দুদিন ধরে মা একটা বই লিখছে। বইয়ের নাম গ্যাস ও অম্বল। এ ব্যাপারে উনি গভীর বিশেষজ্ঞ। পনেরো বছরের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করার একটা দুর্দমনীয় উৎসাহ চলছে বাড়িতে।
সন্ধেবেলা শুনশান, মার ডায়েরি পছন্দ নিয়ে একটা পর্ব গেছে, এটা পুরনো, ওটা বেঁটে, এর পাতা লাল হয়ে গেছে, ডেট নেই কেন ইত্যাদি টালবাহানার পর একটা তাকিয়ায় রেখে লিখছে, তাকিয়ার চেয়ে ডায়েরি বড়।
সকালবেলা আমি বসে ভাবছি কী ভাবব। কিছু একটা ভাবা আমার খুব দরকার!।
গ্যাস সারানো মিস্ত্রি কেশবকে খবর দেওয়া হয়েছে, সে এখুনি এসে পড়বে, পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর মা উঠে আসছে, কেশব এল?
তোমার তো লেখায় মন নেই!
কেশবের বয়স হয়েছে, বহু পুরনো লোক, বহু কালের যাতায়াত।
তাতে কী?
না আমি ছাড়া ও সারাতে পারবে না। আমাকে বলতে হবে ফ্লেমটা কখন ঠিক নেমে যাচ্ছে, এটা রুটি করার পরই হচ্ছে।
হ্যাঁ, রুটি ব্যাপারটা ফ্লেমটা ঠিক নিতে পারছে না!
তুই কী বুঝবি, কেশবকে বললে ধরে নেবে।
কাশতে কাশতে কেশব ঢুকল, শীর্ণ, কোমরের পর থেকে একটু ভাঁজ খেয়ে গেছে, কিন্তু মিস্ত্রি পাকা, দূর থেকে ওভেন দেখেই বলে দেবে কী ডিফেক্ট আছে, পুরনো চালের মত সম্পর্ক, বেড়েই চলেছে।
গ্যাস সারানো হল, মা ইশারা করছে, আমি ভাবি চা করতে বলছে। কিন্তু না, মা একটা স্টিলের গ্লাসের দিকে ঈঙ্গিত করছে, ব্যাপার বুঝলাম না, জল দেব?
না-আ, ভেজানো আছে, দে।
গিয়ে দেখি একটা ক্বাথ মত কী যেন।
এসব কী?
ইসবগুল, জোয়ান মৌরীর আরক।
অ্যাঁ? কেশব খাবে?
কেশব লিকার চা বিড়িখোর, এ দুটোই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অলরেডি ঘড়ি বিড়ির প্যাকেট বের করে রেখেছে টেবিলে, চা খেয়ে ধরাবে।
মা বলল, কেশব তুমি অ্যাত কাশছ কেন?
আমি তো কাশি-ই মাসিমা।
এ তো পেটগরমের কাশি, তোমার পেট ফেঁপেছে।
না না, কেশব অল্প হেসেই গম্ভীর হয়ে গেল।
নাও এটা খেয়ে নাও।
এখন শরবত খাব না মাসিমা, সেই তিনটে বাজবে ভাত খেতে।
না না এটা খেতেই হবে, এ তো গ্যাসের লক্ষণ!
কেশব অনেকক্ষণ নিঃশব্দে অম্লানভাবে হাসল।
আমি চাপা গলায় বলি, কী হচ্ছে কী বিড়ি না খেলে মরে যাবে লোকটা, তুমি ওকে ধরলে কেন?
তা কী করব, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ওর পেট ফুলছে, বায়ু ঊর্ধ্বমুখে সঞ্চরণ করছে। পেট ভেতরে ঢুকে গেছে।
আরে কেশবদা বরাবরই তড়পা খ্যাঁচা।
এ সব কী অসভ্য কথা!
আরে ও গাঁজা টানে, গঙ্গার ধারে একটানে কল্কে ফাটায়, দম জানো?
না না এসব কী! কবে থেকে গ্যাস সারাচ্ছে।
গ্যাস সারায় বলে, গাঁজা খাবে না! ও তো তোমার গ্যাস সারাবে, তুমি ওর গ্যাস সারাতে চাইছ কেন?
আরক খাইয়ে ওর ধুনকি ভাঙতে চাইছ। এ কী অচ্যাচার?
ভদ্রবাড়িতে এসব কী হচ্ছে? আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
বাবা টেনে চিত হয়ে শুয়ে মস্তি নেবার সুযোগ তোমার যদি ঘটত, তুমি একটা স্বপ্নজগতের মধ্যে ট্রাভেল করতে।
কেন আমি কি ট্রাভেল করিনি, দিঘা-পুরী যাইনি!
সাইকেডেলিক জগতে ট্রাভেল, ইচ্ছামত যেখানে খুশি যেতে পারবে।
রান্নাঘরে ফিসফাস গুজগাজ চলছে, কেশব নিঃস্তব্ধ। গিয়ে দেখি সে গুটিগুটি কেটে পড়েছে।
আজকে মিস্ত্রিরিদের দিন। জলের কলে শাঁখ বাজার মত আওয়াজ হচ্ছে, বাঁশিও বাজছে, রাতবিরেতে সবাই ভয় পেয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ শিসের শব্দ, লোকজন চমকে উঠছে। তো ডাকা হয়েছে বীরেন্দরকে। সে বিহারি লোক, তার সাকরেদের নাম জামাই, দুজনেই পাঁইট সেন।
বীরেন্দর বিশাল ভুঁড়ি নিয়ে ঢুকল, সঙ্গে কাঁপতে কাঁপতে জামাই, ক্রিমরোলের মত পাকসিটে চেহারা, চোখ মরার মত আধবোজা, হাত বাঁশপাতার মত কাঁপছে, এই হাতেই রেঞ্চ নিয়ে সরু কার্নিসে উঠবে, সরকারি মাল গ্যাঁড়া মেরে মেরে হাত পাকা। রাস্তার ইলেক্ট্রিক ডুম চুরি করত আগে। ধরা পড়ে ক্যালানি খেয়ে সাগর দত্তে ভর্তি ছিল।
বীরেন্দর খিলে নৌকার মত দুলে দুলে ঢুকল। জামাইকে বলল, পেলাস বের কর, খোল আগে।
হ্যান্ডেল দেব। হাওয়া মারবে?
বীরেন্দর কিছু না দেখেই বলল, বৌদি হাজার খরচা আছে।
মা বলল, না না নতুন কল, অ্যাত কেন লাগবে?
জামাই টেবিলের কানা ধরে, নিজেকে সামলে, কী একটা বলতে গিয়ে কাত হয়ে গেল। হাত তুলে মাছি তাড়ানোর মত নেড়ে বলল, হাজার পেলাস আমার পাঁচশো। ফাটা বাঁশির মত ফ-ফ করে কিছু হাওয়া বেরল।
তারা যুগলে কার্নিসে কেরামতি দেখাচ্ছে। জামাই ভয়ানক দুলছে। প্লাস্টিকের পলকা পাইপ ধরে শূন্যে ঝুলছে। মাঝে মাঝে পকেট থেকে বোতল বের করে টকাস করে মেরে দিচ্ছে। মাল খাওয়াটাকে পুরো শিল্প করে তুলেছে জীবনে।
বীরেন্দর দেওয়ালে ভুঁড়ি ঠেকিয়ে নিজেকে সেট করে রেখেছে। সে সেয়ানা। ভরপুর পেটে বেশি নড়ছে না। জামাইকে নড়াচ্ছে। জামাই বারান্দা থেকে ঝুলে কার্নিসে যাচ্ছে। কার্নিস থেকে টক করে আধশোয়া হয়ে বিড়ি ধরাচ্ছে। চারতলার ওপর, নীচে শক্ত সিমেন্টের চাতাল।
মা ডাকল, জামাই?
অতিরিক্ত পানাশক্তির কারণে সে বিয়ে করার সময় পায়নি, তবু তার নাম কেন জামাই কে জানে!
তুমি উঠে এসো ভাই। ভেতর থেকে সারাও একটা অশৈলী কাণ্ড ঘটবে।
বীরেন্দর টাইট হচ্ছে বলে ভুঁড়ির ওপর শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল, ভেতর থেকে হোবে না মাসিমা। বাইরে থেকে হাওয়া দিতে হোবে।
না না যা করার ভেতরে করো। তখন থেকে দেখছি ওর মাথা ঘুরছে। সকাল থেকে খায়নি নাকি?
আমি পাশ থেকে বললাম, বেশি খেয়েছে।
তুই চুপ কর। খালি পেটে গ্যাস হয়। মামার হয়েছিল, ৩৪ বাস থেকে নামতে গিয়ে উড়ে গেছিল, নতুন ফল্ডিং ছাতাটা হারিয়ে গেল।
কে উড়ে গেছিল, ছাতা, না মামা!
দাঁড়া দাঁড়া, এই বীরেন্দর খালিপেটে বেচারাকে নিয়ে এসেছে, এ ভারি অন্যায়!
