মাছ একটি অর্থকরী ফসল এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মৎস্য প্রতিপালন বা মাছচাষ অবশ্যই একটি লাভজনক ব্যবসা। পশ্চিমবঙ্গ হল ভারতবর্ষের মধ্যে একমাত্র রাজ্য যেখানে আধা-নোনাজল, নোনাজল, উষ্ণ মিঠাজল এবং শীতল জল-এর বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক জলসম্পদ রয়েছে। ১৯৬০-এর দশকের মধ্যবর্তী সময় থেকে এই রাজ্যের সমস্ত জেলায় অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন অন্তর্দেশীয় মাছ যেমন ভারতীয় মেজর কার্প, বিদেশি কার্প, দেশি মাগুর, গলদা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি সঠিক পদ্ধতিতে পুকুরে প্রতিপালন করা হচ্ছে এবং হ্যাচারিতে সেগুলির বীজ উৎপাদন হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে অন্যান্য কিছু অর্থকরী মাছ যেমন শিঙ্গি, পাবদা, পাঙ্গাস, মোনোসেক্স তিলাপিয়া, দেশি ট্যাংরা, ভেটকি, পারশে, ভ্যানামি চিংড়ি— এগুলির ওপরেও গুরুত্ব দিয়েছেন এ রাজ্যের মৎস্যবীজ উৎপাদনকারী এবং প্রগতিশীল মাছচাষিরা।
২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে পশ্চিমবঙ্গে মোট ১৭.৪০ লক্ষ টন পরিমাণ অন্তর্দেশীয় ও সামুদ্রিক মাছ উৎপাদিত হয়েছিল এবং ভারতবর্ষের সামগ্রিক মৎস্য উৎপাদনের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের অবদান ১৪.৯ শতাংশ। যদি শুধুমাত্র অন্তর্দেশীয় মাছের কথা ধরা হয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের অবদান ৩৩.২ শতাংশ এবং মৎস্য উৎপাদনে (বড় বাজারজাত মাছ) ভারতবর্ষের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। ২০১৮-১৯ সালে এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৭.৯ লক্ষ টন৷ পশ্চিমবঙ্গ মৎস্য দপ্তরের উদ্যোগে মৎস্যবিজ্ঞানী, বরিষ্ঠ মৎস্য আধিকারিক, মৎস্য বিশেষজ্ঞ, সমস্ত জেলায় ব্লকে ব্লকে কর্মরত সম্প্রসারণকর্মী এবং মৎস্যচাষি— সকলের সামগ্রিক প্রচেষ্টায় এ রাজ্যে মৎস্যচাষে ঘটেছে প্রসার, বেড়েছে মাছের উৎপাদনও। অসংখ্য মৎস্যচাষি মাছচাষ করে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, গ্রামে গ্রামে অর্থকরী মৎস্যচাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে এখনও অনেক মাঝারি ও বড় আকারের পুকুর আছে যেগুলিতে সংস্কারের অভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক মাছচাষ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সঠিক পদক্ষেপ নিয়ে যদি এইসব জলাশয়গুলিতে মাছচাষ করা যায় তাহলে পশ্চিমবঙ্গে মাছের যে চাহিদা আছে তার অনেকখানি মেটানো সম্ভব হবে। এই আয়ের পথকে সুনিশ্চিত করে আরও বেশি মানুষকে কাজের সুযোগ করে দিলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ জনসাধারণের কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি ও দরিদ্র মৎস্যচাষিদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে, যা সামগ্রিক গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে শক্তিশালী করবে।
বিজ্ঞানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাশাপাশি চলেছে নতুন প্রযুক্তিবিদ্যার উদ্ভাবন ও পুরনোকে আরও উন্নততর করে তার সার্থক রূপায়ণ। কৃষিবিজ্ঞান ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠানে উদ্ভাবিত গবেষণালব্ধ ফল তখনই ফলপ্রসূ হয় যদি তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। মৎস্যবিজ্ঞান তথা মৎস্য প্রতিপালন বিজ্ঞানকে বলা যেতে পারে প্রায়োগিক জীববিজ্ঞান-এর একটি আঙ্গিক। গবেষণাগারে উদ্ভাবিত নতুনতর মৎস্য প্রতিপালন প্রযুক্তি ও পদ্ধতিপ্রণালি গ্রামাঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচলনের ক্ষেত্রে মৎস্যচাষিদের পুকুরে তা প্রদর্শন এবং আরও বেশি করে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আয়োজন করা প্রয়োজন, মাছচাষের বিভিন্ন আধুনিক পদ্ধতি ও ব্যবহারিক দিক সহজ ভাষায় মাছচাষি ভাইদের কাছে তুলে ধরা প্রয়োজন, যার ফলে মৎস্যচাষিদের নতুনতর প্রযুক্তিগুলির প্রতি আকর্ষণ বাড়ানো সম্ভব হবে, তাঁরা অবলম্বন ও অর্থ বিনিয়োগ করতে আগ্রহপ্রকাশ করবেন।
নদীয়ার কল্যাণীতে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মৎস্য দপ্তর-এর মিঠাজল মৎস্য গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র; মেরিন প্রোডাক্ট এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি, কলকাতা শাখা; কেন্দ্রীয় মিঠাজল মৎস্য প্রতিপালন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ভুবনেশ্বর; কেন্দ্রীয় মৎস্যবিজ্ঞান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকাতা; কেন্দ্রীয় অন্তর্দেশীয় মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ব্যারাকপুর এবং কেন্দ্রীয় আধা-নোনাজল মৎস্য প্রতিপালন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কাকদ্বীপ প্রভৃতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রগুলি থেকে অর্থকরী খাদ্যোপযোগী মাছ, চিংড়ি এবং রঙিন বাহারি মাছের নিয়ন্ত্রিত ও আবদ্ধ পরিবেশে প্রতিপালন, পুষ্টি ও খাদ্যবিধি, মাছের প্রণোদিত প্রজনন ও লার্ভাদশার যত্ন, পুকুরের জল ও মাটির তত্ত্বাবধান, আঁতুর পুকুর পরিচালনা, সমন্বয়/ সুসংহত মাছচাষ, বিল ও দিঘিতে চেরা বাঁশ দিয়ে চতুর্দিকে ঘেরা জায়গায় মাছচাষ এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর গবেষণার ফসলকে নিয়ে ও বিজ্ঞানভিত্তিক অনেক রকম মাছচাষের তথ্য নিয়ে মৎস্যবিজ্ঞানীরা ইংরেজি ভাষায় বেশ কিছু আবাঁধা পুস্তিকা ও ক্ষুদ্র পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন— এর মধ্যে কিছু কিছু বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করা হয়েছে। আশা করে হচ্ছে, এমন সহায়িকা ও সম্প্রসারণ-কেন্দ্রিক পুস্তিকা প্রকাশনার মাধ্যমে গ্রামবাংলার উদ্যোগী যুবকরা স্বাবলম্বী, স্বোপার্জন ও স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে এগিয়ে আসবেন— এর সঙ্গে সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে উন্নত পদ্ধতিতে মাছচাষকে আরও সম্প্রসারিত করা সম্ভব হবে, মৎস্যচাষিরা উন্নত প্রক্রিয়ায় মাছচাষ বিষয়ক জ্ঞানে আরও সমৃদ্ধ হতে পারবেন, নতুনতর প্রযুক্তি সম্বন্ধে অবগত হবেন, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন করবেন।
