Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

কারখানা বিরিয়ানি

আব্বাসকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি। ডাল ভাত ঢ্যাঁড়স ভাজা খাওয়া নিরামিষ বিকেলে জিভটাকে একটু উত্তেজিত করতে ইন্ডিয়া ফয়েলস কারখানাকে পেছনে রেখে ষষ্ঠীতলা হয়ে আব্বাসের রাইস প্লেট হোটেলের পাশ দিয়ে কামারহাটিতে বহুদিন গেছি দুনম্বর খেতে। গোরুর মাংসকে ওই নামেই ডাকে। আমার অবশ্য ভদ্রভাবে দোকানে বসে অর্ডার দিয়ে বিরিয়ানি খাওয়া বিশেষ হয়নি। কামারহাটি, রাজাবাজারে অনেক দুপুর কেটেছে ষোল টাকার বিফ বিরিয়ানি খেয়ে।

নিষ্পত্র গাছ ফুটপাতে কোমর ভেঙে দাঁড়িয়ে, ধুলোয় বিষণ্ণ ফুল, বসন্ত চুপিসারে তার নিজের দলের কয়েকজনের সঙ্গে লাল নীল লুডো খেলছে। ঝাঁঝালো রোদেরও কুয়াশা হয়, তার ওপর ছায়ায় চলমান আনাগোনা পুরো রাজাবাজারটাই মনে হয় হলুদ ফানুস। মহানগরীর বুক থেকে কে যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে এখুনি। জল ছেটানো ন্যাংটো বাচ্ছা, গলায় দড়ি বাঁধা টমি কুকুর, খঞ্জ ভিখারির চোখের সামনে ধীরে ধোঁয়াটে জটাজাল পেরিয়ে যাচ্ছে রাজাবাজার, সঙ্গে নিয়ে এক প্রকাণ্ড পেছন কালো হান্ডি, মেহেদি নুর হেকমত চাচা।

বৈশাখ হ্যালুসিনেশনের মাস এ শহরে। খালিপেটে বিরিয়ানি-আলু হলুদ বাল্ব। চালের পাহাড় ঢেউ খেলানো বরফের সাসক্রুজি। তার ওপর ঝলসানো খয়েরি টিলার মত রোদেলা মাংস। ফাটা কাঠের বেঞ্চ, মরচে ধরা নিকেলের প্লেটে কাঁচা লঙ্কা, প্লাস্টিকের বাটিতে কড়কড়ে নুন আঁকড়ে ধরে বসে থাকি। খালিপেটের অভিঘাত মারাত্মক, উড়েও যেতে পারি। সতেরো বছরের নাসির একটা বড় চর্বির টুকরো দিয়ে আমায় বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। লুঙ্গি পরা সাদা দাড়ি ওর নানা, টাকা গোনার ফাঁকে আমায় খর চোখে মাপত। চোখে থাকত এক্সট্রা কেয়ার।

ভিখিরি, ভবঘুরে, টেকনিক্যালি হোমলেস, যাদের বাড়ি আছে, কিন্তু বারান্দায় থাকে, এক বারান্দায় রোদ পড়লে অন্য হাওয়া বারান্দায় উঠে যায়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত চারটাকার ভুনা নেবার জন্য। যন্ত্রপাতি পাশে রেখে খেতে বসা লেবার, চোখে সুরমা, গলায় রুমাল হকার, মধ্যে সিঁথি ঘোর কমলা রং ‘তেরে নাম কাট’ চুল, খসখসে গোসাপের মত কালো মুখ এলাকার মস্তান, সবাই যে যার প্লেটের সমান্তরালে চোখ তুলে আমায় জানেমন টাইপ দৃষ্টিতে মাপত। বেমানান ছাগল আমি ফুলবাগানে ঢুকে পড়েছি।

আব্বাস ছিল অন্যরকম। না কামানো দাড়ি, রোগা ভোগা আব্বাস আমায় বিরিয়ানি চিনিয়েছিল। কামারহাটি অদ্ভুত জায়গা। লাল নীল শরবতের বোতলের গায়ে ট্রি রি রিং শব্দ উঠছে। একপাশে সবজির বাজার। ঢাউস কুমড়ো আলুর গাদার ওপর উঠে চেঁচাচ্ছে বিক্রেতা। ভ্যানে বিক্রি হচ্ছে পুরোনো জামা, চকরাবকরা বারমুডা। লাঠির ডগায় জরিদার কুর্তা পায়জামা পত পত করে উড়ছে। শেরওয়ানি সেলাই হচ্ছে। শাড়িতে চুমকি জরি সুতোর কাজ তুলছে ছোকরা বুড়ো। আব্বাস ছিল শিল্পী, সূক্ষ্ণ কারবারি। বিরিয়ানি নিয়ে ফান্ডা ছিল উচ্চস্তরের।

