহল খাস? ওসব খাস না।
—দিদি, তোরা মনে হয় অ্যালকোহল খাওয়া মানে মাতলামি বুঝিস। মনে আছে গোবিন্দ বসাকের কথা? মদ খেয়ে হৈচৈ করত আর বলত ‘কথা কম কাজ বেশি’। ছোটবেলায় মার সাথে যখন গুপ্তিপাড়া দাদুর ওখানে যেতাম দাদু বাচ্চাদের চা খেতে দিতেন না। ওঁর সামনে হরলিক্স খেয়ে বাইরে চলে যেতাম। মা আমার জন্য লুকিয়ে চা নিয়ে আসতেন। দাদুর ধারণা ছিল চা এক ধরনের নেশা। আসলে সব নির্ভর করে কে কীভাবে খায় তার ওপর। আগে আমাদের জোর করে বেশি বেশি খাওয়ানো হত যাতে মোটা তাজা হই। এখন সেটাকে অসুখ বলে ধরা হয়। আমি অ্যালকোহল খাই, তবে কোনও উপলক্ষ্যে, অথবা কখনও বাসায় নিজেরা বসে একটু রিল্যাক্স করার জন্য। যে দেশের যে নিয়ম।
২০১৬ সালে দেশ থেকে ফেরার পর দিদির সাথে এমন কথা প্রায়ই হত। আমার ক্লাস থাকত সোমবার, তাই ওকে বলতাম ওই দিন ফোন না করতে আর দিদি প্রতিবারই সোমবার লেকচারের সময় ফোন করত। কথার যেন শেষ ছিল না। কত কথা যে বলত। তবে প্রায়ই বাবা, মা, সুধীরদা আর বউদির কথা। মনে হত ও যেন বর্তমানে নয়, অতীতে কোথাও আটকে গেছে। বাড়ির প্রায় সবাই জীবনের শেষ বছরগুলোতে অসুখে ভুগে মারা গেছে। এটাই যেন ওকে আজকাল বেশি দুশ্চিন্তায় রাখে।
—ভাই কী করিস?
—চা খাচ্ছি রে।
আমি সাধারণত ৩টার দিকে চা খাই। দিদিকে বলি তখন ফোন করতে। চা খেতে খেতে রিল্যাক্স মুডে গল্প করা যায়।
—শুধু চা?
—একটা আপেল খেলাম। এখন চা-বিস্কুট। আমার লাঞ্চ।
—এতে পেট ভরে?
—এটুকু খেলে ব্রেনকে চিট করা যায়। ডায়েট কন্ট্রোল মানুষ এভাবেই করে। একটু খাবার দিয়ে ব্রেনকে চিট করে। আসলে এটুকু খেলে আমি রাত ১০-১১ পর্যন্ত অনায়াসে কাজ করতে পারি, কিন্তু আর কিছু খেলেই ৬-৭টার দিকে প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগে।
—তা তখন খেলেই তো পারিস।
—কাজ করব কখন? যাকগে তুই আজ কী খেলি?
—গত কয়েকদিন আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল। বাড়িতে রান্না করিনি।
—এবং সেখানে ঝাল খেয়ে তোর শরীরের সমস্যা। তাই?
—ঠিক ধরেছিস। আসলে সবাই এত করে বলে, না গেলে চলে না।
—যাবি যা, উপহারটা দিয়ে সরে পড়। সমস্যা হলে খাওয়ার কী দরকার?
—ভাই, তুই এসব বুঝবি না। না খেলে লোকজন ভাববে ওদের অবজ্ঞা করছি।
বাবা কিন্তু কখনওই কোথাও যেতেন না। আমিও না। এমনকি শ্যামলদা বা বড়দাদের ওখানে কিছু হলেও আমার জন্য খাবার দিয়ে যেত।
সমাজে থাকতে হলে ইচ্ছা অনিচ্ছায় অনেক কিছুই করতে হয়।
—তাই বলে শরীর খারাপ করে?
