Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

সাধু

আমরা নাকি ভবা পাগলার বংশধর। ছোট থেকে শুনে আসছি। ভবা পাগলা ভক্তিগীতি সম্মেলনে আদ্যাপীঠে আমাদের সামনের সারিতে চেয়ার বাঁধা। চটে বসে অনেকেই উসখুস করছে, কখন গান ফান শেষ হবে। খিচুড়ি আসবে। এলাকা ঝেঁটিয়ে, ভবঘুরে, নিষ্কর্মা, ভণ্ড, পাগল, পেছনে ঘাপটি মেরে বসে বিড়ি টানছে। ‘ভব সংসার মায়ার খেলা’, ‘আসবি যখন যেতে হবে’, ‘সাধের বাসর থাকবে না’ গোছের গান হচ্ছে। ঢুলু ঢুলু চোখে সব পায়েসের বালতির দিকে আড়ে আড়ে চাইছে। ভবের সংসারে রাতের খিদে ফ্রিতে মিলবে কখন, তারা চিন্তিত। লম্ফমেলা বসবে বারোটার পর। প্যাকেটের চাট বোম ফুলুরি। ভজার দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। দুশ্চিন্তা নিয়ে তারা চুট চাট মশা মারছে। ভক্তিগীতির তরল নেশা আছে। এই জীবন নাকি কিছুই নয়, পারাপারের সেতু সামলে রাখো, ক্রমাগত ‘যেতে হবে, যেতে হবে’ শুনতে শুনতে দুটো বুড়ি প্রবল দার্শনিক অভিঘাতে কোণের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাকিরা ঝিমচ্ছে। পায়েসের হাঁড়ি লিমিটেড। হুমদো, জটাজাল সম্বলিত ঘোড়েল সাধুদের জন্য। বাকিরা জলের মত খিচুড়ি কুমড়ো ঝিঙের খোসাওলা ঘ্যাঁট।

তালতোবড়া মুখ, সিড়িঙে তবলচি সাবুদানা পাঞ্জাবি লড়িয়ে সেই সন্ধে ছটা থেকে চাঁট মেরে মেরে ক্লান্ত। আমরা ফ্রিতে বোঁদের লাড্ডু পাব তাই বাসি আলুর চপের মত নেতিয়ে পড়েও তেল চকচকে গ্লেস দিচ্ছি। আমাদের একটা প্রেস্টিজ আছে।

ভবা পাগলা পাঁচ মাসে মায়ের গর্ভ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে মাসি দ্রাক্ষাসুন্দরী দেবীর চোখের সামনে খিল খিল করে হেসে ‘আবার চার মাস বাদে আসছি’ টুকি বলে মিলিয়ে গিয়েছিলেন। এই অলৌকিক মাখন মাখিয়ে পাড়ার লোকের কাছে গালগল্প করে থাকি, শুকনো পাউরুটি বিকোয় না। লাও ঠ্যালা! আমাদের বাড়িতেই সাধু গজাবে কে জানত?

মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলে লরির ব্যবসা করতে গিয়ে লাট খেয়ে পড়ল। আসাম বর্ডারে শুনশান ঝোপের ধারে হাইওয়েতে তার লরি দাঁড়িয়ে। পারমিট ফারমিটের কী সব গণ্ডগোল। খালাসি, ড্রাইভার কিছুক্ষণ বেগুন খেতে লুকিয়ে থেকে পালিয়েছে। বাড়িতে পুলিশ, কান্নাকাটি।
কাকার মাথায় বিস্তীর্ণ টাক, বাঁ ধারে আধহাত লম্বা এক ফালি চুল। গ্রোথটা ওখানেই টিঁকে আছে। সেই সামান্য চুলই এদিক-ওদিক সাজিয়েগুছিয়ে মরুভূমির কাঁটা গাছের মত ব্যবহার করেন। আমাদের দিয়ে পাকা চুল বাছান।

প্রথমেই কালির দোকানে নেড়া হয়ে এলেন। দুটো গেরুয়া যোগাড় হল। অদূরেই রামকৃষ্ণের ইন্টারন্যাশনাল সাধনপীঠ। মুক্তকেশী, বুড়োশিব, রক্ষাকালী, জগৎকালী, মঠ মন্দিরের ছড়াছড়ি। গেরুয়ার অভাব নেই। বনেদী বাড়ির আত্মভোলা ক্ষ্যাপা, অবহেলিত, জীবনযুদ্ধে কাঁচি, ম্যাট্রিক ফেল, বিরহী, প্রেমে হাফসুল, লুঙ্গির মত গেরুয়া জড়িয়ে গঙ্গার ধারে বসে পড়লেই ব্যাস হিল্লে! সার্কাসের রিং মাস্টারের মত লোকে এখানে বাঘের বদলে গেরুয়া খেলায়। যখন তখন গীতার ত্রয়োদশ শ্লোক মিহি করে আওড়ে, হাত দেখাটা শিখে নিলেই মোক্ষলাভ।

দুপুরবেলা বাড়ি নিঝুম। মহিলারা ঘুমোচ্ছে। কাজের মাসি সিরিয়াল দেখছে। এই সময় লরি টু সাধু ট্রান্সফার কাকা, বিভিন্ন মাপের সাধু নিয়ে সোফা সরিয়ে মাটিতে বাঘছালের ছাপমারা মাদুর পেতে পাম্প স্টোভে দম দিতে লাগল। সদ্য সাধু তাই কষ বেশি। পায়েস রান্না হবে। চিঁড়ের পায়েস, ঝিঙের পায়েস, লাউয়ের পায়েস। সাত্ত্বিক আহার! বাড়ি সাধুময়।

কুল কুল করে গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। অগুন্তি ঘাট। মোড়ল ঘাট, বুড়োশিব ঘাট, ভাটির ঘাট, মুক্তকেশী ঘাট, ফাঁড়ির ঘাট, শ্মশান ঘাট। ঘাটে ঘাটে বিচিত্র সাধুর আমদানি। বাক্স বাবা, ভুট্টা বাবা, তালা বাবা, কলকে বাবা, রেডিও বাবা, খিস্তি বাবা। ঘর আলো করে সব বসে আছে। খিচুড়ি চেপেছে। ছোকরা সাধু নেচে নেচে বাটনা বাটছে। দাড়িওলা হুমদো সাধু হাতে পাঁচটা কাঁচালঙ্কা নিয়ে বসে, হিং ক্রিং ওঁং খট করছেন। খিচুড়ি নামলেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন।

কালপিন সাহেবের ঘাট থেকে এক বাবা আসত, তার আবার ভগন্দর। মাটিতে বসতে পারে না। সঙ্গে একটা ছোট টায়ার নিয়ে ঘোরে। সে ঘোর তান্ত্রিক। রাত্রিবেলা তার গা থেকে নীল আলো বেরোয়। ধুনির আগুনে শেয়াল পুড়িয়ে খেয়ে রাত আড়াইটেতে মশারি টাঙিয়ে সাধন শুরু করে। তাদের মতে শয্যা হল সাধনক্ষেত্র। ওখানে বডি শব হয়ে পড়ে থাকে আট ঘণ্টার ঘুমে। দামড়া সাধুদের কলকাকলিতে বাড়ি পূর্ণ। নিম্নাঙ্গে তালা ঝোলানো এক বিশাল নাগা চিমটে হাতে এসেছিলেন মুজফফরপুর থেকে। পাড়ার ডিফেন্স পার্টি রে রে করে তেড়ে আসায় শূন্যে হাত বাড়িয়ে দুহাঁড়ি মোল্লাচকের দই উড়িয়ে এনে, বিশুদ্ধ কাঁচা বিশেষণ দিয়ে বিরক্ত হয়ে কৈলাশে চলে গেলেন।

