পর্ব ১৬
মাস্টারদা
রুশরা বলে, কেউ মারা গেলে তাঁর সম্পর্কে হয় ভাল বলতে হয় নয়তো কিছুই বলতে হয় না। তবে আমি দেখেছি মানুষের মৃত্যুর পরে আমি তাঁদের সম্পর্কে অনেক নতুন কিছু জেনেছি, নতুন করে তাঁদের আবিষ্কার করেছি। দেশে যতদিন ছিলাম, বলতে গেলে পরিচিত কেউই মারা যাননি। যুদ্ধের আগে আগে এক ঠাকুরমা মারা যান। তবে উনি অসুস্থ ছিলেন বিধায় তাঁর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তাঁর মৃত্যুও তাই কোনও প্রভাব ফেলেনি। এরপর মস্কো আসি। ছাত্রজীবনে যত না শিক্ষক মারা গেছেন তার চেয়ে বেশি মারা গেছেন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক। ফরহাদ ভাই, ওয়াজেদ আর দু-একজন প্রিয় শিক্ষক তখন মারা গেলেও তা ছিল কালেভদ্রে। এ সময় বাড়িতেও মৃত্যুর আনাগোনা শুরু হয়, তবে সেটা মস্কো থেকে অনেক দূরে। ১৯৯৪ সালে দুবনা এলে প্রায় প্রতিদিনই দেখি কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে। সবাই ছিল অপরিচিত। প্রথম পরিচিত লোক মারা যায় বেশ পরে। উনি প্রায়ই আমাদের অফিসে আসতেন। বলতেন, ‘বেশি করে চা খাবে, তাহলে খিদে থাকবে না।’ আসলে, এটা ছিল নব্বইয়ের দশকের বিজ্ঞানীদের অবস্থা। তখন বেঁচে থাকাটাই ছিল আশ্চর্য ব্যাপার। মৃত্যু যেন মিছিল করে আসছিল বিজ্ঞানী আর শিক্ষকদের জীবনে। এখন অবশ্য (করোনা কাল বাদ দিলে) মানুষ সেভাবে মরে না। তাই কালেভদ্রে নোটিশ বোর্ডে সে রকম কোনও খবর থাকলে তাঁর সম্পর্কে পড়ি আর অবাক হয়ে আবিষ্কার করি মৃত্যুর পরে তাঁর সম্পর্কে যতটা জানলাম, জীবিত থাকতে সেটা ধারণাও করিনি। যদিও এখন এ দেশে যুদ্ধ চলছে, তবে সেটা অনেক দূরে। যারা মারা যায় তাদের জন্য খারাপ লাগলেও অপরিচিত বিধায় মনের মধ্যে গেঁথে থাকে না।
ছোটবেলার কথা আমার মনে পড়ে সেই ১৯৬৮ সাল থেকে। বড় মাস্টারমহাশয় আমাদের প্রাইভেট পড়াতেন। একদিন দিদিকে ঘষি দিয়ে ঢিল মারলে সেটা পড়ে ওঁর গায়ে। এমন বকেছিলেন যে বি ক্লাসে ভর্তি হয়ে যখন ওঁকে দেখি সামাদকে বেত দিয়ে মারছেন, সেই যে স্কুল ছাড়ি, পরবর্তী এক বছর আর ও-মুখো হইনি। সে সময় মা অসুস্থ। আমার দিন কাটে বড়দা আর বউদির ওখানে। রাতের বেলা বাড়ি ফিরি। বিকেলে কাকা বা মা গল্প শোনান। কাকা বলেন রামায়ণ আর মহাভারতের গল্প, মা লক্ষ্মীর পাঁচালি বা বসুমতির গল্প। কাকার গল্পে তাড়কা রাক্ষসী ছিল বহিরাগত। মায়ের গল্পে দেবদেবীরা ঘরের মেয়ে হয়ে যেত। সে সময় বাড়িতে ছিলাম আমরা পাঁচ ভাই আর দিদি। সুবোধদা আর স্বপনদা ইন্ডিয়া। মায়ের গল্পে ওরা সব সময় থাকত, তাই দূরে থাকলেও চোখের আড়ালে থাকলেও মনের আড়ালে ছিল না। স্বপনদা ছিল হিরো। আমার বয়স যখন ছয় মাস বাড়িতে ডাকাত পড়ে, বাবা মা অজ্ঞান, ডাকাতরা আমাকে ন্যাকড়া দিয়ে পেঁচিয়ে কেরোসিন ঢেলেছে আগুন লাগাবে বলে। তখন স্বপনদা ওদের কাছ থেকে আমার জীবনভিক্ষা করে। আর সেই যে ভয় পায়, ক’দিন পরেই চলে যায় কোলকাতায়। এর পর ও আর দেশে ফেরেনি।
ও সময় বিশাল বিছানায় ঘুমুতাম তপনদা, কল্যাণ, রতন, দিদি, আমি আর মা। আর বাবা শুতেন আমাদের পায়ের কাছে। এর পর ধীরে ধীরে তপনদা কাছারি ঘরে চলে যায়। সেই যাওয়া পরে দীর্ঘ দিন ধরেই চলে। এক সময় কল্যাণদা চলে যায় ইন্ডিয়া। ঘর খালি হতে থাকে।
যদিও সুধীরদা দেশেই ছিল ওর সঙ্গে দেখা তেমন হত না। ও তখন ঢাকা কলেজ শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে গণিতে। বাড়িতে তেমন আসে না। আসলে সে সময় ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার ঝক্কি অনেক। তিন তিনটে বাস বদলাতে হয়, তিন তিনটে নদী পার হতে হয়। তাই ও প্রায়ই যেত মির্জাপুর মামার ওখানে। পরে অবশ্য জেনেছি ও যতটা না মামাবাড়ি যেত তার চেয়ে বেশি করে যেত প্রেম করতে। ১৯৬৯ সালে কোলকাতা যাবার আগে মা তো ওর বিয়ে ঠিক করে গেলেন। ফিরে এসে শুনলাম ওর মত বদলিয়েছে। এখন তার নতুন ভালবাসার মানুষ। বাড়িতে অশান্তি, মা অনড়। ছেলে তার নিজের পছন্দের মেয়েকেই বিয়ে করবে। বাড়ি এল নতুন বউদি— শুক্লা বউদি। ডাকনাম আলতা। দুধে-আলতার মত তার গায়ের রং। সময়ের সঙ্গে সে আর বাড়ির বউ রইল না, হল বাড়ির মেয়ে। তখন থেকেই সুধীরদা বাড়ি থাকতে শুরু করল। কাছে থেকে ওকে দেখার সুযোগ পেলাম। আসলে আমাদের সবার জন্য মা ছিলেন দেওয়ালের মত। আমি বাবার ন্যাওটা। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা আর সমীহের শেষ নেই। মা সেদিক থেকে যতটা না মা তার চেয়ে বেশি খেলার সাথি। কিন্তু কোনও রাতে যদি মনখারাপ হত, মনে মনে ভাবতাম বাবা রাগ করে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন, কল্পনায় মা-ই তখন এগিয়ে আসতেন। মা ছিলেন আশ্রয়ের স্থল। সবার জন্যেই। বাবা আমাদের বকতেন না খুব একটা, তবে বকলে মা হতেন উদ্ধ্বারকারিণী। আমার এখনও অবাক লাগে ভেবে এমন কেন ভাবতাম।
