হুগলি তীরবর্তী ৭২৮ স্কোয়ার কিলোমিটারের এই কলকাতার এক অদ্ভুত জীব কচুরি। রাত বারোটায় সব আলো নিভে যাওয়ার পরও গলির কোণে কাচের বাক্সে দু-চার পিস দোমরানো কচুরি কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোয়। ফরসা ঝকমকে দেওয়াল, বেগবান আলোক দ্যুতির ধারেকাছে কচুরির বসবাস নেই। ঠান্ডাঘরে অ্যাসিডখোর বেওয়ারিস বডির মত কে জানে কতদিন পড়ে থেকে, কোন এক বাসন্তী সন্ধ্যায় ফিনফিনে কাগুজে ওড়নায় সেজে গতি হওয়া মাল হল গরম কুকুর, প্যাটিস, পিজা।
জাতিধর্ম নির্বিশেষে কলকাতায় কচুরি চলে। দুমিনিটে অর্ডার সাপ্লাই তিন মিনিটে মাল উধাও। এ দেশে কচুরি-কর্মীর পায়ের কাছে ম্যাকডোনাল্ডস কোম্পানির বড়কর্তার শুয়ে থাকা উচিত।
উনুনের আঁচে ধোঁয়ায় ধোঁয়াময়, কুয়াশা ঘেরা ঝাপসা, দ্বীপের মত ভাসমান সব কচুরির দোকান। টানা রিকশার ঘণ্টি, বনেদি বাড়ির আঙুরলতা গ্রিলের বারান্দায় মোটা থামের পাশে অন্ধকার। কিছু থাকে না তার অঙ্গসজ্জায়। কিছুই না। বিবর্ণ ঘুপচি, স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার, পেরেকওলা কেঠো বেঞ্চ, সামান্য উঁচু তক্তায় ময়দার বস্তা, ঢাউস ডেকচি, মধ্যে একটি মোটা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ লোক পুকুরে ছিপ ফেলার ভঙ্গিতে যমরাজের শাস্তিদানের কড়াইতে স্থিরনিষ্ঠ প্রজ্ঞাবান শিল্পীর মত রাশি কচুরি ভেজে তুলছেন। তার বিরাট ভুঁড়িটি জ্যালজেলে সুতির ফঙ্গবেনে গামছায় নির্ভর করে ঝুলছে। শুধু গিঁটমারা ওইটুকু বস্ত্র কী করে তার সব কিছু ধরে রেখেছে সে রহস্য কেউ ফাঁস করেনি। তাদের মাথার পেছনে তাম্র যুগের গভীর কালিমালিপ্ত দেওয়ালে তেলকিটকিটে গেঞ্জি, লুঙ্গি, জাঙিয়া, গামছা, হাফ প্যান্ট ঝুলছে। বিশাল ডেকচিতে পাহাড়প্রমাণ ময়দা মাখছে সাকরেদ নেচে নেচে। এ দৃশ্য পৃথিবীর কোনও খাবারের দোকানে দেখা যাবে না।
সেই দশ ফুট পরিসরের আশেপাশে টিকিধারী বিহারি ছাতুওলা, লম্বা জুলপি চোমরানো গোঁপ সিরাজদৌল্লা, ফেরতা দিয়ে আঁচড়ানো চুল সুরমা চোখে নাদির শা, ঝালর ঘাগরা ঘসেটি বেগম, ঝুল গোঁপ রুখু থুতনি চেঙ্গিস খাঁ-কেও দেখা যাবে, নালার ধারে হাবসে পড়ে শালপাতার কোণ চাটছে।
ন্যাংটো বাল্বের নিচে দেয়ালা করছে বালখিল্য কচুরি। ঝটকা গরম জিনিস, পাশেই cool বেবি, চিল বেবি হট ডগ লোফার-লাফাংগাদের গা বাঁচিয়ে আকাশ দেখছে। এদিকে দিল ধড়কাচ্ছে পাড়ার নন্টে। উলটো দিকে পিংকির বারান্দা, নান্টু চায়ে বিস্কুট ভেবে কচুরি চোবাচ্ছে। সমবেত সিটির মাঝে কারিগরদা চ্যাঙারি নাচিয়ে বহুকেলে গুন্ডি পান খাওয়া দাঁত মেলে বলল, ‘কালীবাড়িতে ডালার দোকান, বাপের বহুত পয়সা। প্যাঁড়া-কচুরি কম্বিনেশানেই তো রামকৃষ্ণের মহাতীর্থ চলছে।’ লাড্ডু-কচৌরি তো তীর্থক্ষেত্রের ট্রেডমার্ক।
পুলিশ শালবনির জঙ্গলে মাওবাদী পাকড়াতে গেছে, চোগা প্যান্ট, টাইট বেল্ট, ভারভরন্ত মাখন গালে ঘাম, নিজেকে উন্মোচন করে দেওয়ার অমানুষিক পরিশ্রমের ওপর নো কম্প্রমাইস ট্যাগ দেগে, সিরিয়াস মুখে ফিল্ডিং সাজাচ্ছে। মন্ত্রীদের ঘন ঘন ফোন, অ্যাকশন বলার জন্য হাঁ করেছেন এমন সময় হুমদো কনস্টেবল এসে বলল, ‘স্যার ওদিকে কচুরি ভাজছে।’
টেনশন তো ছিলই, টেনশন তো থাকেই, তা বলে কি ডিজায়ার নেই! আত্মঘাতী বোমাবাজ ধরতে কনফিডেন্স লাগে মিডিওকার পৃথিবী যতই তড়পাক। ভেতরে কি কম বিষ। সর্বপাপতাপহারী ইমেজ থাক পড়ে, ধরা যাক দু-একটা কচুরি এবার! ব্যাস, কলকলনাদে বড়বাবুর পেছনে বাহিনী ছুটল কচুরি খেতে। মাওবাদী কি ছেলের হাতের মোয়া, পরে ধরলেও হবে।
আর কালো নাদা পেট গভীর নাইকুণ্ডলী কচুরি ভাজিয়েদের কখনও নাম থাকে না। তারা হল কারিগরদা, কারিগর কাকা। বংশ পরম্পরায় তাদের গায়ে ছোলার ডালের গন্ধ। ডালের কোয়ালিটির ওপর তাদের পাত্রী ঠিক হয়। পাত্রীপক্ষ শুঁকে বলে, নাঃ হে মজফ্ফরপুরেরটা আরও ফাইন ছিল, পাক্কা নারকেলের গুণ। এ মাঝখানে নিশ্চয়ই পাইস হোটেলে ছিল, ডিমের ডালনার সেন্ট ছাড়ছে। সকাল থেকে তিন বান্ডিল লাল সুতোর বিড়ি টেনে, বিকেল বেলায় চাড্ডি আলো চালের ভাত খায়। যতই বলো, ও শরবতে বিষ নাই! তবু তারা প্রগৈতিহাসিক কড়া থেকে মাল ছেঁকে তুলে, তেল চোবরানো ঝুড়িতে ঢেলে মুচকি হেসে পাশ কাটিয়ে যান। কচুরি ভাজাইয়েরা কচুরি খায় না।
টিনের ত্যাড়াব্যাঁকা একচিলতে বোর্ডে রামকৃষ্ণ, নেতাজি, সাঁইবাবা সবাই বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। রামকৃষ্ণ থেকে মান্না দে কে কচুরি খাননি এ ভূমে। তবে আটা বাঙালির ধাতে ছিল না। জেনুইন বাঙালিকে আটা ধরাতে গিয়ে ফেল মেরেছে মোগল, পাঠান, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ।
আটাও আর্ট আছে। ময়দার সঙ্গে তেল মেশানোয় মিহি আঙুলের খেলা চাই, নইলে ফুলবে না। রাধাবল্লবীর কান ধরে টানলে ডালের পুর সরসর করে গড়িয়ে আসবে, কচুরির বেলায় উল্টো। হেডলাইট কাটা দুশো চৌত্রিশ বাসের মত গাঁ গাঁ করে ফুলবে, ফুলেই থাকবে স্পিড নেবে না। অর্থাৎ পুর ভেতরে ময়দার ছাদ ধরে থাকবে। তবেই না কচুরি।
রাত গড়ালে একচিলতে মেঝেতে তেলচিটে মশারি পড়বে, রাস্তায় ক্লান্ত বাতিদান। কারিগরদারা হাতপাখা নাড়বে। স্টারডম নেই, অ্যানিগমা নেই, ম্যাজিক প্রেজেন্স নেই, তো কী? কচুরি এক অনন্ত পারাবার বাঙালির।