ভারতে প্রাণীবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে এক সম্ভাবনাময় গবেষণার ক্ষেত্র হল মাছের জীববিজ্ঞান। গত শতকের ৭০-এর দশক ও পরবর্তী সময়ে অধ্যাপক জে. এস. দত্তমুনসীর মত পূর্ব-ভারতের মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন বিশিষ্ট মিঠাজলের মাছের জীববিজ্ঞান বিশেষজ্ঞের মধ্যে একজন হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক ড. নরেশচন্দ্র দত্ত। পশ্চিমবঙ্গে তথা পূর্ব-ভারতে মৎস্যবিজ্ঞান, মাছের জীববিজ্ঞান ও প্রাণীবিজ্ঞান বিষয়ক পঠনপাঠন, গবেষণাকার্য ও সামগ্রিক উন্নয়নে অধ্যাপক দত্ত পদচিহ্ন রেখে গেছেন এবং তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। গত বছর ১৯ মার্চ তাঁর দ্বিতীয় প্রয়াণবার্ষিকী উপলক্ষে দুদিন ধরে (২১-২২ মার্চ) উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগে জাতীয় সম্মেলনের অঙ্গ হিসেবে দ্য জ্যুলজিক্যাল সোসাইটির উদ্যোগে প্রথম এন সি দত্ত স্মারক বক্তৃতার আয়োজন হয়।
১৯১৭ সালে বিজ্ঞানচার্য জগদীশচন্দ্র বসু ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ স্থাপন করেছিলেন এবং তিনি এটির নামকরণ করেছিলেন ‘মন্দির’ বা ‘টেম্পল অফ লার্নিং’, যেখানে বিজ্ঞানের আরাধনা করা হবে। খানিকটা একইরকমভাবে অধ্যাপক দত্ত ১৯৭১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপনা শুরুর সময় থেকে ১৯৯৯ সালে অবসরগ্রহণকাল পর্যন্ত ওঁর অফিসকক্ষকে ‘মেডিটেশন রুম’ নামে চিহ্নিত করেছিলেন। আপন মাস্টারমশাই ও মৎস্যবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হিমাদ্রীকুমার মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক ডি এন গাঙ্গুলি, ড. সুদেবভূষণ ঘোষকে তিনি যেমন শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন, তেমনই ৫২ জন ছাত্রছাত্রী সহ (যাদের পিএইচ.ডি গবেষণায় তিনি ছিলেন বিজ্ঞ পরামর্শদাতা) স্নাতকোত্তর প্রাণীবিজ্ঞান ও মৎস্যবিজ্ঞানের বহু ছাত্রছাত্রী তাঁকে বিনম্র ও ভক্তিপূর্ণভাবে শ্রদ্ধা করতেন। বেশ কয়েক বছর বিভাগীয় প্রধান ছিলেন, নিজের সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের ওপর এম.ফিল পঠনপাঠন কার্যক্রমেরও পরিচালক ছিলেন।
পড়াশুনা ও কর্মজীবন
অধ্যাপক নরেশচন্দ্র দত্ত ১৯৩৪ সালের ১ জানু্য়ারি ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে ১৯৫৩ সালে প্রাণীবিজ্ঞানে স্নাতক হন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগ থেকে ১৯৫৫ সালে স্নাতকোত্তর স্তরের পড়াশুনা শেষ করেন এবং ১৯৭২ সালে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কিছু সময় গুরুদাস কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে কাজ করবার পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপনা আরম্ভ করেন। ১৯৯৯ সালে ৬৫ বছর বয়সে এই বিভাগ থেকে অবসরগ্রহণ করেন।
তাঁর মাস্টারমশাই ও বিশিষ্ট মৎস্য ভ্রূণ-উন্নয়নবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ ড. হিমাদ্রীকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে অধ্যাপক দত্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগে স্থাপন করেছিলেন মাছের জীববিজ্ঞান ও জলজবাস্তুতন্ত্র গবেষণাকক্ষ। অন্তর্দেশীয় মাছের শ্রেণিবিন্যাসবিজ্ঞান, বিভিন্ন মাছের ঘ্রাণশক্তি সম্বন্ধীয় দেহস্থ অবয়ব অর্থাৎ অলফেকটরি অ্যাপারেটাস-এর গঠনতন্ত্র, মাছের কঙ্কালে গঠিত পেশি, মাছের তুলনামূলক পেশিতত্ত্ব, মাছের মস্তক অঞ্চলের হাড়সম অংশের আকার-আকৃতি ও খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ, প্রাকৃতিক স্থির ও স্রোতযুক্ত জলে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়া ও