Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

কলাইডালের জিলিপির ঐতিহ্য মালদার লালবাথানিতে

মালদার ভূতনি চরের কলাইডালের খ্যাতি দেশজোড়া। মেদিনীপুরের মুগের ডালের জিলিপির মতই মানিকচকের কলাইডালের জিলাপি একসময় জেলার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাটা পড়েছে সাবেক ঐতিহ্যে। রং আর কেমিক্যাল ব্যবহারে হারিয়ে যাচ্ছে আসল কলাইডালের জিলিপির স্বাদ। কিন্তু ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঐতিহ্যপূর্ণ এই মিষ্টির রেসিপি ধরে রেখেছেন মানিকচকের লালবাথানি গ্রামের প্রবীণ মিষ্টান্নশিল্পী সুবল সরকার।

কলাইডালের জিলিপি।

ষাটোর্ধ্ব সুবলবাবু এই মিষ্টি তৈরির কৌশল শিখে এসেছিলেন বিহার থেকে। তারপর রাজমহল পেরিয়ে এপারে এসে নিজের সাইনবোর্ডহীন ছোট্ট দোকানে দীর্ঘ সময় ধরে একাদিক্রমে এই জিলিপি বানিয়ে আসছেন তিনি। প্রতি শনিবার বিকেলে নিয়ম করে বানানো হয় এই বিশেষ জিলিপি।

কলাইডালের গুঁড়োতে মাপমত জল ঢেলে বিশেষ কায়দায় মণ্ড বানাতে বানাতে সুবলবাবু বলেন, “প্রতি শনিবার গড়ে ১০-১৫ কেজি কলাইডালের গুঁড়ো লেগে যায়। লালবাথানি ছাড়াও মানিকচক, মধুপুর, ধরমপুর, নুরপুর, এনায়েতপুর, রতুয়া বা বাহারাল থেকেও লোক এসে নিয়ে যান। একসময় পাইকারেরা কিনে হাটে বিক্রি করতেন। সারাবছর শনিবার করে ভাজি। আমের সময়টায় বিক্রি বেশি। রমজান মাসে ইফতারির সময়ও অনেকে এসে নিয়ে যান। এখন ১২০ টাকা কেজি চলছে।”

প্রতি শনিবার বিকেলে নিয়ম করে বানানো হয় এই বিশেষ জিলিপি।

বিকেল থেকে জিলিপি ভাজা আরম্ভ হয়ে সন্ধের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। আবার পরের শনিবারের অপেক্ষা। মালদা জেলার মিষ্টির দোকানে জিলিপি সহজেই পাওয়া যায়। অনেকেই কলাইডালের জিলিপি মেলাতেও বিক্রি করেন। তাহলে কোথায় এই জিলিপির বিশিষ্টতা?

সুবলবাবুর ছেলে সঞ্জয় সরকার বলেন, “কলাইয়ের ডাল ভাঙানো থেকে আরম্ভ করে পেষাই করা, মাখা থেকে আরম্ভ করে ভাজার পর রসে ডোবানো— সমস্ত কাজটাই নিজের হাতে বাবা করেন। কোনও অন্য লোক রাখা হয় না। এই জিলিপিতে সময়ের হিসেবটাই আসল। আমরা এখন ছেলে হিসাবে হাত লাগাই। একমাত্র সাদা তেল কেনা ছাড়া সবটাই নিজেদের হাতে করা হয়।”

ঐতিহ্য ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর।

লালবাথানি গ্রামের আদি বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বর্ষীয়ান কালীসাধন মুখোপাধ্যায় বলেন, “আজ পঁচিশ বছর ধরে ওই দোকানের জিলিপি খেয়ে আসছি। একরকম স্বাদ। গরম অবস্থায় সবচেয়ে ভাল লাগে। মালদার অন্য জায়গাতেও কলাইডালের জিলিপি খেয়ে দেখেছি, এদের মত স্বাদ আনতে পারেন না। আর সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছি এরা কোনও রং বা কেমিক্যাল ব্যবহার করেন না। একে আমরা লালবাথানির ঐতিহ্য বলতেই পারি।”

মিষ্টির দিক থেকে মুখ ফিরিয়েছে নতুন প্রজন্ম। কেক-পেস্ট্রি বা ফিউশন মিষ্টিতেই মজেছে তারা। সেখানে তাদের কতটা আকর্ষণ করে এই সাবেক মিষ্টি? এই দোকানে আসা নবীন প্রজন্মের ক্রেতা শিক্ষক সুদাম রবিদাস বলেন, “শহরে গেলে কেক-পেস্ট্রি যেমন খাই, তেমন এখানকার জিলিপিও খুব প্রিয়। দুটো দু’রকম মিষ্টি— একটা ঐতিহ্য, আর একটা আধুনিকতা। দুইয়ের মধ্যে বিরোধ থাকবে কেন?”