গরমের বিকেলে ধানকল মাঠের দিক থেকে গঙ্গার হাওয়া আসত। সমস্ত জায়গাটা নোংরা, চামসে গন্ধ ভরা, বাচ্ছাকাচ্ছা উদোম গায়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সবুজ সাদা মসজিদের ডোমাকৃতি গম্বুজের মাথায় ময়লা আকাশে সন্ধের রং লেগে গেল তো বাঁশের ডগায় ফিট করা চোঙা থেকে আজানের সুর তামাম তল্লাটটাকে কভার করে নিল মরুভূমির ঢেউ খেলানো বালির মত। আব্বাস নামাজের ধার না ধেরে চ্যাঁ ভ্যাঁ চিল্লামিল্লির মধ্যে নিচু স্বরে ওর মালাকাইটের ঝাঁপি খুলত, আর আমি হাঁ করে মাছি গিলতাম। কাগজের প্লেটে যে রোড সাইড জিনিসটা দেয়, কমলা ডালদা চিটচিটে গাদ, ওপরে হলদে তেতো বুড়ো শশা দাগরা করে কাটা, আর পেঁয়াজ ছড়ানো, একে আব্বাস বলে কারখানা প্রোডাক্ট।

আর্টিফিসিয়াল আতর কারখানায় তৈরি হয়। আসল আতরের ভরি হাজারের ওপর। ভাঙা আলু, সেদ্ধ চাল, রোগা চিকেনের হাড় আর একটা হাঁড়ি নিয়ে আব্বাসের ভাইপো, বোনপোরা হাত পাকায় অষ্টমীর সন্ধেয়। টু পাইস হাতখরচা। সেই ঘোলাটে হাঁড়ির ঝাঁকানো কারখানা মাল দুশো গজ লম্বা লাইনের পেছনে দাঁড়িয়ে, খেতে হবে। নইলে আত্মসম্মানের কাছে কী জবাব দেব। কার্নিভাল মুডের বাঙালির তো ওইদিন হুঁশজ্ঞান থাকে না।

ধর্মতলায় অম্বর রেস্তোরাঁর রসুইখানার সামনের দিকটায় আমার এক বন্ধুর অফিস ছিল। অফিস মানে সে সারাদিন চেয়ারে বসে ঢুলত। সামনের টেলিফোনে মাঝেমধ্যে কী সব আসত, ও তন্দ্রা ভেঙে লাল চোখে সে সব ফোন ধরত। একটা সিঁটকে মত লোক ভীষণ বিরক্ত হয়ে ঝড়ের বেগে প্রায়ই ঢুকে বলত, ‘না না আমি আর বেশিক্ষণ এস্টে করতে পারব না, তাড়াতাড়ি খবর দিন তো’। ওই খুপরিতে কীসের ব্যবসা হয় আমার বোধগম্য হয়নি।

তবে অম্বরের প্রধান সেফ আলী সাহেবের সঙ্গে মোলাকাত হয়েছিল। বিজ্ঞ, শান্ত, মেহাদি করা দাড়ি আলীজি আলুবিদ্বেষী ছিল। মাংসগন্ধী ফক্কিকারি আলু হল উঞ্ছবৃত্তি। অম্বরের রসুই ঘরে বিরিয়ানি ডিপার্টমেন্টে পেঁয়াজ ভাজত গোবিন্দ। বেঁটে বিহারি শ্যামাপ্রসাদ মাংস ম্যারিনেট করত। চক্রবর্তী দানবের মত পেল্লাই সব ফ্রিজ খুলে জিনিসপত্র তদারকি করত। আর ফ্রাই ডিপার্টমেন্টের মোবারক মুরগির ছাঁট, পাঠার চর্বি এদিকওদিক তাকাতে তাকাতে পেছনের দরজা দিয়ে সাপ্লাই দিত ওর দিলরুবাকে।

একদিন দেখি অন্ধকার ঝুলকালি মাখা রান্নাঘরে লম্বা চওড়া এক কাবুলি বসে আছে। পরনে আফগানি দেরেসি। দেড় মিটার লম্বা বস্ত্রখণ্ড। বোধহয় আলীর কোনও রিস্তেদার। ডাঁই করা ভাজা আলু ঝুড়িতে শুয়ে আকাশ দেখছে। তার পাশে বসে সে খাচ্ছে প্রায় সাড়ে তিনশো গ্রাম ওজনের মাংসের বিরিয়ানি। কম মশলা ঘন তেলে রাঁধা। তাদের পীড়াপীড়িতে চেখে দেখি ভেড়ার মাংস। রিস্তেদার তো গড়গড় করে লেবেনিজ মানসাফ, শ্রীলঙ্কার বুহারি, থাই হেনা, বর্মার দানপুক, হায়দ্রাবাদের কালয়ানি, দক্ষিণ কানাডার মুসলিম কমিউনিটির বেয়ারি, তামিলনাড়ুর দিনদিগুল, কর্ণাটক উপকূলের ভাতকালি বিচিত্র বিরিয়ানির পাঁজিপুঁথি বলে চপাং করে মাংসে কামড় দিল।

পাল্টা কিছু না বললে কেমন খালি খালি লাগে। তাই পাশ থেকে আস্তে করে একটা ফান্ডা ঝাড়তে গেলাম। ‘রাজিয়া সুলতানা নাকি ক্লান্ত রক্তক্ষয়ে দুর্বল সৈনিকদের পুষ্টির জন্য এই মাংস আলু ভাতের কম্বো প্যাক তৈরি করেছিল। মাজা ব্যথা করে কে এত রুটি ভাজবে, হেঁ হেঁ।’

আলী সাহেব উদাস গলায় বললেন, ‘জঙ্গ লড়াই তো খতম নেহি হতে কভি, হাঁ খানা তো চাইয়ে তাকৎ কে লিয়ে, ফির ধরম কে নাম পে জো জহর রোজ খিঁলাতেঁ হেঁ নেতালোগ, ওহি খানা বন্ধ হোনা চাইয়ে।’

কামারহাটির রাইস প্লেটের আব্বাস ভাই, অম্বরের আলী সাহেব, পাড়ার গৌতম রেস্টুরেন্টের গৌতম, জাকিরা হোটেলের টেবিল বয় মন্টু, হেল্পার মুবারক, হাজি বিরিয়ানি স্টলের টুলে বসা কালো ছেলে দুটো— সবাই যে যার লড়াই লড়ছে, কিন্তু আসল যুদ্ধের অস্ত্রটা ধরে আছে অন্য কেউ।

চিত্র: গুগল

কচুরি

সাধু

লিটল বুদ্ধ

বাংলা আওয়াজ

শেরপা

সবুজ মিডাসের ছোঁয়া

ঘুষ

জুতো

মাদারি কা খেল

সিঁড়ি

ইসবগুল

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

স্বামী বিবেকানন্দ : প্রয়াণদিনে স্মরণ

বিবেকানন্দই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক বাঙালি তথা ভারতীয়। রবীন্দ্রনাথ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ১৯১২-পর্বে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় যাওয়ার পর, এবং তার পরের বছর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। কিন্তু এর প্রায় কুড়ি বছর পূর্বেই বিবেকানন্দ শিকাগো-বক্তৃতা ও আমেরিকা-ইয়োরোপে এক নাগাড়ে প্রথম দফায় চার বছর থাকার সুবাদে আমেরিকার বিদ্বজ্জনমহলে যেমন, তেমনই জার্মানির মাক্সমুলার, ফ্রান্সের রোমাঁ রোলাঁ, রাশিয়ার টলস্টয় প্রমুখের শ্রদ্ধা এবং মনোযোগ আদায় করেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

প্রফুল্ল রায়: ব্রাত্য সময়ের কথাকার

প্রফুল্ল রায় নাকি অতীশ দীপঙ্করের বংশের। দেশভাগের অভিশাপেই দেশছাড়া হতে হয় তাঁকে, ১৯৫০-এ। একটা বিধুর বিষয় আমরা লক্ষ্য না করে পারি না। দেশভাগ সুনীল-শ্যামল-মহাশ্বেতা-শীর্ষেন্দু-অতীনদের কেবল ভূমিচ্যুত করেই ছাড়ল না, এমনকি তাঁদের কারুবাসনাকেও অন্যতর রূপ দেওয়ালো। দেশভাগ না হলে আমরা সুনীলের হাতে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীণ’ বা প্রফুল্ল রায়ের ‘পূর্বপার্বতী’ পেতাম না, যেমন পেতাম না শওকত ওসমানের ‘কর্ণফুলি’ বা হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি।’

Read More »
শৌনক দত্ত

মন্দ মেয়ে ভদ্র অভিনেত্রী: সুকুমারী দত্ত

বিনোদিনী দাসীর বর্ণময় জীবনের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া এই ‘তারকা অভিনেত্রী’-র বহুমাত্রিক জীবনটিও কম রঙিন নয় বরং বিস্মৃত নক্ষত্র এক, যিনি ১২৮২ বঙ্গাব্দের ৩ শ্রাবণ (১৮৭৫ খ্রি., মূল্য ছিল ১ টাকা) ‘অপূর্ব্বসতী’ নাটকটি লিখে বাংলা নাট্যাতিহাসের প্রথম নারী নাট্যকার হিসেবে সুবিদিত হয়ে আছেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস ও কালিদাস

পণ্ডিতেরা তর্ক তুলেছেন, কালিদাস ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ লেখেননি৷ কেননা একেবারে পয়লা আষাঢ়েই যে মেঘ নেমে বৃষ্টি আসবে, তা হয় না। তাঁদের মতে, ওটা আষাঢ়ের শেষদিন, ‘আষাঢ়স্য প্রশম দিবস’ হবে। কিন্তু প্রথম দিবস-ই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং তা এতটাই যে, কালিদাসকে নিয়ে ভারত সরকার যে ডাকটিকিট বের করেছে, সেখানে ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ শ্লোকটি উৎকীর্ণ।

Read More »
রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »