Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

রাশিয়ার চিরকুট

পর্ব ৯

ঠিকানা

সোভিয়েত ইউনিয়নে আসার আগে পর্যন্ত আমার একটাই ঠিকানা ছিল—
পো. + গ্রাম: তরা, মানিকগঞ্জ, বাংলাদেশ।

আমি মস্কো আসি ১৯৮৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। সে বছর বাংলাদেশ থেকে গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরাই ছিলাম শেষ ব্যাচ। এয়ারপোর্টে বড় ভাইয়েরা নিতে এসেছিল। ওখান থেকে সোজা ৬ নম্বর ব্লকে। প্রস্তুতি পর্বের ছেলেরা তখন সেখানেই থাকত। যদিও রুমগুলো ছিল তিন জনের জন্য, থাকতাম আমরা চারজন করে। একজন সোভিয়েত আর তিন জন বিদেশি, সাধারণত বিভিন্ন দেশের ছেলেরা থাকত এক রুমে যাতে নিজেদের ভাষার পরিবর্তে রুশ ভাষার কথা বলার চেষ্টা করে। এটা যে কাজে দিত, সেটা নিজেদের দেখেই বুঝতে পারি।

৬ নম্বর ব্লকে আমি ছিলাম ৩৫৩ নম্বর ঘরে। আমার রুমমেট ছিল সোভিয়েত মালদাভিয়ার কিশিনেভের আন্দ্রেই, ছিল দিল্লির অরুণ, নেপালের বদ্রী। আমিই ছিলাম সব শেষে আসা। অরুণ আর আন্দ্রেই পড়বে ফিললজিতে, বদ্রী সাংবাদিকতায়। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এলেও ফিজিক্সে চলে যাব সেটা ছিল নিশ্চিত। বদ্রী এর আগে তাসখন্দে কমসমলের ট্রেনিংয়ে এসেছিল, রুশ ভাষা কিছুটা জানত, তাই কয়েকদিন পরেই প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে রুম ছেড়ে চলে যায়। তাই আমরা কিছু দিন তিন জনেই ছিলাম, যদিও পরে আমাদের রুমে প্রদীপ নামে সুরিনামের এক ছেলে আসে। শুধুমাত্র অরুণ ছাড়া আর কারও খবর জানি না। অরুণ এখন আমার মতই মস্কোবাসী।

এই রুমটা আমি কখনওই ভালবাসতে পারিনি। আসার দুদিন পরেই যখন আন্দ্রেই একটা রুটিন তৈরি করে বলল কে কবে ঘর পরিষ্কার করবে, আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। এটা ছিল এক বিশাল মানসিক পরীক্ষা। তাছাড়া আমি এর আগে সারা জীবন বাড়িতে কাটিয়েছি। এমনকি বুয়েটে যখন পড়তাম, ক্লাস থেকে হলে ফেরার পথে মানিকগঞ্জগামী মিনিবাস দেখলে প্রায়ই উঠে পড়তাম, চলে যেতাম বাড়ি আর খুব ভোরে এসে ক্লাস করতাম বাড়ি থেকে। যদিও আমাদের ঘরটা ছিল বেশ ফিটফাট, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তবুও এই ঘরের ওপর আমার ছিল যত রাগ, যেন এই ৩৫৩ নম্বর ঘরটাই আমাকে ধরে রেখেছে মস্কোয়, ফিরে যেতে দিচ্ছে না প্রিয় গ্রাম তরায়।

প্রস্তুতি পর্ব শেষ হতে না হতেই আমি চলে যাই পাভলভস্কায়ায়। তখন ফিজিক্স, ম্যাথেমাটিক্স আর রসায়নের ছেলেরা সেখানে থাকত, আর থাকত কৃষিবিদ্যার ছেলেরা। আমি অনেক দিন পরে বাংলাদেশ থেকে গেছি ফিজিক্সে পড়তে, তাই ওখানে সমবয়েসি বাংলাদেশি আর ছিল না। কয়েকজন ছিলেন কৃষিবিদ্যায়, তবে অনেক বড়। তাই ওখানে থাকলেও আমি প্রায়ই চলে আসতাম মিকলুখো মাকলায়ায় বন্ধুদের কাছে। ওই জায়গাটা ভাল বা মন্দ লাগার আগেই আমাদের আবার ফিরিয়ে আনা হয় মিকলুখো মাকলায়ায় ২ নম্বর ব্লকে যেখানে ৫১০ নম্বর ঘরে আমি কাটাই ১৯৮৫-র ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৯৪-এর মে পর্যন্ত। বছর দুই পরে, মানে ১৯৮৭ সালে যখন রুমা-সুস্মি প্লেখানভে থাকতে শুরু করে আর আমি হই ওদের নিত্যদিনের অতিথি, তখন মনে হত বেশ হত যদি আগের মতই পাভলভস্কায়ায় থাকতাম! সব চেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, ঘরটার কথা মনে থাকলেও ঘরের নম্বরটা এখন মনে নেই। আমার ঘরের সামনেই ছিল টেবিল টেনিসের বোর্ড। আমি, রানা, পার্থ, সঞ্জয় মিনশে প্রায়ই খেলতাম। আর মাঝেমধ্যে রানা, পার্থ আর বিশ্বরূপদা গিটার বাজিয়ে গান করত—
উহুমনা উহুমনা উহুমনা বলে…

ওখানে থেকেই ফার্স্ট ইয়ারের ফার্স্ট সেমিস্টারের পরীক্ষা দেই। পড়াশুনা ভালই করতাম, তাই আশা ছিল এক্সিলেন্ট রেজাল্ট হবে। মেকানিক্সের পরীক্ষা দিতে গিয়ে ভিস্কোসিটি শব্দটা ভুলে গেলাম, যদিও আকারে ইঙ্গিতে সব বুঝিয়েছিলাম। টিচার ৪ বসানোর সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ল শব্দটা, কিন্তু উনি বললেন
—খুব দেরি হয়ে গেল।
বিকেলে কথায় কথায় বিশ্বরূপদাকে বললাম।
—যাকগে, আমি তো সাবজেক্টটা জানি।
—জানিস যদি তবে পাঁচ পেতে সমস্যা কোথায়?
এ কথাটা পরে অনেক কাজে লেগেছে।

২ নম্বর ব্লকে কাটে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টুকু। ওটা ছিল নিজেকে গড়ার সময়, ভাললাগার, ভালবাসার সময়। আজকের আমি, এটা ২ নম্বর ব্লকের ৫১০ নম্বর রুমের উত্তরসূরি। যদিও আমার পরে এক এক করে বেশ কিছু ছাত্র আসে দেশ থেকে আমাদের ফ্যাকাল্টিতে, তবে অন্য সব ফ্যাকাল্টির তুলনায় তা ছিল নগণ্য। এর অবশ্য একটা ভাল দিক ছিল। এর ফলে আমার চলাফেরা শুধু বাঙালি বা বাংলাদেশি আড্ডার মধ্যেই সীমিত ছিল না। ক্লাস শেষ লাইব্রেরিতে পড়াশুনা করে চলে যেতাম বাংলাদেশিদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। বাসায় ফিরে সেটা চলত রুশ বা অন্য বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে। ওই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে ভাল চা বা কফি খুব একটা পাওয়া যেত না। আমার জন্য সব সময়ই ভাল ইন্ডিয়ান চা আর কফি পাঠাত বাড়ি থেকে। ফলে আলেগ, আন্দ্রেই, ফিওদর, ইউরা, লেভ, রুস্তাম ওরা সন্ধ্যায় আসত আমার রুমমেট ইয়েভগেনির কাছে। চা খেতাম একসঙ্গে, গল্প হত বিভিন্ন রকমের। আলেগ আর আন্দ্রেই ছিল ইউক্রেন থেকে। আলেগ আমাদের চেয়ে বয়সে বেশ বড়। খুব ভাল ছেলে। ওকে ডাকতাম পল বলে। ও এক নাটকে পলের ভূমিকায় অভিনয় করে এই নাম পেয়েছিল। বেশ কয়েক বছর আগে ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল। অসুস্থ ছিল। এখন যুদ্ধ শুরু হলে চেষ্টা করেছি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। ফোন করেছি। পাইনি। লেভ ইয়েকাতেরিনবুরগ থেকে। তখন নাম ছিল সভেরদলভস্ক। অনেক খুঁজেও ওকে আর পাইনি ভার্সিটি লাইফের পরে। আন্দ্রেই মস্কোবাসী। ফোনে কথা হয়। ইউরার সঙ্গে দেখা হয় ইউনিভার্সিটির জন্মজয়ন্তীতে। ইয়েভগেনি আর আমি রেগুলার জন্মদিনে একে অন্যকে অভিনন্দন জানাই। এবার ওকে লিখেও উত্তর পাইনি। ফিওদরের খবর জানি না। রুস্তাম কাজানে। ওখানে আমি কনফারেন্সে গেলে যোগাযোগ করি, দেখা করি। যেহেতু আমাদের ২ নম্বর ব্লকে নিয়ে আসে মেরামতের পরে, তাই ইচ্ছেমত রুমমেট বেছে নেয়া যেত। পড়াশুনায় ভালো করতাম বলে ফ্যাকাল্টিতে নাম ছিল, সুযোগ-সুবিধাও ছিল। কিন্তু আমার কখনওই মনে হয়নি রুমমেট বেছে নিতে হবে। আমার মত ইয়েভগেনিও পড়ুয়া ছেলে। তাই ও যখন বলল একসঙ্গে থাকার জন্য, কোনও প্রশ্নই মনে জাগেনি। আমাদের সঙ্গে আরও এল রজার বলে মেক্সিকোর এক ছেলে। প্রথম দিনই নিজের ভুল বুঝলাম যখন রজার আলমারিতে তালা ঝুলাল। রুমে ফিরত রাত করে, এসেই শব্দ করে তালা খুলত। কয়েক বছর পরে ও অন্য রুমে চলে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত আমাদের মধ্য বন্ধুত্ব হয়নি। শুধু আমার সঙ্গে নয়, কারও সঙ্গেই ওর বন্ধুত্ব হয়নি। ও চলে গেলে আমাদের রুমে আসে তামিলনাড়ুর শ্রীকুমার। আমাদের মধ্যে ভাল বন্ধুত্ব থাকলেও কথা কম হত। ও রুমে ফিরত গভীর রাতে যখন আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম, আর আমরা যখন ক্লাসে যেতাম ও ঘুমুত। তাই দেখা হত মূলত রবিবার। আর আমরা যখন পরীক্ষা শেষ করে বেড়াতে যেতাম, ও ঘুরে ঘুরে পরীক্ষা দিত। তবে বাইরের পড়াশুনা প্রচুর করত। ছুটির সময়ে কুমার থাকলে আমি প্রায়ই ওকে নিয়ে সকালে দৌড়ুতে যেতাম আর যেতাম চার্চের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আর গভীর রাতে আরবাত স্ট্রিটে রক মিউজিক শুনতে। সেখান থেকে পুলিশ আমাদের চলে যেতে বলত আর যারা গাইত ওদের ভাগিয়ে দিত। এটাই ছিল সোভিয়েত জীবনে আরও একটা বাস্তবতা। ২ নম্বরে থাকার আর একটা সুবিধা হল চাইলেই আমি একা হয়ে যেতে পারতাম যেটা কিনা যে সব হোস্টেলে প্রচুর বাংলাদেশি থাকত সেখানে ছিল প্রায় অসম্ভব। পরে অবশ্য মাঝেমধ্যে আমার রুমেও আড্ডা হত, বিশেষ করে মে’ ডেতে, যখন মস্কোর সব বাংলাদেশি বন্ধুরা আসত আমার ওখানে। সবার কাছ থেকে ১ রুবল করে নিয়ে আমি রুটি-মাংস কিনে আনতাম, সঙ্গে থাকত পিভা। এই রুমে থেকেই আমি আমার মাস্টার্স শেষ করেছি, পিএইচ ডিও এই রুম থেকেই করা। মস্কোর শেষ দিন পর্যন্ত আমি এখানেই ছিলাম।

১৯৯৪ সালের ১৮ মে আমি জয়েন করি দুবনার জয়েন্ট ইনস্টিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চে। থেওরেটিক্যাল ল্যাবে। নতুন আবাস হয় সেখানে, যদিও মস্কোর একটা ফর্মাল ঠিকানা থেকেই যায় লেনিনস্কি প্রোসপেক্টের ৬৯ নম্বর বাড়ির ১০০ নম্বর ফ্ল্যাটে গুলিয়ার ওখানে ১৯৯৯ সালে রুশ নাগরিকত্ব পাবার পরে। তবে থাকা হয়নি। দুবনায় প্রথম দুবছর ছিলাম হোটেলে। ১৯৯৬ সালে ফ্যামিলি দুবনা এলে চলে যাই লেসনায়া ৫-এ।

লেসনায়া— এটা বনের ভেতর। চারিদিকে বড় বড় পাইন গাছের সারি। এখন আমি যে বনে প্রায়ই ঘুরতে যাই সেখানে। এখানে চার ফ্ল্যাটের কটেজ। দুটো ফ্ল্যাট আমাদের ইনস্টিটিউটের। সঙ্গে একটু জায়গা বাগান করার। বাসার চারিদিক ঘেরা। বেরুলেই বিভিন্ন রকমের বুনো ফুল আর ফল। আমি মনিকা আর আন্তনকে নিয়ে সেখানে বিভিন্ন ফল তুলতাম। তবে এতে বাধ সাধল আমার জার্মান প্রতিবেশী। সে তখন জার্মান ডায়াস্পরার প্রেসিডেন্ট। আমার স্ত্রী বাচ্চাদের নিয়ে গাছ লাগাতে গেলেই এই সমস্যা। পরে এটা নিয়ে আমার তখনকার বসের সঙ্গে সেই জার্মানের কথা কাটাকাটি। ওখানে ছিলাম দুই বছর। শান্তি ছিল না। সব সময় একটা ভয়, এই বুঝি আবার কিছু করল। কারণ সে উঠেপড়ে লেগেছে আমাদের বাসাছাড়া করতে। আমি গেছি সেখানে কাজ করতে। যে বাসা তারা দিয়েছে সেখানেই থাকি। কিন্তু আমার বস বেঁকে বসেছে দেখে নেবে বলে। ১৯৯৮ সালের ডিফল্টের পরে জার্মানদের ক্ষমতা বেড়ে যায়। আমার বস হাল ছেড়ে দেয়। আসলে তখন তাঁর নতুন ফিয়াসে। তাঁর চেয়ে ৩৫ বছরের ছোট। জার্মানের কারণে বলতে গেলে তাকে আল্টিমেটাম দেওয়া হয় হয় বিজন আমাদের ল্যাবে থাকবে নয়তো লেনা। আমি দেখলাম এখন আমারই উচিত সক্রিয়ভাবে সমস্যার সমাধান করা। একদিন আমাদের ডেপুটি ডাইরেক্টর ডাকলেন। বিশাল রুম। মনে হয় মিটার দশেক লম্বা। অন্য প্রান্তে বসে আছেন তিনি। রুমে ঢুকতেই বললেন,

‘আমাদের নতুন নিয়ম অনুযায়ী যেসব বিদেশি ১৯৯৬ সালের আগে কাজে জয়েন করেছে তাদের চুক্তি নবায়ন করা হবে না।’

আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম এই ক’বছর কাজ করার সুযোগ দেবার জন্য। বললাম, ঠিক আছে, তাহলে মস্কো চলে যাব। ওখানে কাজ খুঁজব। ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে আসছি। ঠিক যখন দরজা খুললাম, ওদিক থেকে শোনা গেল,

‘একটু অপেক্ষা করুন।’

ফিরে তাকালাম। উনি কাছে আসতে বলে বললেন,

‘শুনলাম প্রতিবেশীর সঙ্গে আপনার ঝামেলা। যদি মিটিয়ে ফেলেন তাহলে হয়তো কিছু একটা করা যাবে।’

‘আমি ঠিক জানি না কি ঝামেলা। সত্যি বলতে ওঁর সঙ্গে আমার কখনও কথা হয়নি। উনি কোনও অভিযোগও করেননি।’

‘তার পরেও দেখেন যদি সমস্যাটা মেটানো যায়।’

আমি বুঝলাম তারা চাইছে আমি নিজে থেকে যেন বাসা ছেড়ে চলে যাই। আমার হয়ে সেই জার্মানের সঙ্গে ঝগড়ার ইচ্ছে তাদের নেই।

‘দেখুন, আমি এসেছি কাজ করতে। যে বাসা দিয়েছে সেখানেই থাকছি। আমি নিজে কিছু বেছে নিইনি। যদি আপনারা অন্য কোনও বাসায় থাকতে দেন, সেখানেই যাব।’

‘ঠিক আছে, আপনি বাসার ব্যাপারে যিনি ডিল করেন তাঁর কাছে যান। আশা করি এই সমসায় আমরা সমাধান করতে পারব।’

ইন্টেরেস্টিং ব্যাপার হল সেই জার্মান ভদ্রলোক নাকি আমাদের বাসাছাড়া করেছিল তার বউয়ের কথায়। এর কিছুদিন পরে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সে তার বন্ধুর মাধ্যমে আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে। তবে তার প্রতি আমার আর কোনওই আগ্রহ ছিল না।

এটা ছিল ডিসেম্বরের শেষ। ১৯৯৮। ক্রিস্টিনার সবে জন্ম হয়েছে। এদেশের আইন অনুযায়ী, ওরা চাইলেই ছয় মাস আগে আমাদের ওখান থেকে সরাতে পারে না। তাই সাময়িকভাবে চুক্তি নবায়ন হল। মাস তিন-চারের মধ্যে ওরা আমাদের নতুন বাসা দেবে। নতুন বাসায় এলাম ১৯৯৯ সালের মে মাসে। তবে মাঝখান থেকে যেটা হল আমি ইতালির ৬ মাসের এক ট্রিপ মিস করলাম। সেখানে যাই ১৯৯৯ সালের জুলাইতে, চার মাসের জন্য। এসেই জয়েন করি নতুন ল্যাবে, ইনফরমেশন টেকনলজিতে।

১৯৯৯ থেকে থাকতে শুরু করি পন্তেকরভো ৫-এর ৫৬ নম্বর ফ্ল্যাটে। ২০০৯ সালে লেনিনস্কি প্রোসপেক্টের বাসা বিক্রি করলে ফর্মাল ঠিকানা হয় বলশায়া চেরেমুশকিনস্কায়ায় ১৮, ফ্ল্যাট ৬১। তবে ২০০৯ সালেই মেট্রো স্পোরতিভনায়ার পাশে দভাতরা রোডে একটা রুম কেনে গুলিয়া। কিছুদিন আগে বলশায়া চেরেমুশকিনস্কায়ার বাসা বিক্রি করলে আমার ঠিকানা আবার বদলিয়ে হয় দভাতরা ৯, ফ্ল্যাট ১৩। গত ডিসেম্বরে এই প্রথম যাই দভাতরার বাসায়, উদ্দেশ্য আইডিয়া নেয়া ওখান থেকে ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নিতে যেতে কতক্ষণ সময় লাগবে। দুবনা থেকে আসার পথে আন্তনকে ফোন করলাম, ও বাসায় কি না আর আমি স্পোরতিভনায়া এলে ও আমাকে মিট করতে পারবে কি না। ও বাসায়ই ছিল। আমাকে নিয়ে গেল। ঘরে ঢুকে আমার মনে হল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যেতে হবে। সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘরের যা তা অবস্থা। এক তলায় ঘর। অনেক পুরানো বাড়ি, জারের আমলের মনে হয় (আসলে ১৯২৯ সালের তৈরি, পরে দেখেছি)। গুলিয়া বলেছিল ঘরে কিছু জিনিসপত্র সরাতে, যাতে বলশায়া চেরেমুশকিনস্কায়া থেকে জিনিসপত্র এখানে আনতে পারি। আমি ফোন করে বললাম, আমি এখানে থাকছি না। এখুনি বেরুচ্ছি।