মৎস্যচাষিরা যাতে সঠিক পদ্ধতিতে মাছচাষ করার জন্য সবরকমের তথ্য হাতের কাছে পান, সেই উদ্দেশ্যে গবেষণা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সময়ে এবং হাতেকলমে শিক্ষাদানের সময়ে (পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যচাষিদের জন্য) প্রশিক্ষণার্থী মৎস্যচাষিদের সঙ্গে যিনি নেতৃত্বে থাকেন, তাঁকে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত কয়েকটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা দেওয়া হয় এবং সকল প্রশিক্ষণার্থীদের সেগুলির প্রতিলিপি তৈরি করে নিয়ে নিজেদের কাছে রাখতে বলা হয়। এমন তথ্যসমৃদ্ধ পুস্তিকাগুলি কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্র এবং গবেষণা কেন্দ্র থেকে মৎস্যচাষিরা সামান্য মূল্যে কিনেও নিতে পারেন। এমন ক্ষুদ্র পুস্তিকাগুলি, বলা যেতে পারে জলজ প্রাণী প্রতিপালনের প্যাকেজ অব প্র্যাকটিস, এক্সটেনশন বুলেটিন অথবা এক্সটেনশন বুকলেট, অধিকাংশই গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত, তবে কিছু কিছু বাংলাতেও রয়েছে। বেশি কপি ছাপানো থাকলে কখনও কখনও তা আগত ও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারী মৎস্যচাষিদের বিনামূল্যে দেওয়াও হয়। কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্র (ফার্ম সায়েন্স সেন্টার) এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা, সম্প্রসারণ ও খামার অধিকরণ বিভাগ থেকে প্রকাশিত এমন আবাঁধা পুস্তিকা ও পুস্তকগুলি বাংলায় প্রকাশিত৷
অন্তর্দেশীয় মাছচাষের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর প্রত্যেক মৎস্যচাষিভাইয়ের সঠিক ও বিশেষ জ্ঞান থাকা একান্ত প্রয়োজন— যার ফলে তাঁরা মাছচাষ করলে মাছের দ্রুত বাড়বৃদ্ধি ও সর্বাধিক ফলন অবশ্যই পাবেন, মাছচাষের দিকে আরও বেশি করে আকৃষ্ট হবেন৷ এই জ্ঞানপ্রসারের জন্য বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে কিছু পত্রপত্রিকা এবং পুস্তিকা৷ এই প্রতিবেদকও সাম্প্রতিককালে উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তি যেমন অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন অন্তর্দেশীয় মাছের প্রণোদিত প্রজনন ও লার্ভাদশাগুলির প্রতিপালন পদ্ধতির ওপর নিজের মত করে এবং অনেক প্রগতিশীল ও অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত মৎস্যচাষি তাঁদের ঐতিহ্যিক জ্ঞানভাণ্ডার, কৌশল ও বিজ্ঞানকে অবলম্বন করে কেমন পদ্ধতিতে পুকুরে উল্লিখিত ও অন্যান্য মাছ মৌরলা, সরপুঁটি, পারশে, শিঙ্গি প্রতিপালন করে বাজারজাত অবস্থায় উন্নীত করছেন, বিভিন্ন সময়ে তাঁদের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে যে জ্ঞানার্জন হয়েছে, তা বর্ণনা করে বাংলা ভাষায় বেশ কিছু প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক চন্দ্রশেখর চক্রবর্তীর মতে, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অর্থনীতিতে মৎস্যচাষের বিকাশ দীর্ঘকাল ধরেই প্রভূতভাবে প্রচলিত৷ উন্নত প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে মৎস্যচাষিবন্ধুদের কাজে লাগাতে হলে সর্বোপরি প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সচেতনতা৷ মৎস্যচাষের উন্নয়নের সর্বাগ্রে প্রয়োজন চিরাচরিতভাবে ব্যবহৃত প্রযুক্তির পরিমিতকরণ, পরিমার্জন এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের আঙ্গিক পরিবর্তন৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সম্প্রসারণ ও খামার অধিকরণ-এর বিজ্ঞানীদের মতে, মৎস্যখামারিদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় ব্যবহৃত প্রযুক্তির সঙ্গে বিজ্ঞান মেশাতে পারলে বাড়বে উৎপাদন এবং সেই উৎপাদন হবে স্থিতিশীল। তাই মৎস্যসম্পদের স্থিতিশীল উৎপাদনের লক্ষ্যে অন্যতম প্রয়োজন মৎস্যখামারিকে উপযুক্তভাবে প্রশিক্ষিত করা। সহজ বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রকাশনা পারে গ্রামবাংলায় মৎস্যখামারির চেতনার উন্মেষ ঘটাতে, তাঁকে প্রশিক্ষিত করতে, উদ্বুদ্ধ করতে।
এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘মৎস্যচাষ’ নামক একটি বই গ্রামবাংলার মৎস্যচাষিভাইদের কাছে মৎস্যবিজ্ঞান সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সম্পূর্ণভাবে বিনামূল্যে বিতরণের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হয়েছে। রঙিন মাছচাষ, জিওল মাছের চাষ-এর ওপরও পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞানসম্মত মাছচাষকে সাধারণ মাছচাষির কাছে প্রসারিত করতে প্রয়োজন নিবিড় প্রশিক্ষণ এবং যথাযথ সহায়ক তথ্যপঞ্জি৷ এই লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মৎস্য দপ্তরের বিভিন্ন জেলা মৎস্য বিভাগ থেকে বাংলা ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছে সহায়তা পুস্তিকা, যা মৎস্যচাষি ভাইদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ করতে সমর্থ হবে। সম্বলহীন মানুষ কেমনভাবে নিজের আয় বাড়াতে পারেন, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাডাল্ট, কন্টিনিউয়িং এডুকেশন অ্যান্ড এক্সটেনশন বিভাগ থেকে সেই পরামর্শ দেবার জন্য প্রকাশিত হয়েছে ‘আয় বাড়ানোর পাঠমালা’ পুস্তিকাসমূহ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী-কমিশন এই পুস্তিকা ছাপানোর অর্থসংস্থান করেছে।
পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দপ্তর থেকে ‘আয় বাড়াতে প্রাণী পালন’ নামক বইটি প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে কম লেখাপড়া জানা মানুষও প্রাণী পালনের কাজে লাগতে পারেন। ত্রিপুরা মৎস্য মহাবিদ্যালয়, আগরতলা থেকে ‘দারিদ্র্য দূরীকরণে মাছচাষ’ এবং অন্যান্য কিছু আবাঁধা পুস্তিকা বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে। মাছের মহামারী ক্ষত রোগ, বিজ্ঞানসম্মত প্রথায় মিঠাজলের ঝিনুকে মুক্তো উৎপাদন, দেশি মাগুর মাছ ও গলদা চিংড়ির প্রণোদিত প্রজনন, বিল বাঁওড়ে মাছচাষ, মাছচাষের বারোমাস্যা, মাছের মিশ্র চাষ, সুন্দরবনের কাদাকাঁকড়ার গুরুত্ব, নোনা জলে চিংড়ি চাষ, একনজরে গলদা চিংড়ির চাষ, মৎস্যচাষোপযোগী জলাশয়ের জল ও মাটির গুণাগুণ ও সঠিক পরিচালনা, মাগুর ও শিঙ্গি সম্পর্কে কিছু কথা— এমন শিরোনামের পুস্তিকাগুলি রাজ্যের মৎস্যচাষিদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ মৎস্য দপ্তর থেকে প্রকাশিত হয়েছে। মৎস্যচাষের মাধ্যমে রাজ্যের মানুষকে আর্থিক উন্নয়নের পথে স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে এ এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
