১.
প্রতিটি দৃশ্য তার দর্শকের দিকে অপলক তাকিয়ে।
এ-কথা ভেবে ফের চাঁদ দেখি আমি।
খামারবাড়ির চাঁদ, খোলা মাঠের চাঁদ,
ফ্ল্যাটের বারান্দার জাফরিকাটা চাঁদ— এক হয় নাকি?
তুমি খুব হেসেছিলে এইটুকু শুনেই, তখনই
হ্যারিকেন ঘিরে থাকা অন্ধকার কেঁপে ওঠে
কেঁপে ওঠে তার শিখা,
কেঁপে ওঠেন চেপে বন্ধ কলঘরের দরজার ওপাশে
স্নানরতা বৃদ্ধা মা তোমার
“মেয়েকে উদ্ধার করো, হে বড়ঠাকুর”
সন্ধ্যা দেখানোর সময় বিড়বিড় করেন তিনি
যদিও তুমি এসব কিছুই জানো না
গালে ঠোনা মেরে, সোনা ডেকে
আদর রেখেছ তখন খুলে।
২.
কী অদ্ভুত দেখো, দেবী, তুমি হাঁ করলে আমার এই অনৃত বিশ্ব
দর্শন হয়, যেন সব পুরাণ কাব্য উল্টে দিয়ে, হেলায় মাড়িয়ে
ছুটে আসছে ঘোর-কৃষ্ণ লোকোমোটিভ
জিভে জেগে ওঠে সাপ-জন্মের স্মৃতি
পাপ নিয়ে আজকাল তেমন কিছুই ভাবি না
যা হওয়ার হবে, চিত্রগুপ্ত বুঝে নেবে চুকেবুকে গেলে
অতএব আরও হাজার জন্ম নিতে রাজি আছি আমি
যদি তোমার স্তন থেকে খসে পড়া জোনাকির আলোয়
কাটাতে পারি আস্ত আস্ত রাত…
যদি তুমি জাগাও বরাভয় মুদ্রায়, প্রসন্ন হাসি আঁকা ঠোঁটে
কাঙাল ও বাচাল হতে রাজি আছি আরও অনেকবার
যদি প্রেম দাও।
৩.
সন্তানবতী রাত ক্রমশ চাঁদ ও নক্ষত্রের জন্ম দেয়
আমি স্থবির দর্শক, দেখি এইসব আর একে একে
খুলে দিই সকল নিদ্রাকপাট
হুড়মুড় ঢুকে পড়ে হাসনুহানা,
. নিরক্ষীয় বাতাস কাঁপায় ঢোঁড়াই খোলস…
কে নেবে আমাকে? কে ডাকবে ভাটার নদীতে কাদা খেলার জন্য?
শতকজোড়া এই নিঃসঙ্গতা আর তো সহ্য হয় না, বিবিজান
এসো আকাশগঙ্গার নিচে
জিনপরি পাঁজরে নিয়ে অপেক্ষায় আমি
এসো এই জাদুরাতে বাগানে আমার।
৪.
জিভ তো বার করেই রেখেছ, আর কী, দাও।
চাপিয়ে দাও বুকে আমার রক্তপদ, লালাভ চরণ
তোমার কী-ই বা আসে যায়
সংবিগ্ন ফুল ঠিক রেখে যাবে ভক্তদল
যাদের তুমি ভালইবাস অবরে-সবরে।
একটা অঞ্জলি কি আমারও পাওনা হয় না গো?
হলই না হয় ঘেঁটু, ভাঁটু কিংবা ধুতরো
ইগো-টিগো তো না হয় চুলোয় উঠেছে
সেই যেদিন শ্বাসে প্রশ্বাসে ঝড় ডেকে তুমি
সাত নাকি সত্তর নৌকা ডুবিয়ে হেসেছিলে খলখলে হাসি
সেই সেদিন থেকে ফ্রয়েড সায়েবের দাড়িও
ঢুকতে পায়নিকো এই তল্লাটে
তাই বলে এত হেলা? এতখানি এলেবেলে যাপন?
এত হেলাফেলার বস্তু আমি নই, বুঝলে তো
আমি শুভদীপ রায়চৌধুরী,
আমি রামপ্রসাদের সুরার পাত্র চুরি করে পালিয়ে এসেছি।
৫.
মানুষ দুরকমের হয়,
নদীর পাশে বসিয়ে দেখো
মানুষ দুরকমের হয়
কিছুজন উৎস ও মোহনার কথা বলে
বাকিকিছু প্রবাহ বিষয়ে উৎসাহী
৬.
এক-একটা দিন থাকে মন কাপ্তান হয়ে ঘোরে
কলার উঁচিয়ে শিস, ওলে ওলে গান মোড়ে মোড়ে
হাওয়া লেগেছে গো হাওয়া লেগেছে,
বুড়ি পিসিমা কান ঢালে লাজুক নববিবাহিতার
আমার তাতে কী আসে যায়? কিছুই না
আমি লক্কা পায়রা ওড়ানোর ছলে ছাদে যাব রোজ
কর্কশ শব্দ করে বুলেট ছোটাব বাড়ির নিচে
তোমার ওই স্সালা বুড়ো বাপ কদ্দিন আগলাবে?
হাজার বছর ধরে আমি ল্যাবিরিন্থে বারবার ঢুকি
দূরে কোথাও এই ধাঁধার গোলোকে
বসে আছে আততায়ী ষাঁড় যার নিশ্বাসে—
কুয়াশা হয়ে আসছে চারিপাশ জেনেও এগিয়ে যাই
কদ্দিন আগলাবে স্সালা ওই বুড়ো বাপ তোমার?
আমি ডায়েরি লিখি না, বইয়ের পাতায় শুকোই না পাইন পাতা
দার্জিলিংয়ে আমার চোদ্দপুরুষে কেউ কখনও যায়নি
কখনও তোমাকে আধভেজা, বাড়ি ফিরতে দেখে
“এমন দিনে তারে বলা যায়” গেয়ে তো উঠিনি
চিঠিতে আমার বানান ভুল হয়,
কী যেন নাম তোমার? ‘ণ’ নাকি ‘ন’ লেখো শেষটাতে?
৭.
উদাসীজন বসে চোখের ওপর
বিবাগীজন কাঁদে হৃদয় জুড়ে
পথিকজন ঝাঁপিয়ে পড়ে পায়
চালাকজন কল ও কাঠি নাড়ে
৮.
“যার যার যেখ্যানে বসার, সে সে সেখ্যানেই বসেছে তো?”
বুড়ো মাঝির প্রশ্নের ওপর সন্ধ্যা নামে যেই
উপবিষ্টজনের মুখে আততায়ী ঘনিয়ে আসে
কুয়াশা বন্যপ্রাণীর মত জলের সকাশে
নেমে আসে, পান করে, নদীর বর্তুল শরীর
মোহনাগভীর থেকে উঁকি দেয় ভিজে চাঁদ, মাঝি লণ্ঠন তুলে ধরে,
ওদিকে তামাকদেবতার থান, ওদিকে নিশান ওড়ে অরণ্যচূড়ে
অপূর্ব শব্দ চয়ন। খুব সুন্দর হয়েছে। শুভেচ্ছা।