এই বাসায় যখন আর একটা রুম কেনে গুলিয়া বিভিন্ন যুক্তি দিত মেট্রোর সঙ্গেই বাসা, সেন্ট্রাল এরিয়ায়, তায় পলিক্লিনিক, হসপিটালসহ বিভিন্ন সুযোগসুবিধা অনেক। যেহেতু এই এলাকায় আমি এর আগে প্রচুর এসেছি, এখানে আমার বন্ধু দীপু পড়ত ফার্স্ট মেডিক্যালে, পাশেই আমার প্রিয় নভদেভিচি মনাস্তির, লুঝনিকি স্টেডিয়াম— তাই বাসা না দেখলেও আপত্তি করিনি। বাসায় ফিরলে গুলিয়া জিজ্ঞেস করল,
—কেমন দেখলে বাসা?
—এক টুকরো নরকের মত।
—কিন্তু চারিদিক স্বর্গের মত সুন্দর। একটু রিকনসট্র্যাকশন করলেই দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।
—আগে করো।

আমার সবচেয়ে খারাপ লাগছিলো মনিকা-ক্রিস্তিনা এখানে থাকবে বলে। তবে স্বর্গের ভেতর এক টুকরো নরক এ কথাটা যেন মনে গেঁথে রইল পরবর্তী কয়েকদিন। মনে পড়ল বিশাল উঁচু প্রাচীরের ভেতরে অট্টালিকায় বাস করা মানুষগুলোর কথা যারা দামি দামি গাড়িতে বাসায় ঢোকে আর বাসা থেকে বেরোয়, স্বর্গটা সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর ভয় পায় বাইরে বেরুতে পাছে নরকের দেখা মেলে। এরকম নিজ নিজ স্বর্গে বাস বর্তমান যুগের ফ্যাশন। তাই গুলিয়াকে বললাম,
—জানো, আমার কিন্তু এই নরকটাই ভাল লাগছে। চাবি তো আমাদের হাতেই। যখন খুশি স্বর্গে বেড়াতে যাব, আর স্বর্গসুখে ক্লান্তি এলে আমাদের নরকে ঢুকব। তাছাড়া হাল্কা চুনকাম করলে, দরজা বদলালে আমাদেরটাও দেখতে এক টুকরো স্বর্গ হয়ে যাবে।

হ্যাঁ তাই। নিজের ছোট্ট প্রাসাদে জীবন কাটালে দুদিন আগে হোক আর দুদিন পরে হোক, কুপমণ্ডক হয়ে যেতে হবে। এটা অনেকটা কচ্ছপের জীবনের মত। যেখানেই যাও নিজের ঘর সঙ্গে করে নিয়ে যাও, আর মাথা বের করলেই হাজারো বিপদের সম্মুখীন হও। তার চেয়ে অনেক ভাল যখন চারিদিকে মুক্ত আলো হাওয়া, পাখির ডাক, শিশুদের কোলাহল। আমার তো মনে হয় নরকবেষ্টিত স্বর্গের থেকে স্বর্গবেষ্টিত নরক অনেক ভাল। অংকও তাই বলে। গড়পড়তা হিসেব নিলে নরকবেষ্টিত স্বর্গের নরকত্ব যে হারে বাড়ে, ঠিক সে হারেই বাড়ে স্বর্গবেষ্টিত নরকের স্বর্গত্ব।

