‘গীতগোবিন্দ’ (সংস্কৃতে ‘গীত গোবিন্দম্’) কাব্যের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোনও ভারতীয়ের মনে সন্দেহ নেই। ভারতের প্রায় সবক’টি আধুনিক ভাষা এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রধান ভাষাসমূহে অনূদিত হয়েছে ‘গীতগোবিন্দ’। জয়দেব বিরচিত এই কাব্যের অনুবাদ পড়ে আপ্লুত হয়েছিলেন জার্মান মহাকবি গ্যোটেও। কয়েক শতাব্দী ধরে সরাসরি সংস্কৃত ভাষায় জয়দেবীয় ‘গীতগোবিন্দ’ পাঠের ঐতিহ্যের অংশীদার বাঙালির কাছে এই কাব্য ‘বাংলারই মত’। তথাপি অন্যান্য ভারতীয় ভাষার মত বাংলা ভাষাতেও রচিত হয়েছে ‘গীতগোবিন্দ’-এর একাধিক ভাষ্য।
কবি জয়দেব জন্মেছিলেন বাংলায়, বীরভূমের কেন্দ্রবিল্ব বা চলতি কথায় কেদুলি গ্রামে। সেই অঞ্চলে কবিকে পুনঃস্মরণের প্রয়াস জারি কয়েক শতক ধরে। জয়দেব-কেদুলিতে অজয় নদের তীরে পৌষসংক্রান্তিতে কবি জয়দেবের স্মৃতিতে হয়ে আসছে বাউল-কীর্তন মেলা। দেশের প্রাচীনতম সেই মেলা কেন্দুলি মেলা, জয়দেব মেলা বা জয়দেব-কেন্দুলি মেলা নামে সুপরিচিত। তবে মেলা থাকলেও যাঁর স্মরণে এই মেলা, তাঁর কিন্তু কোনও মূর্তি নেই। ‘জয়দেবের মূর্তি নাই, কিন্তু মেলা আছে’— এই আক্ষরিক সত্য কথাটা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
কেঁদ বা কেন্দু এবং বেল গাছের প্রাচুর্য ছিল বলে এলাকার নাম ছিল ‘কেন্দ্রবিল্ব’, অপভ্রংশে তা থেকে ‘কেন্দুলি’ বা ‘কেঁন্দুলি’। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর ‘গীতগোবিন্দ’-র কবি জয়দেবের নামে প্রতিবছর কেন্দুলিতে অজয় নদের পাড়ে পৌষের মকর সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে যে মেলা বসে তার আয়োজক বাউল-ফকিররা। ‘বাউল মেলা’ বলে সমধিক পরিচিত এই মেলায় বাউল-ফকির ছাড়াও যোগ দেন বৈষ্ণব সহজিয়ারাও। এই বৈষ্ণব সহজিয়ারা জয়দেবকে তাঁদের আদি গুরু বলে মানেন, যদিও কবির সঙ্গে তাঁদের কোনওদিন দেখা হয়নি। আসলে জয়দেব মেলা শুরুতে ছিল কীর্তন মেলা।
জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ গীতিকাব্যে বর্ণিত প্রেমসাধনার বিষয়টি পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব-পথ প্রস্তুত করে দিয়েছিল। শ্রীচৈতন্য আবেগ-আবেশে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ আস্বাদন করতেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই জয়দেবের স্মরণ মেলায় কীর্তনীয়ারাই ভিড় জমাতেন এবং শ্রীচৈতন্যের আদর্শে এই মেলা ছিল কীর্তন মেলা। বৈষ্ণব সহজিয়াগণ জয়দেবকে গুরু মেনে এই মেলায় তাঁরাও আখড়া বাঁধতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে জয়দেবের ‘কীর্তন মেলা’ রূপ বদলে হয়ে যায় ‘বাউল মেলা’। জয়দেব মেলায় এখনও কীর্তন আর বাউলে ঠোকাঠুকি চলে।