—ভাই, তুই তো নিজেই বলিস, খেলেও মরব, না খেলেও মরব, তাই খেয়ে মরাই ভাল।
—তা যা বলেছিস। শুনলাম আজকাল অনেক সন্ত্রাসবাদী স্বর্গের দ্বারে হল্লা করছে। তাই ঢোকানোর আগে কড়া চেক। অনেক সময় নাকি সাত দিন পর্যন্ত গেটে বসিয়ে রাখে। কোনও খাবারদাবার দেয় না এ সময়। কথাটা সত্য হলে ভরা পেটে মরাই ভাল।
—তুই আসবি না এবার?
—জানি না। আসলে এখন পড়াতে শুরু করেছি। ডিসেম্বরে আর ছুটি পাওয়া যায় না। তবুও দেখি ভ্রমররা কবে নাগাদ আসে। তাহলে ভেবে দেখব।
এসবই ছিল আমাদের নিত্যদিনের কথা। প্রায় সবার সাথে কথা হয় কোনও না কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে, মানে কথার কোনও একটা বিষয় থাকে। সেভার ছোটবেলায় এমনভাবে কথা বলতাম আমরা। এখন দিদির সাথে। কোনও বিষয় নেই। যা মনে আসে তাই বলে যাওয়া। এ যেন বানের জলে ভাসতে ভাসতে চলে যাওয়া। কোনও লক্ষ্য নেই, কোনও উদ্দেশ্য নেই। শুধুই ভেসে যাওয়া। আমাদের কথাও ছিল সেরকম। বলাটাই আসল। কী বললাম সে নিয়ে দিদির মাথাব্যথা ছিল না, এই যে কথা বলছি সেটাই আসল। আমার কাজ থাকলেও কিছু বলতাম না যতক্ষণ না ও নিজে থেকে ফোন রেখে দিত। বিরক্ত হতাম কি? না। আমি জানতাম, সময়টা আমি সব সময় ম্যানেজ করে নিতে পারব।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরের ২২ বা ২৩ তারিখ। দিদি ফোন করল।
—আজ মাকে স্বপ্নে দেখলাম।
—মাকে তো প্রায়ই দেখিস তুই। ১২ জানুয়ারি মার মৃত্যুবার্ষিকী, এ নিয়ে ভেবেছিস, তাই হয়তো স্বপ্নে দেখেছিস। বেল্লালকে বলে শ্মশানটা পরিষ্কার করিয়ে নিস।
—নারে ভাই, মাকে অন্য রকম দেখলাম। যেন আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
—দিদি, মা-বাবা আমাদের ক্ষতি চান না। তুই মাথা থেকে এ চিন্তা দূর কর।
—তোর তো দুদিন পরে জন্মদিন। কে জানে আবার ফোন করা হয় কিনা। আগে থেকেই অভিনন্দন জানাচ্ছি।
—রুশিরা আগে থেকে জন্মদিনের অভিনন্দন জানায় না। তুই ২৫ তারিখে ফোন করিস। আমি অপেক্ষা করব।
২৫ তারিখে ফোন করল। তবে অল্প সময়ের জন্য। কী নিয়ে যেন ব্যস্ত ছিল তাই বেশিক্ষণ কথা হয়নি। এরপর আমি নিজেই বেশ কয়েকদিন সময় করতে পারিনি ফোন করতে। বছরের শেষ, বিভিন্ন রিপোর্ট রেডি করতে হয়, নববর্ষের আর সেভার জন্মদিনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
৩১ ডিসেম্বর সকালে ফোন এল। রতন করেছে। এত সকালে সাধারণত ওরা ফোন করে না। তাই একটু চিন্তিত ভাবেই ফোনটা ধরলাম।
—ভোরে প্রতিদিনের মত দিদিকে ডাকলাম, বলল, একটু পরে উঠবে। ঘণ্টা দেড়েক অপেক্ষার পর যখন উঠল না, আবার ডাকাডাকি শুরু করলাম। শেষপর্যন্ত সুব্রতকে নিয়ে দরজা ভেঙে দেখি ও বিছানা থেকে পড়ে নীচে শুয়ে আছে। এইমাত্র মন্নুতে নিয়ে এলাম, জ্ঞান আছে। কতগুলো টেস্ট করাতে হবে।
