ব্যাপ্ত হয় সারা অঙ্গে
মুখের উপরে তবু কেবলই সশব্দে ঘোরে একটি নীল মাছি
বেঁচে আছি আজও বেঁচে আছি
এইসব অনুভূতি ম্লান হয়, হতে হতে শব্দচূর্ণ ঝরে
তোমার আমার মুখে নিঝুম মর্মরে
অথবা এমনই ব্যস্ত স্তব্ধতা সঞ্চিত ছিল মায়াবী বাক্সোতে
হিমঘন তুষারের স্রোতে
অবশ স্পন্দন দেবে এইভাবে গাঢ় নীল বিষাক্ত মক্ষিকা
সমাধি তুহিন পাত্রে বিষে স্নিগ্ধ শিখা
মৃত্যুর শীতল দিয়ে আলস্যে নির্মম প্রেমে জ্বালো; ধ্বংসবীজ
রোপণে তন্দ্রার মোহ ভেবেছ বিলীন হবে, জানো না কিছুই
কীভাবে ধূসর মৃদু ঘুমের পরিজ
গলে যায় কৃপণের তালু বেয়ে, শনিবার এলে
বন্দি দুই বাহু পদ অঙ্গ দিয়ে মনে হয় ছুঁই
অনেক জমানো কাজ, লুপ্ত হবে সব জানি রবির বিকেলে
কফির হেলানো কাপে, সামান্য সঞ্চয় নীল কুণ্ডলীটুকুও
এভাবে মাছির মতো উড়ে উড়ে ‘দুয়ো’
বলে বলে ঘুরে যায়; বাসে ট্রামে রাস্তাতেও সর্বক্ষণ ঘুম
ব্যাপ্ত হয় সারা অঙ্গে, মাথায় কুয়াশা, পথে নিহত কুসুম।
*
যা হতে পারিনি
যা হতে পারিনি, যা হতে পারি না
যা হবে না কোনোদিন
তাই নিয়ে কত ঈর্ষা হিংসা
ক্ষোভ বিদ্বেষ ঋণ
রেখে চলে যাওয়া, শীতে কেঁপে ওঠা
ভোর ভোর কুয়াশায়
বুকে অভিমান, গলায় আগুন
জ্বর ছমছম গায়
আগুনে পুড়ছে কেউ সে পুড়ুক
আমার কী আসে যায়
আমি পুড়ছি না জ্বর জ্বর গায়ে
অভিমানে বেদনায়!
হতে কি পেরেছি কিছুই কখনো
ছুঁয়েছি রুপোলি মুখ!
নিরুদ্দেশেই যাব, বুকে কাঁটা
ফুটছে, তা সে ফুটুক
*
পাঁচিল
টাকার মধ্যে জমিয়ে রেখেছে তারা
কিছুটা কি অভিমান
বড় স্নেহে তাই তুলে তুলে নেয় লোকে
রুমালেতে মোছে ঘাম
ব্যাংকে লকারে দিয়ে রাখে তাকে চাবি
তার বুঝি করে শীত
ঘাসের শিশির পড়ে থাকে ভিজে ভোরে
রাস্তার কংক্রিট
তারা চেয়ে চেয়ে দেখে মুগ্ধের চোখে
সকলেই অসহায়
মোহরের মেঘ অভিমানে জমে জমে
বৃষ্টি শুধু ঝরায়
আমিও পারিনি ফেরাতে দুচোখ লোভী
তুমিও পারোনি কিছু
দুজনের মাঝে পাঁচিল তুলেছি শুধু
ক্রমশ হয়েছি নিচু
*
বিষাদে আপ্লুত থাকি
যে হাতে ছুঁয়েছি তাকে সেই হাত রক্তকালিমায়
ভরা আজ, যে শরীরে একদিন তাকে আলিঙ্গনে
জড়িয়েছি, শয্যাশায়ী সে শরীর বিনম্র লজ্জায়
চুম্বনে ঝরে না মধু আজ শুধু অকালবোধনে
প্রতি মধ্যরাতে কত জ্বলেছিল স্বপ্নের জোনাকি
কত ভেসেছিল নীল জাহাজেরা সমুদ্রের জলে
নিশীথে সুগন্ধি ধূপ, জল্পনা কল্পনা
সারাদিন সারারাত তার সঙ্গে, সেসব কথা কি
বিস্মরণ ধুলোচাপা, অনেক বলেছি কথা, আর বলব না
সাত সমুদ্রের পারে কুমারীর চোখের কাজলে
কী ছিল কুহক মোহ, সাবানের ফেনিল বুদ্বুদ
কত না রক্তিম হত গোধূলির ম্লান সূর্যালোকে
কবে যেন বিস্ফোরণে ভেঙে গেল, গুলি ও বারুদ
বিষাক্ত করেছে আজ জতুগৃহ, শিরায় শিরায়
শুধু শ্বেতকণিকার পদধ্বনি সুগম্ভীর, শোকে
বিষাদে আপ্লুত থাকি, পরাজিত গ্লানি বেদনায়
ভাঙা জানালার ফাঁকে হিমতুষারের ঝড়, শীত
দিদিমা কেন যে নাম রেখেছিলে আমার সুজিত!
*
নৌকো কবে ভেসে গেছে
কোথাও কেমনভাবে স্বর্ণরেণু কুহেলির মতো
স্তূপময় জমেছিল, জলধারা বর্ষাকণা মেঘময়তার
প্রান্তে এসে পড়ে থাকে, ওই তার স্তনচূড়ো, যেন ক্ষয় তার
ধূম হয়ে ঝরে পড়ে, ঝরোঝরো নম্র অবনত
ভারে ভারে ভরে থাকা এ মেদুর পরাবৃত্ত গোল বৃত্তাকার
ফলানো ছুরির নিচে ফুলে থাকে, যেন তার কত
আদরে আদুর হয়ে ভরে থাকা, ভরে থাকা কোমল সংখ্যার
শঙ্খধ্বনি বেজেছিল, কোমল লাবণ্য গন্ধ আলোর সন্তত
এভাবে বঙ্কিম হয়ে অস্পষ্ট আভাস হয়, কোমল পাতার
নৌকো কবে ভেসে গেছে মায়ার কুয়াশাপুরে চূর্ণ পরাহত।
অসাধারণ এই গুচ্ছ কবিতা। সুজিত বসুর কবিতা আমাদের প্রাণিত করেছে সাতের-আটের দশকে। দেশ পত্রিকা সহ সেসময় সব নামী পত্র পত্রিকায় সুজিত বসুর কবিতা পড়তাম। মাঝে হাতে এসেছে দুটি কাব্যগ্রন্থ; কিন্তু কবি যেন হঠাৎ নিখোঁজ। আবার এখানে সেখানে দেখছি তাঁর কবিতা। গত বছর শারদীয় কবি সম্মেলন সহ বিভিন্ন শারদ সংখ্যায় অসাধারণ সব কবিতা পড়েছি। ভালোভাষাকে ধন্যবাদ, এই কবিতাগুচ্ছ পাঠকদের উপহার দেবার জন্য।
কবি সুজিত বসুর কবিতাগুচ্ছ অসাধারন। এই কবিতাগুচ্ছ এর ছন্দে ও আবেগে পরিপূর্ণ অর্থপূর্ন প্রতিটি কবিতা পড়ে খুবই ভালো লাগলো। কবির এই কবিতাগুচ্ছ পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য ভালোবাসা কে অশেষ ধন্যবাদ। আশাকরি আগামীতেও কবি সুজিত বসুর লেখা সুন্দর সুন্দর কবিতা আমাদের উপহার দেবেন।
কবি সুজিত বোস আত্মাকে আলোড়িত করে এমন কবিতা লিখেছেন। কবিতাগুলো পড়তে খুব ভালো লাগে। আরো কবিতার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করব।