আমরা যারা নব্বই দশকে বড় হয়েছি তাদের কাছে সোমালিয়া, রুয়ান্ডা কিংবা বসনিয়া নামগুলো এক-একটা বিভীষিকার মত। টিভি খুললেই সেসব দেশের যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞের ছবি দেখা যেত। সেসব দেশ এখন কেমন আছে আসুন একটু খোঁজ নিয়ে জানা যাক।
১৯৯৪ সালের ৭ এপ্রিল। হঠাৎ করে রুয়ান্ডা জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতু ঝাপিয়ে পড়ে তুতসি জনগোষ্ঠীর ওপর। এ দাঙ্গায় ১০০ দিনে ৮ লক্ষ মানুষ মারা যায়। সে রুয়ান্ডা এখন আফ্রিকার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ দেশ। রুয়ান্ডাকে বলা হয় আফ্রিকার ‘টেক-হাব’। রুয়ান্ডা ব্যবসা করার জন্য আফ্রিকার দ্বিতীয় সেরা দেশ। সেখানে আফ্রিকার সেরা বিচার বিভাগ, দ্বিতীয় সেরা পুলিশ, তৃতীয় সেরা সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। রুয়ান্ডায় প্রতিটি শিশুর জন্য ১টি করে ল্যাপটপ রয়েছে। রুয়ান্ডায় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা। এটি লিঙ্গসমতার ক্ষেত্রে আফ্রিকার দ্বিতীয় শীর্ষ দেশ।
রুয়ান্ডা আফ্রিকার নেতৃস্থানীয় ই-কমার্স রাষ্ট্র। এর রাজধানী কিগালি আফ্রিকার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহর। এটি আফ্রিকার প্রথম দেশ যেখানে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা ড্রোনের মাধ্যমে দেওয়া হয়। রাষ্ট্র থেকে প্রত্যেক নাগরিকের চক্ষু পরীক্ষা করা হয়। রুয়ান্ডা জরায়ুর ক্যান্সার নির্মূলে বিশ্বের প্রথম দেশ হতে চলেছে। জাতীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থা রুয়ান্ডা এয়ার আফ্রিকার সবচেয়ে বড় বিমান সংস্থা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। রুয়ান্ডাকে ইতিমধ্যে আফ্রিকার সিঙ্গাপুর বলা হয়। অথচ ভূবেষ্টিত এ রাষ্ট্রটির জনসংখ্যা যেমন কম, আয়তনেও তেমন ছোট। খুব বেশি যে খনিজ সম্পদ আছে তাও না।
দেশটিতে জার্মান ও বেলজিয়ামের উপনিবেশ ছিল। ১৯৬২ সালে দেশটি স্বাধীন হয়। ১৯৯৪ সালে দেশটির জনসংখ্যা ছিল ৭০ লক্ষ। এর মধ্যে ৮৫% ছিল হুতু, ১৪% তুতসি এবং ১% তোয়া জনগোষ্ঠী।
হুতু ও তুতসি জনগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা কঠিন। তারা একই ভাষায় কথা বলে। দীর্ঘদিন একই সঙ্গে বসবাস করে আসছে। ১৮৮৪ সালে তুতসি রাজার কাছ থেকে জার্মানি রুয়ান্ডার ক্ষমতা কেড়ে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯১৬ সালে জার্মানির কাছ থেকে বেলজিয়াম রুয়ান্ডার শাসন বুঝে নেয়। ক্ষমতা পেয়ে তারা ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসিতে এগোতে থাকে। ১৯২০ সালে তারা প্রতিটি নাগরিকের শারীরিক বৈশিষ্ট্য পরিমাপ করে হুতু ও তুতসিতে পৃথক করে। প্রত্যেক নাগরিককে পরিচয়পত্র প্রদান করে। যে মানুষগুলো জানতই না তারা কোন জনগোষ্ঠীর, ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো তাদের তা ডেকে এনে জানিয়ে দেয়।
দুটি গোষ্ঠীর সর্দারদের উদ্বুদ্ধ করে এক গোষ্ঠী থেকে আর-এক গোষ্ঠীকে শ্রেষ্ঠতর ভাবতে। বিশেষ শারীরিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে তাদের আলাদা করে প্রত্যেককে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। বেলজিয়ামের শাসকগোষ্ঠী সংখ্যালঘিষ্ঠ তুতসিদের কাছে টেনে নেয়। তাদের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সুবিধা দিয়ে এগিয়ে যেতে সুযোগ করে দেয়। তুতসিরা তাতে ভাবতে শুরু করে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতুদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর।
১৯৬২ সালে রুয়ান্ডার প্রথম জাতীয় নির্বাচনে হুতুরা ক্ষমতায় আসে। গ্রেগরি কায়িবান্দা প্রেসিডেন্ট হন। রুয়ান্ডা স্বাধীন হয়। ১৯৭৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কায়িবান্দাকে হটিয়ে তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেবক মিলিটারি অফিসার জুভেনাল হাবায়ারিমানা ক্ষমতায় আসেন। অনির্বাচিত সরকার সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে জাতিগত বিদ্বেষকে কাজে লাগাতে শুরু করে। তখন থেকে হুতু-তুতসি দাঙ্গা শুরু হয়।
অনেক তুতসি দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নেন।
১৯৯০ সালে রুয়ান্ডান পেট্রিয়াটিক ফ্রন্ট বা আরপিএফ নামে একটি বিদ্রোহী বাহিনীর আবির্ভাব ঘটে। এটি মূলত নির্বাসিত তুতসি যুবকদের দ্বারা গঠিত হয়েছিল। তারা উগান্ডা থেকে রুয়ান্ডার সরকারি বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করেন। ১৯৯৩ সালের আগস্ট মাসে রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট হাবায়ারিমানার সঙ্গে আরপিএফ-এর সঙ্গে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। কিন্তু এই শান্তিচুক্তি রুয়ান্ডায় শান্তি বয়ে আনেনি। দুই পক্ষেই এই শান্তিচুক্তির বিরোধীদের তৎপরতা শুরু হয়।
১৯৯৪ সালে ৬ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট হাবায়ারিমারাকে বহনকারী বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। সেখানেই প্রেসিডেন্ট মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু কারা এই কাজটি করেছে সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে হুতু উগ্রবাদীরা এই পুরো সুযোগটা নেয়। দুঃখজনকভাবে সরকারি রেডিও থেকে প্রতিবেশী তুতসিদের হত্যা করার আহ্বান জানানো হয়। সরকারই পুরো হত্যাযজ্ঞকে উৎসাহিত করে। এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী রুয়ান্ডায় নিযুক্ত হয়। তারাও নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়। রুয়ান্ডায় ২৬০ জন শান্তিরক্ষী নিহত হন।
এত মৃত্যুর পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অধিক শান্তিরক্ষী নিয়োগে গড়িমসি করে। পরের বছর যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিল কিল্টন স্বীকার করেন রুয়ান্ডায় তারা সঠিক ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত রুয়ান্ডা জুড়ে অরাজকতা ছিল। কোনও সরকারের অস্তিত্ব ছিল না।
জুলাই মাসে আরপিএফ দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে মাঠে নামে। জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে তারা পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। হুতু বিজিমুঙ্গুকে প্রেসিডেন্ট ও তুতসি আরপিএফ-এর কমান্ডার পল কাগামেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট করে জাতীয় ঐক্যমতের সরকার গঠন করা হয়। আরপিএফ-এর সাফল্য দেখে পালিয়ে যাওয়া তুতসিরা পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে ফিরতে শুরু করেন। আরপিএফ আবার জাতীয় পুনর্মিলন ও ন্যায়বিচার শুরু করে। রুয়ান্ডার গ্রামে গ্রামে একসময় গাকাকা নামের গ্রাম্য আদালত ছিল। সেটা আবার চালু করা হয়। যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের জন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল ফর রুয়ান্ডা (আইসিটিআর) প্রতিষ্ঠা করা হয়।
২০০০ সালে পাস্তুর বিজিমুঙ্গু পদত্যাগের পল কাগামে প্রেসিডেন্ট হন। কাগামে পরবর্তীকালে ২০০৩ এবং ২০১০ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেন। যদিও মানবাধিকার সংস্থাগুলি এই নির্বাচনগুলিকে ‘রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং বাক-স্বাধীনতার ওপর আঘাত’ বলে সমালোচনা করেছে। রুয়ান্ডার সংবিধানের ১০১নং অনুচ্ছেদ পূর্বে কেউ দুবারের অধিক রাষ্ট্রপতি হতে পারতেন না। কিন্তু ২০১৫-র গণভোটে তার পরিবর্তন করা হয়। সংবিধানের এই পরিবর্তনের মাধ্যমে, কাগামে ২০৩৪ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহাল থাকতে পারবেন। কাগামে ২০১৭ সালে ৯৮.৭৯% ভোট নিয়ে তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হন।
এখন রুয়ান্ডাকে বলা হয় আফ্রিকার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন দেশ। আফ্রিকার অন্যতম ‘ফার্স্ট গ্রোয়িং কান্ট্রি’-র খেতাব দেওয়া হয়েছে রুয়ান্ডাকে। রুয়ান্ডা কীভাবে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন দেশ হল তার বিবরণ দেব এখানে।
২০০০ সাল থেকে রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আছেন পল কাগামে। উনি প্রতি মাসের শেষ শনিবার সারা দেশব্যাপী একটি কার্যক্রম পরিচালনা করেন। একে কিনিয়ারওয়ান্ডা ভাষায় উমুগান্ডা বলে। যার অর্থ, সাধারণ কোনও উদ্দেশ্যে একত্রিত হওয়া। মাসের এই এক শনিবার রুয়ান্ডার সর্বস্তরের মানুষ নিজ নিজ এলাকা পরিষ্কার করতে নামেন। এমনকি রাষ্ট্রপতি নিজেও এ কাজে হাত দেন। ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী সকল নাগরিকের এই কাজে অংশ নেওয়া বাধ্যতামূলক। এছাড়া প্রতি পরিবারকে মাসে দুই হাজার ও কোম্পানিকে ১০ হাজার স্থানীয় মুদ্রায় কর দিতে হয় পরিচ্ছন্নতার জন্য। একে পাবলিক ক্লিনিং ট্যাক্স বলা হয়।
২০০৮ সাল থেকে রুয়ান্ডায় প্লাস্টিক ব্যাগ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। রুয়ান্ডানরা কাগজ, কাপড়, কলার পাতা এবং প্যাপিরাস সহ অন্যান্য জৈব-অপচনযোগ্য উৎস থেকে তৈরি ব্যাগ ব্যবহার করেন। রুয়ান্ডায় ব্যাপক বনায়ন হচ্ছে। ২০২২ সালের মধ্যে দেশটির ৩৫ শতাংশ ভূমি বনে আচ্ছাদিত করা হবে।