সুধীরদার জন্ম ১৯৪৫ সালের ২৫ নভেম্বর মানে আমার চেয়ে ও প্রায় ২০ বছরের বড়। মনে পড়ে ওর বিয়েতে বউদিদের পক্ষ থেকে একটা টি-সেট দিয়েছিল। একান্নবর্তী বড় বাড়ির এই ছোট্ট অংশে যৌতুক নেবার রেওয়াজ ছিল না। রতন বাদে সবাই বিয়ে করেছে প্রেম করে, তাই যৌতুকের প্রশ্ন আসেনি কোনওদিন। যাহোক, আমি ওই টি-সেট থেকে নিজের জন্য একটা কাপ বেছে নিয়েছিলাম। সুধীরদা তখন ছাত্র পড়ায় আর মাস্টারি করে বানিয়াজুরি হাইস্কুলে। সকালে রান্না ঘরে চুল্লি ঘিরে বসে চায়ের আসর। বিকেলের চা মূলত বারান্দায়, কখনও আমাদের এদিকটায়, কখনও বড়দার ওখানে। সকালে ঘুম থেকে উঠে চায়ের জন্য সবাই বসে থাকি চুলার পাশে। একদিন তাড়াহুড়ো করে সুধীরদা আমার কাপে চা খেলে আমি অন্য একটা কাপ থেকে ওর মাথায় গরম চা ঢেলে দিই। খুব রেগে গেছিল, তবে কিছুই বলার সুযোগ পায়নি। বাবা, মা, কাকা, জ্যাঠার রায়— ওর ভুল ছিল আমার কাপে চা খেয়ে। তবে এ নিয়ে আমার প্রতি ওর ভালবাসা কমেনি। প্রতিদিনই চুয়িং গাম, চকোলেট, বিস্কুট এসব আনত আমার জন্য। ও কিন্তু কখনওই আমাদের সঙ্গে খেলাধুলা করত না। বড়দা থেকে শুরু করে আমরা সবাই যখন একসঙ্গে ফুটবল, ভলিবল খেলতাম— সুধীরদা হয় বই পড়ত বা চা খেত অথবা ছাত্র পড়াত। রাস্তা ভাঙলে বা জল এলে আমরা যখন সবাই মিলে রাস্তায় মাটি তুলতাম, খালের উপর সাঁকো তৈরি করতাম— সুধীরদা বই নিয়ে পড়ে থাকত। তবে রাজনৈতিক মন্তব্য করত বিশেষ করে বিবিসির খবর শোনার সময়। পরে আমরা যখন বাম রাজনীতি শুরু করি, তখনও ও ছিল নির্বিকার, রাজনীতি-বিমুখ। তবে যেটা করত তা হল বই কিনে আমাদের পড়তে দিত। ওর হাত ধরেই আমার পরিচয় বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে। এরপর জন্মদিনে কৃত্তিবাসী রামায়ণ আর কাশীদাসী মহাভারত দেয়। এরপর প্রায়ই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, দস্তয়েভস্কি, তুরগিনেভ এসব দিতে শুরু করে। তবে এ ব্যাপারে শুধু সুধীরদাই নয়, বাড়ির অন্যেরাও উৎসাহ দিত। আর ছিলেন পণ্ডিত স্যার। সুধীরদা বা পণ্ডিত স্যার কোনও বই হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, এই বইটা পড়িস।
যতদূর জানি, আমাদের স্কুলের অনেককেই পাঠ্যপুস্তকের বাইরের বই পড়তে আগ্রহী করে তোলেন এই দুজন। আমাকে সব সময় বিশ্বসাহিত্যের নাম করা লেখকদের বই পড়তে দিলেও সুধীরদা ডিটেকটিভ পড়তে পছন্দ করত। মাসুদ রানা, বেনহুর, নীহাররঞ্জন— এসব বই বগলদাবা করে হাঁটত। আর ঘর থেকে বেরুনোর সময় কিছু চাল আর একটু লবণ মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে বেরিয়ে যেত। সুধীরদা আর বউদি যে ঘরে থাকত তার নাম ছিল বড় ঘর। ওখানেই কুলের ঠাকুরদেবতা ঘুমুত, খেত। ওই ঘরেই থাকত বস্তা ভরা লবণ, চিনি, কোলা ভরা গুড় আর ড্রাম ভরা চাল, ডাল ইত্যাদি। ওর এই চাল আর লবণ খেতে দেখে আমরা মুচকি মুচকি হাসতাম। আমি সে অর্থে ডিটেকটিভ একদমই পড়িনি। একটাই বই পড়েছি, হত্যা হাহাকারে। তবে দস্তয়েভস্কি, কাম্যু, কাফকা, সারত্রে পড়ে আমি যেন ডিটেকটিভ পড়ার আনন্দ পেয়েছি। স্কুলে থাকতেই কোলকাতা থেকে অংক আর পদার্থবিদ্যার বই এনে পড়তে দিত।
এই অংকগুলো করিস তো। পরে যখন ছাত্র পড়াতে শুরু করে আমাকে বলত অন্যদের সাহায্য করতে।
দেখ তো অংকটা মিলছে না। তোর হয় কি না?
ধীরে ধীরে আমরা হই কলিগ। একবার মনে আছে স্কুলে সুধীরদা আর ক্ষিতীশ স্যারের মধ্যে বিতর্ক শুরু হল দ্বিঘাত সমীকরণ নিয়ে। আমি ক্লাস টেনে পড়ি। দুজনে এসে আমার মতামত জানতে চাইলেন। ভারি মুস্কিল। সুধীরদা আমাদের প্রতিটি অংক বিশ্লেষণ করে শেখায়, ক্ষিতীশ স্যার ফর্মুলা অনুযায়ী। কেউ ভুল করছে না। তাই বললাম, আসলে আমরা যদি জানার জন্য পড়ি তাহলে বিশ্লেষণ করে পড়াই ভাল আর যদি নম্বরের জন্য পড়ি ফর্মুলাই যথেষ্ট। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের প্রাইওরিটি কী?
