Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

কবির অন্তর্জীবন: একটি সফল ঐতিহাসিক উপন্যাস

বিশিষ্ট রবীন্দ্র অধ্যাপক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য মহাশয়ের সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘হৃদয়ে রয়েছ গোপনে’ (ফেব্রুয়ারি ২০২২) হৃদয় স্পর্শ করার মত উপন্যাস। রচনারীতির দিক থেকে গ্রন্থটিকে বলা যেতে পারে ‘জীবনধর্মী ঐতিহাসিক উপন্যাস’ বা ‘কবিজীবনী’। রবীন্দ্রনাথের জীবনের ঘটনাপঞ্জী বা কার্যবিবরণী তুলে ধরবার উদ্দেশ্য নিয়ে এ গ্রন্থ রচিত হয়নি। ‘কবিরে পাবে না তাহার জীবনচরিতে’ কবির এই বাণীকে শিরোধার্য করে ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথের অন্তর্জীবনের গভীরে প্রবেশ করে সকলের আড়ালে থাকা অকৃত্রিম এবং স্বাভাবিক মহত্ত্বের সত্যটাকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। একদা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মহৎব্যক্তির কার্য বিবরণ কেবল তথ্য মাত্র, তাঁহার মহত্ত্বটাই সত্য, সেই সত্যটি পাঠকের মনে উদিত করিয়া দিতে ঐতিহাসিকের গবেষণা অপেক্ষা কবিপ্রতিভার আবশ্যকতা অধিক।’ ‘হৃদয়ে রয়েছ গোপনে’ এই উপন্যাসে ঐতিহাসিকের গবেষণার পরিচয় যেমন খুঁজে পাওয়া যায় তেমনি বেশি বেশি করে মেলে কবির অন্তরে লুকিয়ে থাকা কবির পরিচয়।

রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা বাংলা সাহিত্যে এই প্রথম যথার্থ জীবনীধর্মী ঐতিহাসিক উপন্যাস রচিত হল বলা যেতে পারে। লেখক গতানুগতিক ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে গিয়ে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে উপন্যাসের মিনারটি গড়ে তুলেছেন। আজ থেকে একশ বছর আগেকার শান্তিনিকেতনের পুরাতন আশ্রমের পরিবেশকে পটভূমি বা ভিত্তিভূমি হিসেবে গ্রহণ করে উপন্যাসের প্লট নির্মিত। ষাটটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত করে উপন্যাসের প্লট সাজানো হয়েছে। প্রত্যেক পরিচ্ছেদের শুরুতেই অধ্যায়সূচক চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছে বসন্তের প্রতীকে নন্দলাল বসুর আঁকা একটি দুর্লভ রেখাচিত্র। রেখাচিত্রের ঠিক নীচেই দু-একটি বাক্যে পরিচ্ছেদের সারকথাটি তুলে ধরা হয়েছে। গ্রন্থের অভ্যন্তরে স্বতন্ত্র পৃষ্ঠায় মূল্যবান বারোটি ছবি সংযোজিত হয়েছে। গ্রন্থের প্রচ্ছদটি সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে তুলেছেন বিশিষ্ট চিত্রচিন্তক চিত্রী সুশোভন অধিকারী ও কৃতী চিত্রশিল্পী সুমন কবিরাজ। গ্রন্থনামটি যেমন হাতের স্পর্শে অনুভববেদ্য তেমনি গ্রন্থের জ্যাকেটটি হয়েছে সুশোভন ও মনোহর। যা দেখে মনে হয় গ্রন্থকার বিষয়গুণেই শুধু গ্রন্থটিকে আকর্ষণীয় করে তুলতে চাননি প্রকাশনার ক্ষেত্রেও এক বিশেষ মাত্রা যুক্ত করে দিয়েছেন।

বঙ্গসমাজে স্বনামধন্যা এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব— খ্যাতিসম্পন্না প্রিয়দর্শিনী নারী কাশীবাসী ফণীভূষণ অধিকারীর কন্যা প্রীতি অধিকারী ওরফে লেডি রাণু মুখার্জির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রেমপ্রীতি ভালবাসার সম্পর্ক নিয়ে রচিত এই উপন্যাস। ঔপন্যাসিক অসমবয়সী দুই নরনারীর মধ্যে গড়ে ওঠা ঘনিষ্ঠ প্রেম মধুর সম্পর্কের সত্যটাকে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “তারপর একদিন সবকিছু আমার চোখের সামনে কেমন পরিষ্কার হয়ে গেল। এই প্রেমের মধ্যে তো লুকোচুরির কিছু নেই— এই প্রেম সত্য নির্মল স্বতঃস্ফূর্ত সুন্দর এবং সৃষ্টিশীল। তার পরিণতি হয়ত মধুর ও সুখকর হতে পারেনি, তথাপি সেই দুটি অসমবয়সী নরনারীর অতিবাহিত সাতটি বসন্তের সম্পর্কের সত্যটিকে অস্বীকার করি কেমন করে? একেও তো বলা যায় উভয়ের মধ্যে এক ধরণের আধুনিক রিলেসনশিপ।”