প্রজননসম্বন্ধীয় শারীরবিজ্ঞান, মাছের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস, ডিম্বধারণশক্তি ও বিভিন্ন শারীরিক জীবসূচক (যেমন গোনাডোসোম্যাটিক সূচক), জলজ পরিবেশে বিদ্যমান প্রাণীজাত ও উদ্ভিদজাত অণুজীব প্ল্যাঙ্কটনের বৈচিত্র্য, পেরিফাইটন প্রাণীর বৈচিত্র্য, স্থির জলাশয়ের তলদেশে মাটিতে বসবাসকারী বিভিন্ন অমেরুদণ্ডী ছোট প্রাণী, শোধন করে নেওয়া গৃহজাত ময়লাজল মিশ্রিত মিঠাজল ও আধা-নোনা জলের মাছচাষের পুকুরের ভৌত-রাসায়নিক গুণাবলি, মৎস্যবৈচিত্র্য ও মাছের বাড়বৃদ্ধি, স্বাভাবিক কারণে জীবপ্রাণীর প্রাচুর্য্য ও সম্পদ-ক্ষয়ের বিশ্লেষণের দ্বারা জলদূষণের মাত্রার পরিমাপন (অর্থাৎ বায়োইন্ডিকেটরস অফ অ্যাকুয়েটিক পলিউশন), জলজবাস্তুতন্ত্রের শক্তি ও স্বাভাবিক উৎপাদনশীলতা, মৎস্যচাষের পুকুরের তত্ত্বাবধানব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা— এমন বিভিন্ন পাঠ্যবিষয়বস্তুতে অধ্যাপক নরেন্দ্রচন্দ্র দত্তের গবেষণা, অধ্যয়ন ও অনুসন্ধানে গভীর আগ্রহ ছিল।
অধ্যাপক দত্তের অবদান
অধ্যাপক দত্ত নিজের দুইজন প্রথিতযশা মাস্টারমশাই অধ্যাপক এইচ কে মুখোপাধ্যায় ও অধ্যাপক ডি এন গাঙ্গুলির নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগে দুটি অ্যাকাডেমি স্থাপন করেন। তাঁদের নামে ১৯৭৭ সাল থেকে প্রতিবছর স্মারক বক্তৃতা আয়োজন করা হয় ও ভারতবর্ষের গণ্যমান্য মৎস্যবিজ্ঞানী বক্তব্য পরিবেশন করেন। অন্তর্দেশীয় মৎস্যবৈচিত্র্য অনুসন্ধানেও অধ্যাপক দত্তর অবদান উল্লেখযোগ্য। ১৯৭২ সালের ঘটনা। অধ্যাপক ডি এন গাঙ্গুলির সঙ্গে বিহারের সুবর্ণরেখা ও তার শাখানদীতে বিদ্যমান মৎস্যবৈচিত্র্যের ওপর প্রগাঢ়ভাবে সমীক্ষা করে মুখে শুঁড়বিশিষ্ট Glyptothorax গণ-এর দুটি নতুন প্রজাতির মাছের সন্ধান পান অধ্যাপক নরেশচন্দ্র দত্ত এবং সেগুলির বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগত বিবরণী তিনি পেশ করেন, যা ছিল ভারতে প্রথম। ২০১৫ সালে এক সমীক্ষার সময় মৎস্যবিজ্ঞানীরা আসাম রাজ্যের বরাক ও কাটাখাল নদীতে একটি নতুন শুঁড়বিশিষ্ট মাছের সন্ধান পান। অধ্যাপক দত্তকে সম্মান জানিয়ে এই মাছটির নামকরণ করা হয় Hara nareshi। বলা বাহুল্য, এই মৎস্যবিজ্ঞানীরা একসময় নরেশচন্দ্রের অধীনেই গবেষণা করেছিলেন।
১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ৩০ জন গবেষক অধ্যাপক দত্তের অধীনে পিএইচ.ডি গবেষণা করে প্রাণীবিজ্ঞানে ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করে ফেলেছিলেন, অন্য ২২ জন গবেষক ওঁর অধীনে সেই সময়ে গবেষণা করছিলেন এবং দুইজন গবেষক (ছাত্রী) তাঁর কাছে রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট পদে কাজ করছিলেন। অবসরগ্রহণের পর অধ্যাপক দত্ত ভারতবর্ষে প্রাণীবিজ্ঞান ও মৎস্যবিজ্ঞানের ইতিহাস বিষয়ে আরও অনুসন্ধান ও জ্ঞানার্জনে আগ্রহী হন। ২০০৬-২০১০ সাল সময়ে অধ্যাপক দত্তের অধীনে ‘বিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে প্রাণীবিজ্ঞান ও পরিবেশ বিজ্ঞানের গবেষণায় উন্নয়ন’ বিষয়ে পিএইচ.ডি-উত্তর গবেষণা কার্যক্রমে নিযুক্ত ছিলেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০১১ সালে যিনি পোস্ট-ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন এবং তিনিই ছিলেন অধ্যাপক দত্তের শেষ গবেষক ছাত্র/ছাত্রী।