১২০ টাকা কেজি।

সুবলবাবুর চার ছেলে মিষ্টি তৈরির কাজে বাবাকে সাহায্য করেন। তারাই এই জিলিপির ঐতিহ্য ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। ইতিহাস বলে, ত্রয়োদশ খ্রিস্টাব্দে মধ্যপ্রাচ্য ও ইরান থেকে আসা এই মিষ্টিকে ভারতীয়রা আপন করে নিয়েছেন পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে। মারাঠি মিষ্টান্ন বিশেষজ্ঞ দিলীপ পদগাঁওকর তাঁর ‘জার্নি অফ দ্য জলেবি’ নিবন্ধে কলাইডালের বাঙালি জিলিপিরও উল্লেখ করেছেন। প্রতিমা ঠাকুরের বিখ্যাত বই ‘ঠাকুরবাড়ির রান্নাবান্না’-তেও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের জিলিপি-প্রিয়তার উল্লেখ আছে। জিলিপি ভালবাসতেন ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবও। রামপ্রসাদের শাক্ত পদাবলিতেও জিলিপির উল্লেখ আছে।

সুবল সরকার অতকিছু জানেন না। প্রতি শনিবার ঝুপসি আমবাগানে ঘেরা গ্রামে ঢিমে আঁচে গরম তেলের উপর তাঁর হাতের জাদুতে তৈরি হয় এক-একটি জিলিপির ফুল… তিন দশক ধরে ঐতিহ্য আর আধুনিকতা তাঁর হাতেই বাঁধা পড়তে থাকে।

চিত্র: লেখক
4.5 6 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব

আমাদের খেলা করা দরকার, তাই আমাদের কয়েকজন ছেলে মিলে ক্লাব তৈরি করতে হবে। কোথায় করা যায়? — অমুক জায়গায় — ওই জায়গাটা পড়ে আছে, তা যাদের জায়গা তারা বললেন, “ওই তো ওখানে জঙ্গল হয়ে আছে, তা যদি তোমরা জঙ্গল-টঙ্গল পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে ক্লাব তৈরি করতে পার তো করো।” আমাদের আর পায় কে — আমরা মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলে। উদ্ধার করলাম। উদ্ধার-টুদ্ধার করে এর বাড়ি থকে চারটে বাঁশ, ওর বাড়ি থেকে তিনটে হোগলা এভাবে যোগাড়-যন্ত্র করে-টরে একটা চালাঘর তৈরি করা হলো। সেই চালাঘরকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে আমাদের নতুন লাইব্রেরী তৈরি হলো। ক্লাবের নাম হলো ‘সেনহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাব’।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো! সেই থেকেই ‘বাগনান’!

ছোট্ট ওই ভূখণ্ডটি বাঘের উপস্থিতির জন্যই তখন ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয় বলে প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরার অভিমত। এই বিষয়ে তিনি আরও জানান, আরবি ভাষা অনুযায়ী ‘নান’ কথার অর্থ হল ‘চরভূমি’। ‘নান’ শব্দের আরও একটি অর্থ হল ‘ছাউনি’। তখন কাছারিপাড়া ছাড়াও নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় ইংরেজ সেনাদের ছাউনি ছিল বলে জানা যায়। যার মধ্যে খাদিনান, পাতিনান, খাজুরনান, বাইনান, চিৎনান, মাছিনান ইত্যাদি জনপদগুলি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু নদীর চরে বাঘেশ্বরী দেবীর পুজো হত, সেই জন্য প্রাথমিকভাবে এলাকাটি ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ‘বাঘনান’ অপভ্রংশ হয়ে ‘বাগনান’-এ পরিণত হয়েছে।

Read More »
আবদুল্লাহ আল আমিন

কবিগান: সমাজবাস্তবতা, বিষয়বৈভব ও রূপবৈচিত্র্য

এমন লোকপ্রিয় বিষয় বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা ভাষা, সঙ্গীত ও সাহিত্যে কবিগান ও কবিয়ালদের অবদানের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগান সংগ্রহ এবং এ বিষয় পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে কবিয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কিংবা কবিগানকে সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক এ গানকে সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই গানের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে লোকায়ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক যার অধিকাংশই অনালোচিত ও অনালোকিত রয়েছে অদ্যাবধি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »
দীপক সাহা

বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়ে ইতিহাসকে লেন্সবন্দি করেছেন সাইদা খানম

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে উপমহাদেশের বিখ্যাত প্রায় সকল ব্যক্তিত্ব— ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী, বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আশাপূর্ণা দেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়— কার ছবি তোলেননি! সেই সঙ্গে রানি এলিজাবেথ, মাদার টেরেসা, মার্শাল টিটো, অড্রে হেপবার্নের মতো বিখ্যাত মানুষদের ছবিও তুলেছেন। এই বিশাল তালিকায় আরও তিনটি নাম যুক্ত করে না দিলে অন্যায় হবে। চন্দ্রবিজয়ী নিল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিনস, মাইকেল কলিন্সের ছবিও তুলেছেন তিনি।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

মামলায় জয়ী হয়ে থোড় কুঁচি দিয়ে কালীর আরাধনা করেন জমিদার-গিন্নি

দেবী কালিকার খড়ের মেড় দেখে মজুমদার গিন্নি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, মামলার রায় যদি তাঁদের পক্ষে যায় তাহলে কলাগাছের থোড় কুঁচো দিয়ে হলেও জগজ্জননী মা মহাকালীর পুজো করা হবে, আর যদি মামলার রায় তাঁদের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে ওই খড়ের মেড় দামোদরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। যদিও সেদিন দুপুরের মধ্যেই আদালত থেকে মজুমদার জমিদার পক্ষের জয়লাভের খবর পৌঁছেছিল থলিয়ার মজুমদার বাড়িতে। মজুমদার-গিন্নিও অক্ষরে অক্ষরে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। মামলায় জয়লাভের খবর পাওয়া মাত্রই জমিদার-গিন্নির নির্দেশে প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দীপাবলি উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে যায়।

Read More »