Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ভালবাসা না হারায়, দুনিয়াজুড়ে প্রেমের তীর্থে আজব হত্যে

‘ভালবাসা দিয়েই ভালবাসার ঋণ পরিশোধ করা যায়।’ আলেকজান্দ্রা ব্রাকেনের এই চিরন্তন অনুভূতিকে অবলম্বন করেই বলতে হয়, প্রেমের জন্য সবাই কত কিছুই না করে! কত অদ্ভুত অদ্ভুত রীতি-রেওয়াজে ভালবাসার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চায় মানুষ। ভালবাসা টিকিয়ে রাখার জন্য নানান অদ্ভুত প্রথা চালু আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আর এই আজব সব প্রথা দেখতে এবং সেখানে হত্যে দিতে আসেন দুনিয়ার নরনারী। লন্ডনের বাঙালিপাড়া ব্রিক লেন থেকে শুরু করে প্যারিস, নিউ ইয়র্ক, টোকিও, মস্কো, বার্লিন, প্রাগ, রোম, সিডনি, মেলবোর্ন, বেইজিং, সিওল— সব বড় বড় শহরেই দেখা যায় প্রেমিক-প্রেমিকার এই নৈকট্য ভরা ইস্তেহার।

প্যারিসের ‘পন্ত দ্যঁ আর্টস’ ব্রিজ, আবেগ এবং বিশ্বস্ততার প্রতীক।

ফরাসি ভাষাকে ভালবাসার ভাষা আর প্যারিসকে বলা হয় ভালবাসার শহর। সেইন নদী প্যারিসকে ভালবেসে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে পুরো শহর জুড়ে ছড়িয়ে আছে; একইভাবে শৈল্পিক সব স্থাপত্যশৈলী নিয়ে এই নদীর উপরেই প্রায় ৩৭টি ব্রিজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ব্রিজগুলোর ওপর দিয়ে হাঁটতে গেলেই যে কেউ টের পাবেন ব্রিজের রেলিংগুলোতে একধরনের বিশেষ তালা ঝুলে আছে। এগুলোকে ‘লাভ প্যাডলক’ বা ‘লাভ-লক’ বলা হয়। প্যারিসের ‘পন্ত দ্যঁ আর্টস’ ব্রিজ, আবেগ এবং বিশ্বস্ততার প্রতীকের এমনই এক উদাহরণ।

প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা যে কোনও একজন অন্যজনের নামের আদ্যক্ষর দেওয়া একটি তালা ব্রিজের রেলিংয়ে বেঁধে রাখেন এবং চাবিটি ফেলে দেন সেইন নদীতে। চাবি হারিয়ে যাওয়ার ফলে তালা কখনও খুলে যায় না; ঠিক তেমনই প্রেমিক-প্রেমিকাও যেন জন্মজন্মান্তর অটুট বন্ধনেই বাঁধা থাকে। এমনটাই প্রত্যাশা করে বাঁধা হয় এই তালাগুলো। প্রেমিক-প্রেমিকার ভালবাসার এমন নিদর্শনের কারণেই প্যারিস ভালবাসার শহর হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। আর অদ্ভুতভাবেই আমিও জড়িয়ে গেছি সেই ভালবাসার মায়াবী বন্ধনে।

তবে ভালবাসার ওজন তো নেহাত কম না! ফলে সেইন নদীর উপর নির্মিত ‘পন্ত দ্যঁ আর্টস’ সেতুর দু’পাশের রেলিং ওই উপচে পড়া লাভ-লকের ভারে ধসে পড়ার উপক্রম হল। ২০১৫ সালে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে ব্রিজটি রক্ষার জন্য তালাগুলো সরিয়ে ফেলেন। ওই সরিয়ে দেওয়া তালার মোট ওজন ছিল ৪৫ টন। নদীর তলদেশে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৭ লক্ষ চাবি খুঁজে বের করার কোনও প্রচেষ্টার কথা অবশ্য জানা যায়নি। এর পুনরাবৃত্তি রোধে ব্রিজের ফেন্সের ডিজাইনেও পরিবর্তন আনা হয়।

ইউক্রেনের ক্লেভান শহরের কাছে অবস্থিত ‘টানেল অব লাভ’।

ভালবাসাকে বন্দি করতে না পারার ব্যর্থতা নিয়ে ঝুলিয়ে রাখা তালা আর চিরকুট নিয়ে বিখ্যাত সার্বিয়ান মহিলা কবি দেসাঙ্কা মাকসিমোভিচ একসময় ‘Prayer for Love’ শিরোনামের একটি কবিতা লেখেন। বহু ভাষায় অনূদিত হয় কবিতাটি। ‘Three Meters Above the Sky’ এবং ‘I Desire you’ নামে ইতালিয়ান ভাষায় দুটি রোমান্টিক উপন্যাসও এই কাহিনি নিয়ে লেখা হয়। তৈরি হয় বহু বিখ্যাত সিনেমা। রোমান্টিক লেখালেখির ওপর ‘The Golden Padlock’ নামে পুরস্কারেরও ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালবাসা দিবসে ইতালিতে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।

