মালদার ভূতনি চরের কলাইডালের খ্যাতি দেশজোড়া। মেদিনীপুরের মুগের ডালের জিলিপির মতই মানিকচকের কলাইডালের জিলাপি একসময় জেলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাটা পড়েছে সাবেক ঐতিহ্যে। রং আর কেমিক্যাল ব্যবহারে হারিয়ে যাচ্ছে আসল কলাইডালের জিলিপির স্বাদ। কিন্তু ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঐতিহ্যপূর্ণ এই মিষ্টির রেসিপি ধরে রেখেছেন মানিকচকের লালবাথানি গ্রামের প্রবীণ মিষ্টান্নশিল্পী সুবল সরকার।
ষাটোর্ধ্ব সুবলবাবু এই মিষ্টি তৈরির কৌশল শিখে এসেছিলেন বিহার থেকে। তারপর রাজমহল পেরিয়ে এপারে এসে নিজের সাইনবোর্ডহীন ছোট্ট দোকানে দীর্ঘ সময় ধরে একাদিক্রমে এই জিলিপি বানিয়ে আসছেন তিনি। প্রতি শনিবার বিকেলে নিয়ম করে বানানো হয় এই বিশেষ জিলিপি।
কলাইডালের গুঁড়োতে মাপমত জল ঢেলে বিশেষ কায়দায় মণ্ড বানাতে বানাতে সুবলবাবু বলেন, “প্রতি শনিবার গড়ে ১০-১৫ কেজি কলাইডালের গুঁড়ো লেগে যায়। লালবাথানি ছাড়াও মানিকচক, মধুপুর, ধরমপুর, নুরপুর, এনায়েতপুর, রতুয়া বা বাহারাল থেকেও লোক এসে নিয়ে যান। একসময় পাইকারেরা কিনে হাটে বিক্রি করতেন। সারাবছর শনিবার করে ভাজি। আমের সময়টায় বিক্রি বেশি। রমজান মাসে ইফতারির সময়ও অনেকে এসে নিয়ে যান। এখন ১২০ টাকা কেজি চলছে।”
বিকেল থেকে জিলিপি ভাজা আরম্ভ হয়ে সন্ধের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। আবার পরের শনিবারের অপেক্ষা। মালদা জেলার মিষ্টির দোকানে জিলিপি সহজেই পাওয়া যায়। অনেকেই কলাইডালের জিলিপি মেলাতেও বিক্রি করেন। তাহলে কোথায় এই জিলিপির বিশিষ্টতা?
সুবলবাবুর ছেলে সঞ্জয় সরকার বলেন, “কলাইয়ের ডাল ভাঙানো থেকে আরম্ভ করে পেষাই করা, মাখা থেকে আরম্ভ করে ভাজার পর রসে ডোবানো— সমস্ত কাজটাই নিজের হাতে বাবা করেন। কোনও অন্য লোক রাখা হয় না। এই জিলিপিতে সময়ের হিসেবটাই আসল। আমরা এখন ছেলে হিসাবে হাত লাগাই। একমাত্র সাদা তেল কেনা ছাড়া সবটাই নিজেদের হাতে করা হয়।”
লালবাথানি গ্রামের আদি বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বর্ষীয়ান কালীসাধন মুখোপাধ্যায় বলেন, “আজ পঁচিশ বছর ধরে ওই দোকানের জিলিপি খেয়ে আসছি। একরকম স্বাদ। গরম অবস্থায় সবচেয়ে ভাল লাগে। মালদার অন্য জায়গাতেও কলাইডালের জিলিপি খেয়ে দেখেছি, এদের মত স্বাদ আনতে পারেন না। আর সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছি এরা কোনও রং বা কেমিক্যাল ব্যবহার করেন না। একে আমরা লালবাথানির ঐতিহ্য বলতেই পারি।”
মিষ্টির দিক থেকে মুখ ফিরিয়েছে নতুন প্রজন্ম। কেক-পেস্ট্রি বা ফিউশন মিষ্টিতেই মজেছে তারা। সেখানে তাদের কতটা আকর্ষণ করে এই সাবেক মিষ্টি? এই দোকানে আসা নবীন প্রজন্মের ক্রেতা শিক্ষক সুদাম রবিদাস বলেন, “শহরে গেলে কেক-পেস্ট্রি যেমন খাই, তেমন এখানকার জিলিপিও খুব প্রিয়। দুটো দু’রকম মিষ্টি— একটা ঐতিহ্য, আর একটা আধুনিকতা। দুইয়ের মধ্যে বিরোধ থাকবে কেন?”
সুবলবাবুর চার ছেলে মিষ্টি তৈরির কাজে বাবাকে সাহায্য করেন। তারাই এই জিলিপির ঐতিহ্য ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। ইতিহাস বলে, ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রাচ্য ও ইরান থেকে আসা এই মিষ্টিকে ভারতীয়রা আপন করে নিয়েছেন পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে। মারাঠি মিষ্টান্ন বিশেষজ্ঞ দিলীপ পদগাঁওকর তাঁর ‘জার্নি অফ দ্য জলেবি’ নিবন্ধে কলাইডালের বাঙালি জিলিপিরও উল্লেখ করেছেন। প্রতিমা ঠাকুরের বিখ্যাত বই ‘ঠাকুরবাড়ির রান্নাবান্না’-তেও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের জিলিপি-প্রিয়তার উল্লেখ আছে। জিলিপি ভালবাসতেন ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবও। রামপ্রসাদের শাক্ত পদাবলিতেও জিলিপির উল্লেখ আছে।
সুবল সরকার অতকিছু জানেন না। প্রতি শনিবার ঝুপসি আমবাগানে ঘেরা গ্রামে ঢিমে আঁচে গরম তেলের উপর তাঁর হাতের জাদুতে তৈরি হয় এক-একটি জিলিপির ফুল… তিন দশক ধরে ঐতিহ্য আর আধুনিকতা তাঁর হাতেই বাঁধা পড়তে থাকে।