ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) পরবর্তী যুগে শেক্স্পিয়র (১৫৬৪-১৬১৬)-এর কোরিওলেনাস (১৬০৭-০৯) নিয়ে নতুন সমস্যা দেখা দিল।১ ব্যক্তি কোরিওলেনাস-এর সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে সমালোচকদের নজর গেল অন্যদিকে। শুরু হল নাট্যকারের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আলোচনার পালা। এমনকি, সুবিধেমত শেক্স্পিয়র-কে অভিজাততন্ত্র অথবা সাধারণতন্ত্রর সমর্থক বলেও প্রমাণ করলেন কেউ-কেউ। রোমের জনগণ ও তাদের নির্বাচিত কর্মচারীদের (ট্রিবিউন) কটাক্ষ পুলক জাগাল শিরোমণি-মার্কা সমালোচকদের মনে। উল্টোদিকে, কোরিওলেনাস-এর নির্বাসন আর শেষ পরিণতিতে ভরসা রাখলেন প্রজাতন্ত্রর প্রবক্তারা। বিশ শতকের প্রথম দিকেও নাটকটি নিয়ে ধন্দ কাটেনি। সেইজন্যে, কোরিওলেনাস-এর অভিনয় হয়েছে খুবই কম।
ঘটনা হল, গ্রিক দার্শনিক ও ঐতিহাসিক প্লুতার্ক (৪৬-১২০)-এর লেখায় শেক্স্পিয়র খুঁজে পেয়েছিলেন নিজেরই সমাজের প্রতিফলন। খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকের রোমের মত সতেরো শতকের ইংল্যান্ডেও বহাল ছিল শোষক আর শোষিতের লড়াই। প্রাচুর্য ও বৈভবের বিপরীতে তিনি দেখেন অনাহার ও দারিদ্র। পাশাপাশি, সমসাময়িক দুই বিরোধী রাজনৈতিক শ্রেণির খামতি সম্বন্ধেও শেক্স্পিয়র ছিলেন সমান ওয়াকিফ্হাল। তাই কোনও একটি শিবিরকে পুরোপুরি সমর্থন যোগাতে পারেননি তিনি। বরং বলা যায়, ঐতিহাসিক কাহিনির মোড়কে নাট্যকার আসলে হাজির করেছেন তাঁর চারপাশের সার্বিক ছবি। তাই হয়তো পোল্যান্ডের সাহিত্য-বিশারদ ইয়ান কট বলেন, কোরিওলেনাস একটি আধুনিক নাটক।২
সন্দেহ নেই যে, প্রধান চরিত্রর ওপরই বেশি জোর পড়েছে নাটকে। কোরিওলেনাস-এর দৃঢ়তা, বীরত্ব আর সামরিক গুণাবলি মেলে ধরা হয়েছে সেখানে। কিন্তু যে আত্মাভিমান তাঁকে রোমের পক্ষে লড়তে সহায়তা করল, তা-ই আবার ডেকে আনল তাঁর সর্বনাশ। পুরোদস্তুর অভিজাত-মনোভাবাপন্ন কোরিওলেনাস-এর কাছে জনগণের কণ্ঠস্বর ছিল চরম অসহনীয়। লুঠের মাল তিনি সৈন্যদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করার পরামর্শ দেন ঠিকই; আবার তাঁর আশ্রয়দাতা (যাঁর নাম কোরিওলেনাস বেমালুম ভুলে যান) কোরিওলি-র এক গরিব বাসিন্দার মুক্তির জন্যে আর্জিও জানান (অঙ্ক ১, দৃশ্য ৯)। মহত্ত্বর এমন নিদর্শন সম্ভ্রান্ত বংশের নাগরিকদের কাছ থেকে মাঝেমধ্যে পাওয়া বিরল নয়। কিন্তু কোরিওলেনাস-এর শ্রেণিচরিত্র বেরিয়ে এল যখন রোমের জনতা শস্যর দাম কমানোর দাবিতে সেনেট-এর বিরুদ্ধে সরব হল। কোনওরকম রাখঢাক ছাড়াই কোরিওলেনাস শুনিয়ে দিলেন তাঁর মনের কথা— সাধারণ মানুষ হল বদ, দুর্গন্ধময় ও মেরুদণ্ডহীন এক জনসমষ্টি। অভিজাতরা না-থাকলে নিজেদের মধ্যে কুকুরের মত খেয়োখেয়ি করেই মরত তারা। বিশ্বাস নয়, এদের বরং কচুকাটা করলেই বেশি খুশি হন কোরিওলেনাস। স্বাভাবিক যে, শাসনকর্তা (কনসাল) হওয়ার জন্যে জনতার কাছে ভোটভিক্ষের প্রথা তাঁর না-পসন্দ হবে; বুঝিয়ে-সুজিয়ে পাঠালেও সামান্য উত্তেজনায় তাঁর নম্রতার মুখোস খসে যাবে। নিজের সত্তা কখনওই গোপন রাখতে পারেননি কোরিওলেনাস।
কোরিওলেনাস-এর দুটি দোষ ছিল। আউফিদিয়াস-কে দিয়ে প্রথমটি উল্লেখ করেন স্বয়ং শেক্স্পিয়র (অঙ্ক ৪, দৃশ্য ৭)— দম্ভ (অতিরিক্ত সাফল্যে মাথা ঘুরে যাওয়া), ত্রুটিপূর্ণ বিচারক্ষমতা (পরিস্থিতি অনুযায়ী ফায়দা না-তোলা) অথবা অনমনীয় স্বভাব (সামরিক আর অসামরিক জগতের মধ্যে ফারাক না-করা)। শাস্তি হিসেবে এর জন্যে তাঁর ওপর নেমে আসে নির্বাসনের খাঁড়া। কোরিওলেনাস-এর দ্বিতীয় অপরাধ হল, শত্রুর সঙ্গে মিলে নিজের দেশকে আক্রমণ। নির্বাসনের পর প্রতিশোধের রোখ চেপে যায় তাঁর মাথায়। অতীতে যে-রোমের হয়ে লড়ে বহুবার আহত হন পরে তারই বিরুদ্ধে তলোয়ার ধরলেন কোরিওলেনাস। বোঝা যায়, রোমের চেয়েও তাঁর কাছে আত্মমর্যাদার মূল্য বেশি। মা ভলামনিয়া-র আর্জি শেষে যখন তাঁর মন ভেজালো আর তিনি শান্তিচুক্তি করতে রাজি হলেন তখন অবশ্য বড্ড দেরি হয়ে গেছে। নতুন বন্ধুরা (যাঁরা আগে ছিলেন পরমশত্রু) বিশ্বাসভঙ্গর দায়ে এবার তাঁকে হত্যা করলেন।
মনে রাখা ভাল, সমসাময়িক বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক নাটক লেখার কথা ষোলো বা সতেরো শতকের ইংল্যান্ডে ভাবাই যেত না। একদিকে যেমন ছিল আমলামহলের কড়া দৃষ্টি তেমনি অন্যদিকে রাজানুগ্রহ হারানোর ভয়। তাই নাট্যকারকে তখন নিজের রাজনৈতিক মতামত জানাতে হত পরোক্ষে— বেশিরভাগ সময় অতীতের কোনও কাহিনির আড়ালে। কোরিওলেনাস-এ ঠিক তা-ই ঘটেছে।
আদর্শ শাসক সম্পর্কে শেক্স্পিয়র-এর ধারণা ছিল সুনির্দিষ্ট— দক্ষ প্রশাসক ছাড়াও তাঁকে হতে হবে পরদুঃখকাতর, প্রজাদের হিতকারী রক্ষক। বলা বাহুল্য, জনগণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যর ঘোরতর বিরোধী কোরিওলেনাস এসব শর্ত পূরণ করতে পারেননি। যেহেতু থিয়েটার ছিল শেক্স্পিয়র-এর সময় প্রচারের সবচেয়ে জোরালো গণমাধ্যম, তাই প্রশ্ন জাগে: দর্শকের সামনে তিনি কি ব্যর্থ শাসকের নমুনা তুলে ধরলেন আর সেইসঙ্গে কোরিওলেনাস-এর পরিণতি দেখিয়ে শাসকবর্গকে সতর্ক করলেন? প্রশ্নটি অসঙ্গত নয় কারণ ১৬০৭-এ ইংল্যান্ডে অনেকগুলি কৃষক বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। খেয়াল রাখতে হবে, অভ্যুত্থান দিয়েই শুরু হয় কোরিওলেনাস । চাষের সাধারণ জমিকে সেইসময় ব্যক্তি মালিকানার আওতায় এনে ভেড়া চড়াবার জন্যে ঘিরে ফেলা হচ্ছিল জোরকদমে। জনতার আন্দোলনকে দমাতে সক্রিয় ভূমিকাও নেন রাজা প্রথম জেম্স্ (১৫৬৭-১৬০৩)। এছাড়া, অভিজাত সম্প্রদায়ভুক্ত অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রের (যেমন এসেক্স্-এর আর্ল আর র্যালে-র আর্ল) সঙ্গেও কোরিওলেনাস-এর তুলনা টানা হয়েছে।
লক্ষ্য করার বিষয়, শোষণের দুটি দিক ধরা পড়েছে কোরিওলেনাস-এ। প্রধান চরিত্র যদি হয় শাসকের স্বৈরাচারী রূপ তাহলে অন্যান্য অভিজাতরা তার কৌশলী প্রতিনিধি। অনুকূল সমাজব্যবস্থা বহাল রাখতে চিন্তাভাবনার জগতে কর্তৃত্ব কায়েমের চেষ্টা চালায় শাসকগোষ্ঠী। ভাবাদর্শ প্রচারে নিযুক্তও থাকে নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। কোরিওলেনাস-এ সেই কাজ করেন মেনেনিয়াস। বিদ্রোহী জনতাকে ভজাতে তিনি ‘পেটের গল্প’ আওড়ান; এমনকি, এও বলেন— সাধারণ মানুষের দুর্দশার জন্যে অভিজাতরা নন, দেবতারাই বরং দায়ী। তাই লাঠি-সোঁটা ফেলে তাদের প্রয়োজন নতজানু হয়ে প্রার্থনায় বসা। মেনেনিয়াস-এর চাতুরির আরও নমুনা আছে। তিনি বিলক্ষণ জানতেন: অনমনীয় মনোভাব দেখালে জনগণের ভোট আদায় করতে পারবেন না কোরিওলেনাস। তাই বন্ধুকে শান্ত রাখার মরিয়া চেষ্টা তিনি করে চললেন অবিরাম। যে-কোনও উপায়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখাই মেনেনিয়াস-এর অভীষ্ট। ভলামনিয়া-রও উদ্দেশ্য তা-ই। কাজ হাসিল করতে কোরিওলেনাস-কে ফন্দি আঁটার পরামর্শ দিলেন তাঁর মা। তিনি যুক্তি সাজালেন— সিদ্ধিলাভের জন্যে অভদ্র ও অশিক্ষিত জনতাকে তোষামোদ করাও গৌরবের ব্যাপার (অঙ্ক ৩, দৃশ্য ২)।
এও সত্যি যে, অভিজাত শ্রেণির পাশাপাশি রোমের সাধারণ নাগরিকদের খাটো করে দেখিয়েছেন শেক্স্পিয়র। কোরিওলেনাস-এ বারবার তাদের অস্থির ও আবেগসর্বস্ব মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। এছাড়া, রোমের জনগণের রাজনৈতিক বোধও ছিল অত্যন্ত সীমিত। নাটকের প্রথম দৃশ্যে নিজেদের দুঃসহ জীবনের জন্যে অভিজাত সম্প্রদায়কে তারা দোষারোপ করল ঠিকই; এমনকি, সেনেট-এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে রাস্তায়ও নামল। কিন্তু অল্প পরেই দেখা গেল, যে-কোরিওলেনাস তাদের গালমন্দ করেন, তাঁরই অধীনে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে তারা। কর্মচারীর পদ তৈরি হওয়ায় তাদের রাগ পড়ে গেছিল। একইভাবে, প্রথা অনুযায়ী কোরিওলেনাস-কে ভোট দেওয়ার পর নির্বাচিত কর্মচারীদের কথায় খেপে উঠে তাঁর নির্বাসনের দাবিতে নাগরিকরা হইচই বাধায় (অঙ্ক ৩, দৃশ্য ৩)। আবার, কোরিওলেনাস যখন রোমের বিরুদ্ধে অস্ত্র শানাচ্ছেন তখন সবকিছুর জন্যে কর্মচারীদের দায়ী করতেও তারা ছাড়ে না (অঙ্ক ৫, দৃশ্য ৪)।
জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বেলায়ও শেক্স্পিয়র একইরকম নির্দয়। ব্রুটাস আর সিসিনিয়াস মতলববাজ— জনতাকে উস্কে সর্বদা ফায়দা তুলতে ব্যস্ত। রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়, কোরিওলেনাস-এর বিরুদ্ধে কাজ করেছে তাঁদের ব্যক্তিগত বিদ্বেষ। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁরা অবশ্য বিভেদ ভুলে কোরিওলেনাস-এর রাগ ভাঙাতে উঠে-পড়ে লাগলেন (অঙ্ক ৫, দৃশ্য ১)। এতদিন যে অভিজাত ব্যক্তিদের বিরোধিতা করেছেন এবার প্রাণের ভয়ে তাঁদেরই শরণাপন্ন হলেন কর্মচারীরা।
প্রশ্ন হল, শোষিতের প্রতি নাট্যকারের এমন দৃষ্টিভঙ্গির হেতু কী? আসলে শেক্স্পিয়র ছিলেন ঘোর বাস্তববাদী। সমাজের নীচুতলায় জন্মে জনগণকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন তিনি। চারপাশের অশিক্ষা ও দারিদ্র তাঁকে বুঝতে সাহায্য করে যে, সাধারণতান্ত্রিক রোম আর সতেরো শতকের ইংল্যান্ডের জনতার মধ্যে ফারাক খুবই কম। শোষণের মাত্রা তীব্র হলে তারা রুখে দাঁড়ায় বটে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে অসংঘবদ্ধ হওয়ায় সেই বিদ্রোহ বেশিক্ষণ টেকে না। পরিণত রাজনৈতিক বোধের অভাব থাকায় সহজেই অন্যদিকে ঘোরানো যায় তাদের মনোযোগ। তাই নিজেদের চেতনার মান নিয়ে ঠাট্টা করতেও দেখা গেল তৃতীয় নাগরিককে (অঙ্ক ২, দৃশ্য ৩)।
ইতিহাসের নিরিখে দেখলে, রোমের নির্বাসিত প্রতিনিধিদের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট প্রগতিশীল। সেনেট-এর ভেতর রোমের স্বাধীন পুরুষ নাগরিকদের স্বার্থরক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতেন তাঁরা। খ্রিস্টপূর্ব ২৭-এ রোমের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হলে কর্মচারীর পদ আর থাকেনি; সাধারণ মানুষও হারায় তাদের অধিকার। খেয়াল রাখা জরুরি, প্লুতার্ক-এর জন্মর আগেই গ্রিস চলে গেছিল রোমের সম্রাটের অধীনে। তিনি নিজেও অভিজাত শ্রেণিকে সমর্থন করতেন। এ থেকে গড়ে ওঠে তাঁর ইতিহাসবোধ। স্বাভাবিক যে, প্লুতার্ক-এর লেখায় জনপ্রতিনিধিদের কুচক্রী বলে দেখানো হবে। আবার সতেরো শতকের ইংল্যান্ডে যখন রাজাই শেষকথা তখন জননেতাদের অন্যভাবে হাজির করা শেক্স্পিয়র-এর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই অন্য বেশকিছু জায়গায় মূল সূত্র থেকে সরে গেলেও ব্রুটাস ও সিসিনিয়াস-কে ফন্দিবাজ বলেই নিন্দে করলেন নাট্যকার। প্রধান চরিত্রকে নির্বাসনে পাঠালেও নাটকের শেষে অভিজাত শ্রেণির কাছে তাঁদের মাথা নোয়াতে হল।