কেউই অখুশি হননি।
ক্লাস টেনে আমাদের প্রথম ক্লাস নিতেন পণ্ডিত স্যার। আমি প্রতিদিনই লেট করতাম। তবে জানালা দিয়ে দূরে আমাকে আসতে দেখে উনি আমাকে প্রেজেন্ট করে রাখতেন। আমার মনে হয় তখন আমি ছিলাম লেনিনের বিখ্যাত ‘এক পা আগে দুই পা পিছে’ বইয়ের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত উদাহরণ। তবে এটা ঠিক গবেষণার কাজ তাড়াহুড়ো করে করতে নেই, এমনকি কাজ শেষ করেও বারবার প্রশ্ন করতে হয়। হয়তো এভাবেই আমার মধ্যে গবেষণা করার মানসিকতা তৈরি হয়েছিল।
সুধীরদার ক্লাস ছিল পরে। কোনও কোনও দিন প্রথম ক্লাস থাকলে নাম ডাকত। ও জানত আমি ওকে ইয়েস স্যার বলব না। আর সবাই সেই অপেক্ষায়ই থাকত আমি কী বলব, ইয়েস স্যার না ইয়েস দাদা। আমি ছিলাম ফার্স্ট বয়। ও আমাকে বাদ দিয়ে বিচিত্রকে দিয়ে শুরু করত। আমাদের সময়ে ভাল ছাত্ররা ক্লাস এইট থেকে মানিকগঞ্জ সরকারি হাইস্কুলে পড়তে যেত। আমি অবশ্য তেমন ভাবিনি। সুধীরদা নিজেই বলল, নিজের পড়াটাই আসল। তুই তো এখানেই পড়াশুনা করছিস। মানিকগঞ্জ গিয়ে কী হবে?
আবার যখন স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা উঠল, ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে গিয়েও ফিরে এলাম। তখন স্টার মার্ক থাকলে ভর্তিতে সমস্যা হত না, তবে হস্টেলে সিট পাওয়া সমস্যা। রামকৃষ্ণ মিশনে অনেকেই থাকত। ততদিনে অবশ্য ঈশ্বর আর আমার পথ দুটো দিকে গেছে বেঁকে। ভর্তি হওয়া হল না। সুধীরদাও চায়নি আমি বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাই। আসলে অংকের প্রতি আমার বরাবরই দুর্বলতা ছিল। সুধীরদা আর তপনদা গণিতে মাস্টার্স করে তাই আমার পদার্থবিদ্যা বেছে নেওয়া। মস্কো আসি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। এয়ারপোর্টে নেমেই বলি সাবজেক্ট বদলে পদার্থবিদ্যায় যাব। ছাত্র সংগঠনের প্রচেষ্টায় সেটা সম্ভব হয়েছিল। পরে শিক্ষকদের কেউ কেউ রসায়নে, কেউ কেউ গণিতে পড়তে বলেছেন। কিন্তু ইতিমধ্যে আমি পদার্থবিদ্যার প্রেমে পাগল।
আমি মস্কো আসি রাজনৈতিক কারণে। তখন ছাত্র ইউনিয়ন আর খেলাঘর নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে বাবা প্রমাদ গণলেন। এর আগে স্বপনদা নক্সাল করে বাড়ির সবাইকে অনেক দুশ্চিন্তায় রেখেছে। তাই বাবা বললেন, দেশ ছাড়তে হবে। যদি চাও আমেরিকা যেতে পারো অথবা রাশিয়া, যেহেতু সেই রাজনীতিই করছ। কিন্তু দেশে থাকা হবে না।
সুধীরদা আমার আমেরিকা যাওয়ার পক্ষে ছিল। আমরা যারা বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম তারা রাশিয়ার পক্ষে। তাছাড়া রাশিয়ার প্রতি আমার ভালবাসা যতটা না সমাজতন্ত্রের জন্য তার চেয়ে বেশি করে দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়, চেখভ— এঁদের লেখা থেকে। এমনকি রাশিয়ায় আসার পরেও কালেভদ্রে সুধীরদা চিঠি লিখলে আমি যেন আমেরিকা চলে যাই সেটাই বারবার বলত আর আমিও অমলদা, গণেশদাদের উদাহরণ দিয়ে ওর সন্দেহ দূর করার চেষ্টা করতাম।
সুধীরদার সঙ্গে আমি নিজের মিল খুঁজে পাই মনিকার জন্মের পরে। এ দেশে অনেকের বিয়ের আগেই বাচ্চা হয়, বাচ্চা হবার পরেও অনেকেই অফিসিয়ালি বিয়েও করে না আবার বিয়ের পরেও অনেকেই বাচ্চা নেয় না। আমাদের দেশে বিয়ে মানেই বাচ্চা। বিয়ের অনেকদিন পরেও যদি বাচ্চা না হয়, শুরু হয় কানাঘুষা। আর সেটা যত না করে বাড়ির লোক তার চেয়ে বেশি পাড়া-প্রতিবেশী। অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে কেন যে এত আগ্রহী আমাদের দেশের মানুষ?
অনেক দিন পর্যন্ত আমিই ছিলাম বাড়ির ছোট সন্তান। এর মধ্যে অবশ্য সুবোধদা আর ভাগবতদার সন্তান হয়েছিল, তবে ওরা থাকত ইন্ডিয়া, তাই সুধীরদার বিয়ের পরে সবাই নতুন মুখের আশায় বসে ছিল। তবে সেটা খুব তাড়াতাড়ি হয়নি। ভ্রমরের জন্ম ১৯৭৫ সালে। আমার বয়স তখন ১১। সুধীরদা মনে হয় পুত্রসন্তান হবে বলে আশা করেছিল, তাই প্রথম প্রথম প্রায়ই খিটিমিটি করত। কিন্তু তারপর ভ্রমরকে এমনভাবে ভালবেসে ফেলে যে যাকে বলে ভ্রমর অন্তপ্রাণ। সেই ছোটবেলা থেকেই ও ভ্রমরকে বোঝাতে চেষ্টা করত আর ভ্রমর না বুঝলে রেগে যেত। একদিন হঠাৎ শুনি ভ্রমরের কান্না। সুধীরদা কী যেন বলছে আর ভ্রমর শুনছে না। বউদি স্কুলে। সুধীরদা বলছে, ‘এবার তোকে খুন করে ফেলব।’ আমি দৌড়ে গিয়ে সুধীরদাকে ধাক্কা দিয়ে ভ্রমরকে নিয়ে আসি। না আমি না সুধীরদা— কেউই এমন আচরণ আশা করিনি। অনেক পরে মনিকা দুবনা আসে মাত্র দুই বছর বয়সে। গুলিয়াকে মাঝেমধ্যে আন্তনকে নিয়ে মস্কো যেতে হত নাচের ক্লাসে। আমি মনিকাকে বুঝিয়ে কিন্ডার গারটেনে পাঠানোর চেষ্টা করতাম আর ও কিছুতেই যেতে চাইত না। আমার অফিস যাওয়া হত না। মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড রেগে যেতাম, শাস্তিও দিতাম। সুধীরদা ভ্রমরকে কোলে নিয়ে প্রায়ই গান করত, গান মানে অসংলগ্ন শব্দাবলি। আমিও অবাক হয়ে দেখতাম, মনিকা, ক্রিস্টিনা বা সেভাকে কোলে নিয়ে আমি সুর করে গাইতাম, গুলিয়া যাকে বলত, ‘স্তো ভিঝু তো ই পাইয়ু’, মানে যা দেখি তাই গাই। তখন নিজের ভেতর সুধীরদার ছবি খুঁজে পেতাম। এটা ছিল অবাক করা কাণ্ড। সুধীরদা চাকরি শুরু করে ১৯৭০ সালে। কিন্তু বাড়ির অবস্থা ভাল থাকায় কোনও টাকাপয়সা বাড়িতে দিতে হত না। ওর টাকা খরচ হয়ে যেত বই আর চায়ের দোকানে। এমনকি যখন অনেক ছাত্র পড়াতে শুরু করে আর উপার্জন বাড়ে তখনও এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি। যারা প্রাইভেট পড়ে টাকা দিত দিত, না দিলেও কোনও কথা ছিল না। ছাত্ররা গরিব হলে টাকা তো নিতই না উল্টো ওদের বই কিনে দিত। পড়ানোর আনন্দেই ও পড়াত। তাই বাবা মা কখনওই ঠিক ওর ওপর ভরসা রাখেননি। বাবা মায়ের ভরসা ছিল পরবর্তী সন্তানদের ওপর, যারা রাজনীতি করত, সামাজিক কাজকর্মে এগিয়ে যেত। এককথায় আর দশ জনের মত ছিল। সুধীর পাগলার মত ছিল না। আশ্চর্যের ব্যাপার পাগল উপাধিটা সুধীরদার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভাগ্যেও জুটেছিল বাড়িতে থাকতেই। তবে সেখানে আমি সুধীরদার সঙ্গে মিল খুঁজে পেতাম না, ছিল আমার এক্সেন্ট্রিক ব্যবহার। তবে কেউই বাবা মায়ের আশা পূরণ করতে পারেনি আর পরবর্তী পর্যায়ে সুধীরদা, বউদি আর দিদি সংসারের হাল ধরে।