গ্রামীণ মৎস্যজীবী বা কৃষিজীবী মানুষের ধ্যানধারণা এবং ঐতিহ্যিক জ্ঞানভাণ্ডার কিন্তু বেশ শক্তিশালী ও সমৃদ্ধপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গ্রামবাংলায় পেশাদারী প্রগতিশীল ও অভিজ্ঞ মৎস্যচাষিরা মাছচাষের পুকুরের উর্বরতাশক্তি বাড়ানোর জন্য ও প্ল্যাঙ্কটনজাত অণুখাদ্যকণার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে প্রয়োগ করেন একপ্রকার ‘জৈব জুস’, যা তৈরি করতে প্রয়োজন হয় ৩০০ গ্রাম বাদামের খোল, ২৫০ গ্রাম চালের কুঁড়ো, ২৫ গ্রাম ইস্ট, ৩০০ গ্রাম চিটেগুড় ও ১০ গ্রাম গমের আটা৷ প্রতি শতক (চল্লিশ বর্গ মিটার) পুকুরে প্রতিবার এমন ফার্মেন্টেড জুস ব্যবহার করা হয়, মাসে দুবার ব্যবহারে তারা উপকৃত হয়েছেন। এই বিষয়টি কিন্তু কোনও মৎস্যবিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়ের পাতায় লেখা নেই, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও মাস্টারমশাইয়ের থেকেও নয়, এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা গিয়েছে ওইসব মৎস্যচাষিদের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে।
সাম্প্রতিককালে গবেষণা প্রতিষ্ঠানে মৎস্যবিজ্ঞানীদের দ্বারা উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তি যেমন অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন অন্তর্দেশীয় মাছ (ভেটকি, বোয়াল, চিতল)-এর প্রণোদিত প্রজনন, লার্ভাদশাগুলির প্রতিপালন পদ্ধতির ওপর অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত মৎস্যচাষিদের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে যে জ্ঞানার্জন হয়েছে, সেসবেরও বর্ণনা করে বাংলা ভাষায় বেশ কিছু প্রবন্ধ রচনা করেছেন এই প্রতিবেদকও। অন্তর্দেশীয় মৎস্যপ্রতিপালনবিজ্ঞান, প্রগতিশীল মৎস্যচাষীদের সহিত সাক্ষাৎকার, মাছের রোগ দূরীকরণে মৎস্যচাষীদ্বারা উদ্ভাবিত কার্যকরী প্রযুক্তি, গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতিকরণে মাছচাষ, মাছের জীববিজ্ঞান-এর উপর নতুন গবেষণার ফসল, বিশিষ্ট প্রয়াত মৎস্যবিজ্ঞানীদের কথা, দেশীয় লুপ্তপ্রায় মাছেদের সংরক্ষণ, মাছের স্বাস্থ্য পরিচর্যা রোগ নিয়ন্ত্রণ-এর খুঁটিনাটি বিষয়, মাছচাষে ঐতিহ্যিক প্রাযুক্তিক জ্ঞানভাণ্ডারের প্রয়োগ, ইলিশ মাছের সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা, অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে বাগদা চিংড়ি চাষের কুপ্রভাব, পুংলিঙ্গবিশিষ্ট তিলাপিয়ার বীজ উৎপাদন প্রতিপালন— এমন বিভিন্ন বিষয়ে বিজ্ঞানকে অটুট রেখে সাধারণ মানুষের কাছে বোধগম্য ও গ্রহণযোগ্য প্রবন্ধগুলি গত কুড়ি বছরে প্রতিষ্ঠিত বাংলা বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রয়াস সাধারণ মানুষের মধ্যে আধুনিক জীববিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে এবং গ্রামবাংলায় মৎস্য প্রতিপালনের সম্প্রসারণ ও ব্যাপকতা বৃদ্ধিতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে এবং নতুনতর প্রযুক্তি অনুপ্রাণিত মৎস্যচাষিদের অবলম্বন করতে উৎসাহিত করবে বলে আশা।
চিত্র: গুগল
নরেশচন্দ্র দত্ত: যাঁর সম্মানে এক মাছের নাম রাখা হয় Hara nareshi