অধ্যাপক দত্তের কাছে গবেষণাকারী অনেকেই পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত বিভিন্ন মৎস্যবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এবং ইউজিসি/আইসিএআর পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাক্রমে মৎস্যবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক পদে নিযুক্ত আছেন, কেউ কেউ অবসর গ্রহণ করে ফেলেছেন। অধ্যাপক দত্ত পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি থিসিস পরীক্ষক (প্রাণীবিজ্ঞান ও মৎস্যবিজ্ঞান), আমন্ত্রিত অধ্যাপক ও জাতীয় স্তরের বিজ্ঞান অধিবেশনে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে গিয়েছেন, জাতীয় স্তরে পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্যান্য রাজ্যে বেশ কয়েকবার বিশেষভাবে সম্মানিত হয়েছিলেন। ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পর্ষদের মৎস্যবিজ্ঞান ও মৎস্য প্রতিপালন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিতে গবেষণা কার্যক্রম ও পঠনপাঠন বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত প্রবীণ বাঙালি ও অবাঙালি মৎস্যবিজ্ঞানীদের সঙ্গে অধ্যাপক দত্তের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও উল্লেখযোগ্য পরিচিতি ছিল। বর্তমান লেখক বেশ কয়েকবার এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছেন।
অন্যান্য সম্মানপ্রাপ্তি
অধ্যাপক দত্ত ১৯৯০ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের ৭৭তম অধিবেশনে একত্রভাবে প্রাণীবিজ্ঞান, কীটপতঙ্গবিজ্ঞান ও মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন, তা অনুষ্ঠিত হয়েছিল কেরলের কোচিন শহরে। ১৯৯৩ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের ৮০তম অধিবেশনে গোয়ায় অধ্যাপক দত্তকে প্লাটিনাম জ্যুবিলি (হীরকজয়ন্তী) বক্তৃতা পরিবেশন করবার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আন্তর্জাতিক মৎস্যবিজ্ঞান অধিবেশনে বক্তব্য পরিবেশন করবার জন্য তিনি ১৯৭৫ সালে কানাডার ভ্যানকাউভার শহরে, ১৯৮২ সালে জার্মানির হ্যামবার্গ শহরে ও ১৯৮৮ সালে হাঙ্গেরির কেজথেলি শহরে গিয়েছিলেন।
ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশন, ইনল্যান্ড ফিশারিজ সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া, দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি, দ্য জ্যুলজিক্যাল সোসাইটি, ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ-এর মত স্বনামখ্যাত সংস্থাগুলির নিয়ন্ত্রকমণ্ডলীতে সভাপতি, সহ-সভাপতি অথবা সেক্রেটারি (সচিব) পদে অধ্যাপক দত্ত বিভিন্ন সময় নিযুক্ত ছিলেন। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে কলকাতায় জাতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের শততম অধিবেশনে অধ্যাপক দত্তকে সম্মান জানানো হয়। ২০১৩ সালের জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মৎস্য দপ্তর তাঁকে ‘মীনমিত্র’ পুরস্কার প্রদান করে, ২০১৪ সালে দ্য জ্যুলজিক্যাল সোসাইটি, কলকাতা তাঁকে ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। ২০১৬-র ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার সায়েন্স সিটিতে ‘মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ এবং মৎস্যপ্রতিপালন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি’ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তাঁকে বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানকেন্দ্রিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক দত্তকে বিভিন্ন সময়ে সম্মানিত করেছেন, যাঁরা ছিলেন অধ্যাপক দত্তের ছাত্রসম।
শেষের কথা
১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে অধ্যাপক নরেশচন্দ্র দত্তের ৬০তম জন্মবর্ষ উপলক্ষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার বিশিষ্ট তথা প্রাক্তন অধ্যাপক, পাখির এনডোক্রাইন গ্রন্থিবিজ্ঞান বিষয়ক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ এবং ড. দত্তের বয়োজ্যেষ্ঠ ড. অশোক ঘোষ (১৯২৭-২০০৩) বলেন: ‘নরেশের পিএইচ.ডি থিসিস জমা দেওয়ার কোনও তাড়া আমি দেখিনি। সব সময়েই সে বলত যে তার কাজের অপূর্ণতা এখনও রয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নরেশ প্রাণীবিজ্ঞানের বিভিন্নমুখী বিষয়ে গবেষণা শুরু করে। নরেশের কাছে গবেষণার কাজ করেছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা ছাত্রছাত্রী। আমার দৃঢ় ধারণা নরেশ একজন সুশিক্ষক ও সফল সংগঠক। কখনও সে দিল্লি কিংবা জয়পুরে মৎস্যবিজ্ঞান অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে, আবার কখনও ছুটে গেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার নিমপীঠ কিংবা কৈখালিতে মৎস্যচাষি বা মৎস্যজীবীদের কাছে। নরেশ একজন বর্ণময় ব্যক্তিত্ব।’
কেন্দ্রীয় মৎস্যবিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ব্যারাকপুর) ষাট বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৭ সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে যে পুস্তকটি প্রকাশিত হয়, সেখানে প্রতিষ্ঠানটির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সম্বন্ধে খুব সুন্দর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন অধ্যাপক দত্ত। ১৯৩৬ সালে অধ্যাপক এইচ কে মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগে ফিশারি ল্যাবরেটরি স্থাপন করেন এবং মাছের জীবনবিজ্ঞানের ওপর গবেষণা আরম্ভ হয়। এই প্রজ্জ্বলিত জ্ঞানের দীপকে বহন করেছিলেন তাঁরই সুযোগ্য ছাত্র ড. নরেশচন্দ্র দত্ত। জলজবাস্তুতন্ত্র ও মৎস্যবিজ্ঞান বিষয়ে অধ্যাপক দত্তর গবেষণাধর্মী বক্তৃতাগুলি ছিল সত্যিই আকর্ষণীয় ও অসাধারণ। ২০০৪ সালের জুন মাসে তাঁর স্ত্রী সবিতা দত্ত প্রয়াত হন। বর্তমান লেখক অধ্যাপক দত্তের আশীর্বাদধন্য। ১৯৯৯ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে পড়াশুনা, গবেষণাসুলভ মানসিকতা ও প্রবন্ধ লেখালেখির বিষয়ে লেখককে তিনি উৎসাহ যুগিয়েছেন, ২০০৭ সালের এপ্রিলে ভুবনেশ্বরে লেখকের কাছে তিনি হাতে লেখা একটি পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিলেন, যা আজীবন একটি মূল্যবান সম্পদ (লেখক সেই সময়ে কেন্দ্রীয় মিঠাজল মৎস্যপ্রতিপালন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে একটি গবেষণা কার্যক্রমে বরিষ্ঠ গবেষক)। অধ্যাপক দত্ত সকলকে আন্তরিকভাবে স্নেহ করতেন, সহৃদয়ে পড়াশুনা ও গবেষণায় প্রেরণা যোগাতেন— ছাত্রছাত্রী এবং তাঁর মধ্যে এক অটল আনুগত্যসম্পন্ন যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল। আপন জ্ঞান ও গুণের বলে তিনি সকলকে আপন করে নিতে পারতেন— এ ছিল তাঁর এক অসামান্য ক্ষমতা। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে নিরহংকারী, মহানুভব, নিষ্ঠাবান ও পরিশ্রমী মানুষ।
এই অসামান্য বিজ্ঞানসাধক, অসীম জ্ঞানতপস্বী, উৎসর্গীপ্রাণ শিক্ষক, মধুর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ‘অধ্যাপকদের অধ্যাপক’ ড. নরেশচন্দ্র দত্ত ২০১৮ সালের ১৯ মার্চ সন্ধ্যা ৭টার সময়ে ৮৪ বছর বয়সে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স-এর উদ্যোগে কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অফ কালচার প্রতিষ্ঠান থেকে ‘Introduction to History of Science in India’ নামক একটি পুস্তক প্রকাশিত হয়। একটি জায়গায় অধ্যাপক দত্ত লিখেছিলেন: ‘Versatile zoologist Dr S. L. Hora had a sympathetic heart and he loved to encourage young scholars, providing them freely with all facilities of research. He was a broad and noble-minded person with great adaptability’। এই কথাগুলি নিঃসন্দেহে অধ্যাপক দত্তের নিজের সম্বন্ধেও প্রযোজ্য।