এই আধুনিক রিলেসনশিপের সত্যটিকে ধরবার জন্য ঔপন্যাসিক প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন রাণুকে লেখা রবীন্দ্রনাথের দুশো আটটি চিঠি এবং রবীন্দ্রনাথকে লেখাকে রাণুর আটষট্টিটি চিঠি। তাছাড়া ঔপন্যাসিকের সারা জীবনের বহু রবীন্দ্র সান্নিধ্য ধন্য মানুষের সাক্ষাতের অভিজ্ঞতাও বিশেষ সহায়ক হয়ে উঠেছে। উপন্যাসের প্রতিটি পাতায় গেঁথে দেওয়া হয়েছে ১৯৬৬ সাল থেকে শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে বসবাসের ফলে ঔপন্যাসিকের মনে ছাপ ফেলা শান্তিনিকেতনের মাটি, পথঘাট, আকাশ, বৃক্ষলতা, ঘরবাড়ি, শালবীথি, আম্রকুঞ্জ, মন্দির, ছাতিমতলা, খোয়াই, কোপাই নদীর কথা। ঔপন্যাসিকের প্রাণের কথাগুলো, ব্যথাগুলো, স্বপ্নগুলো, আশাগুলো, সত্যিগুলো যা এতদিন হৃদয়ে গোপন ছিল তা ভাষায় প্রকাশিত হল ‘হৃদয়ে রয়েছ গোপনে’ উপন্যাসে।

রাণু-রবীন্দ্রনাথের পারস্পরিক চিঠিগুলি ঔপন্যাসিককে দীর্ঘদিন ভাবিয়ে তুলেছিল। তাই এই দুজনের সম্পর্ককে তিনি খুব সাদা সহজ সরল সাধারণ সম্পর্ক বলে মেনে নিতে পারেননি। তিনি সেই সম্পর্কের মধ্যে দেখেছেন নানা বিচিত্র মাত্রার বহু রঙের রামধনু। সেই মধুর সম্পর্কে তিনি কখনও দেখেছেন মেঘ, কখনও বৃষ্টি আবার কখনও মুক্ত নীল আকাশ।

তিনশো ষাট পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির সূচনা রাণুর অতীত স্মৃতিচারণায়। বিবাহের পর কবির জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে লেডি রাণু মুখার্জি এসেছেন তার চিরচেনা ও অতিপুরাতন শান্তিনিকেতনে। ঔপন্যাসিকের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটেছে। শান্তিনিকেতনের পরিবেশ, প্রকৃতি এবং মানুষজন আজও দোলা দিয়ে যায় তার হৃদয়ে। একে একে তার স্মৃতিতে ভিড় করে আসে পুরনো সেই দিনের কথা। আজ তিনি নেই কিন্তু আছেন তিনি সর্বত্র। শান্তিনিকেতনের আকাশে বাতাসে, রাণুর সর্বাঙ্গে, হৃদয় জুড়ে তাঁর আসন। অতীতের সেই মন্দির, উদয়ন বাড়ি, উত্তরায়ণ, বৈতালিক উৎসব রাণুর স্মৃতির কোণে কোণে বাজে অনুক্ষণ। আজও রাণু ভুলতে পারে না তার একান্ত আপন শান্তিনিকেতনকে এবং সব থেকে আপন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার সম্পর্কের সত্যটাকে। যে সত্যটি ঔপন্যাসিক তাঁর উপন্যাসে ধরবার চেষ্টা করেছেন বারে বারে।

ঔপন্যাসিক জানিয়েছেন, রাণুর প্রথমত রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভালবাসা জন্মেছিল তাঁর লেখা পড়েই। যখন তার বয়স দশ বছর দশ মাস তখন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় লেখা রাণুর পড়া হয়ে গেছে। এহেন পড়ুয়া রাণুর সঙ্গে কবির ভালবাসা ক্রমেই গভীর হয়ে উঠেছিল— চিঠি আদানপ্রদানের মাধ্যমে, রবীন্দ্রনাথকে কাছে পেয়ে এবং শান্তিনিকেতনে বসবাসের ফলে। রাণুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে কবির জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতার (বেলা) মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই, কলকাতাতে। বেলার মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথের মনে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল তা কবি ভুলতে পেরেছিলেন রাণুকে কাছে পেয়েই। ঔপন্যাসিক জানিয়েছেন প্রিয়সঙ্গসুখবঞ্চিত কবি বেলার মৃত্যুশোক ভোলবার জন্যই বেলার মৃত্যুর দিন থেকে পর পর দশ বারো দিন ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় বন্ধু রাণুর কাছে। একদিন কবি তাঁর প্রিয় বৌঠানের কাছে যেমন প্রাণের কথাগুলো উজাড় করে নিবেদন করতেন তেমনই আজ কবি তাঁর প্রিয় সখীর কাছে মনের জমে থাকা কষ্টগুলো, বেদনাগুলো, স্মৃতিগুলো উজাড় করে দিতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে রাণু কতটা ভালবেসেছিল, আর রবীন্দ্রনাথই বা কতটা রাণুকে স্থান দিয়েছিলেন তাঁর মনের মণিকোঠায় তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন ঔপন্যাসিক তাঁর মূল্যবান গ্রন্থে।

রবীন্দ্রনাথ রাণুকে ভালবেসেছিলেন, স্নেহ করেছিলেন, যত্নে রেখেছিলেন, শত শত চিঠি দিয়ে তাঁর সঙ্গে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত সম্পর্ক রেখেছিলেন, কুশল কামনা করেছিলেন, মঙ্গল কামনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রাণুর কত কথা, কত গল্প, কত গান, কবিতা, নাটক, কত কত অভিনয় কত মহড়া, ছায়া ঘেরা পাহাড়ী পথে বৈকালিক ভ্রমণ, কত দুরন্তপনা, কত অত্যাচার, কত রাগ অভিমান, আদরের পরিচয় মিলবে এই উপন্যাসের পাতায় পাতায়। এক কথায় বলা যেতে পারে, ষাটোর্ধ্ব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কিশোরী রাণুর প্রথম যৌবনের সাতটি বসন্তের অবিস্মরণীয় সময়ের ফেলে আসা মধুর স্মৃতির অমূল্য সেরা স্মারক গ্রন্থ ‘হৃদয়ে রয়েছ গোপনে’।

উপন্যাসের নায়িকা রাণুকে রবীন্দ্রনাথ খেলাচ্ছলে বলেছিলেন, ‘আমাদের সত্যিকারের বিয়ে হয়ে গেছে।’ রবীন্দ্রনাথের মুখের এই বাক্যটিকেই রাণু তার জীবনে ধ্রুবতারার মত গ্রহণ করে বলে, ‘‘আমি কবিকে ভালোবাসি; উনি আমার পিতার চেয়েও বয়সে বড়ো হলেও ওঁকেই আমি আমার মন প্রাণ সমগ্র সত্তা দিয়ে ভালোবাসি। উনিও আমাকে আমারই মতন ভালোবাসেন।’’ ঔপন্যাসিকের সমীক্ষা অবশ্য অন্য কথা বলে, রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের মত করেই রাণুকে তাঁর জীবনে গ্রহণ করেছিলেন, স্থান দিয়েছিলেন। ঔপন্যাসিক কবির মুখে সে কথাই শুনিয়েছেন, ‘‘তোমাকে আমি সর্বস্ব দিয়ে সর্বাঙ্গ দিয়ে ভালোবেসেছি, অস্বীকার করছি না। সেই স্নেহ যত্ন আদর ভালোবাসা তোমার প্রতি আমার চিরকালই থাকবে। কিন্তু তুমি আমাকে বিশ্ববাসীর আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে গৃহবাসী হয়ে থাকতে বলো না। তা আমি পারব না রাণু।’’ কবির এত স্নেহ, এত আদর, এত ভালবাসা সত্ত্বেও রাণুর বিবাহ স্থির হল প্রখ্যাত মহিলা ঔপন্যাসিক অনুরূপা দেবীর উৎসাহ উদ্‌যোগে বিখ্যাত শিল্পপতি সার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র বীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে। রাণুর জীবনে এল দুই নাথ একজন হলেন তার পতিদেবতা বীরেন্দ্রনাথ এবং অন্যজন হলেন তার হৃদয়ের গোপন নিভৃত প্রকোষ্ঠে বিরাজিত সুখদুঃখের নাথ তার অন্তরতর রবীন্দ্রনাথ।