কবি জয়দেবের জন্ম ১১৭০ খ্রিস্টাব্দে বীরভূমের কেন্দুলিতে। এবং ১২৪৫ খ্রিস্টাব্দে সেখানেই তিনি দেহ রাখেন। এই জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক আছে। ওড়িশাবাসীর একাংশের দাবি, তিনি জন্মেছিলেন উৎকলে। এই দাবি অনেকাংশে মনগড়া এবং তার সপক্ষে খুব শক্তপোক্ত কোনও তথ্যপ্রমাণ নেই। তা সত্ত্বেও জয়দেবকে ওড়িয়া প্রমাণে তৎপর তাঁরা। শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬ খ্রি.–১৫৩৩ খ্রি.) পরবর্তী মাধব পট্টনায়কের আগে কোনও সূত্রেই জয়দেবকে উৎকলবাসী বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়নি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই মাধব পট্টনায়ক শ্রীচৈতন্যদেবকেও ওড়িয়া প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিলেন।
সেনরাজ লক্ষ্মণসেনের (১১৭৮-১২০৬ খ্রি.) সভাকবি ছিলেন জয়দেব এবং জয়দেবের প্রভাবেই পারিবারিকসূত্রে শৈব লক্ষ্মণসেন বৈষ্ণব হন। ডোম-কন্যা নিয়ে তন্ত্রসাধনাকে কেন্দ্র করে পিতা বল্লালসেনের সঙ্গে বিবাদের জেরে রাজধানী ছেড়ে সেনপাহাড়িতে যখন লক্ষ্মণসেন বসবাস করছিলেন, তখনই কবির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। জনশ্রুতি, রাজা লক্ষ্মণসেনের রাজসভায় ‘গীতগোবিন্দ’ অভিনীতও হয়েছিল। জয়দেবের স্মরণে বীরভূমের কেন্দুলির মাটিতে অজয় তীরে বহুকাল ধরে চলে আসা মেলাও প্রমাণ করে, জয়দেব এখানে ছিলেন। জয়দেব স্মৃতিবিজড়িত রাধাবিনোদ মন্দির, রাধাবল্লভ মন্দির ছাড়াও কেন্দুলির অজয় তীরে রয়েছে জয়দেবের তন্ত্রসাধনার স্থান বলে চিহ্নিত কুশেশ্বর শিব মন্দির।
বাংলার সেনরাজ লক্ষ্মণসেনের সন্ধিবিগ্রহিক উমাপতিধরের লেখা একটি প্রশস্তি দেখা যায় প্রদ্যুম্নেশ্বর মন্দিরে। শ্রীমদ্ভভাগবতের বৈষ্ণব-তোষিণা টীকায় সনাতন গোস্বামী লিখেছেন: ‘শ্রীজয়দেব-সহচরেণ মহারাজ লক্ষ্মণসেন মন্ত্রীবরেণ উপাপতিধরেণ।’ অর্থাৎ, উমাপতিধর ছিলেন জয়দেবের সহচর। এছাড়া রাজা লক্ষ্মণসেনের মহাসামন্ত বটু দাসের পুত্র শ্রীধর দাসের ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থে জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যের ষষ্ঠ সর্গে উল্লিখিত ‘অঙ্গে ষ্বাভরণং’ ও একাদশ সর্গে উল্লিখিত ‘জয়শ্রী বিন্যস্তৈ’ শ্লোক দুটি উদ্ধৃত হয়েছে। এ থেকে বলা যায়, কবি জয়দেব ছিলেন শ্রীধর দাসের পরিচিত ও সমসাময়িক।
বুলার সাহেব কাশ্মীরের একটি গীতগোবিন্দ কাব্যের পু়ঁথিতে লক্ষ্মণসেনের নাম দেখেছিলেন। তাই জয়দেব ছিলেন লক্ষ্মণসেনের সমসাময়িক এবং তাঁর রাজসভার কবি। জয়দেব নিজেকে বলেছেন: ‘পদ্মাবতীচরণ-চারণ চক্রবর্ত্তী।’ বলা বাহুল্য, ‘চক্রবর্ত্তী’ বা চক্রবর্তী একটি বহুল প্রচলিত বাঙালি পদবি। লক্ষ্মণসেনের আরেক সভাকবি ধোয়ীর ‘পবনদূত’ কাব্যে দেখা যাচ্ছে: ‘দৃষ্ট্বা দেবং ভুবনবিজয়ে লক্ষ্মং ক্ষৌণিপালং।’ এভাবেই লক্ষ্মণসেনের নাম দেখা যায়। সুতরাং, ধোয়ী লক্ষ্মণসেনের সমসাময়িক। আর ধোয়ী, উমাপতিধর, গোবর্দ্ধন, জয়দেব সমসাময়িক এবং তাঁরা সবাই লক্ষ্মণসেনের সভাসদ ছিলেন।
লক্ষ্মণসেনের সভাকবি জয়দেবকে কেন্দুবিল্বরূপী সমুদ্র থেকে উদিত চন্দ্র বলা হয়েছে। তাঁকে সহজিয়া সাধকগণ আদি রসিক বলেন। তার মানে, তিনি ছিলেন সহজযানী পন্থী। সেন ও সেন পরবর্তী যুগের উৎকল চরমভাবে সহজযান বিরোধী ছিল। তার প্রমাণ, সারলাদাসের চণ্ডীপুরাণে তাম্রলিপ্তের সহজিয়াদের কৌরবদের সমতুল্য বলা হয়েছে। আজও বাংলার সমস্ত বাউল ও বৈষ্ণবগণ বীরভূমের কেঁন্দুলিকেই তাঁর লীলাভূমি বলে থাকেন, তাঁরা কিন্তু কখনওই উৎকলের কথা বলেন না। শ্রীধর দাসের ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থে সংকলিত জয়দেবের বীররসাত্মক পদগুলি গৌড়ীয় রীতিতে রচিত। সুতরাং, তিনি যে গৌড়বাসী ছিলেন, তা বলাই যায়।
হলায়ুধ মিশ্র রচিত ‘সেকশুভোদয়া’ গ্রন্থে জয়দেব ও পদ্মাবতীর দাক্ষিণাত্যের বূঢ়ন মিশ্রকে সঙ্গীতের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত করার কথা আছে। তাই বলা যায়, সেন রাষ্ট্রের রাজধানীর কাছাকাছি স্থানেই জয়দেবের বাস ছিল। জয়দেব ছিলেন রাধামাধবের উপাসক। অথচ উৎকলে আজও রাধাশক্তির উপাসনার ধারা বড়ই দুর্বল। যেটুকু আছে সেটাও শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাবে। তাঁর মাধ্যমেই পুরীতে প্রতাপরুদ্রদেবের হাত ধরে জয়দেবের পদাবলী জনপ্রিয় হয়েছিল। গজপতি প্রতাপরুদ্রদেবের শাসনামলে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাশনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন ‘বৈষ্ণব লীলামৃত’ কাব্য রচয়িতা মাধব পট্টনায়ক। চৈতন্যদেবকে উৎকলের সন্তান দাবিতে মাধবের উদ্দেশ্যটি এইখানে স্পষ্ট হয় সহজেই।
জয়দেব নিজে একান্তভাবে বৈষ্ণব ছিলেন না, তিনি ছিলেন পঞ্চদেবতার উপাসক স্মার্ত ব্রাহ্মণ গৃহস্থ। তিনি শিবস্তুতি লিখেছিলেন, যা উল্লিখিত আছে শ্রীধর দাসের ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থে (১/৪/৪)। এছাড়া আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমাণ করেছেন, জয়দেব যোগমার্গী পদও রচনা করেছিলেন। জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ শৃঙ্গার রসের কাব্য বলেই পরিচিত ছিল এবং লক্ষ্মণসেনের রাজসভায় এসব চর্চা হত। পরবর্তী সময়ে রূপ গোস্বামীর রসব্যাখ্যার প্রভাবে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের কাছে নতুন মর্যাদায় অন্যতম ধর্মগ্রন্থ হিসেবে ‘গীতগোবিন্দ’ স্বীকৃতি পায়। এরপর যে সব ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে আশ্রয় ভক্তি ও প্রেম মুখ্য ছিল, সেই সব সম্প্রদায়ের কাছে ‘গীতগোবিন্দ’ সমাদৃত হয়। ফলে সহজিয়া বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছেও কবি জয়দেব হয়ে ওঠেন আদি গুরু।
এই সূত্রে বল্লভাচারী সম্প্রদায়ের কাছেও ‘গীতগোবিন্দ’ অন্যতম ধর্মগ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হয়। পরবর্তী সময়ে বল্লভাচার্যের পুত্র বিঠ্ঠলেশ্বর জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যের অনুকরণেই রচনা করেন ‘শৃঙ্গার-রসমণ্ডন’ গ্রন্থ। এভাবেই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন সময়ে গীতগোবিন্দ কাব্যের ৪০খানার বেশি টীকা লেখা হয়েছে এবং এই কাব্যের অনুকরণে লেখা হয়েছে ১০/১২খানি কাব্য। এছাড়াও বিভিন্ন সংকলনগ্রন্থে গীতগোবিন্দ থেকে বহু শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে। গীতগোবিন্দ কাব্যের এই জনপ্রিয়তার কারণেই মেবারপতি মহারাণা কুম্ভের নামে প্রচলিত রসিকপ্রিয়া (১৪৩৩-১৪৬৮ খ্রি.) পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের একটি ওড়িয়া শিলালিপি থেকে (১৪৯৯ খ্রি.) জানা যায়, মহারাজ প্রতাপরুদ্রের আদেশে ওই সময় থেকে জগন্নাথ মন্দিরে শুধুমাত্র গীতগোবিন্দের গান ও শ্লোক গাওয়া শুরু হয়।
বীরভূমের কেদুলিতে কবি জয়দেব যে-সমস্ত স্থাবর ভূ-সম্পত্তি রেখে যান, সে সব গ্রামের বন্দ্যোপাধ্যায় ও অধিকারী বংশ স্থানীয় ব্রাহ্মণ হিসেবে দানস্বরূপ পান। তারপর থেকে তাঁরাই এসব জমির ভোগ-দখল করে আসছেন বলে জানা যায়। এছাড়াও তাঁরা জয়দেব মেলা সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ করার আগে পর্যন্ত এখানকার মন্দিরের প্রণামী ও জমির খাজনার আয় পেতেন।
পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার পিঙ্গলা গ্রামের বাৎস্য গোত্রীয় কাঞ্জিলাল পদবিধারী কুলীন ব্রাহ্মণরা নিজেদের জয়দেবের বংশধর বলে দাবি করে থাকেন। তাঁদের আদি নিবাস ছিল বীরভূম জেলার কেদুলি গ্রামে। ১২০২ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজির নদীয়া বিজয়ের পর সেনরাজ লক্ষ্মণসেন যখন পূর্ববঙ্গে চলে যান, তখন তাঁরাও চলে যান।
কথিত আছে, জয়দেব কেদুলি থেকে ৩৬ মাইল দূরে কাটোয়ায় গঙ্গাস্নানে যেতেন। এত দূরের পথ যাতায়াত করতে ভীষণ কষ্ট হত দেখে স্বয়ং মা গঙ্গা জয়দেবকে বলেন, তোমাকে আর কষ্ট করে এতদূর আসতে হবে না। প্রতিদিন আমি বেলা দশ দণ্ড পর্যন্ত চিরকাল অজয়ের কদমখণ্ডী ঘাটে থাকব। ওই সময় ওখানে স্নান করলে গঙ্গাস্নানের ফল হবে। এই বহুল প্রচলিত প্রবাদটি হোরেস জেমস উইলসন সংগ্রহ করেন এবং রজনীকান্ত গুপ্ত তাঁর রচিত ‘জয়দেব’ গ্রন্থের ৪০ পাতায় এর উল্লেখ করেছেন। এই বিশ্বাসে বহু মানুষ কদমখণ্ডীর ঘাটে এসে স্নান করেন এবং গঙ্গাতীরে সৎকারের ফল লাভের আশায় এখানকার শ্মশানে শবদাহও করেন। এই কদমখণ্ডী ঘাটের কিছুটা উত্তরে সিদ্ধিলাভ করেন কাঙাল ক্ষ্যাপাচাঁদ নামে এক সাধক। কেদুলিতে সেই স্থানটি কাঙাল ক্ষ্যাপার আশ্রম নামে পরিচিত। এখানে বেশ কয়েকটি সমাধি রয়েছে। এর মধ্যে জয়দেব ও পদ্মাবতী এবং পরবর্তীকালের অন্যান্য বৈষ্ণব বাবাজির সমাধি আছে বলে কথিত।
জয়দেব এবং পদ্মাবতী দু’জনেই ছিলেন নৃত্য-গীতে পটু। অজয়ের তীরে তাঁরা গীতগোবিন্দ গাইতেন এবং শিল্পীর জীবনযাপন করতেন। জয়দেব তাঁর লেখা ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্য পুরীর জগন্নাথদেবকে শোনানোর পর সেখানে কিছুদিন কাটিয়ে একসময় বীরভূমের কেঁদুলিতে নিজের ঘরে ফেরেন। এরপর কেঁদুলির অজয় তীরের কদমখণ্ডীর ঘাটে কুড়িয়ে পাওয়া রাধাদামোদর বিগ্রহ ও গীতগোবিন্দ পুঁথিটি জয়পুররাজার কাছে দিয়ে আসেন। তখন থেকেই সেখানে জয়পুররাজ রাধাদামোদর বিগ্রহ ও গীতগোবিন্দ পু়ঁথির দৈনিক সেবা-পুজো চালিয়ে আসছেন। জয়পুর থেকে বীরভূমের কেঁদুলিতে ফিরে আসার কিছুদিন পর পত্নী পদ্মাবতীসহ কেঁদুলির অজয় নদের তীরে কদমখণ্ডীর ঘাটে উত্তরায়ণ সংক্রান্তির দিন সমাধিস্থ হয়ে দেহত্যাগ করেন। (‘বীরভূমি’ পত্রিকা, জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৫, পৃষ্ঠা ৯৬)। অবশ্য, জয়দেবের মৃত্যু বারাণসীতে হয়েছে বলে দাবি ওড়িশাবাসীর একাংশের।
জেলা বীরভূমের বোলপুর মহকুমার অন্তর্গত অজয় নদের তীরে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৮ মিটার (১৫৭ ফুট) উচ্চতায় ২৩.৬৩ ডিগ্রি উত্তর এবং ৮৭.৪৩ ডিগ্রি পূর্ব স্থানাঙ্কে অবস্থিত জয়দেবের জন্মভিটের ওপর দাঁড়িয়ে কেন্দ্রবিল্ব বা চলতি কথায় কেন্দুলি গ্রাম। স্থানটি মোগলযুগে ছিল সেনপাহাড়ির অন্তর্গত। সম্রাট ঔরঙ্গজেবের জারি করা এক ফরমান অনুসারে, এটি বর্ধমানের মহারাজা কৃষ্ণরাম রায়ের অধিকারভুক্ত হয়। এই গ্রামের যুগলকিশোর মুখোপাধ্যায় ছিলেন বর্ধমান রাজদরবারের সভাকবি এবং বলা হয়, তাঁর অনুরোধেই বর্ধমানের মহারানি ব্রজকিশোরী ওরফে নৈরাণী দেবী ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে জয়দেবের ভিটের ওপর বর্তমান রাধাবিনোদ মন্দিরটি তৈরি করে দেন। এরপর ১৮৬০-এর দশকে বৃন্দাবনের নিম্বার্ক বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের রাধারমণ ব্রজবাসী তাঁদের কুলগুরু জয়দেবের জন্মভিটেয় নিম্বার্ক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।
কবি জয়দেব তাঁর ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যে দেবতার সঙ্গে মানুষের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। ২৮৬টি শ্লোক এবং ২৪টি গীতের সমন্বয়ে ১টি সর্গে রচিত সংস্কৃত গীতিকাব্য ‘গীতগোবিন্দ’ ওড়িশার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরেও নিত্য পাঠ করা হয়। গীতগোবিন্দের ভাষা সহজ সংস্কৃত, বাংলার কাছাকাছি। চরণ শেষে আছে অন্ত্যমিল, যা সংস্কৃত সাহিত্যে প্রায় দুর্লভ। প্রচলিত বিষয়টি আমরা প্রায় সবাই জানি: ‘গীতগোবিন্দ’ লেখার সময় দশম সর্গের নবম পদে এসে আটকে যান কবি। ‘স্মরগরলং খণ্ডনং মমশিরসিমণ্ডনম্’ লিখে কবি চাইলেন, শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধার চরণ ধরতে চাইবেন। কিন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যাঁর চরণতলে, সেই শ্রীকৃষ্ণ কেন শ্রীরাধার চরণ ধরতে যাবেন? অজয়ে স্নানে গেলেন চিন্তিত কবি। এসে দেখেন কাব্য সম্পূর্ণ, লেখা হয়েছে, ‘দেহি পদপল্লবমুদারম্’। ‘বিশ্বাসী’-দের দাবি, লেখাটি সম্পূর্ণ করেন স্বয়ং তাঁদের ভগবানই। তবে মনে হয়, ‘সৃষ্টিঘোরে আচ্ছন্ন’ কবি নিজেই সেটি সম্পূর্ণ করেন।