আমার বউ কিছু করে তারপর তার জন্য অজুহাত খোঁজে আর আমি সেটাকে খণ্ডন করি। এই প্রথম আমিও তার কাজের সপক্ষে যুক্তি খুঁজছি।

যখন থেকে আমি স্পোরতিভনায়া থেকে ক্লাস নিতে শুরু করলাম তখন থেকেই এর পজিটিভ দিকগুলো বুঝতে পারলেম। মেট্রোর সঙ্গে লাগানো বলে রাতবিরাতে বাসায় ফিরতে সমস্যা হয় না, বিশেষ করে ছেলেমেয়েরা বাইরে গেলে টেনশন অনুভব করি না। যেহেতু জায়গাগুলোর সঙ্গে অনেক স্মৃতি তাই যেকোনও মুহূর্তে পুরনো দিনে ফিরে যাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে মজার যে ব্যাপার তা হল সকাল। যদিও বাসা থেকে সেন্টার মাত্র দশ মিনিটের পথ (মেট্রোয় ক্রেমলিন পর্যন্ত যেতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট লাগে) আশেপাশে কোনও বড় রাস্তা না থাকায় রাতে গাড়িঘোড়ার শব্দ নেই। আগে প্রতিটি বাসাই ছিল মস্কোর ব্যস্ততম রাস্তাগুলোর উপরে, তাই কী দিন কী রাত— গাড়ির শব্দে কান ঝালাপালা। প্রথম দিন সকালে এখানে আমার ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। মনে পড়ে গেল গ্রামের বাড়ির কথা। একতলায় বাসা বলে পাখির কলরব একেবারে সেই গ্রামের অনুভূতি জাগিয়ে তুলছিল। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল আমি দেশে সারাজীবন একতলা বাড়িতে কাটিয়েছি, অথচ এখানে এক তলায় বাসা শুনে মনটা খারাপ হয়েছে। আগে দুবনা থেকে মস্কো গেলে গাড়ির শব্দে রাতে ঘুম হত না, এখন এখানে দুবনার চেয়েও ভাল ঘুম হয়। তাছাড়া মস্কো সেন্ট্রাল রেল তৈরি হবার পর যাতায়াত সহজ হয়ে গেছে। এখন মেট্রো স্পোরতিভনায়ার পাশাপাশি লুঝনিকি রেলস্টেশন যাতায়াত আরও সহজ করে দিয়েছে। ওদিকে চাইলে হাঁটতে হাঁটতেই ভার্সিটি পর্যন্ত চলে যাওয়া যায় মস্কো নদীর উপর দিয়ে। ফ্রুঞ্জেনস্কায়া বাসা থেকে মিনিট দশেকের হাঁটা পথ। বাড়ির চারিদিকে অসংখ্য পার্ক। সব মিলে এলাকাটাকে খুব ভালবেসে ফেলেছি। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, ছাত্রজীবন শেষ করে মস্কোর ঠিকানা বারবার বদলালেও আমি পারতপক্ষে সেখানে বাস করনি। হয় উইকএন্ড অথবা গণমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে শুরু করার পর মাঝেমধ্যে রাত কাটানো। সেই ১৯৯৪ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমার স্থায়ী নিবাস দুবনা, যদিও স্থায়ী ঠিকানা মস্কো। তবে ঘরবাড়ির চেয়ে ঠিকানা হিসেবে আমার সবচেয়ে ভাল লাগে ভোলগার তীর বা পাশের বন।
গল্প লিখতে গিয়ে আমার মনে পড়ল সোভিয়েত আমলের সেই জনপ্রিয় গান, ‘আমার ঠিকানা কোন বাড়ি বা রাস্তা নয় আমার ঠিকানা সোভিয়েত ইউনিয়ন।’

দুবনা, ০৭ মে ২০২২

চিত্র: লেখক

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ২

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৩

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৪

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৫

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৬

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৭

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৮

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১০

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১১

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১২

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৩

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৪

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »