‘ঝড়ের দিনে মামার দেশে/ আম কুড়াতে সুখ…’। কবি জসীম উদ্দীনের লেখা এই কবিতায় আম কুড়োবার সুখকর অনুভূতি আদিকাল থেকে আমাদের মনে বিরাজমান। আম নিয়ে খনাও তাঁর বচনে বলে গেছেন কত কথা! ‘আমে ধান, তেঁতুলে বান।’ ‘বিশ হাত করি ফাঁক/ আম কাঁঠাল পুঁতে রাখ।’
আম ভারতীয় উপমহাদেশীয় একপ্রকারের সুস্বাদু ফল। কাঁচা অবস্থায় এর রং সবুজ এবং পাকা অবস্থায় হলুদ, হলুদাভ লাল ও লাল রঙের হয়ে থাকে। বৈজ্ঞানিক নাম Mangifera indica। এটা Anacardiaceae পরিবারের সদস্য। ‘আম’ অমৃতফল। আম্র, চুত, রসাল, সহকার, অতিসৌরভ, কামাঙ্গ, মধুদূত, মাকান্দ ও পিকবল্লভ— অনেক নাম তার। এদেশেই ৩৫০ প্রজাতির আম রয়েছে। বাইরের দেশে কিছু কিছু আমের ফলন হয়। মধ্য আমেরিকা, মেক্সিকো, ব্রাজিল, মিশর, শ্রীলঙ্কা, মাদাগাসকার এবং ব্রহ্মদেশেও। কিন্তু এখানকার আমের মত স্বাদ ও প্রাচীন ঐতিহ্য নেই ওদের। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭-এ সিন্ধু উপত্যকায় অমৃতফল দেখে অবাক হয়েছিলেন আলেকজান্ডার। হিউয়েন সাং, ইবন বতুতা প্রমুখ পর্যটকেরা প্রচুর সুখ্যাতি করেছেন ভারতীয় আমের। সবচেয়ে বেশি বলেছেন যিনি, তাঁর নাম ইবন বতুতা। আমকে তিনি বলেছেন কমলা আর আপেল— দুই ফলের সর্বগুণসার।
পশ্চিমবঙ্গে যত ফলের বাগান আছে, তার শতকরা ৬১ ভাগই আমের বাগান। আর এই আমবাগানের শতকরা ৩০ ভাগই মালদায়। সেখানে প্রাধান্য ফজলির। ল্যাংড়া, হিমসাগরও আছে। মালদার পরেই মুর্শিদাবাদের দাবি। ২২ হাজার একর জুড়ে আমবাগান। গাছের সংখ্যা লাখপাঁচেক। একটা ব্যাপারে মালদার থেকে মুর্শিদাবাদ এগিয়ে। নবাবদের পুরনো আমবাগান, ‘রইসবাগ’-এ এখনও ১০০ রকমের আমগাছ রয়েছে। আগে নাকি ১৫০ রকমের আমগাছ ছিল। রাজা-বাদশা-নবাবদের উৎসাহে আমের ফলনের চর্চা হত। নষ্ট হয়ে গিয়েছে আকবরের সাজানা দ্বারভাঙার ‘লাখবাগ’। ১,০০,০০০ আমগাছ নাকি ছিল সে বাগানে। বাবরের প্রিয় কৈর্না আমের গাছ এনে এখানে বাগিচা করেন আকবর। দিল্লিতে খুব কদর ছিল কৈর্নার। কৈর্না নাম কেন হয়েছিল আমটির, তা জানা যায়নি। তবে সেকালে বাদশা-বেগমদের যিনি যে আম পছন্দ করতেন সে আম হত তাঁর নামাঙ্কিত। যেমন, রানিপসন্দ, রাজাপসন্দ ইত্যাদি। বড়লাট যে আম খেয়েছেন সে আমটির নাম হল ভাইসরয়।
অনেক সময় আমের নামকরণ হয় বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ দিয়ে। যেমন স্বর্ণরেখা, সিঁদুরটিপ, গোলাপখাস, জাফরানি। এক এক জায়গার বা অঞ্চলের নাম দিয়ে নামকরণ হয়। চেন্নাইয়ের মাদ্রাজি, ব্যাঙ্গালোরের তোতাপুরি, লখনউয়ের দশেরা, চৌসা, বেনারসের ল্যাংড়া, মুম্বাইয়ের আলফানসো।
আম নিয়ে অবশ্য অনেক গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। মালদহের মাধবপুরে আছে রাজ্য সরকারের ‘ম্যাংগো রিসার্চ সেন্টার’। দক্ষিণের নীলম এবং উত্তরের দেরি আম মিলিয়ে নতুন দু’জাতের আমও গবেষকরা তৈরি করেছেন। এই আমের নামও বেশ গালভরা— মল্লিকা ও আম্রপালি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিশ্বের অন্যতম সেরা ফল এই আম। রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) আম নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে ফেলেছেন।
তবে অতি ভোরে ছুটে এসে আম কুড়ানোর মজাই আলাদা। মালদা-মুর্শিদাবাদে রেওয়াজ, গাছতলার ফল যে কেউ কুড়াতে পারে। শত শত গরিব পরিবার আমের মরসুমে আম কুড়িয়েই বাঁচে। আম, আমচুর, আমসত্ত্ব, আমসি থেকে আমকাসুন্দি পর্যন্ত হরেক জিনিস তৈরি করেন অন্যের বাগানের আম থেকেই। বাগানের মালিক নিষেধ করেন না। একসময় দক্ষিণ ভারতে মালিকের হুকুম ছাড়া গাছতলার আম তুলে নিলে তার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। এবং এই দক্ষিণের আমের ব্যাপারে এমন এক করুণ কাহিনি ‘আল রিহালা’-য় লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন ইবন বতুতা, যা চিরকাল আমপ্রেমীদের চোখের জল ঝরাবে।
বতুতা মালাবার থেকে যখন কুইলনে প্রবেশ করেন তখন সেখানে ছিলেন তিবারি পদবিধারী এক রাজা। পুত্রসন্তান না থাকায় তাঁর কিশোর ভ্রাতৃপুত্রকে খুব স্নেহ করতেন। একদিন বিকেলে দুটি ঘোড়ায় দু’জন, সামনে রাজা, পেছনে ভ্রাতুষ্পুত্র যাচ্ছেন ছায়াঘন আমবাগানের পথ দিয়ে। হঠাৎ পেছনের ঘোড়ার খুরের শব্দ না পেয়ে, ভাইপোর জন্য উদ্বিগ্ন রাজা পেছনে তাকিয়ে দেখেন, ঘোড়া থেকে নেমে পরম আনন্দে কিশোরটি আম কুড়াচ্ছে আর সে দৃশ্য দেখছেন পথের লোকজন ও প্রজারা। রাজার সামনেই তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র রাজ্যের আইনভঙ্গ করেছে। এই অপরাধের একমাত্র শান্তি প্রাণদণ্ড। কিশোরের দেহ রাজারই তরবারিতে দ্বিখণ্ডিত হয়। আর তার কুড়নো সেই আমটিকে দু-টুকরো করে পুঁতে দেওয়া হয় তার কবরে। ঘটনাটিকে ‘মর্মান্তিক’ বলেছেন বতুতা।