Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

নিরপেক্ষতা ও নাগরিক সমাজ

নাগরিক সমাজের নিরপেক্ষতা সম্পর্কে বঙ্গসমাজের অগ্রগণ্য কিছু সদস্যের অভিমত হল, নিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই। কোনও একটি পক্ষ তো অবলম্বন করতেই হবে। অতএব নিরপেক্ষ থাকা কথাটির কোনও মানে নেই। সত্যি কি তাই? চূড়ান্ত এই মতটি জানার পর কয়েকটি কথা মনে হয়েছে। বস্তুত মতটির সমর্থকদের অস্বচ্ছ চিন্তাচ্ছন্নতা পীড়াদায়ক বলে গণ্য হয়েছে নিম্নোক্ত কারণে:

১. নিরপেক্ষ থাকার অর্থ একটুও অস্পষ্ট নয়। কোনওপ্রকার দুর্বলতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে সত্য ও ন্যায়কে আঁকড়ে ধরে থাকা নামক অবস্থানকে বলে নিরপেক্ষ থাকা।

২. সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকাকেও যদি কেউ পক্ষাবলম্বন বলে অভিহিত করে তাহলে তা মূর্খতার নামান্তর বলে গণ্য হবে।

৩. কোনও একটি পক্ষকে অবলম্বন করতেই হবে— কেন? যদি উভয়পক্ষই অন্যায়কারী হয়— তাহলে? সেক্ষেত্রে তো নিরপেক্ষ অবস্থানের গুরুত্ব সমধিক এবং স্পষ্টও। এরপরেও নিরপেক্ষতাকে অস্বীকার করা যায় কোন যুক্তিতে?

৪. নিরপেক্ষতাকে যারা মুখের জোরে উড়িয়ে দিতে চায় ফুঁ দিয়ে, তারা তা করুক। তবে সত্য হল, নিরপেক্ষতা একটি কঠিন আয়াসসাধ্য মানবিক গুণ। এই গুণ যদি কেউ আয়ত্ত করতে ব্যর্থ হয়, তা দোষের নয়। কিন্তু তাই বলে এটিকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করার প্রচেষ্টা নিন্দনীয়, নিঃসন্দেহে।

এখনও বলা হয়নি, কাদের নিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থানের কথা ওঠে? তারা হলেন পশ্চিমবঙ্গ নামক আমাদের রাজ্যের শাসকদল ও প্রধান বিরোধী দল, যাদের বর্জন ও সমর্থন করা নিয়ে নাগরিক সমাজের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার কথা ওঠে। নাগরিক সমাজের নেতৃবর্গের কেউ কেউ বলেন, এই দু’পক্ষের মধ্যে একপক্ষ অবলম্বন করতেই হবে। কেউ কেউ আরও একধাপ এগিয়ে বলে ওঠেন, নিরপেক্ষতা বলে কিছু হয় না! এই দু’টি মতের বাইরে তৃতীয় একটি মতও যে থাকতে পারে সে সত্যকে তারা আমল দেন না একটুও। সেই মতটি নিম্নরূপ:

Advertisement

যেকোনও রাজ্য অথবা দেশে নাগরিক সমাজের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদেরকে দেশের অন্যান্য দেশবাসীদের পথপ্রদর্শক বলে মান্যতা দেওয়া হয়। তাই তাঁরা নিরপেক্ষ থাকবেন— সেটিই তাঁদের কাছে স্বাভাবিক প্রত্যাশা। একটু ব্যাখ্যা দেওয়া যাক।

আমাদের রাজ্যে শাসকদল ও বিরোধী দল উভয় দলেরই রাজনীতি ক্ষমতাকেন্দ্রিক। ক্ষমতা আবার পেলে অথবা ক্ষমতা একবার পেলে ‘সব’ করে দেব— দু’দলেরই মুখে একইপ্রকার মন্ত্র। দেশবাসীও শিখে গেছে তাই ক্ষমতাই আসল কথা। তারা জেনে গেছে, ক্ষমতা পূজাতেই ‘সব’ মেলে। এমন দলদের কারও মনের কোণেও দেশ অথবা দেশবাসীর কল্যাণভাবনা ঠাঁই পায় না। পেলে তারা কখনওই বলতে পারতেন না এমন কথা— ‘আমাদের দলের কর্মীরা এত সংখ্যায় মারা গেছে’। কোনও দলই বলে না, আমাদের দেশের এত মানুষ মারা গেছে। এমন কথা বলতে পারলে রাজনৈতিক দলও নিরপেক্ষ হতে পারত। নাগরিক সমাজের মূল কাজ হল, কোনও দলের স্তাবকতা না করে শাসক বা বিরোধী সব দলকেই চাপে রেখে নিরপেক্ষ হতে বাধ্য করা। সে পথে বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বিবিধ সুবিধা, পুরস্কার, পারিতোষিক ইত্যাদি পাওয়ার প্রবল ইচ্ছা বা মনোবাসনা। সেসব দমন করে কোনও দলেরই সমর্থক না হয়ে নিজেরা নিরপেক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলিকে দেশপ্রেমিক করে না তুলতে পারলেও নিদেনপক্ষে দেশহিতৈষী দলে রূপান্তরিত করার লক্ষ্য নিয়ে কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়। লেখক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মী মহলের সকল নাগরিকগণ সেক্ষেত্রে মুক্তমনে নিজ নিজ ক্ষেত্রকে বেছে নিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ এবং ন্যায়ের সমর্থনসূচক কর্মকাণ্ড সম্ভব করতে পারেন।