দিদি একা এক ঘরে থাকে। কতবার বলেছি দেশে গেলে আমি যে ঘরটায় থাকি সেখানে থাকতে। কয়েকটা রুম। রতন মুন্না আর রিতমকে নিয়ে ওই ঘরে থাকে। একসাথে থাকলে সবার টেনশন কম থাকে। বিশেষ করে যখন শরীর খারাপ। কিছুতেই শুনবে না। কে জানে যদি আমাদের কথা শুনত আজ এ বিপদে পড়তে হত না।
—ঠিক আছে। টেস্ট করে দেখ কী বলে।
যতদূর বুঝলাম টেস্ট করেছে, কিন্তু ডাক্তাররা সঠিক কিছু বলতে পারছেন না। আরেকটা টেস্ট মনে হয় রিপিট করতে হবে। কে জানে এরা ইচ্ছে করে এসব করেন কি না। বৃহস্পতিবার রতন ফোন করে বলল, ডাক্তাররা বলছে দিদিকে বাসায় নিয়ে যেতে। ওরা কেউ থাকবে না, তাই বাড়ি নেওয়াই নাকি ভাল।
—দেখ, ওরা যেভাবে বলে সেভাবেই কর। দিদির অবশ্য জ্ঞান আছে, তবে একা খেতে কষ্ট হয়। কথা বলতে চাইলাম, বলল না।
শুক্রবার সকালে রতনের ফোন। দিদির অবস্থার অবনতি হয়েছে, আমরা অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় যাচ্ছি। আপাতত পপুলারে আইসিইউ-এ সিট পাওয়া গেছে। লাল্টু আসছে, নিলয় চলে যাবে। যদি ওখানে কিছুদিন থাকতে হয় বেল্লালকে রেখে আমি বাড়ি ফিরব। ওদিকে কিছুই গুছিয়ে আসতে পারিনি।
দিদি আইসিইউ-তে রইল কয়েক দিন। ডায়াগনোসিস ঠিকমত করতে পারছে না। ধরেই নিয়েছে স্ট্রোক করেছিল। আমার মনে পড়ল দিদির একবার জন্ডিস হয়েছিল। বললাম, ডাক্তারকে জানাতে। শেষপর্যন্ত দেখা গেল লিভারের সমস্যা। এর মধ্যে ওর জ্ঞান ফিরেছে। আইসিইউ থেকে নর্মাল কেবিনে দিয়েছে। লাল্টু আছে পিজিতে। চেষ্টা করা হচ্ছে ওখানে শিফট করতে। তাহলে লাল্টু হেল্প করতে পারবে আর স্থানীয় কোনও নার্সকে রাখা যাবে।
দিদির অবস্থা আগের মত শঙ্কাজনক নয় তবে ইমপ্রুভমেন্ট হচ্ছে ধীর লয়ে। ওকে ইতিমধ্যে পিজিতে শিফট করা হয়েছে। একদিন কুন্তল ফোন করল পিজি থেকে।
—নাও, পিসিমনির সাথে কথা বলো।
২৫ ডিসেম্বরের পর দিদির সাথে এই প্রথম কথা হবে।
—দিদি, কী খবর? এখন তো ভালই মনে হচ্ছে। একটু অপেক্ষা কর, সব ঠিক হয়ে যাবে।
—নারে ভাই, আমার মনে হয় পুরোপুরি সেরে উঠব না।
—ডাক্তাররা কিছু সেরকম কিছু বলেনি।
—ভাই, তোর মনে আছে বলেছিলি সম্মানের সাথে মরার কথা। রতনকে বলিস, যদি ঘরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে যেন আমাকে অযথা বাঁচিয়ে না রাখে। আমারও মরা হবে না, ওরও বাঁচা হবে না। তুই বললেই হবে।
—ঠিক আছে, ডাক্তার কী বলে শুনি। তেমন কিছু হলে আমি ওদের বলব।
—বলবি তো?
—তুই এখন কেমন ফিল করছিস?
—খুব একটা ভাল না। প্রচণ্ড ব্যথা। খুব কষ্ট হয়রে সহ্য করতে।
—ঠিক আছে কাকা, পিসিমনি টায়ার্ড। পরে আবার কথা বলিয়ে দেব।
এর মধ্যে রতন ফিরে এল।
—ডাক্তার কী বলল?