১৯৮৯ সালে মাস্টার্স কমপ্লিট করে যখন দেশে ফিরি সুধীরদা অনেক বলেকয়ে আমাকে আমেরিকান কালচারাল সেন্টারে পাঠাল বার দুয়েক। সে সময় কমরেডরা আর কমরেড নেই, আমি নিজেই রেনেগেড হয়ে গেছি, তাই মস্কোর হাতছানি ছিল আবার তেমন পিছুটানও ছিল না। তবে শেষপর্যন্ত মস্কো ফিরে যাই পিএইচ.ডি করার জন্য। ওই সময় আমাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠি। বাড়িতে টেলিফোন ছিল না, আজকের মত ইন্টারনেট ছিল না। তাই অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও ওর কাছ থেকে আলাদা করে চিঠি পেতাম না। ১৯৯১ সালে যখন দেশে যাই বাবা মারা গেছেন। সময় কেটেছে চুপচাপ বসে থেকে। ১৯৯৭ সালে আবার যাই মূলত পুনায় একটা কংগ্রেসে যোগ দিতে। তখন আমি অলরেডি দুবনায় চাকরি করি। এবার মাও মারা গেছেন। এককথায় দেশের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক হালকা থেকে হালকাতর হয়ে আসছে। নিজেও ব্যস্ত কাজ আর সংসার নিয়ে। আসলে এখানে যখন বিয়ে করে থেকে যাই, তখন সুধীরদা বুঝতে পারে আমি আর আমেরিকা যাচ্ছি না, তাই আমাকে নিয়ে ওর আশা হতাশায় পরিণত হয়েছে।
এরপর নতুন শতাব্দীতে ইন্টারনেটের কল্যাণে নতুন করে যোগাযোগ হয় বাড়ির সঙ্গে। গ্রামীণ ফোন আসে। আমরাও অল্প পয়সায় ফোন করার উপায় খুঁজে পাই। ইতিমধ্যে ভ্রমর ইউনিভার্সিটি শেষ করে বিয়ে বসেছে, কিছু দিন দেশে কাজ করে ওরা চলে গেছে অস্ট্রেলিয়া ২০০৫-এর শুরুতে। সব মিলিয়ে সুধীরদা ভেঙে পড়েছে মানসিকভাবে। পরে শুনেছি দেশে কী সব ঝামেলায় ও মহিলা কলেজের চাকরি ছেড়ে দেয়, অনেক দিন বহরমপুর মামার ওখানে থাকে। সেখানে ওর ছাত্ররা আজও নাকি সেই স্যারের কথা স্মরণ করে। এরপর দেশে ফিরে চাকরি না খুঁজে প্রাইভেট পড়াতে শুরু করে মানিকগঞ্জ একটা রুম ভাড়া করে। আমি দেশে থাকতেই দেখেছি ও শুধু স্কুল-কলেজের ছাত্রদেরই নয়, ইউনিভার্সিটির অনার্স বা মাস্টার্স কোর্সের ছাত্রদেরও পড়াত। কঠিন জিনিস সহজ করে বোঝানোর এক অদ্ভুত শক্তি ছিল ওর। সেই ছোটবেলা থেকেই একটা কথা চালু ছিল বাড়িতে— সুধীর অতিরিক্ত চা খেয়ে লিভার নষ্ট করে ফেলেছে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্ট ভোগ করেছে লিভার নিয়ে। প্রায়ই হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। সব মিলিয়ে ২০০৭-এর পর থেকেই যাকে বলে যমে-মানুষে টানাটানি। এর মধ্যে কোনও রকম পূর্বাভাস না দিয়ে ২০০৯ সালে বউদির মৃত্যু। এরপর ফোন করলেই বলত, ‘বিজন, আমি আর বাঁচতে চাই না। আর বাঁচব নারে।’ মানুষ যখন জীবনকে ভালবাসতে ভুলে যায় তখন তাকে জীবনে ফিরিয়ে আনা কষ্ট।
২০০৯ সাল ডিএসসি ডিফেন্ড করার পর মস্কোর বাংলাদেশী সমাজে আমার কদর কেমন করে যেন বেড়ে যায়। যদিও আমি নিজে কোনও রকম পরিবর্তন খুঁজে পাইনি, তবে বন্ধুরা কী যেন দেখতে পেয়েছিল। শুরু হল যোগাযোগ, ফোন নম্বর বিনিময়। কেউ কেউ সংগঠন করা যায় কিনা সেটা বলে। গুলিয়া তখন বাচ্চাদের নিয়ে মস্কো চলে এসেছে, তাই সংগঠন মানে মস্কো আসার অজুহাত। আমিও যেন হাতে চাঁদ পেলাম। ২০১০ সালে পালন করলাম বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। সাড়া পেলাম অভাবনীয়। শুরু হল বাংলাদেশ প্রবাসী পরিষদ, রাশিয়া গঠনের কাজ। তখন মস্কোয় বাংলাদেশ দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত আর মিনিস্টার দুজনেই আমাদের ভিপুস্কনিক, মানে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে পাশ করা। আমাকে বলা হল আমাদের সংগঠন করার কথা তাঁদের জানাতে।
তোমরা যে সংগঠন করতে চাইছ এরা (মস্কোর বাঙালি সমাজের কিছু হোমরাচোমরাদের নাম বললেন) এটা করতে দেবে।
আমরা জনা দশেক মানুষ এক হয়েছি সংগঠন করব বলে। আমাদের ঘোষণাপত্র থাকবে বাহাত্তরের সংবিধানের প্রতি আনুগত্য রেখে। যদি কেউ আমাদের সঙ্গে আসতে চায়, ওয়েলকাম। আমরা কারও বিরুদ্ধে কিছু করছি না। শুধু নিজেদের স্বপ্নের কথা বলার জন্য একটা সামাজিক ফোরাম তৈরি করছি।