জ্যোৎস্নাজড়িত বারান্দা সাধুরা হারমোনিয়াম বাজিয়ে “এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায় স্বপ্ন মধুর মোহে” গাইছে, এমন বিচিত্র আখড়া এই বাড়িতেই সম্ভব হয়েছিল। আর একজন ইলেক্ট্রিক বাবা আমদানি করেছিল ট্যাঙ্কার বাপি। তেলের ট্যাঙ্কার থেকে তেল ঝাড়াই তার কাজ। সেই বাবার গায়ে টিউব ধরলেই জ্বলে ওঠে। তার নেই, কানেকশন নেই।

রথের মেলার দিন রাত দশটায় ট্যাঙ্কার বাপি মার্ডার হল। হিস্যার ব্যাপার, স্থানীয় নেতা টিটাগড় থেকে দর্জি কালুকে সুপারি দিয়ে সূক্ষ্ণ কাজ করিয়েছে। লাউয়ের ওপর ন্যাকড়া রেখে কালু ভোজালি চালায়। ন্যাকড়া ছিঁড়ে ফালি, লাউয়ের নধর গা ফোকাস মারছে। ভোজালি খেয়ে মিত্তিরদের রকে শুয়ে জল জল করছিল। কেউ নেই শুনশান। ঝপাঝপ জানলা দরজা বন্ধ। ইলেক্ট্রিক বাবা, ছ ফুট হাইট, বুক অবধি দাড়ি, হাতে লোহার বালা, উল্টোনো নাড়িভুঁড়ি কুড়িয়েকাচিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। বাঁচেনি অবশ্য। পুলিশ বাবাকে ধরে জেরার চেষ্টা করেছিল। সে ভয়ংকর কাণ্ড। থানার আলো নিভিয়ে খটাখট হাড় বাজিয়ে, নিজের গায়ে বাল্ব জ্বেলে বসে, তুবড়ির মত সংস্কৃত শ্লোক বলতে লাগলেন। ট্যাকেল করা দুঃসাধ্য হওয়ায় বড়বাবু জিপে করে হাওড়ায় ছেড়ে আসেন। ভেল্কি, ফেল্কি সাধারণ মানুষের জন্য গিফট। হিমসাগরের গভীরে তাদের চলাচল।

সংসারীর অতীত ভবিষ্যৎ বর্তমান আছে। সাধুর নেই। অতীত অনুশোচনার, ভবিষ্যৎ আতঙ্কের। গঙ্গার দুপাড় দিয়ে বেলা ডোবার আলো বয়ে যায়। চিমটে, কম্বল, কমুণ্ডল, ভেল্কি, ভেক, সব পড়ে থাকে, ভাব তার নিজস্ব নৌকায় উঠে পাড়ি দিয়েছে বহুদূর। একদিন ‘যাই একটু ঘুরে আসি’ বলে ভরদুপুরে কাকা সেই যে গেলেন। আর ফেরেননি। মাঝে মাঝে খবর আসত, তাকে দেখা গেছে, কাশীতে মণিকর্ণিকা ঘাটে, গাড়োয়ালের কোনও অঘোরী সাধুর আখড়ায় প্রবল শীতের রাতে খিচুড়ি রাঁধছেন। একবার হাওড়া স্টেসনে এসেছিলেন। বাড়ি আসেননি, ফিরতি ট্রেনে উঠে চললেন কোথায় বলেননি। দুঃখের মধ্যে, পরার্থের মধ্যে, সেবার মধ্যে কোনও আনন্দময় সত্য তিনি খুঁজে পেলেন! রাতের অবর্ণনীয় রহস্যময়তায় কালপিন সাহেবের শ্মশানে চিতা জ্বলে। গঙ্গা থেকে উঠে আসে নৈঃশব্দ্য শান্ত বাতাস। কে জানে পথ পাশে বৃক্ষতলে, কোন পাহাড়ের শিলাসনে, কোন কলনাদিনী নদীর নির্জন তটে তার দেখা মিলে যাবে।

চিত্রণ: মুনির হোসেন

কচুরি

Advertisement

কারখানা বিরিয়ানি

লিটল বুদ্ধ

বাংলা আওয়াজ

শেরপা

সবুজ মিডাসের ছোঁয়া

ঘুষ

জুতো

মাদারি কা খেল

সিঁড়ি

ইসবগুল

One Response

  1. একেবারে আধুনিক হুতোম । হ্যাঁ, শীর্ষেন্দু, মায় তারাপদর ছাপও আছে বইকি । তবে অতীতকে আহরণ করেই তো বর্তমানের ঐশ্বর্য । অত্যন্ত সাবলীল লেখা নির্বাধ গতিতে এগিয়ে গেছে সমাপ্তির দিকে, যেখানে একটা volte face আমাদের জন্য ওৎ পেতে আছে । এত রংদার লেখা ইদানীং বড় একটা চোখে পড়ে না । লেখিকাকে টুপি-তোলা শুভেচ্ছা জানাই ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 − two =

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আমার স্মৃতিতে ঋত্বিককুমার ঘটক

দুটো‌ জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম তাঁর।‌ এক, তিনি কথা বলার সময় আত্মমগ্ন‌ থাকতেন। কারও দিকে‌ তাকিয়ে‌ কথা বলতেন না। তাকাতেন‌ হয় সুদূরে, আর নয়তো‌ চোখ বুজে‌ কথা বলতেন। আর দ্বিতীয় যা, তা হল‌ ঋত্বিকের চোখ। এত উজ্জ্বল আর‌ মরমী, এক-ই সঙ্গে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত আর লুব্ধক নক্ষত্রের মতো দীপ্ত, তা আর কারও মধ্যে দেখিনি। সত্যজিৎ-মৃণালের মধ্যেও না, যদিও ঘটনাচক্রে ওই দু’জনের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল অনেক বেশি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঋত্বিক ঘটক ও বাংলাদেশ

ঋত্বিক ঘটকের জীবনের প্রথম বাইশ বছর (১৯২৫-১৯৪৭) কেটেছে মূলত পূর্ব-বাংলায়, যা এখনকার বাংলাদেশ। তাঁর জন্ম ঢাকার ২,ঋষিকেশ দাস রোডের ঝুলন বাড়িতে। ১৯৪৭, অর্থাৎ দেশভাগ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি মূলত পূর্ব-বাংলায় কাটান। আমরা দেখব, পূর্ব-বাংলা যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, সে-দেশ, সে-ভূমির প্রভাব তদনুরূপ ঋত্বিকেরও পড়েছিল তাঁর চলচ্চিত্রে।

Read More »
মণিকর্ণিকা রায়

অনুগল্প: অর্জন

অসহায় বৃদ্ধের খাওয়া হয়ে গেলে মাঝেমাঝে গল্পও করত ওঁর সাথে। আদিত্য লক্ষ্য করেছিল এই ব্যাপারটা যেন তার মনে একটা বদল আনছে— যেন রোজ তার শরীর-মন জুড়ে সঞ্চালিত হচ্ছে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি। যেন সে সত্যিই মানুষ হয়ে উঠছে।

Read More »
মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনানন্দ দাশের সময়চেতনা: পুরাণ, প্রকৃতি ও আধুনিক নিঃসঙ্গতার নন্দনতত্ত্ব

পৌরাণিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিগত সময়চেতনা তাঁকে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে এক স্থায়ী ও ব্যতিক্রমী মহাকবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শিল্পকর্ম আমাদের শেখায়— দ্রুত ধাবমান জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে চলতে, নীরবতার গভীরে কান পাততে এবং প্রতিটি ক্ষণিকের মাঝে অনন্তের ইশারাকে খুঁজে পেতে। তাঁর সাহিত্য ভবিষ্যতের প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের জন্য আধুনিকতার এক অমূল্য পাঠ হয়ে থাকবে, যা মানুষের জীবনকে শিল্প ও প্রকৃতির একাত্মতায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং প্রমাণ করে দেয়— কাব্যই চূড়ান্ত আশ্রয়, যখন সমস্ত পথ ফুরিয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে?

Read More »