সবকিছু বিচারের পর বলা চলে, তৎকালীন সমাজের আর্থ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বগুলি ফুটে উঠেছে শেক্স্পিয়র-এর কোরিওলেনাস-এ। কিন্তু সেসব দ্বন্দ্বর সংশ্লেষণ ঘটানোর চেষ্টা এখানে অনুপস্থিত। সেটা অবশ্য স্বাভাবিক। ইতিহাসের ওই পর্যায় সাধারণ মানুষকে নেতৃত্ব দিতে গড়ে ওঠেনি কোনও আলাদা শ্রেণি। খেটে-খাওয়া জনতার সামনে এককাট্টা হওয়ারও সুযোগ আসেনি। নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি আর ক্ষমতাদখলের প্রশ্ন তাই মূল্যহীন। সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদে আমূল পরিবর্তন না-ঘটলে তা অসম্ভব। সেইজন্যে কোরিওলেনাস-এর দ্বন্দ্বগুলির মধ্যে ঐক্যস্থাপন করা গেল বিশ শতকে বের্টল্ট ব্রেশ্ট্ (১৮৯৮-১৯৫৬)-এর রূপান্তরের মাধ্যমে।
***
দীর্ঘদিন নির্বাসিতের জীবন কাটিয়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পূর্ব জার্মানিতে ব্রেশ্ট্ বসবাস শুরু করেন ১৯৪৯-এ; নিজের দল ‘বের্লিনের অঁসম্বল’ গঠন করে নামান একের পর এক প্রযোজনা। পছন্দসই সহকারীদের সঙ্গে মিলে তিনি বদলে দিতে চেয়েছিলেন জার্মান নাট্যপ্রযোজনার ধারা। নিজের নাটক মঞ্চস্থ ছাড়াও তখন ব্রেশ্ট্ হাত দেন রূপান্তরের কাজে। দলের সম্ভারে একগুচ্ছ ধ্রুপদী নাটক রাখার ইচ্ছে ছিল তাঁর। সেগুলি অবশ্য দরকারমত অদলবদল করে নেওয়া হত।
কোরিওলেনাস নিয়ে ব্রেশ্ট্-এর আগ্রহ বহুদিনের। ১৯২০ নাগাদ শেক্স্পিয়র-এর নাটকটি এরিক এঙ্গেল যখন পরিচালনা করেন তখন সেটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। এমনকি, ব্রেশ্ট্-এর নিজের নাটক গোলকধাঁধায় (১৯২১/২২) লক্ষ্য করা যায় কোরিওলেনাস-এর ছাপ। তাই নতুন পরিস্থিতিতে বের্লিনের অঁসম্বল-এর জন্যে তিনি যে আবার সেটি নাড়াচাড়া করবেন— এ তো স্বাভাবিক।
১৯৫১-র শেষদিকে নাটকটি নিয়ে বসলেন ব্রেশ্ট্। প্রায় এক বছর ধরে বিক্ষিপ্তভাবে চলল রূপান্তরের কাজ। কিন্তু কোরিওলান অবশ্য অসম্পূর্ণ থেকে গেল।৩ প্রথম অঙ্কর তৃতীয় দৃশ্য (সেটি মহলা চলাকালীন লিখতে চেয়েছিলেন ব্রেশ্ট্) আর পঞ্চম অঙ্কর সপ্তম দৃশ্য (নাটকের অন্তিম দৃশ্য) তিনি ধরতেই পারেননি। পরবর্তীকালে ব্রেশ্ট্-এর সামগ্রিক পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রূপান্তরটি শেষ করেন তাঁর সহযোগীরা। বের্লিনের অঁসম্বল সেটি প্রথম অভিনয় করে সেপ্টেম্বর ১৯৬৪-তে।
মনে রাখা দরকার, বিশ শতকের প্রেক্ষিতে কোরিওলেনাস-কে হাজির করেছেন ব্রেশ্ট্। সতেরো শতকের পর ইওরোপের আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকখানি পাল্টায়; পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণির উত্থান ঘটে। এর ফলে ব্রেশ্ট্-এর কোরিওলান-এ দুজন জননেতা দেখা দেন অন্যরূপে। ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যর পরিবর্তে এখানে তাঁদের কাজকর্মর ভিত্তি গভীর রাজনৈতিক বোধ (নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ঐতিহাসিক ভূমিকার কথাও ব্রেশ্ট্-এর মনে ছিল)। এছাড়া, কোরিওলান-এর জনগণও সমান পরিপক্ক। তাই প্রথম দৃশ্যে তাদের বিপরীতধর্মী সিদ্ধান্তর মধ্যে সহজে ঐক্যস্থাপন করতে পেরেছেন ব্রেশ্ট্। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব (সেনেট-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ) সাময়িকভাবে মুলতুবি রেখে বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে সমঝোতা (অভিজাত সম্প্রদায়ের অধীনে যুদ্ধ) করল জনতা। বিদেশিদের থেকে রোম-কে রক্ষার জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে তারা সামিল হল সচেতনভাবে। ব্রেশ্ট্-এর এমন ভাবনার মূলে ছিল দুটি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। জাপানি আগ্রাসনের সময় (১৯৩৭-৪১) চিয়াঙ কাই-শেক ও চিনা কমিউনিস্টদের যৌথ লড়াই আর নাৎসিবাহিনীর বিপক্ষে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণপন্থী-বামপন্থী জোট (১৯৪১)। বলার প্রয়োজন নেই যে, কোরিওলান-এ রোমের নাগরিকরা তাৎক্ষণিক আবেগের বশে মত বদল করেনি; অন্যদিকে, ব্রুটাস ও সিসিনিয়াস সর্বদা নিজেদের লক্ষ্যে স্থির থেকেছেন। দেশের স্বার্থে সাময়িক আপসের পর আবার শুরু হয়েছে শ্রেণিসংগ্রাম।
শেক্স্পিয়র-এর সঙ্গে ব্রেশ্ট্-এর নাটকের ফারাক শেষের দিকে আরও বাড়ে। নির্বাসিত কোরিওলেনাস রোম দখলের ছক কষলে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ডাক দেন জননেতারা। জাতীয়তার প্রশ্নে কোরিওলেনাস-এর অবস্থান পুরোপুরি ঘুরে যায়; জনগণ কিন্তু থাকে আগের মতই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। লক্ষ্য করার ব্যাপার, এবার আর-এক শাসনকর্তা (কমিনিয়াস) তাদের পাশে দাঁড়ালেন, এমনকি, অস্ত্রও যোগান দিলেন। আক্রমণ ঠেকাতে শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গে যুক্ত হল বুর্জোয়াদের আগুয়ান অংশ। ভলামনিয়া-ও ছেলেকে জানালেন যে, রোমের মানুষ তাঁকে আর অপরিহার্য ভাবে না।
কোরিওলান-এ জোর পড়েছে শান্তি আর মৈত্রীর ওপর। রোম আর আন্তিয়াম-এর দুই নাগরিকের বন্ধুত্বপূর্ণ কথাবার্তা (অঙ্ক ৪, দৃশ্য ১) বুঝিয়ে দেয়: যুদ্ধর মূলে রয়েছে দুদেশের শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ— যার সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনও যোগ নেই। কোরিওলেনাস-এর মধ্যে এক ফ্যাসিস্ত স্বৈরাচারীকে খুঁজে পেয়েছিলেন ব্রেশ্ট্— যিনি সকলের কাছে সমান বিপজ্জনক। তাই কোরিওলেনাস যে শান্তিচুক্তি করতে চেয়েছিলেন— সে-প্রসঙ্গ বাদ গেল এখানে। আউফিদিয়াস-এর মুখেও শোনা গেল না প্রধান চরিত্রর মহত্ত্বর গুণগান। কোরিওলান-এর শেষে একটি বাড়তি দৃশ্য (অঙ্ক ৫, দৃশ্য ৭) জুড়ে নাট্যকার দেখালেন: কোরিওলেনাস-এর বীরত্বের সম্মানে কাপিটল-এ তাঁর নাম খোদাই আর তাঁর মৃত্যুর পর নিকট আত্মীয়াদের আনুষ্ঠানিকভাবে শোক পালন— দুটি প্রস্তাবই সোজাসুজি খারিজ করল সেনেট। কোরিওলেনাস-এর মত গণশত্রুকে ভুলে সেখানে বরং পাশ হল খাল কাটার মত জনকল্যাণমূলক প্রকল্প আর শত্রুদের (কোরিওলি-দের) জমি ফেরত দেওয়ার আইন।
এক নতুন যুগের সাক্ষী ছিলেন ব্রেশ্ট্। তিনি দেখেন, শাসকগোষ্ঠীর খামখেয়ালিপনার ওপর নির্ভর না-করে একের পর এক দেশে জনগণ প্রতিষ্ঠা করছে নিজেদের অধিকার, সাধারণ মানুষ হয়ে উঠছে ইতিহাসের চালিকাশক্তি। তাই কোরিওলান-এও সেসব তুলে ধরতে পারলেন তিনি। শেক্স্পিয়র-এর অভিজ্ঞতা অবশ্য ছিল অন্যরকম। কিন্তু তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে কখনওই দ্বিধা করেননি ব্রেশ্ট্। কোরিওলান-এর নাট্যকার বলেন, “আমার বিশ্বাস: নিশ্চিত এতখানি প্রত্যয়ের সঙ্গে নয়, কিন্তু অনেক বেশি দক্ষভাবে আমাদের মতোই সময়ের বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করতেন তিনি [শেক্স্পিয়র]।’’
১. নাটক আর সে-সম্পর্কে নানা খবরাখবরের জন্যে: William Shakespeare, Coriolanus, ed. Philip Brockbank, London: Methuen, 1976 দ্র.। এছাড়া, Coriolanus, eds. Jonathan Bate and Eric Rasmussen, intro. Jonathan Bate, New York: The Modern Library, 2011 দেখা যেতে পারে।
২. Jan Kott, Shakespeare Our Contemporary, trans. Boleslaw Taborski, London: Routledge, 1991, p. 147 দ্র.।
৩. নাটক আর তা নিয়ে যাবতীয় আলোচনার জন্যে: Bertolt Brecht, Collected Plays, Vol. 9, eds. Ralph Manheim and John Willett, New York: Vintage, 1973 দ্র.।
কভার: বের্লিনের অঁসম্বল প্রযোজিত ‘কোরিওলেনাস’ (১৯৬৪)।
অসাধারণ সমাপতন পৌরাণিক নাটক ও আজকের রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে। সমকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে নতুনভাবে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য। ভালো লাগলো।
অসাধারণ। খুব ভালো লাগলো?