এরপর শুরু হল রাজনীতি। দূতাবাস থেকে চাইল আমরা যেন ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ করি। রাষ্ট্রদূত ফোন করলে বললাম, ‘আজ আপনারা ক্ষমতায় তাই বঙ্গবন্ধুর নাম লিখতে বলছেন। দুদিন পরে অন্যেরা ক্ষমতায় এসে যদি এ নাম সরাতে বলে বা অন্য নাম বসাতে বলে তখন আমরা কী করব?’ বোঝা গেল কথাটা তাঁদের মনঃপূত হয়নি। আমরাও সংগঠনের ঘোষণাপত্র আর গঠনতন্ত্র নিয়ে স্থবিরাবস্থায় পড়ে গেলাম। অনেকের মতে অন্য সংগঠনের কেউ আমাদের সংগঠনের কমিটিতে নির্বাচিত হতে পারবে না। আমার যুক্তি, ‘দেখো, আমাদের সংগঠনের যেকোনও সদস্যের সমান অধিকার থাকা উচিত, মানে যে কেউ যেকোনও পদে নির্বাচিত হতে পারে। কিন্তু একবার যদি কেউ নির্বাচিত হয় তখন বলতে পারো, এখন তোমার দায়িত্ব অনেক বেশি, তাই তুমি অন্য সংগঠনের কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হতে পারবে না।’ কিন্তু এই সহজ কথাটা বোঝানোও সহজ হল না। মানুষ আসলে দল করার আগেই দলীয় আতর গায়ে মাখে। বড় বড় আদর্শের বুলি— এটা তোতা পাখির বুলি বই কিছু নয়। যাহোক ২০১০ সালের ৪ জুলাই প্রবাসী পরিষদ আত্মপ্রকাশ করল আর ওই বছর ২৪ ডিসেম্বর আমরা একটা কম্প্রমাইজে এসে সংগঠনের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র গ্রহণ করলাম। পরের দিন আমার আর শাহীনের জন্মদিন। তাই দুজনে চলে গেলাম ওর বাসায়।
সে সময় আমাদের মত সাধারণ চাকুরিজীবীদের পকেটে স্মার্টফোন আসেনি। ই-মেইল চেক করতে হয় ডেস্কটপ বা ল্যাপটপে। শাহীন আমাকে ওর ল্যাপটপ দিয়ে গেল রান্না করতে। দেখি তপনদার মেইল। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছে। বেশ বড় চিঠি। এক জায়গায় লিখেছে, সুধীরদা তো বছর পাঁচেক আগেই মারা গেছে। আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম, চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে এল। আবার যে চিঠিটা পড়ব সে শক্তি পর্যন্ত রইল না। পরের দিন ঘুম ভাঙতেই দিদিকে ফোন করলাম।
আচ্ছা, সুধীরদা পাঁচ বছর আগে মারা গেছে সেটা বলিসনি কেন?
তোকে এ কথা কে বলল। তুই না সেদিনও ওর সাথে কথা বললি।
তোরা কাউকে দিয়ে সুধীরদার গলায় কথা বলিয়েছিস।
ছোটবেলায় আমার প্রায়ই মনে হত মা বোয়াল মাছ বা অন্য মাছ কেটে রুই বা কই মাছ বানিয়ে আমাকে খেতে দেন। এখনও সেটাই মনে হল।
ভাই, তুই আমার কথা বিশ্বাস করছিস না কেন? কথা বলবি। দাদা তো বাড়িতেই।
না।
অনেকক্ষণ থ হয়ে বসে রইলাম। তারপর এক সময় চিঠিটা আবার পড়লাম। ওখানে লেখা ছিল সুনীলদার মৃত্যুর কথা। কমরেড সুনীল রায়। উনি আমাদের বাড়িতে আসতেন। মনে হয় কোনও একসময় আমি নিজেই সুনীলদার কথা জানতে চাইছিলাম। তপনদা সেই প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছে। আর আমি ভুল করে সুনীলদার পরিবর্তে সুধীরদা পড়ে তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়েছি। সে রাতে মস্কোয় বরফবৃষ্টি হয়েছে। শাহীনের গাড়ির কাচ আইস মানে বরফে ঢাকা। অনেক কষ্ট করে কাচ পরিষ্কার করা গেল। শাহীন আমাকে আকাদেমিচেস্কায়ায় বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি একটা কেক কিনে গেলাম বাচ্চাদের সঙ্গে দেখা করতে।
যতদূর শুনেছি পরের দিকে সুধীরদা রাজনীতি করত, রাজনীতি মানে আওয়ামী লীগ। করত সক্রিয়ভাবেই। শুনেছি একবার যখন শেখ হাসিনা তরা হয়ে ঢাকায় যান, সুধীরদা তাঁকে নেমে জনগণের সঙ্গে কথা বলতে অনুরোধ করে। উনি রাজি হননি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সুধীরদা নাকি মুখের ওপর বলে দেন, যদি সাধারণ মানুষের সাথে নেমে কথা না বলতে পারেন আপনি আবার কীসের নেত্রী। সত্যমিথ্যা বলতে পারব না, তবে আমাদের বাড়ির কেউই এরকমভাবে কারও মুখের ওপর নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করে না। সুধীরদা সব সময়ই ছাত্রদের প্রিয় ছিল। ও নিজে যেমন ছাত্রদের ভালবাসত, ছাত্ররাও একইভাবে ওকে ভালবাসত, শ্রদ্ধা করত। ২০০২ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সারা দেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হয়। একদিন বিএনপি, জামাতের এরকম একটা দল মিছিল করে আসছিল তরা গ্রামের হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করার জন্য। ওই মিছিল থেকে এক ছাত্র দৌড়ে আসে আমাদের বাড়ি তার সুধীর স্যারকে সতর্ক করে দিতে। আর সঙ্গে সঙ্গে মজনু ভাইরা এসে বাড়ির সবাইকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যায়। এটা কি সাফল্য না ব্যর্থতা? একদিকে ছাত্রের ভালবাসা সুধীরদাকে আক্রমণের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। অন্য দিকে যে মানুষ জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে তাঁর ছাত্রদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছে, তাদের ভালবেসেছে, সেই ছাত্রদের একজন যদি ধর্মীয় উন্মাদনার শিকার হয়ে অন্য ধর্মের মানুষদের আক্রমণ করে সেটাও তো ওই শিক্ষকেরই ব্যর্থতা। শিক্ষক তো শুধু অংক বা কোনও বিশেষ বিষয় শেখান না, ছাত্রদের সবার আগে মানুষ হতে শেখান।
সত্তরের দশকে আর আশির দশকের শুরুর দিকে পড়াশুনা ছাড়া আমার জীবনে সুধীরদার উপস্থিতি তেমন অনুভব করেছি বলে মনে হয় না। আসলে ও আমাদের বিভিন্ন রকম বই পড়তে দিত ঠিকই কিন্তু আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনে কখনও অংশগ্রহণ করত না। আমাদের বাড়িতে পাকিস্তান আমল থেকেই আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন ছিল, তবে কেউ সক্রিয় রাজনীতি করত না। তপনদা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িত থাকলে থাকতেও পারত, তবে বাড়িতে এ নিয়ে কখনওই কথাবার্তা বলত না। হয়তো সবাই তখন স্বপনদাকে নিয়ে চিন্তিত ছিল বলে। বড়দা বছরের ৯ মাস বাড়ির বাইরে থাকত। আগে নিজে যাত্রাদলে অভিনয় করত আর ১৯৬৯ সাল থেকে নিজেই অম্বিকা নাট্য প্রতিষ্ঠান নামে এক যাত্রার দল তৈরি করে। বড়দার উদ্যোগে আমি ১ কাঁচাটাকা দিয়ে মালিকদের একজন হতাম সেই দলের। বড়দা যখন বাইরে থাকত আমি থাকতাম তপনদার তত্ত্বাবধানে। ওর সঙ্গেই খেতাম এক থালায়। ১৯৮০-১৯৮২ সালে আমি যখন কলেজে পড়ি একদিন কে যেন খবর দিল তপনদা অপেক্ষা করছে যতীন ঘোষের মিষ্টির দোকানে। গেলে ও আমাকে আজাহার ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে চলে গেল। এটা করেছে মনে হয় আমার ওপর কোনও রকম চাপ সৃষ্টি না করার জন্য। ক’দিন পরে কলেজে নির্বাচন। আজাহার ভাই বললেন ছাত্র ইউনিয়ন থেকে এজিএস পদে ইলেকশন করতে। ওই সময় দেবেশ নামে আমাদের এক ক্লাসমেট যে ছাত্র লীগ থেকে এজিএস পদে ইলেকশন করেছিল, বলেই বসল, ‘বিজনদা যেদিন রাজনীতি করবে সেদিন সূর্য পশ্চিম দিকে উঠবে।’ আমি রাজনীতিসচেতন ছিলাম, রেগুলার এ নিয়ে পড়াশুনা করতাম, সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনীতির বিষয়ে আগ্রহী ছিলাম কিন্তু সরাসরি রাজনীতি করার ইচ্ছে কখনওই ছিল না। আমার মনে হয়েছে ভাল বিশেষজ্ঞ হয়েই দেশের সেবা করা যায়। আজাহার ভাইকে আমি বললাম ভেবে দেখব। তারা যেন আমাকে ছাত্র ইউনিয়ন সম্পর্কে লিটেরেচার দেন পড়তে। পরে তুলু ভাই, লতিফ ভাই, দুলালদা, পরেশদা সহ অনেকেই আমাদের বাড়ি এলেন। অনেক কথা হল। কিন্তু আমার প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পেলাম না। ঠিক হল আমি ছাত্র ইউনিয়নের মেম্বারশিপ নেব না, তবে ইলেকশন করব। যদি একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তর পাই, যোগ দেব। এরপর ইলেকশন করলাম। তবে সেই ইলেকশনের অভিজ্ঞতা খুব একটা ভাল ছিল না। ওরা নিজেরাই আমার নির্বাচনী পোস্টার ছাপাল। তাতে লিখল যে আমি পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি আর এসএসসি-তে স্টার পেয়েছি। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পাবার ব্যাপারটা ছিল মিথ্যে। আরও একটা ব্যাপার হল নির্বাচনের আগে আগে। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে স্কলারশিপ দেবার ব্যাপারে কলেজে ঘোষণা করা হল। ব্যাপারটা দাঁড়াল আমি যেন স্কলারশিপের জন্য নির্বাচন করছি। আমার বিশ্বাস আমি নিজের রেজাল্ট দিয়েই সেটা করতে পারতাম। এ ধরনের কাজকর্ম আমাকে ব্যথিত করেছিল। আমার কলেজজীবন নিয়ে পরে কখনও লিখব। ধীরে ধীরে জড়িত হলাম খেলাঘরের সঙ্গে। গ্রামে খেলাঘর আসর করলাম। রতন শুরু করল খেলাঘর আর উদীচী করা। এককথায় আমাদের ঘরে বাম রাজনীতি ঢুকল। ঢাকা থেকে সুনীলদা, লেনিন ভাই, মানিকগঞ্জের আজাহার ভাই, হজরত ভাই, প্রমথদা সহ বাম ঘরানার রাজনীতিবিদদের জন্যে বাড়ির দ্বার খুলে গেল। সুধীরদা ছিল তখন ড. কামাল হোসেনের অনুসারী। ফলে তপনদা বা রতন যেখানে শুধু ভাই নয় কমরেড হল, সুধীরদা শুধু দাদাই রয়ে গেল। এরপর মস্কো এলাম। এর আগে আমি অবশ্য বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলাম। এরশাদের দমননীতির ফলে ক্লাস শুরু হয়েছিল অনেক পরে। একদিন ফিজিক্স ক্লাসে টিচারকে একটা প্রশ্ন করায় বললেন, ‘ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য এসব না জানলেও চলবে।’ তখনই ঠিক করেছিলাম যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন যাওয়া নাও হয়, পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় ভর্তি হব। মস্কো আসার পরে যখন সাবজেক্ট চেঞ্জ করি বাবা নিজে কিছু না বললেও সঞ্জীব স্যারসহ অনেককে দিয়েই বলানোর চেষ্টা করেছেন বিষয় না বদলাতে। তবে সুধীরদা আমার পদার্থবিদ্যা পড়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।
সত্তর আর আশির দশকে বিদেশ যাওয়া আজকালের মত ডাল-ভাত ছিল না। তখনও মধ্যপ্রাচ্যে এত লোক যেতে শুরু করেনি। আমাদের এলাকা থেকে হাতেগোনা কিছু লোক বিদেশে পড়াশুনা করত। তবে এরপরে আমাদের স্কুলের অনেকেই বাইরে যায় বৃত্তি নিয়ে। বর্তমানে প্রায় সব বাবা-মাই চান ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশুনা করুক, সেখানেই সংসার পেতে বসুক। এই সূত্র ধরে অনেকেই বাইরে থেকে যায়, পেছনে রেখে যায় বৃদ্ধ বাবা-মাকে। যে বাবা-মার ইচ্ছাপূরণের জন্য সন্তান দেশছাড়া হয় তাকেই আবার অকৃতজ্ঞ বলে অভিযুক্ত হতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে ভ্রমর বিয়ে বসে, ওরা দুজন দেশেই অনেকদিন চাকরি করে আর এক সময় অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। সুধীরদা মনে হয় এটা ঠিক মেনে নিতে পারেনি। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বেড়াতে যায়নি। তখন থেকেই শুরু হয় এক ধরনের ডিপ্রেশন।
ইতিমধ্যে আমাদের আগের জেনারেশনের সবাই বিদায় নিয়েছেন। আমাদের জেনারেশনের বড়দি আর ভাগুদাও চলে গেছে। কিছুদিন আগে রঞ্জিতদা মারা গেল। রঞ্জিতদাও ছিল সুধীরদার মতই— সব হৈহুল্লোড় থেকে দূরে। ও-ও ফুটবল বা ভলিবল খেলত না। নাম ছিল ম্যারা বাবু। এমনকি বিয়ের পরেও বসে থাকত কখন মেজমা মুখে ভাত তুলে দেবে। বিএ পাস করে একটা স্কুলে পড়াত। তিন কন্যার জনক। তারপর অসুখ, অনেক দিন বাড়ি আর হাসপাতাল। আমাদের বাড়ি বরাবরই অনেক কুকুর ছিল, তবে যতদিন কুকুর ছোট ছিল আমরা সবাই ওদের আদর করতাম, এরপর ওরা হয়ে যেত বেওয়ারিশ। বাড়িতে খেত, ঘুমুত, রাতে কেউ গেলে ঘেউ ঘেউ করত, তবে যাকে বলা হয় অস্পৃশ্য ছিল। একমাত্র রঞ্জিতদাই ওদের সঙ্গে একটু খেলাধুলা করত, গায়ে হাত বুলিয়ে দিত। সেই রঞ্জিতদা অসুস্থ। একদিন বাড়ি থেকে ফোন এল।
রঞ্জিতদাকে বাড়ি নিয়ে এলাম, ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছে। কে জানে আর কতক্ষণ বাঁচবে। কথা বল।
কীরে রঞ্জিতদা, কী খবর? শরীর এখন কেমন?