মা, সাবধান! কেসটা অন্য আছে, পুরো ছড়িয়ে যাবে।
মার তো প্রাক্তন নকশালদের মত ভুড়ভুড়ি। ছিটকে রান্নাঘরে চলে গেল। সেই স্টিলের গ্লাস। আমি আঁতকে উঠি। ভয়ংকর বাওয়াল হতে চলেছে।
মা কী করছ?
জামাইয়ের মাথা ঘুরছে, পড়ে যাবে।
হঠাৎ করে মা সিপিএম হয়ে যায়, ভুল সিদ্ধান্তে অটল। উত্তেজনায় কমলা হয়ে গেছে। আমি পাশে মানানসই কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মার উচ্চাকাঙ্ক্ষা থামানোর সাধ্য আমার নেই। জামাই রেলিংয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে, বীরেন্দর নাট টাইট দিচ্ছে। মা হাত থেকে পুরো বেরিয়ে গেছে। জামাইকে গ্লাস ধরিয়ে দিয়েছে। জামাই একচুমুকে গ্লাসটা মেরে দিল। স্টিলের গ্লাসটা পেছন পকেটে পুরে, পাঁইটটা মার হাতে ফেরত দিল।
জামাই আরক খেয়ে উচ্ছ্বসিত। সে রেলিং থেকে নেমে মার পায়ে পড়ে গেল।
মাসিমা প্যাকেট পুরো একঘর! লম্ফর প্যাকেট খেয়ে পেট ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। পুরো লুক্কুসু!
মা পাঁইট হাতে দাঁড়িয়ে আছে, বারান্দায় ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। আমার সত্যি বলতে প্রচুর হাসি পাচ্ছে। একেবারে গুলগুলিয়ে উঠছে। কিন্তু ভদ্রলোকেরা আমায় কুলাঙ্গার আনকালচার্ড বলবে, তাই দুঃখু দুঃখু ভাব করে রেসকিউ করতে এলাম।
জামাই অসুরের মত মায়ের পায়ে। বীরেন্দর হেই হেই করে কুকুর তাড়ানোর মত করে উঠল। তার নিজের অবস্থাও দ্রুতগামী কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার মত যথেষ্ঠ সক্ষম নয়।
জামাই তালমিছরির শিশিতে দুলালচন্দ্র ভড়ের ছবির মত হেসে স্থির হয়ে আছে। বীরেন্দর “নাম শালা নাম”— বলতে সে পাইপ ধরে সোজা নিচে নামতে লাগল। সার্কাসের শেষ খেলা! বাঘের খেলা! রিং মাস্টার বীরেন্দর একটা অশ্লীল দিল ওপর থেকে।
নামার আগে জামাই বলল, মাসিমা, আমার পাঁচশো, পেলাস রিস নিয়ে কাজ করলাম দুশো, পেলাস দুবার দোকানে গেলাম পঞ্চাশ, পেলাস পলিপ্যাকেট তিরিশ, মোট, সাতশো আশি।
আমি কী করব? বায়োকেমিস্ট্রির অধ্যাপকের মত মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া।
দেখি দরজা দিয়ে রিনা উঁকি মারছে। তারা যন্ত্রপাতি গুটিয়ে হিসেব বুঝে নেমে গেল, বীরেন্দর সিঁড়ি দিয়ে জামাই পাইপ দিয়ে।
কাকিমা ও তো টিবি রুগি! আমাদের ওদিকে থাকত এখন রাস্তায় শোয়। রিনা বলল।
মা, আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে অস্ফুটে বলল, আহা! এত বড় একটা সহানুভূতির লোপ্পা বল, মা না খেলে ছাড়তে পারে কখনও।
দুপুরে খেতে বসেছি, মা বলল খালিপেটে চিকেন খাস না, একটু ঝোল খেয়ে নে।
দুপুরে কি করে ভরা পেটে খেতে বসা যায়? এ প্রশ্ন তুলব এত আহাম্মক আমি নই। কাল থেকে আগে একটু মুড়ি ভেজানো জল খেয়ে নিবি।
ঝোল এল। কাঁচকলার বালিস মাথায় দিয়ে শুয়ে আছে ঠান্ডা মাগুর মাছ। চারপাশে পেঁপের প্রাচীর। অদূরে ঝুড়ি ঢাকা চিলি চিকেন। মাঝে মুড়ি ভেজানো জলের পরিখা, সংযোগ সেতু।
আমি বলি, গ্লাসটা তো জামাই নিয়ে গেল, পেলাস তিরিশ টাকা চুল্লুর দাম। আবার ইসবগুল-ফুলও খেল। তা বোতলটা কী করবে?
মা গম্ভীর মুখে বলল, রীনাকে দিয়ে ধুইয়ে নিয়েছি, কেরাসিন রাখব।