—আশা তো দিচ্ছে। তবে আরও কয়েকদিন না গেলে ঠিক বোঝা যাবে না।
ইতিমধ্যে কেটে গেছে কয়েক সপ্তাহ। আবার একদিন দিদির সাথে কথা হল। সেদিন আমার বন্ধু রকিব গেছিল দিদিকে দেখতে।
রকিব ফোন করল। ওর নিজের শরীর খারাপ।
—নে, বন্যাদির সাথে কথা বল।
—দিদি, কেমন লাগছে তোর? এখন আগের চেয়ে ভাল?
—হ্যাঁ ভাই। অনেকটাই ভাল হয়ে গেছি। আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। বাড়ি যাব। রতনকে বলে দিস।
—ঠিক আছে। রতনকে বলব। ডাক্তার বললেই বাড়ি নিয়ে যাবে।
জানুয়ারির শেষ। গ্রামে প্রচণ্ড ঠান্ডা। রতন চাইছিল আরও কয়েকটা দিন পিজিতে থেকে যেতে। এখানে আর যাই হোক নার্স আছেন। কিছু টাকা লাগলেও যত্ন নেন।
—ভাল হত যদি শীত কমা না পর্যন্ত এখানে থাকা যেত। এর মধ্যে ভিসা করার চেষ্টা করি। যদি সম্ভব হয় এখান থেকেই ইন্ডিয়া নিয়ে যাব।
—ওরা এত দিন রাখবেন কি?
—সেটাই তো বুঝতে পারছি না। লাল্টু চেষ্টা করছে।
—তা না হলে মন্নুতে নিয়ে রাখ। কেবিন নে। নার্স রাখ। দরকারে বাড়ি থেকে খাবার এনে খাওয়াতে পারবি।
—সে চেষ্টাও করব।
—ডাক্তার কী বলে?
—আরও কয়েকটা দিন ক্রিটিক্যাল। সমস্যা যে লিভারের এটা ধরতে ধরতেই খুব মূল্যবান সময় নষ্ট হয়েছে। তাই টেনশনে আছি কী করব ভেবে।
—দিদির সাথে আমার কথা হয়েছে। যদি দেখিস ও আর নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না, যদি বাবা-মা’র মতই ঘরে পড়ে যায় সেটা কিন্তু তুই এখন আর সামাল দিতে পারবি না। সেক্ষেত্রে চিকিৎসা বন্ধ করাই ভাল, তবে শুধু ডাক্তার বললে। দিদি আমাকে বারবার এই অনুরোধ করেছে। দেখিস, ওকে যেন কষ্ট করে বেঁচে থাকতে না হয়।
—তুই তো বলেই খালাস। লোকে কী বলবে?
—শোন, লোকজন বলেই খালাস। কষ্টটা তো আর ওরা ভোগ করবে না। সবাই সম্মানের সাথে মরার অধিকার রাখে।
আমি ১৯৮৩ থেকে বাইরে। রতন আর দিদি প্রায় চল্লিশ বছর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব বিপদ-আপদ ঠেকিয়েছে। ওরা শুধু ভাইবোন নয়, সহযোদ্ধা। আমি দূরে তাই খুব সহজে এসব বলতে পারি। তবে সেটা করতে হবে রতনকে। বলার চেয়ে করাটা সব সময়ই কঠিন।
এরপর আমি তপনদাকে ফোন করলাম। বললাম,
—দিদিকে খুব সম্ভব নিয়ে যেতে বলছে। আপাতত মন্নুতে থাকুক কেবিন ভাড়া করে। তবে যদি দেখো বাবা বা মা’র মত ঘরে পড়ে যাবে, চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়ো। দিদির সেটাই ইচ্ছা। আমি রতনকে বলেছি। ও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
—ঠিক আছে।
এর মধ্যে মন্নুতে যোগাযোগ করা হয়েছে। সব আয়োজন চলছে দিদিকে মন্নুতে শিফট করার। কাল সকালে নিয়ে যাবে।
