Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

মোরব্বা ও তার বীরভূমী বৃত্তান্ত

ঝলকে দেখে মনে হবে যেন মিছরি। মিছরির দানার মতই স্বচ্ছ আর মিঠে। কিন্তু মুখে দিতেই নরম তুলতুলে। আর স্বাদে-গন্ধে অনন্য। এ হল আসল মোরব্বা। বীরভূম জেলার সদর শহর সিউড়ি বিখ্যাত সেই মোরব্বার খাতিরে। বাংলার বহু খ্যাতনামা মানুষ এই সিউড়ির মোরব্বার স্বাদ-গন্ধে মজেছেন। ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে দেশীয়ভাবে প্রস্তুত এই মোরব্বার রকমফেরও তৈরি হয়েছে। স্বচ্ছ, নরম এই মিষ্টিটি মূলত চালকুমড়োর টুকরো থেকে বানানো হয়। তবে অন্যান্য সবজি ও মরসুমি ফল ব্যবহার করেও চমৎকার মোরব্বা হয়ে থাকে। মোরব্বার বীরভূমী বৃত্তান্তটিও চমকপ্রদ।

ফল সংরক্ষণের পথেই মোরব্বার জন্ম। সবজি বা ফল এবং চিনি ও মশলার মিশেলেই মোরব্বা। ভারতে বিলাসী মোগল সম্রাট শাহজাহানের রসুইখানায় মোরব্বার উৎপত্তি বলে কথিত আছে। আগ্রা ছিল সম্রাট শাহজাহানের রাজধানী। সম্ভবত সেই কারণেই আগ্রা সহ উত্তর ভারতে  মোরব্বা জনপ্রিয় হয়। মোরব্বাকে উত্তর ভারতে বলে ‘পেঠা’। উত্তর ভারতে জনপ্রিয় মিষ্টিটি দেখতে সাধারণত আয়তাকার হয়। এখানে কেশর পেঠা, অঙ্গুরি পেঠা প্রভৃতি উৎকৃষ্ট মোরব্বাও পাওয়া যায়। আনাজ বা মরসুমি ফলের মূল উপাদানটি অক্ষুন্ন রেখে স্বাদ ও গন্ধে ভিন্নতা আনতে অনেক সময় এতে নারকেল বা কেওড়ার নির্যাসও ব্যবহৃত হয়। আগ্রা শহরে প্রবল লোকপ্রিয়তার কারণে এটিকে সচরাচর ‘আগ্রার পেঠা’ বলা হয়।

দক্ষিণ ককেশীয় অঞ্চলের দেশসমূহ এবং পশ্চিম, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মোরব্বা অনেককাল ধরে প্রচলিত। জানা যায়, আলেকজান্ডারের সৈন্যদলে থাকা বৈদ্যদের হাত ধরে মোরব্বার মত সংরক্ষণযোগ্য খাদ্যবস্তুটি ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বে। এটি ভারত ও পাকিস্তানে বেশ জনপ্রিয়। অনেকে বলেন, পর্তুগিজদের কাছ থেকে ভারতীয়রা মোরব্বা বানানো শিখেছেন। কিন্তু ভারতে অনেককাল ধরেই ওষুধ ও পথ‍্য হিসেবে বিশেষ ধরনের মোরব্বা প্রচলিত এবং কার্যকরী। যেমন, বেলের মোরব্বা কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে, আমলকীর মোরব্বা মুখের রুচি ফেরাতে, হরীতকীর মোরব্বা হজমিকারক হিসেবে ব‍্যবহৃত হয়ে আসছে।