গীতগোবিন্দের দ্বাদশ তথা শেষ সর্গের শেষ পদে জয়দেব তাঁর পিতা-মাতার পরিচয় দিয়ে বলেছেন, পিতা— ভোজদেব এবং মাতা— বামা দেবী। কথিত আছে, জয়দেবের স্ত্রী পদ্মাবতী ছিলেন দক্ষিণ ভারতের এক ব্রাহ্মণকন্যা। দক্ষিণ ভারতের এক ব্রাহ্মণ দম্পতি পুরীর জগন্নাথদেবের কাছে মানত করে কন্যারূপে পদ্মাবতীকে পান। পরে জগন্নাথের মন্দিরে কন্যাকে তাঁরা উৎসর্গ করেন এবং স্বপ্নাদেশে জয়দেবের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন। গীতগোবিন্দ লিখে জগন্নাথদেবকে শোনাতে পুরীধামে গিয়েছিলেন কবি জয়দেব। সেই সময় তাঁর সঙ্গে পদ্মাবতীর বিয়ে হয়। এসব কাহিনির কোনও ভিত্তি নেই। কারণ, দেবদাসীকে বিবাহ দেবার মত উদারতা তৎকালীন উৎকলীয় সমাজে ছিল না। বরং তা অত্যন্ত গর্হিত কাজ বলেই বিবেচিত হওয়ার কথা।
‘গীতগোবিন্দ’-এর সূত্রে ভারতের সব প্রান্তেই পৌঁছে গিয়েছিলেন কবি জয়দেব। দক্ষিণ ভারতের মন্দির ভাস্কর্যে নৃত্যরতা যে নারী মূর্তি দেখা যায়, তা জয়দেবের কল্পনা এবং এইসব মূর্তি হল পদ্মাবতীর আদলে। দক্ষিণ ভারতের ‘কথাকলি’ নৃত্যে রয়েছে জয়দেবের গীতগোবিন্দের প্রভাব। দক্ষিণ ভারতের সাধক কবি ত্যাগরাজ (১৭৬৭-১৮৪৬ খ্রি.) তাঁর ‘প্রহ্লাদ বিজয়ম্’ কাব্যের ভূমিকায় বাঙালি কবি জয়দেবকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। শিখদের ধর্মগ্রন্থ ‘গ্রন্থসাহিব’-এর চারটি শ্লোক জয়দেবের গীতগোবিন্দের চারটি শ্লোকের অনুসরণে লেখা। এছাড়া মণিপুরে খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতক থেকেই গীতগোবিন্দের প্রভাব পড়েছে।
জয়দেব তাঁর ‘গীতগোবিন্দ’ গীতিকাব্যে দেবতার সঙ্গে মানুষের যে মেলবন্ধন তৈরি করেছিলেন, পরবর্তীকালে সহজিয়া বাউল বৈষ্ণবরা সেটাই গ্রহণ করেছেন এবং জয়দেবকে তাঁদের আদি গুরু মেনেছেন। যেমন, দেবতার সঙ্গে মানুষের যে মেলবন্ধন তৈরি করেছিলেন জয়দেব, পরবর্তীকালে সাঁই লালন সেই কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন, ‘এই মানুষের হবে মাধুর্য ভজন।/ তাই তো মানুষ রূপ পাঠালেন নিরঞ্জন।।’ তাই বীরভূমের অজয় তীরে কেন্দুলির কদমখণ্ডীর ঘাট থেকে শুরু করে বাংলার ইতিহাসের পাতা, দক্ষিণ ভারতের মন্দির ভাস্কর্য-নৃত্যকলা, কীর্তনীয়া-বাউল-ফকিরদের মনে ঘরের কাছেই আরশিনগরে বসবাস করছেন গীতগোবিন্দের কবি জয়দেব। কৃষ্ণদাসের ‘ভক্তমাল’ এবং অষ্টাদশ শতকের বনমালী দাসের ‘জয়দেব চরিত্র’ অনুসরণ করে মাইকেল মধুসূদন দত্তও লিখেছিলেন ‘জয়দেব’ কবিতা।
‘চল যাই, জয়দেব গোকুল ভবনে
তব সঙ্গে, যথারঙ্গে তমালের তলে
শিখিপুচ্ছ-চূড়া শিরে, পীতধড়া গলে
নাচে শ্যাম, বামে রাধা— সৌদামিনী ঘনে!
না পাই যাদবে যদি, তুমি কুতূহলে
পুরিও নিকুঞ্জরাজী বেণুর স্বননে!
ভুলিবে গোকুল-কুল এ তোমার ছলে,—
নাচিবে শিখিনি সুখে, গাবে পিকগণে,—
বহিবে সমীর ধীরে সুস্বর-লহরি,—
মৃদুতর কলকলে কালিন্দী আপনি
চলিবে! আনন্দে শুনি সে মধুর ধ্বনি,
ধৈরজ ধরি কি রবে ব্রজের সুন্দরী?
মাধবের রব, কবি, ও তব বদনে,
কে আছে ভারতে ভক্ত নাহি ভাবি মনে?
(জয়দেব: মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
তথ্যসূত্র:
১) বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদি পর্ব : নীহাররঞ্জন রায়।
২) বীরভূমের ইতিহাস : গৌরীহর মিত্র।