৬ ফেব্রুয়ারি রতনের ফোনের অপেক্ষায় আছি। ফোন এল।
—শোন, রাতে দিদির অবস্থার খুব অবনতি ঘটে। এখন চলছে যমে-মানুষে টানাটানি। মনে হয় টিকবে না, বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারব না।
—আচ্ছা। ভেঙে পড়ার কিছু নেই। এমন পরিণতি একদিন আমাদের সবারই হবে।
—অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করেছি। নিলয়, লাল্টুরা এলেই রওনা হব। ডাক্তাররা আর কোনও আশা দিচ্ছেন না।
এ এক অবাক ব্যাপার। বাবা, সুধীরদা মৃত্যুর আগে হাসপাতালে ছিলেন। ডাক্তাররা শেষমুহূর্তে এদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন সেখানে মরার জন্য। অথচ রাশিয়ায় এ অবস্থায় রোগীকে চাইলেও পাঠাবে না, শেষমুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করবে যদি বাঁচিয়ে তোলা যায়। ডাক্তারদের এমন পলায়নপর মনোভাব কেন? দিদির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা দেখছি। এটা যেন দায়িত্ব এড়ানো, বলা, আমরা জীবিত রোগীকে বাড়ি পাঠিয়েছি, বাড়িতে মৃত্যু হলে আমাদের কীই বা করার আছে!
না, বাবা, মা, সুধীরদার মত দিদির আর বাড়ির উঠানে মরা হল না। তার আগেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল।
দিদির জন্ম ১৯৫৫ সালের ২১ আগস্ট। প্রায় ৬৫ বছর পৃথিবীতে কাটিয়ে ২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ও চলে গেল। আমি আমাদের ফ্যামিলি গ্রুপে লিখলাম,
—আজ ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ আমার বোন মারা গেল।
গুলিয়াকে মুখেই জানালাম।
—খুব দুঃখজনক।
—মনে হয় দিদি মরে বেঁচে গেল। বেঁচে থাকলে বরং অনেক কষ্ট পেত।
গুলিয়া জানে এসময় আমার সাথে কথা বলা ঠিক হবে না। আমি ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ভোলগার দিকে।
অনেকক্ষণ পরে মনিকা সমবেদনা জানাল।
ক্রিস্টিনা জানতে চাইল, ‘কী হয়েছিল?’
—লিভারের সমস্যা।
—আন্টি কি ড্রিঙ্ক করত?
কষ্টের মধ্যে হাসি পেল। এখানে অতিরিক্ত ড্রিঙ্ক করার ফলে অনেকের লিভার নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের দেশে এ লাইনে হয়তো কেউই ভাববে না।
—না। আন্টি কখনই ড্রিঙ্ক করত না।’
কয়েকদিন পরে মস্কো গেলাম। ক্লাস নিতে। বাসায় ফিরেছি। দেখি সেভা অপেক্ষা করছে।
—চলো, দোকানে যাই।
—চল।
সেভা কথা বলতে চাইলে হয় দোকানে নয়তো ঘুরতে যেতে চায়। ঘরে থাকলে সাধারণত কোনও না কোনও কাজে ব্যস্ত থাকি আমরা, তাই কথা বলতে চাইলে বাইরে যাওয়াই সঠিক মনে করি।
—কী হয়েছিল আন্টির?
—লিভারের সমস্যা।
—তোমার খুব মনখারাপ?
—একটু তো হবেই। আমার একমাত্র বোন।
—ডাক্তাররা কিছু করতে পারল না?
—নারে। চেষ্টা করেছে। তবে অবস্থা যা দাঁড়িয়েছিল তাতে জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে বেছে নিতে হলে আমি মৃত্যুকেই বেছে নিতাম। এরপর বেঁচে থাকলে শুধু কষ্টই পেত, আমার দিদি, ভাইয়েরা, আমি— আমরা সবাই। প্রিয় মানুষের কষ্ট দেখা আর তার জন্যে কিছু করতে না পারা— এই অসহায়ত্ব অমানবিক।
—আমার মনে হয়, শেষপর্যন্ত চেষ্টা করা উচিত মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।
—ঠিক আছে। আমি আমার সব দিয়ে তোকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করব, তবে আমি যদি এমন অবস্থায় পড়ি তুই কিন্তু আমাকে ধরে রাখিস না। বাঁচার মতই মরতেও হয় মাথা উঁচু করে।
সেভা কিছু বলল না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। হ্যাঁ, এসব বোঝার অভিজ্ঞতা ওর এখনও হয়নি।
কয়েকদিন আগে এক বন্ধু জানতে চেয়েছিল ‘যা হয় ভালর জন্যেই হয়, কথাটা কতটুকু সত্য?’ তখন এ নিয়ে লিখেছিলাম যে, সেটা নির্ভর করে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। বর্তমানে যা আছে সেটাই ইনিশিয়াল কন্ডিশন। একে ব্যবহার করেই সমস্যা সমাধান করতে হবে আর সে জন্যে দরকার পজিটিভ এটিচুড। করোনাকালে মনে হয় দিদি ও অবস্থায় বেঁচে থাকলে সমস্যা আরও তীব্র হত। হাসপাতাল বন্ধ, বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেবার উপায় নেই। এটা ঠিক এমন অবস্থায় আমরা একা পড়তাম না, অনেকেই এর মধ্যে দিয়ে গেছেন, যাচ্ছেন। তবে আমরা শুধু কী হল আর কী হতে পারত— এটা তুলনা করতে পারি। সেদিক থেকে মনে হয় দিদির প্রস্থান অসময়ে হয়নি। আসলে কেন যেন আমরা সব সময় মনে করি সব মানুষই সবসময় অসময়ে মারা যায়। কেন? কারও কি মরার কোনও সময় আছে? কেউ কি কোনও গ্যারান্টি নিয়ে আসেন?
দিদি মারা গেল এক বছর হয়ে গেল। ও যে মারা গেছে আমার সেটা প্রায়ই মনে থাকে না। হঠাৎ কখনও মনে হয় দিদি অনেক দিন ফোন করে না। আর তখনই বুঝতে পারি দিদি নেই। তাছাড়া বাবা, মা, বউদি, সুধীরদার মৃত্যুদিবসে ও ফোন করত। আমি নিজেও অনেক সময় ফোন করে বলতাম বেল্লালকে দিয়ে শ্মশান পরিষ্কার করিয়ে মোমবাতি জ্বালাতে। গত একবছর সেটা আর বলা হয়নি। এবার ভাইফোঁটার দিনও দিদি আর ফোন করে বলেনি, ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা/ যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা।’
সব কিছুর পরেও দিদি ছিল সবার আবদারের জায়গা। কেউ কেউ টাকাপয়সা চেয়ে দিদিকে কষ্ট দিত। অনেক দিন থেকেই বাড়িতে লোকজন নেই বললেই চলে। প্রায় সবাই চাকরিজীবী, ঢাকায় থাকে। কিন্তু দেশে এলে সবাই পিসিমণির সাথে একটু দেখা করে যায়। সবাই নিজেদের সুখদুঃখের কথা শেয়ার করে। নিজে বিয়েথা করেনি, তাই বাড়ির সবাইকে যেটুকু পারে সাহায্য করার মধ্যেই ছিল ওর আনন্দ। পূজার অনেক আগে থেকেই তালিকা প্রস্তুত করত কাকে কী দেবে। এককথায় বাড়ির তো বটেই আত্মীয়স্বজনদের এক অদৃশ্য সুতায় বেঁধে রাখত ও। তাই তো এখন অন্যদের সাথে কথা বললে দিদির কথা বারবার উঠে আসে, ওর অভাবটা সবাই অনুভব করে।
কিছুদিন আগে নিলয় অস্ট্রেলিয়া চলে গেল। বুয়েট থেকে মাস্টার্স করে ক্যানবেরায় পিএইচডি করবে। সেদিন কথা হচ্ছিল।
—চলো এবার ডিসেম্বরে সবাই মিলে দেশে যাই।
—দেখি। আসলে জানিস তো শেষের দিকে দেশে গেলে সব সময় পিসিমণি সঙ্গ দিত। আমার বাংলাদেশ যেমন তরা গ্রাম, আমার বাড়িও অনেকটা পিসিমণির মত। বাড়িতে পিসিমণি নেই সেটা ভাবতেই পারি না। যাব তো বটেই। তবে ঠিক জানি না কবে। যতদিন বাড়ি না যাই দিদি বেঁচে থাকবে আমার কল্পনায়। ভোলগার তীরে বা বনে হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে কথাও বলব। কিন্তু দেশে গিয়ে ওকে দেখতে না পেলে দিদি মনে হয় সত্যি সত্যিই মরে যাবে।
—তা অবশ্য ঠিক। আমার কি মনে হয় জানো?
—বল।
—যদি পিসিমণি চাকরিটা ছেড়ে না দিত হয়তো এতটা ভেঙে পড়ত না।
—আমারও তা মনে হয়। আমিই তো ওকে বলেছিলাম চাকরি ছাড়তে। শেষের দিকে অনেক কষ্ট হত যাতায়াত করতে।
—তা ঠিক। তবুও কিছু একটা নিয়ে থাকত।
—হ্যাঁ, এটাই সমস্যা। বিশেষ করে গ্রামে। অনেক সময় কথা বলার মানুষ পাওয়া যায় না। আসলে মানুষ তার পরিচিত সার্কেল থেকে বেরিয়ে এলে নতুন পরিবেশে সহজে মানিয়ে নিতে পারে না। তাছাড়া চাকরি থাকাকালীন একটা রেগুলার ইনকাম ছিল, ছিল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। পেনশনে গেলে কিছুটা হলেও হিসাব করে চলতে হয়। মনে আছে দিদির চাকরি থাকাকালীন অনেকেই ওর কাছে প্রাইভেট পড়তে চাইত। চাকরি ছাড়ার পর আর কেউ আসতে চাইত না। জানিস কেন? লোকজন আজকাল পড়াশুনা করে পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার জন্য। যখন কেউ শিক্ষকতা করেন সকলের ধারণা তারা কী ধরনের প্রশ্ন হবে সেটা জানেন। দিদি ভেবেছিল চাকরি থেকে অবসর নিয়ে দু-একটা টিউশনি করে সময় কাটাবে। এমনকি বিনে পয়সায় পড়াতে চাইলেও ছাত্র পাওয়া যেত না। সবাই আজকাল প্র্যাগম্যাটিক। কর্ম নয়, ফলটাই আসল। আমার এখন মনে হয় দিদিকে বলা দরকার ছিল চাকরিটা একেবারে ছেড়ে না দিয়ে সপ্তাহে দুদিন কাজ করা, যদিও জানি না দেশে এরকম অপশন আছে কিনা। আমাদের ছোটবেলায় বাড়ি ভর্তি লোকজন ছিল, চাইলেও কেউ বেকার থাকতে মানে কাজ ছাড়া বসে থাকতে পারত না। এখন বাড়ি ফাঁকা। সেটাও একটা সমস্যা। তবে এ নিয়ে আমরা এখন শুধু ভাবতেই পারি, এর বেশি কিছু আর নয়। জীবনের এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে যাওয়ার অনেক পথ থাকলেও একটামাত্র পথই আমরা বেছে নিতে পারি। আর ভাবতে পারি অন্য পথে গেলে কী হত। কিন্তু সেই পথে আমাদের কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হত সেটা আমরা জানি না। তবে সেই পথ আর সেই চ্যালেঞ্জ যে ভিন্ন হত তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাই এখন ও নিয়ে ভেবে লাভ নেই। ডিসেম্বর আসুক। তোরা যখন আসার প্ল্যান করিস জানাস আগে থেকে। আমি চেষ্টা করব।
—ঠিক আছে।
দেখতে দেখতে এসে গেল ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২। দুই বছর আগে এই দিনে দিদি ম্যাটার থেকে এনার্জিতে পরিণনত হয়েছিল। নিত্যতার সূত্র অনুযায়ী কোনও কিছু ধ্বংস হয় না, রূপান্তরিত হয় মাত্র।
দুবনা, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২
কভার: ইলিউশন।/ চিত্র: লেখক
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ২
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৩
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৪
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৫
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৭
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৮
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৯
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১০
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১১
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১২
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৩
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৪