তোর সাথে আর দেখা হল না। আর হয়তো বাঁচব না। মেয়েরা রইল, সবাই ওদের দেখে রাখিস।
২০০৮ সালে রঞ্জিতদা চলে গেল। বড়দি আর ভাগুদা মারা গেছে কোলকাতায়। রঞ্জিতদা ছিল বাড়ির ছেলে। ও, তপনদা আর বউদি পাশাপাশি বয়সের। আমাদের ছোটবেলা কেটেছে একসঙ্গে গানবাজনা করে। দিদি, রতন আর এক সময় আমি গান শিখতাম, রঞ্জিতদা, কল্যাণদা আর আমি তবলা শিখতাম। একসঙ্গে সকাল বিকাল চা খাওয়া, গল্প করা। রঞ্জিতদা রসিয়ে রসিয়ে গল্প করতে পারত। আজ ও চলে গেল। সবাই নতুন করে বুঝতে পারল এবার আমাদের জেনারেশনের চলে যাবার সময় এসেছে। কতই বা বয়স ছিল ওর তখন? ৫৫?
বউদি অস্ট্রেলিয়া যায় ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরে ইশানের জন্মের পর পর। সুধীরদারও যাবার কথা ছিল। গেল না। বউদির সঙ্গে প্রায়ই ফোনে অনেক কথা হত। ওই সময় সুধীরদা গেলে অনেক কথাই বলা যেত। আমি ডিএসসি ডিফেন্ড করলাম ২০০৯ সালের ৬ অক্টোবর। দাদা-বউদি সহ বাড়ির সবাই খুশি। অনেক বার বলেছে দেশে ঘুরে যেতে, কিন্তু বিভিন্ন কারণে হয়ে ওঠেনি। ২০০৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর বউদি চলে গেলে অপ্রত্যাশিতভাবে। মনে নেই সেই সময় কেউ ফোন করেছিল নাকি পরবর্তীতে দিদি হাজার বার বলেছিল সেদিনের ঘটনা, মনে হয় সব যেন চাক্ষুষ দেখা। প্রতিদিন সকালে দিদি আর বউদি একসঙ্গে বেরিয়ে যায় চাকরিতে। বউদি জাবরা গার্লস স্কুলে আর দিদি উথুলী গার্লস স্কুলে। দিদি ক্লাস নিচ্ছিল। হঠাৎ ফোন এল জাবরা থেকে, দিদি, বউদির রক্তবমি হচ্ছে। তাকে নিয়ে আমরা মানিকগঞ্জ হাসপাতালে যাচ্ছি। আপনি চলে আসেন।
সুধীরদা বাড়িতে অসুস্থ। রতন ঢাকা গেছে বিটিভির অডিশনে। এর মধ্যে অনেকেই খবর পেয়ে চলে এসেছে মানিকগঞ্জ। যেহেতু রক্তবমি হয়েছে তাই মূল সন্দেহ পাকস্থলির ওপর। এক পর্যায়ে তারা রোগীকে ঢাকা নিয়ে যেতে বলে। পপুলারে (?) নিয়ে যাওয়া হয়। দুদিন যমে-মানুষে টানাটানি। বানের জলের মত টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কেউই স্ট্রোক যে করতে পারে সেটা ভাবছে না। সঠিক ডায়াগনোসিসের অভাবে কত রোগী যে অকালে প্রাণ হারায়। এ ঘটনা যেন বাড়ির ভিত্তি নাড়িয়ে দিল। সবাই চিন্তিত ছিল সুধীরদাকে নিয়ে আর সেখানে এভাবে বউদি চলে গেল। কীভাবে দাদাকে জানানো হবে বৌদির মৃত্যুসংবাদ? বিশেষ করে ওর শরীরের যে অবস্থা। দিদি ফোন করে যতটুকু না কথা বলে তার চেয়ে বেশি কাঁদে।
দিদি, দেখ তো গত ২০ বছরে বাড়ির মৃত্যুগুলোর কথা স্মরণ করে। জ্যাঠামশাই, বাবা, কাকা, মা, খুড়িমা, বড়মা, জেঠিমা, মেজমা, বড়দি, ভাগুদা, রঞ্জিতদা সবাই অসুখে কীরকম কষ্ট করে মারা গেছে? বউদি তো বলতে গেলে কোনও কষ্টই করেনি। এখন কী করবি। যদি এ অবস্থায় ঘরে পড়ে থাকত ব্যাপারটা কি ভাল হত।
জানি এভাবে বলতে নেই, তবে মাঝেমধ্যে কঠিন হলেও অনেক সত্য কথা বলতে হয়। সুধীরদা বউদির মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না। আমি ফোন করি।
বিজন, এ কী হল? আমি আর বাঁচব না। বাঁচতে চাই না।
মরে যাওয়া তো অপশন হল না। ভ্রমর আছে। ওর ছেলে আছে। বউদি তোমাকে বাঁচানোর জন্য কী না করল। আর তুমি এখন বলছ বাঁচতে চাও না, এটা কোনও কথা হল?
তুই কবে আসবি?
এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। সময়, সুযোগ, সামর্থ্য— কোনওটাই নেই।
চাইলেই তো আসা যায় না। দেখি চেষ্টা করব।
পরবর্তী একটা বছর সুধীরদা হাসপাতাল আর বাড়ি করে কাটাল। এই ভাল তো এই খারাপ। মনে হয় ওই সময় যদি আবার ছাত্রদের কাছে ফিরে যেতে পারত তাহলে মানসিক কষ্টটা কিছুটা হলেও ভুলে থাকতে পারত। মানিকগঞ্জে একটা ঘরও রাখা ছিল। কিন্তু শারীরিক বা মানসিক কোনওভাবেই ও এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। এ যেন বসে বসে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা। আশ্চর্যের ব্যাপার হল বাবা-মাকেও দেখেছি পরস্পরের ওপর প্রচণ্ড নির্ভরশীল। একই ঘটনা ভাইদের ক্ষেত্রে। যদিও বাবা, সুবোধদা, সুধীরদা এমনকি মনে হয় স্বপনদা নিজেও রান্নাবান্না সহ বিভিন্ন কাজে বউদের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল, তপনদা থেকে শুরু করে আমি পর্যন্ত সবাই এসব ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রায় সবই নিজেরা করতে পারি, করি। তারপরেও পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, ভালবাসার অভাব নেই। একসময় আমার মনে হত শুধুমাত্র পারিবারিক ট্র্যাডিশনের জন্যেই সংসারজীবনে আমি সুখী হতে বাধ্য। আমার সঙ্গে মাঝে গুলিয়ার যে সমস্যা তৈরি হয়েছিল তার একটা অন্যতম কারণ ছিল আমার এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস।
সুধীরদা মারা গেল ২০১১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। রঞ্জিতদাকে দিয়ে শুরু, তারপর দীর্ঘ দুই বছর মৃত্যুর মিছিল। একে একে চলে গেল তিন জন। এক কালে কোলাহলমুখর বাড়িতে ধীরে ধীরে নেমে এল কবরের স্তব্ধতা। সেই ১৯৯১ থেকে শুরু করে বাবা, মা, সুধীরদা— সবাই অনেক রোগে ভুগে হারিয়ে গেল। এদের দেখাশুনার মূল দায়িত্ব পড়েছে বউদি, দিদি আর রতনের কাঁধে। ক্রমাগত বিপর্যয় রতনকে সংসার গড়ে তুলতে দিচ্ছে না। শেষপর্যন্ত সুধীরদা যখন মারা গেল, রতন বিয়ে করল। আমাদের ভাইদের মধ্যে একমাত্র আরেঞ্জ ম্যারেজ। আসলে ওটা না করালে হয়তো ওর আর নিজের থেকে বিয়ে করা হয়েই উঠত না। সুধীরদা শেষের দিকে কী শারীরিকভাবে, কী মানসিকভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে মনে হত এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই অনেক ভাল।
সুধীরদা মারা যাবার পরে কয়েকবার দেশে যাই। দেখা হয় ওর অসংখ্য ছাত্রদের সঙ্গে। সবাই এখনও প্রচণ্ড শ্রদ্ধার সঙ্গে ওকে স্মরণ করে। ও যেমন গরিব ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছে, এমনকি নিজের পকেটের টাকায় বই কিনে অনেককে সাহায্য করেছে, ওর অনেক ছাত্রকেও দেখেছি অন্যদের পাশে দাঁড়াতে। ১৯৯২ সালে আমার ক্লাসমেট রানা আমেরিকা চলে যাবার সময় আমার কাছে কিছু বই রেখে যায়। এর একটা ছিল গীতা। ওখানে একটা শ্লোক আছে ‘ফলের চিন্তা না করে নিজের কাজ করে যাও’, যার পাশে রানা লিখেছিল ‘হাস্যকর’। তখন তেমন বুঝতাম না, পরে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে নিজের মত করে সেই শ্লোকের ব্যাখ্যা করেছি, ‘নিজের কাজকে উপভোগ করো, কাজের আনন্দে কাজ করো। যদি কাজ করে আনন্দ পাও ফল আসবেই।’ শুধু কি তাই, যদি সবাই নিজের নিজের কাজটা ঠিক মত করে তাহলে সমাজ এমনিতেই উন্নত হতে বাধ্য। এক সময় মনে হত ভাল কিছু করার জন্য সংগঠন বা সমষ্টির বিকল্প নেই, কিন্তু সুধীরদাকে দেখে বুঝলাম, যদি ইচ্ছে থাকে, চেষ্টা থাকে একাই সমাজটাকে অনেকটাই বদলে দেওয়া যায়। অন্তত অনেক ভাল মানুষ তৈরি করা যায় যারা তোমার পতাকা সামনে নিয়ে যাবে। আমরা অন্যান্য ভাইয়েরা, যারা সব সময় সামাজিক কাজকর্মে অগ্রণী ছিলাম, তারা সবাই মিলে যা করতে না পেরেছি, সুধীরদা শুধু ভালবেসে ছাত্র পড়িয়ে, তাদের মধ্যে বই পড়ার পোকা ঢুকিয়ে, নিজে উদাহরণ হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে কিছুটা হলেও নতুন মানুষ গড়তে সাহায্য করেছে। তার শত শত ছাত্রছাত্রীর সম্মিলিত শক্তি যেকোনও রাজনৈতিক শক্তির চেয়ে শক্তিশালী, কেননা তারা অন্যদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় কোনও কিছু প্রত্যাশা না করে। হ্যাঁ, আমি নিজেও অনেকদিন থেকেই এভাবেই ভাবতে শুরু করি। তবে সুধীরদা মারা যাবার পরে বুঝতে পারলাম আমার জীবনে ওর প্রভাব কত। আমার বিশ্বাস ওর প্রভাব শুধু আমার জীবনেই নয় ওর ছাত্রদের অনেকের জীবনেও বেশ তীব্র। একজন শিক্ষক এর চেয়ে আর বেশি কীই বা আশা করতে পারে!
জানি না বাবা অন্যদের বলতেন কি না, তবে আমাকে সব সময়ই বলতেন বিবেকের কাছে সৎ থাকতে। বলতেন এমন কাজ কোরো না যাতে পরে নিজের কাছে নিজেকে লজ্জিত হতে হয়। কেননা অন্যকে ফাঁকি দেওয়া যায় কিন্তু নিজেকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। সুধীরদাকে দেখে মনে হয় বাবার বলা এ কথাটা ও জানত আর নিজের কাজটা অত্যন্ত সততার সঙ্গেই করত। নিজের কাছে সৎ না থাকলে এত মানুষের কাছে সৎ থাকা যায় না, এত মানুষের ভালবাসা পাওয়া যায় না।
এটা লিখেছিলাম ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। ইতিমধ্যেই অনেক জল বয়ে গেছে ভোলগা দিয়ে। দিদি মারা গেছে। ও বেঁচে থাকলে ঠিক ফোন করত, বলত সুধীরদার কথা, ওর শ্মশানে বাতি দেবার কথা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়, হারিয়ে যায় মানুষ, কিন্তু স্মৃতি ঠিকই ফিরে ফিরে আসে।
দুবনা, ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
চিত্র: লেখক
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ২
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৩
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৪
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৫
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৬
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৭
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৮
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৯
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১০
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১১
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১২
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৩
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৪
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৫
রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৭