নাগরিক সমাজের এমন ভূমিকাকেই দেশবাসী নিরপেক্ষ বলে মর্যাদা দিয়ে বাঁচার খোরাক সংগ্রহ করে, প্রাণে সাহস পায়, ভালবাসা ও শ্রদ্ধায় উদ্দীপিত হয়। আমাদের এই রাজ্যে তার বদলে আমরা দেখেছি, সাধারণ মানুষ দীর্ঘ দশক ধরে বঞ্চনা ও নিপীড়ন সহ্য করার পরে যখন প্রাণদানে অকুতোভয় হয়েছে, নির্যাতনকে বুক পেতে নিয়েও আন্দোলন জোরদার করেছে তখন কেবল তখনই নাগরিক সমাজ অকস্মাৎ আলস্য ঘুচিয়ে প্রতিবাদীরূপে আত্মপ্রকাশের উদ্দীপনায় মেতেছে। অতঃপর আবার তাদেরই কেউ কেউ নিরপেক্ষতার অর্থহীনতা প্রতিষ্ঠা করার ‘দায়িত্বপালনে’ তৎপর হয়েছেন এবং দেশবাসীদেরও সে মতের যাথার্থ্য বোঝাতে চেয়েছেন। এই দৈন্য ভাবায়, লজ্জা দেয়!

এইপ্রকার নিরপেক্ষতার দৃষ্টান্তস্বরূপ মনে পড়ছে রবীন্দ্র-সৃষ্ট রামকানাইয়ের নিরপেক্ষতার কথা এবং সেইসঙ্গে একথাও মনে হচ্ছে যে, সেই মানুষটির নিরপেক্ষতা তো ‘নির্বুদ্ধিতা’ বলে কথিত হয়েছে কাহিনির শিরোনামেই! তাহলে, প্রশ্ন জাগে মনে, নাগরিক সমাজের কিছু নেতৃবর্গের কাছেও কি নিরপেক্ষতার অর্থ নির্বুদ্ধিতা, যার আদতে কোনও মানে নেই বাস্তবের কঠোরতা মাঝে? সেদিক থেকে ‘নিরপেক্ষতা’ শব্দটি অর্থহীনই বটে!

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nine + two =

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আমার স্মৃতিতে ঋত্বিককুমার ঘটক

দুটো‌ জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম তাঁর।‌ এক, তিনি কথা বলার সময় আত্মমগ্ন‌ থাকতেন। কারও দিকে‌ তাকিয়ে‌ কথা বলতেন না। তাকাতেন‌ হয় সুদূরে, আর নয়তো‌ চোখ বুজে‌ কথা বলতেন। আর দ্বিতীয় যা, তা হল‌ ঋত্বিকের চোখ। এত উজ্জ্বল আর‌ মরমী, এক-ই সঙ্গে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত আর লুব্ধক নক্ষত্রের মতো দীপ্ত, তা আর কারও মধ্যে দেখিনি। সত্যজিৎ-মৃণালের মধ্যেও না, যদিও ঘটনাচক্রে ওই দু’জনের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল অনেক বেশি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঋত্বিক ঘটক ও বাংলাদেশ

ঋত্বিক ঘটকের জীবনের প্রথম বাইশ বছর (১৯২৫-১৯৪৭) কেটেছে মূলত পূর্ব-বাংলায়, যা এখনকার বাংলাদেশ। তাঁর জন্ম ঢাকার ২,ঋষিকেশ দাস রোডের ঝুলন বাড়িতে। ১৯৪৭, অর্থাৎ দেশভাগ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি মূলত পূর্ব-বাংলায় কাটান। আমরা দেখব, পূর্ব-বাংলা যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, সে-দেশ, সে-ভূমির প্রভাব তদনুরূপ ঋত্বিকেরও পড়েছিল তাঁর চলচ্চিত্রে।

Read More »
মণিকর্ণিকা রায়

অনুগল্প: অর্জন

অসহায় বৃদ্ধের খাওয়া হয়ে গেলে মাঝেমাঝে গল্পও করত ওঁর সাথে। আদিত্য লক্ষ্য করেছিল এই ব্যাপারটা যেন তার মনে একটা বদল আনছে— যেন রোজ তার শরীর-মন জুড়ে সঞ্চালিত হচ্ছে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি। যেন সে সত্যিই মানুষ হয়ে উঠছে।

Read More »
মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনানন্দ দাশের সময়চেতনা: পুরাণ, প্রকৃতি ও আধুনিক নিঃসঙ্গতার নন্দনতত্ত্ব

পৌরাণিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিগত সময়চেতনা তাঁকে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে এক স্থায়ী ও ব্যতিক্রমী মহাকবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শিল্পকর্ম আমাদের শেখায়— দ্রুত ধাবমান জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে চলতে, নীরবতার গভীরে কান পাততে এবং প্রতিটি ক্ষণিকের মাঝে অনন্তের ইশারাকে খুঁজে পেতে। তাঁর সাহিত্য ভবিষ্যতের প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের জন্য আধুনিকতার এক অমূল্য পাঠ হয়ে থাকবে, যা মানুষের জীবনকে শিল্প ও প্রকৃতির একাত্মতায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং প্রমাণ করে দেয়— কাব্যই চূড়ান্ত আশ্রয়, যখন সমস্ত পথ ফুরিয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে?

Read More »