বিবাহের পূর্বে একটা সময়ে রাণুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ককে ঘিরে জটিল আবর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। যার জন্য গুরুদেবকে অনেক বেদনা, যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। বিষয়টিকে পাখির চোখ করে এর জন্য কে বা কারা দায়ী ছিলেন তাঁর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ঔপন্যাসিক তুলে ধরেছেন তাঁর উপন্যাসে। পাশাপাশি এই বিষয়টিও স্পষ্ট করে দিয়েছেন রাণুর প্রেমে রবীন্দ্রনাথ কি তৃপ্ত হতে পেরেছিলেন? প্রেম এই শব্দটি কীভাবে জীবনে গ্রহণ করেছিলেন কবি? ঔপন্যাসিকের রাণু বলে, ‘‘আমি শুধু জানি যা হল প্রেম তা হল ভালোবাসা। তার অনেকটা আমি কবির কাছ থেকেই শিখেছি। প্রকৃত প্রেমে পূর্ণতা আছে, পাপ নেই।’’ আসলে রবীন্দ্রনাথ দেহযুক্ত প্রেমে বিশ্বাসী ছিলেন না। দেহহীন প্রেমের বীণাই তিনি বাজিয়েছেন সারাজীবন। আর সেই দেহহীন চামেলীর সুবাসই ঔপন্যাসিক বিলিয়েছেন তাঁর ‘হৃদয়ে রয়েছ গোপনে’ উপন্যাসের সর্বত্র। দেখিয়েছেন উমার প্রার্থনা তপস্যারূপে শঙ্করকে আঘাত করে যখন জাগিয়ে দিতে পারে তখনই তিনি সুন্দর হয়ে পূর্ণ হয়ে, চিরনবীন হয়ে বেরিয়ে আসেন। অষ্টাদশী রাণু ভালবাসা দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে তেমন করে জাগাতে পারেনি। ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথের চিঠির অংশ তুলে ধরে কবির মনের আক্ষেপ ও বাসনার অতৃপ্তির সত্যটাকেই স্পষ্ট করেছেন, “কতকাল থেকে উৎসুক হয়ে আমি ইচ্ছা করেছি কোনো মেয়ে আমার সম্পূর্ণ আমাকে প্রার্থনা করুক; আমার খণ্ডিত আমাকে নয়। আজো তা হল না-সেই জন্যেই আমার সম্পূর্ণ উদ্বোধন হয় নি। কি জানি আমার উমা কোন্‌ দেশে কোথায় আছে? হয়ত আর জন্মে সেই তপস্বিনীর দেখা পাব।’’

এ কথা সত্য, রাণু ও রবীন্দ্রনাথের প্রেমের অম্লমধুর সম্পর্কের কথাতেই পূর্ণ এই উপন্যাস। কিন্তু সেই প্রেমকথা বলতে গিয়ে শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যুক্ত কত যে মানুষ ও কত যে ঘটনার কথা বলেছেন ঔপন্যাসিক যা উপন্যাসের শ্রীবৃদ্ধির সহায়ক হয়ে উঠেছে। উপন্যাসে ঘটনা ও চরিত্রগুলি এমনভাবে মূল কাহিনির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে যাকে আলাদা কোনও শাখা কাহিনি বা উপকাহিনি বলে মনে হয় না। অকারণ মেদস্ফীত করবার জন্য যে এই সব ঘটনা ও চরিত্রগুলি নির্মিত হয়নি তা উপন্যাসটি পাঠ করলেই বোঝা যায়। আর শুধু তো মানুষ নয়! শান্তিনিকেতনের পরিবেশ, প্রকৃতি, উৎসবের যে পরিচয় উপন্যাসে মেলে তাতে করে আমরা খুব সহজেই ফিরে যেতে পারি আজ থেকে একশো বছর আগে, পুরনো সেই শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতন যে প্রকৃতির লীলাভূমি ঔপন্যাসিক তাঁকে মন ও প্রাণ দিয়ে অনুভব করেছেন, আর রোম্যান্টিক দৃষ্টি দিয়ে তাঁকেই ফুটিয়ে তুলেছেন। সেকারণে উপন্যাসে প্রকৃতির ভূমিকা হয়ে উঠেছে জীবন্ত। প্রকৃতি যেন এখানে আপন মনে নিজেই নিজের কথা বলে চলেছে।

‘হৃদয়ে রয়েছ গোপনে’ উপন্যাসটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। উপন্যাসটিতে রবীন্দ্রনাথের কত না কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ সৃষ্টির ইতিহাস তথা উৎসভূমি খুঁজে পাওয়া যায়। উপন্যাসে বিভিন্ন প্রসঙ্গে গানের ব্যবহার হয়েছে যথাযথ। ঔপন্যাসিক গানগুলি দিয়ে তাঁর নায়ক-নায়িকার জীবন ও মনের এবং প্রাণের স্বরলিপিটি ধরবার চেষ্টা করেছেন। যেন বলতে চেয়েছেন— ‘আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলবো না গো, গান দিয়ে দ্বার খোলাব।’

ঔপন্যাসিক তাঁর এই উপন্যাসে নানা রবীন্দ্রনাথের একটি মালা গেঁথে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ যে শুধুমাত্র একজন কবি নন, কর্মী, শিল্পী, সাধক, প্রেমিক তাঁরও পরিচয় রয়েছে এই উপন্যাসে। শিক্ষক হিসেবে, অভিনেতা হিসেবে, প্রযোজক হিসেবে সর্বোপরি মানুষ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন তাকেই নানাভাবে দেখবার ও বোঝবার চেষ্টা করেছেন গ্রন্থকার।

এই গ্রন্থে রয়েছে ভ্রমণ বৃত্তান্তের নানা তথ্য। রাণুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের এই কালপর্বে ভ্রমণপিপাসু রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর কত দেশ কত স্থান পরিক্রমা করেছিলেন, কী ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তারও বিস্তৃত বিবরণ একজন ঐতিহাসিকের মত নিরাসক্ত দৃষ্টিতে ছবির মত গেঁথে দিয়েছেন। সেই সময়ে বিখ্যাত যাঁরা, প্রখ্যাত যাঁরা তাঁদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের বন্ধন কত সুদৃঢ় ছিল, তাঁরাও মনে ও প্রাণে কীভাবে শান্তিনিকেতনকে আপন বলে গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের হৃদয়ের গোপন কথাটিও আছে এই উপন্যাসে।

সত্যিই পুরাতন শান্তিনিকেতনের পটভূমিতে রবীন্দ্রনাথ ও রাণুকে নিয়ে রচিত এ এক অনবদ্য প্রেমের উপাখ্যান, জীবননির্ভর আশ্চর্য এক ঐতিহাসিক উপন্যাস। ইতিহাসের তথ্য আর উপন্যাসের কল্পনার সত্য এই উপন্যাসে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে । উপন্যাসের ভাষা ঝকঝকে তকতকে সুন্দর। বাক্যের গঠন কখনও কখনও হয়ে উঠেছে ভাবাবেগপূর্ণ রোম্যান্টিক। উপন্যাসের সমাপ্তি মনোমুগ্ধকর। রাণুর জীবন ‘রোদন ভরা বসন্তে’ পরিণত হয়েছিল কিনা জানি না কিন্তু উপন্যাস পাঠে এটুকু জেনেছি রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে এবং স্নেহ আশীর্বাদে রাণুর বিবাহবাসর পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। অবচেতনেই রাণুর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল সেই চিরন্তন ধ্বনি—
‘তোমার কোমলকান্ত চরণ-পল্লব
চিরস্পর্শ রেখে দেয় জীবন তরীতে,—
কোনো ভয় নাহি করি বাঁচিতে মরিতে।’

3.7 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

সন্দীপ মজুমদার

মামলায় জয়ী হয়ে থোড় কুঁচি দিয়ে কালীর আরাধনা করেন জমিদার-গিন্নি

রূপনারায়ণ মজুমদারের হাত ধরেই মা মহাকালীপুজো শুরু হয়। যেহেতু জমিদার-গিন্নি পুজোর উপকরণ হিসাবে কলা-থোড় কুঁচোর কথা মুখে এনেছিলেন, তাই পুজোর অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে সেদিন দেবীকে থোড় কুঁচোও উৎসর্গ করা হয়েছিল। আজ ১৬৯ বছর পরেও সেই রীতির কোনও পরিবর্তন হয়নি। এখনও মজুমদার বাড়ির কালী পুজোয় অন্যান্য সকল উপকরণের সঙ্গে মা মহাকালীকে থোড় কুঁচানো দেওয়া হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বরিশাল শ্মশান-দীপালি

সমগ্র উপমহাদেশে বরিশাল শ্মশান একটি বিশেষ কারণে অনন্য। এই শ্মশানের বৈশিষ্ট্য হল, প্রতিবছর কার্তিকী অমাবস্যায়, (যাকে শাস্ত্রে ‘অশ্বযুজা’ মাস বলে) সেখানকার এই শ্মশানে যে কালীপুজো হয়, সেখানকার পুজোর আগের দিন ভূতচতুর্দশীর রাতে লক্ষ লোকের সমাবেশ হয়। উদ্দেশ্য, ওখানে যাঁদের দাহ করা হয়েছে, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। সমগ্র শ্মশান জুড়ে কয়েক হাজার মঠ বা স্মৃতিসৌধ আছে, মুসলমানদের যেমন আছে বনানী বা অন্য বহু গোরস্তানে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বৌদ্ধসম্প্রদায়ের প্রবারণা ও কঠিন চীবরদান উৎসব

বিশ্বের বহু দেশেই এই উৎসব সাড়ম্বরে পালিত হয়। স্পেন ও ফ্রান্স-সহ ইয়োরোপীয় দেশে চীনা, জাপানি, বাঙালি বৌদ্ধরা পালন করেন যেমন, তেমনই বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি থেকে কুয়াকাটা-কলাপাড়া এই উৎসবে মেতে ওঠে। ইওরোপীয়দের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েকবছর আগে দালাই লামা যেবার শিলিগুড়িতে তাঁর বার্ষিক অনুষ্ঠান করলেন, সেবার প্যারিস থেকে আগত বেশ কিছু ফরাসির সঙ্গে আলাপ হয়, যাঁরা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত। তাঁদের কাছেই শুনেছিলাম, ফ্রান্সে বহু মানুষ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিচ্ছেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপুজো: অতীত দিনের স্মৃতি

মহালয়া দিয়ে হত পুজোর প্রকৃত সূচনা। শরতের ভোররাতে আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত এই অনুষ্ঠানটির শ্রোতা অন্তহীন, এবং এখনও তা সমান জনপ্রিয়। বাংলাদেশেও অনুষ্ঠানটির শ্রোতা অগণিত। আমাদের শৈশবে বাড়ি বাড়ি রেডিও ছিল না, টিভি তো আসেইনি। বাড়ির পাশে মাঠে মাইক থাকত, আর প্রায় তিনশো গজ দূরের এক বাড়িতে মাউথপিস রাখা থাকত। সেখান থেকে ভেসে আসত মহালয়ার গান, ভাষ্য।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গাপূজা, মূর্তিপূজা: দেশে দেশে

আসলে বাঙালি নিরন্তর এক অনুসন্ধানী, ব্যতিক্রমী, অভিনব-চিন্তক, ক্রমবিকাশপ্রিয় ও অন্তিমে রহস্যময় জাতি। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমান আস্তিক নাস্তিকে মিলিত এই জাতি সঙ্ঘারাম আর মিনার, ধ্বজা ও ওংকার, জগমোহন-মিরহাব-স্তূপ-ভস্মাচ্ছাদিত এক জাতি, নিজ মুদ্রাদোষে নয়, মু্দ্রাগুণে আলাদা।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শারদোৎসব: বাংলাদেশে

দুর্গাপুজো কেবল ভক্তের জন্য-ই নয়, ভাল লাগাদের জন্যও। যে ভাল লাগা থেকে ভাই গিরীশচন্দ্র সেন কোরানশরীফ বাংলায় অনুবাদ করেন, অদ্বৈত আচার্য যবন হরিদাসের উচ্ছিষ্ট নিজহাতে পরিষ্কার করেন, স্বামী বিবেকানন্দ মুসলিম-তনয়াকে কুমারীপুজো করেন! দুর্গা বাঙালির কাছে, ধর্মনির্বিশেষে আগ্রহের, যেহেতু এই দেবী পরিবারসহ আসেন, আর সঙ্গে নিয়ে আসেন কাশফুল আর শিউলি। তাই তো সনাতন রামপ্রসাদ, খ্রিস্টান মাইকেল, ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ এবং মুসলমান কাজী নজরুল দুর্গাকে নিয়ে কলম না ধরে পারেননি!

Read More »