বাংলার প্রচলিত হাজার মিষ্টান্নের মধ্যে বেশ কিছু মিষ্টি স্থাননাম সহ জনমনে ঠাঁই পেয়েছে। যেমন, কলকাতার রসগোল্লা ও রসমালাই, বর্ধমানের সীতাভোগ আর মিহিদানা, কৃষ্ণনগরের সরভাজা আর সরপুরিয়া, জয়নগরের মোয়া, শক্তিগড়ের ল্যাংচা, নবদ্বীপের লাল দই, মালদার রসকদম্ব ও কানসাট, বেলিয়াতোড়ের মেচা সন্দেশ, লালবাগের ছানাবড়া, জনাই ও বেলডাঙার মনোহরা, কামারপুকুরের সাদা বোঁদে, দুই মেদিনীপুর ও হুগলির মুগের জিলিপি, ক্ষীরপাইয়ের বাবরশা, কাটোয়া, কালনা ও রানাঘাটের পান্তুয়া, বেলাকোবার চমচম, শান্তিপুরের নিকুতি, চন্দননগরের জলভরা, মুড়াগাছার ছানার জিলিপি, কোচবিহারের মণ্ডা, মাদারিহাটের কমলাভোগ ইত্যাদি। সিউড়ি নামের সঙ্গে তেমনভাবেই জড়িয়ে গিয়েছে মোরব্বার নাম।

বীরভূমের মোরব্বার জন্ম রাজনগরে। জেলা বীরভূমের একদা রাজধানী বর্তমানে ঝাড়খণ্ড লাগোয়া প্রান্তিক অঞ্চল এই রাজনগর। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে রাজনগরে শাসনক্ষমতার পালাবদল ঘটে। বীরত্বের জন্য জনসাধারণের কাছে খ‍্যাতকৃত‍্য রাজনগরের ‘বীররাজা’ বসন্ত চৌধুরী নিজের পাঠান সেনাপতি ভ্রাতৃদ্বয় আসাদ খান ও জোনেদ খানের অতর্কিত আক্রমণের মুখে পড়েন। দুই ভাইয়ের সম্মিলিত হামলার বিরুদ্ধে লড়ে যান তুখোড় মল্লযোদ্ধা বসন্ত চৌধুরী। কিন্তু লড়তে লড়তে বীররাজা আসাদ খানকে নিয়ে পাশের কুয়োয় পড়ে গেলে দু’জনেরই মৃত্যু হয়। জোনেদ খানের হাত ধরে বীরভূমে শুরু হয় পাঠান রাজত্ব।

বীরভূম তখন ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। আজকের ঝাড়খণ্ড তখন ছিল বীরভূমের অংশ। বর্তমান ঝাড়খণ্ডের বৈদ্যনাথ-দেওঘর পর্যন্ত ছিল বীরভূমের মধ্যে। আর বীরভূমের রাজধানী তখন রাজনগর। চারদিকে বেল, হরীতকী, আমলকী সহ বিভিন্ন গাছ তখন বনে। এছাড়া রাজনগরের পাঠান রাজারাও বহু ফলের গাছ লাগান। জানা যায়, জনৈক পাঠান রাজা উত্তর ভারতে ঘুরতে গিয়ে চালকুমড়োর মোরব্বা চেখে বেজায় খুশি হন। তাঁর উদ্যোগেই রাজনগরে মোরব্বা বানানোর তোড়জোড় শুরু হয়। এজন্য  মোদক সম্প্রদায়ের সুদক্ষ মিষ্টির কারিগরদেরও নিয়ে আসা হয়। পরবর্তীকালে রাজনগরের কিছু কারিগর কর্মসূত্রে সিউড়িতে চলে গেলে সেখানেও শুরু হয় মোরব্বা বানানোর কাজ।

দেখা যাচ্ছে, রাজনগর থেকে মোরব্বা গেল সিউড়ি এবং সিউড়ি থেকেই মোরব্বা হল বীরভূম তথা বাংলায় বিখ্যাত। সিউড়ি বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ‘মোরব্বা’ নামের দোকানটি দীর্ঘদিন ধরে মিষ্টিরসিকদের মোরব্বা যুগিয়ে আসছে। এখানে পাশাপাশি আরও কয়েকটি দোকান রয়েছে, সেখানেও অন্যান্য মিষ্টির পাশাপাশি থরে থরে সাজানো থাকে বেল, আমলকী, হরীতকী, শতমূলীর মোরব্বা। জানা গিয়েছে, এখানকার অনেক দোকানের কারিগর আসেন বেনারস থেকে। তবে হরীতকীর মোরব্বা আলকাতরার মত কালো বলে তার চাহিদা কম। খেজুরের মোরব্বা তো আমরা অহরহ খেয়ে থাকি। হাটেবাজারে আমরা যে দলাপাকানো খেজুর দেখি, তা আদতে পিণ্ডরূপী খেজুরের মোরব্বা। তবে যিনি একবার সিউড়ির মোরব্বার স্বাদ পেয়েছেন, তিনি এই ঝুঠো মোরব্বায় সম্ভবত ভুলবেন না কখনও।

চিত্র: গুগল
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

স্বামী বিবেকানন্দ : প্রয়াণদিনে স্মরণ

বিবেকানন্দই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক বাঙালি তথা ভারতীয়। রবীন্দ্রনাথ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ১৯১২-পর্বে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় যাওয়ার পর, এবং তার পরের বছর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। কিন্তু এর প্রায় কুড়ি বছর পূর্বেই বিবেকানন্দ শিকাগো-বক্তৃতা ও আমেরিকা-ইয়োরোপে এক নাগাড়ে প্রথম দফায় চার বছর থাকার সুবাদে আমেরিকার বিদ্বজ্জনমহলে যেমন, তেমনই জার্মানির মাক্সমুলার, ফ্রান্সের রোমাঁ রোলাঁ, রাশিয়ার টলস্টয় প্রমুখের শ্রদ্ধা এবং মনোযোগ আদায় করেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

প্রফুল্ল রায়: ব্রাত্য সময়ের কথাকার

প্রফুল্ল রায় নাকি অতীশ দীপঙ্করের বংশের। দেশভাগের অভিশাপেই দেশছাড়া হতে হয় তাঁকে, ১৯৫০-এ। একটা বিধুর বিষয় আমরা লক্ষ্য না করে পারি না। দেশভাগ সুনীল-শ্যামল-মহাশ্বেতা-শীর্ষেন্দু-অতীনদের কেবল ভূমিচ্যুত করেই ছাড়ল না, এমনকি তাঁদের কারুবাসনাকেও অন্যতর রূপ দেওয়ালো। দেশভাগ না হলে আমরা সুনীলের হাতে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীণ’ বা প্রফুল্ল রায়ের ‘পূর্বপার্বতী’ পেতাম না, যেমন পেতাম না শওকত ওসমানের ‘কর্ণফুলি’ বা হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি।’

Read More »
শৌনক দত্ত

মন্দ মেয়ে ভদ্র অভিনেত্রী: সুকুমারী দত্ত

বিনোদিনী দাসীর বর্ণময় জীবনের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া এই ‘তারকা অভিনেত্রী’-র বহুমাত্রিক জীবনটিও কম রঙিন নয় বরং বিস্মৃত নক্ষত্র এক, যিনি ১২৮২ বঙ্গাব্দের ৩ শ্রাবণ (১৮৭৫ খ্রি., মূল্য ছিল ১ টাকা) ‘অপূর্ব্বসতী’ নাটকটি লিখে বাংলা নাট্যাতিহাসের প্রথম নারী নাট্যকার হিসেবে সুবিদিত হয়ে আছেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস ও কালিদাস

পণ্ডিতেরা তর্ক তুলেছেন, কালিদাস ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ লেখেননি৷ কেননা একেবারে পয়লা আষাঢ়েই যে মেঘ নেমে বৃষ্টি আসবে, তা হয় না। তাঁদের মতে, ওটা আষাঢ়ের শেষদিন, ‘আষাঢ়স্য প্রশম দিবস’ হবে। কিন্তু প্রথম দিবস-ই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং তা এতটাই যে, কালিদাসকে নিয়ে ভারত সরকার যে ডাকটিকিট বের করেছে, সেখানে ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ শ্লোকটি উৎকীর্ণ।

Read More »
রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »