অনেকেই কোনও খবর রাখিনি, আমরা এখন এক গুরুত্বপূর্ণ পক্ষকাল পালন করছি। জাতীয় চক্ষুদান পক্ষ, ২৫-এ আগস্ট থেকে ৮-ই সেপ্টেম্বর; ভারতে এই পনেরো দিন দেশবাসীকে চক্ষুদানের ব্যাপারে খবরাখবর পৌঁছে দিতে, জনসচেতনতা প্রসারে ও চক্ষুদানের অঙ্গীকারে নানা কাজকর্ম হয়ে থাকে। ডা. আর ই এস মুথাইয়া ১৯৪৮-এ চেন্নাইতে প্রথম কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করেন। তাঁর উদ্যোগেই চেন্নাই রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ অফথ্যালমোলজি-তে ভারতের প্রথম আই ব্যাঙ্ক গড়ে ওঠে। তাহলে আমরা এবছর সেই উদ্যোগের পঁচাত্তর বছরে পদার্পণ করেছি। এমন এক গুরুত্বপূর্ণ পক্ষকালে ভারতের দৃষ্টিহীন মানুষ, চক্ষুদান ও কর্নিয়া প্রতিস্থাপন কোনখানে দাঁড়িয়ে দেখে নেওয়া যাক।
National Programme for Control of Blindness (NPCB)-এর ২০২০-র হিসেবে নানান বয়স মিলিয়ে ভারতে প্রায় ৪.৮ কোটি দৃষ্টিহীন মানুষ রয়েছেন। এর মধ্যে দুটি চোখেরই কর্নিয়ার কারণে অন্ধত্ব ৭.৪ শতাংশের। আশার কথা, গত দশ বছরে এর প্রায় ৫০ শতাংশ দৃষ্টিহীন মানুষের সংখ্যা কমেছে। যাই হোক, এখনও ভারতে কমবেশি ৬৮ লক্ষ মানুষ শুধুমাত্র কর্নিয়ার অসুস্থতার কারণে দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতায় জীবন কাটাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে ৪০ লক্ষ মানুষের দুই চোখের কর্নিয়াই বিপন্ন। এ দেশে বছরে এক লক্ষ কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হলেও কুল্লে ২৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়। আবার পরবর্তী বছরে নতুন কর্নিয়া-জনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে প্রায় ২০,০০০। তা আই ব্যাঙ্ক এবং চক্ষুদানের উদ্যোগকে এক বড় চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
চক্ষুদান নিয়ে মানুষের মনের মধ্যে জমাট বেঁধে আছে নানা ভীতি, অন্ধসংস্কার আর ভিত্তিহীন বিশ্বাস। অথচ চক্ষুদান মানে মোটেই শবদেহের কোনও বিকৃতি দেখা যাবে না; পরজন্ম যদি থেকেও থাকে তবে অন্ধ হয়ে জন্মানোর অভিশাপ নিতান্তই কষ্টকল্পনা। কোনও ধর্মগ্রন্থেই মরণোত্তর চক্ষুদানে কোনও আপত্তির কথা বা কারণ লেখা নেই। তবু মানুষের মনে কোথায় যেন একটা জড়তা চেপে বসে আছে। প্রয়াত প্রিয়জনের চোখদুটি যদি দৃষ্টিহীন গ্রাহকের চোখে প্রতিস্থাপন করা হয়, তবে সেই মানুষটি তো আরও কতদিন এই সুন্দর পৃথিবীর আলো, রং, রূপ দেখতে থাকবেন। এ তো একরকম মরণোত্তর জীবন বলা চলে। অনেক ক্ষেত্রেই যদি বা কোনও মানুষ তাঁর চক্ষুদুটি লিখিতভাবে দান করেও যান, দেখা যায় মৃত্যুর পর আত্মীয়-স্বজনের নানান ওজর-আপত্তিতে মৃতের নিকট আত্মীয়েরা পিছিয়ে যান। তাই জাতীয় চক্ষুদান পক্ষটিতে আমাদের বিদ্যালয় স্তর থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কাছে অবধি সচেতনতার বার্তা নিয়ে পৌঁছতে হবে।
এখন দেখা যাক, কর্নিয়া বলতে আমরা কী বুঝব। চোখের ওপরে পাতলা (৫০০ থেকে ৬০০ মাইক্রন) স্বচ্ছ আবরণীকলার নাম কর্নিয়া। পাঁচটি স্তর নিয়ে কর্নিয়া গঠিত। রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী এই পুরো স্তরগুলি অথবা উপরিস্তরটি মৃত মানুষটির চোখের ওপর থেকে মৃত্যুর ছয় ঘণ্টার মধ্যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। এই কর্নিয়া সংগ্রহের জন্য মৃত ব্যক্তির চোখে কোনও রকম বিকৃতি হয় না। চাইলে কৃত্রিম স্বচ্ছ প্লাস্টিকের আবরণী দিয়ে চোখের উপরিতল ঢেকেও দেওয়া যেতে পারে। সংরক্ষিত সুস্থ কর্নিয়া পরে কোনও রোগীর অসুস্থ কর্নিয়া সরিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয় (কেরাটোপ্লাস্টি)। কর্নিয়ার রোগে রোগী কিছুই স্পষ্ট দেখতে পারেন না; সব কিছুই ঘোলাটে অস্বচ্ছ লাগে, কেননা চোখের রেটিনাতে স্পষ্ট ছবি তৈরিতে আলোকে লেন্সের ভিতর দিয়ে সঠিকভাবে প্রতিসরণের মুখ্য দায়িত্ব এই কর্নিয়ার। তাই মৃত্যুর পর চোখদুটি পুড়িয়ে দিয়ে, বা মাটির নিচে চাপা দিয়ে, যদি নষ্ট না করে, দান করে দেন, তাহলে মৃত মানুষটির চোখ দিয়ে আরও দীর্ঘদিন একজন বা দুজন জীবিত মানুষ এই আলো আর রঙের দুনিয়ায় সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারবেন।
সারা দেশে Eye Bank Association of India (EBAI)-র অধীনে কমবেশি ৭৫০টি আই ব্যাঙ্ক ও চক্ষু সংরক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এগুলির মধ্যে ১৫টি আই ব্যাঙ্ক দেশের বার্ষিক কর্নিয়া সংগ্রহের অর্ধেক সংগ্রহ করে থাকে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বলছে, আমাদের রাজ্যে মোট দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের ৩.৫% থেকে ৪.২% মানুষ অসুস্থ কর্নিয়ার কারণে দৃষ্টিহীন। এখন এই রাজ্যে কর্নিয়া সংগ্রহ যথেষ্ট বেড়েছে; বিগত পনেরো বছরের সংগৃহীত কর্নিয়ার যথাযথ ও সফল ব্যবহার ২৬.৫% থেকে বেড়ে ৫৯% হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় সাফল্য। কলকাতার Regional Institute of Ophthalmology (RIO) জানাচ্ছে, ২০১৫ থেকে ২০১৮-র মধ্যে সংগৃহীত ৬৩৪৮টি কর্নিয়ার ২৬৫৭টির উপযুক্ত ব্যবহার সম্ভব হয়েছে। এই সংখ্যা আরও বাড়াতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
এ রাজ্যের ৩১টি আই ব্যাঙ্কের ৯টি আছে কলকাতায় আর বাকি সব জেলায় ছড়িয়ে। এছাড়াও রয়েছে কমবেশি ৪০টি চক্ষু সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কেন্দ্র। এখন দরকার চক্ষুদানের জন্য জনসচেতনতা প্রসারের কাজে সকলের অংশগ্রহণ; এগিয়ে এসে নিজে সপরিবারে চক্ষুদানের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে স্বজন-প্রতিবেশীকে উদ্বুদ্ধ করার কাজ ত্বরান্বিত করা। মনে রাখতে হবে চক্ষুদানে দাতা ও গ্রহীতার ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, জাতি কিছুই কোনও বাধা নয়; এমনকি রক্তের গ্রুপ নিয়েও কোনও বাছবিচার নেই। দরকার শুধু প্রয়াত মানুটির স্বজন-পরিজনের মুক্তমনের দরদী চিন্তার। তাহলেই আগামী দিনে এ দেশে সুস্থ চোখের মানুষ যথার্থই চক্ষুষ্মান হয়ে উঠবেন, এগিয়ে আসবেন দৃষ্টিহীন মানুষকে দৃষ্টিদানে।