ইউক্রেনের ক্লেভান শহরের কাছে অবস্থিত ‘টানেল অব লাভ’ পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর স্থানগুলোর মধ্যে একটি। সবুজ গাছ-পাতায় ঘেরা একটি রেলওয়ে টানেলের মধ্যে দিয়ে চলে গিয়েছে রেললাইন। এটি পৃথিবীর অন্যতম একটি রোমান্টিক স্থান হিসেবে পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রেমিক যুগল ও দম্পতিরা এই টানেলে বেড়াতে আসেন। তাঁরা পরস্পরকে চুম্বন করেন এবং নিজেদের সম্পর্কের সুখ ও দীর্ঘস্থায়িতার জন্য প্রার্থনা করেন। এই জায়গাটি সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল যদি এই পথটির ওপর দিয়ে হাত ধরে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে যান এবং তাঁরা যদি কোনও কামনা করেন তাহলে তা বাস্তবে পরিণত হয়।

রোমের ইচ্ছেপূরণের ফোয়ারা, ত্রেভি ফাউন্টেন।

আবার রোমে আছে ইচ্ছেপূরণের ফোয়ারা, ত্রেভি ফাউন্টেন (Trevi Fountain)। যারা রোমে বেড়াতে আসেন তাঁরা এই ফোয়ারায় কয়েন ফেলে দেন। কয়েন ফেলার একটি বিশেষ নিয়ম আছে। ফোয়ারার উল্টো দিকে ফিরে ডান হাতে কয়েন রেখে সেটা বাম কাঁধের উপর দিয়ে ছুড়ে ফোয়ারার জলে ফেলতে হয়। একটি কয়েন ফেললে পূরণ হয় স্বপ্নের শহর রোমে আবারও বেড়াতে আসার ইচ্ছা। দুটি ফেললে রোমে আবার ফিরে আসবেন এবং প্রেমে পড়বেন সেই শহরেই কারও সঙ্গে। তিনটি কয়েন ফেললে রোমে ফিরে আসবেন, প্রেমে পড়বেন এবং বিয়ের কাজটাও সেরে ফেলবেন রোমেই। এই প্রচলিত বিশ্বাসের কারণেই বহু পর্যটক মার্বেল পাথরের ভাস্কর্যযুক্ত এই ফোয়ারায় কয়েন ফেলেন। বছরে প্রায় ৬ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের কয়েন পাওয়া যায় এই ফোয়ারা থেকে। পুরো টাকাটাই দিয়ে দেওয়া হয় চ্যারিটিকে।

ভেরেনায় ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’-এর নায়িকা জুলিয়েটের ঝুলবারান্দা।

প্রেম, বিশ্বাস, আশা-আকাঙ্ক্ষার বিচিত্র মূর্ছনায় মানুষ বেঁচে থাকে নিজস্ব অস্তিত্বে। সেখানে অপ্রতিরোধ্য বলে কিছু নেই। আছে শুধু অনুভবের স্পন্দন। তাই হয়তো ইতালির ভেরেনায় ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’-এর নায়িকা জুলিয়েটের ঝুলবারান্দাটি হয়ে উঠেছে প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য একটি তীর্থস্থানের মত। বিশ্বের নানান দেশ থেকে হাজারো প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল, দম্পতি বেড়াতে আসেন ইতালির ভেরেনায় জুলিয়েটের বাড়িটিতে। জুলিয়েটের বাড়িটির মূল ফটকের দেয়ালে পর্যটকরা অসংখ্য চিঠি ও চিরকুট লাগিয়ে রেখে যান। কেউ কেউ আবার দেয়ালের গায়েই ভালবাসার কথা লিখে রাখেন ভালবাসার স্মৃতি হিসেবে। এই প্রচলন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে ‘Letters to Juliet’ সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর থেকে। প্রেমিক-প্রেমিকাদের চিঠিতে দেয়াল ঢাকা পড়ে যায় প্রায়শই। প্রেমের আলো অন্ধকার, ব্যথা-বেদনা, প্রিয় মানুষটিকে না পাওয়ার নৈঃশব্দ্য কথা কিংবা সম্পর্কের সুখশান্তি কামনা করে প্রতিদিন অসংখ্য চিরকুট জমা হয় এই দেয়ালে। মানুষের বিশ্বাস, এতে তাদের সমস্যার সমাধান হবে এবং প্রেম অটুট থাকবে।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়/ চিত্র: গুগল
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
পার্থ
পার্থ
2 years ago

খুব ভালো লাগল

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

ভূতের একটি বাজে গল্প

দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিতেই প্রথমে যেটি চোখে পড়ল, সেটি সেই লাল-হলুদ মাফলার, খাটের পাশে ঝোলানো। তাহলে সিড়িঙ্গেবাবু নিশ্চয়ই এই ঘরেই অধিষ্ঠান করেন, তালা দিয়ে কোথাও বেরিয়েছেন। হঠাৎ আমি ভূতগ্রস্তের মত করিডর ধরে হাঁটছি আর এক-একটা করে ঘরের দরজা ঠেলে ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছি। কী আশ্চর্য, প্রতিটি ঘরেই কোথাও না কোথাও দেখছি একটা করে ওই লাল-হলুদ মাফলার ঝুলছে। যত দ্রুত পারি দোতলায় ঘরগুলোর দরজা ঠেলে উঁকি দিলাম। সবখানেই এক ছবি।

Read More »
সুজিত বসু

কবিতা: জীবনের নানা দিক

ট্রেনের জানালা থেকে চোখে পড়ে ঘাসের গালিচা/ কোমল রোদের স্নেহে ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চল শান্তির নিদ্রায়/ সমুদ্রে দ্বীপের মতো ছোট ছোট বাড়িগুলি ঘাসের শয্যায়/ অতি দ্রুত বদলে যায় দৃশ্যাবলি, ট্রেন থামে ব্রাসেলস স্টেশনে/ বেলজিয়ামের মোহ দূরে রেখে ট্রেন চলে স্থির নিশানায়/ অভ্রান্ত লক্ষ্যের দিকে, আমস্টারডাম ডাকে কুহকী মায়ায়/ নগরে পৌঁছেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য, সুন্দরী ট্রামেরা/ হাতছানি দিয়ে ডাকে, বহু বহুদিন পরে প্রিয় বাহনের/ ডাকে সাড়া দিয়ে আমি পৌঁছে যাই মহার্ঘ নিবাসে

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব

আমাদের খেলা করা দরকার, তাই আমাদের কয়েকজন ছেলে মিলে ক্লাব তৈরি করতে হবে। কোথায় করা যায়? — অমুক জায়গায় — ওই জায়গাটা পড়ে আছে, তা যাদের জায়গা তারা বললেন, “ওই তো ওখানে জঙ্গল হয়ে আছে, তা যদি তোমরা জঙ্গল-টঙ্গল পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে ক্লাব তৈরি করতে পার তো করো।” আমাদের আর পায় কে — আমরা মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলে। উদ্ধার করলাম। উদ্ধার-টুদ্ধার করে এর বাড়ি থকে চারটে বাঁশ, ওর বাড়ি থেকে তিনটে হোগলা এভাবে যোগাড়-যন্ত্র করে-টরে একটা চালাঘর তৈরি করা হলো। সেই চালাঘরকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে আমাদের নতুন লাইব্রেরী তৈরি হলো। ক্লাবের নাম হলো ‘সেনহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাব’।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো! সেই থেকেই ‘বাগনান’!

ছোট্ট ওই ভূখণ্ডটি বাঘের উপস্থিতির জন্যই তখন ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয় বলে প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরার অভিমত। এই বিষয়ে তিনি আরও জানান, আরবি ভাষা অনুযায়ী ‘নান’ কথার অর্থ হল ‘চরভূমি’। ‘নান’ শব্দের আরও একটি অর্থ হল ‘ছাউনি’। তখন কাছারিপাড়া ছাড়াও নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় ইংরেজ সেনাদের ছাউনি ছিল বলে জানা যায়। যার মধ্যে খাদিনান, পাতিনান, খাজুরনান, বাইনান, চিৎনান, মাছিনান ইত্যাদি জনপদগুলি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু নদীর চরে বাঘেশ্বরী দেবীর পুজো হত, সেই জন্য প্রাথমিকভাবে এলাকাটি ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ‘বাঘনান’ অপভ্রংশ হয়ে ‘বাগনান’-এ পরিণত হয়েছে।

Read More »
আবদুল্লাহ আল আমিন

কবিগান: সমাজবাস্তবতা, বিষয়বৈভব ও রূপবৈচিত্র্য

এমন লোকপ্রিয় বিষয় বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা ভাষা, সঙ্গীত ও সাহিত্যে কবিগান ও কবিয়ালদের অবদানের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগান সংগ্রহ এবং এ বিষয় পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে কবিয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কিংবা কবিগানকে সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক এ গানকে সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই গানের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে লোকায়ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক যার অধিকাংশই অনালোচিত ও অনালোকিত রয়েছে অদ্যাবধি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »