Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

দুলু মাসির নববর্ষ

সকাল থেকে মা খুব উত্তেজিত। মাসি আসছে। পুজোয় বসার আগে দুম দুম করে বাথরুমের দরজা ধাক্কাচ্ছে, ‘চিত্ত, ঠিক সময় পৌঁছে যাস স্টেশনে কিন্তু। দুলু আবার মেসেজ করেছে।’

বাবারে বাবা, মা কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বাবা একবার কাগজ থেকে মুখ তুলে চা খেতে খেতে বলেছিল, ‘দুলু তো কলকাতা খুব ভালই চেনে। নিজেই তো এদিক-ওদিক যায়। একা চলে আসতে পারে না?’

মা দপ্ করে জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে কর্ড লাইনে চলে গিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলতে থাকে, ‘আজ তোমার ভাই আসার থাকলে তো গতকাল রাত থেকে জেগে বসে থাকতে। ভাই এলে যাও কেন আনতে? সে কি অবলা? নেকু পুশু? এর সঙ্গেই গলা চড়তে থাকে, ‘ছেলেটাও হয়েছে বাবার মত। উত্তর দেবার কথা মনে থাকে না!’

মোটমাট মাসি আসছে। আমার কয়েকদিন কলেজ যাওয়া বন্ধ হবে। ওনাকে এদিক-ওদিক সব আত্মীয়স্বজনের বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। মা কিন্তু সে ব্যাপারে নীরব। তখন মা কিছুই দেখতে পাবে না। আর একদিন ওয়ান-ডে খেলা দেখতে গেলেই তখন কলেজ কামাই থেকে যাবতীয় না করা কাজ মনে পড়ে যাবে। মাসি এলে আমার লাভ, মা একটু অন্যমনস্ক থাকে। খুশি খুশি থাকে।

ঘরে ঢুকেই একপ্রস্থ দিদি দিদি বলে জড়াজড়ি হবার পর নিয়ম মেনে বললে, ‘কী খারাপ হয়েছে তোর শরীর?’ মাসি সবার দিকে তাকালে। গত দু-চার বছর আসেনি। মানে আসতে পারেনি, তার জন্যে ভীষণ ভীষণ আফসোস। একটু ধাতস্থ হয়ে ঢকঢক করে এক গেলাস জল খেয়ে বললে, ‘উফ! বাবা এবার দম নিতে পারব।’

আমার কাঁধে চাপড় মেরে বললে, ‘বি রেডি, চিত্ত। কাল নববর্ষ।’

‘তো? আমি কী করব? কাল সকালে মাঠে ম্যাচ আছে।’

‘ওসব ছাড়। কোনও কথা হবে না। দুপুর দুপুর খেয়েই আমি আর তুই বেড়িয়ে পড়ব নববর্ষ করতে।’

হঠাৎ গলার স্বরটা কেমন ভেঙে গেল। হেঁচকি তুলে শেষ চেষ্টা করি, ‘এই গরমে নববর্ষ? তুমি পাগল হলে?’

‘গরম?’ আকাশ থেকে পড়লে। ‘কোথায় গরম?’ আলতো হেসে বলে, ‘এ তো যথেষ্ট ঠান্ডা। এখুনি তো বাজার করবার সময়। প্রচুর কিনবার পড়ে আছে।’

বললাম, ‘আটত্রিশ ডিগ্রি গরম নয়?’ মাসি শাড়ির কোণটা কলারের মতন তুলে বললে, ‘ওরে সোনা, এটা আমাদের কাছে কিছুই নয়। আমরা পঁয়তাল্লিশ আটচল্লিশ-এ খেলি। এসব দেখে অভ্যস্ত।’ বলে আর দাঁড়াল না। কাল মনে হয় গেল আমার সারাদিন। মাসির পাল্লায় পড়ে কী হাল হবে কে জানে!

গড়িয়াহাট পৌঁছে মাসি আর আমাকে চিনছেই না। চোখ বড় বড়, চকচক করছে, খালি ঘুরছে। ফুটপাতে সব চৈত্র শেষের ঢালাও সেল তো নয়, যেন সোনা বেচাকেনা চলছে। লোকজন হুমড়ি খেয়ে সেইসব নাড়াচাড়া করছে। বাতাসে চিৎকার, চেঁচামেচি, ‘দিদি এটা নিন, এত কম পাবেন না, এই শেষ আর নেই।’ সব সময় এই গেল এই গেল ভাব। লোকও তাই। নিচ্ছে কম, দেখছে বেশি। তার পিছনে আর একটা লাইন। দেখছে কী হয় কী হয়, অবস্থা বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সুযোগ খুঁজছে। তার পিছনে চলমান উঁকিঝুঁকি মারা জনতা।

গড়িয়াহাট ফুটপাত যথেষ্ট চওড়া কিন্তু রাস্তার দিকে স্টল আর বাড়ির দিকে মাটিতে ফেলে সাময়িক উদ্দাম কেনাকাটার জটলা। হাঁটার কোনও উপায় নেই। প্রচণ্ড শরীরের দক্ষতা ছাড়া অসম্ভব। হৈহৈ, চেঁচামেচি, যে বিক্রি করবে তার নানা স্বরে ডাক, সব মিলিয়ে যাচ্ছেতাই কাণ্ড। বাংলা বলছে, না হিন্দি বলছে, বোঝা যাচ্ছে না। যখন যে রকম এখানে দিদি, এখানে। আইয়ে, দিদি আইয়ে দিদি, দিদি। এই শেষ, কোনও কিছু আর পাবেন না।

আর পাবেন না বললেই বাঙালি মহিলারা যেরকম খেপে যায়, সেরকম বোধহয় আর কিছুতে খেপে না। তারপর মাসির এই ‘যা থাকে কপালে, চৈত্রের সেলে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে’ মনোভাবের মধ্যে নববর্ষের গড়িয়াহাট যেন যুদ্ধক্ষেত্র। বাসে, অটোতে, গাড়িতে দলেদলে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পিপীলিকার আগুনে ঝাঁপ দেবার মত। বেপরোয়া, ‘লড়েঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ ভাব মুখে। আজই কেনাকাটার শেষদিন জীবনে।

মাসি সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে চলছে আর লোকের ধাক্কায় নড়েচড়ে যাচ্ছে। খালি বলছে, ‘কই রে? কোথায় গেল? এখানেই ছিল না?’

বললাম, ‘আরেকটু এগিয়ে।’ এত স্টল ব্যানার আর জামাকাপড় ঝোলানো যে সাইনবোর্ড দেখাই যাচ্ছে না। বাজারে বেরিয়েছে কিন্তু মেজাজ সপ্তমে। যেতে যেতে দুজন বললে, ‘দেখে চলতে পারেন না? চোখে কি ঠুলি পরেছেন?’ একজনের চটি মাসি পা দিয়ে চেপে দরদাম করছে পাশের স্টলের বেডকভার নিয়ে। আর সেই মহিলা যখন দেখলে আর যেতে পারছে না, ঘুরে মাসিকে বললে, ‘চাই?’

মাসি অবাক, ‘কী?’

‘চটি।’ বলে কটমট চোখে দাঁত খিচিয়ে নীচের দিকে তাকালেন। মাসি বুঝতে পেরে জিভ কাটলে, ‘সরি দিদি, সরি দিদি। বুঝতে পারিনি।’ তিনিও তেমনি ত্যাদোড়, বললে, ‘আমাকে কি আপনার দিদির বয়সী লাগছে পিসিমণি?’

মাসি আমার দিকে জিভ বার করে হেসে উঠলে। আর কথা বাড়ানো নেই। আমরা দুজনই বেডকভার ছেড়ে সামনে। শেষে দেখা গেল লক্ষ্মী ব্রাদার্স। এইবার একমুখ হাসি ফুটল। ‘এই তো, চল চল চিত্ত। আয় আয়…’ বলে দরজা ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়লে, তখনও আমি জনসমুদ্রে সাঁতার কেটে যাচ্ছি।

লক্ষ্মী ব্রাদার্স-এর সঙ্গে মাসির যে কি নাড়ির টান, জানি না। কিন্তু ফি-বছর অ্যানুয়াল লিভ নিয়ে ঠিক এই সময় আসবে দিল্লি থেকে। এই প্যাঁচপেঁচে গরমে কলকাতায় কেউ বাইরে থেকে এই সময় আসতেই চায় না। মাসি কিন্তু অন্য ধাতুতে গড়া। এই সময়ই আসবে। লক্ষ্মী ব্রাদার্স-এ যাবে। নিজের, মেয়ের, গয়না সোনার জলে পরিষ্কার করাবে, নতুন গড়বে। প্রত্যেক বার কিছু না কিছু গড়াবেই। সোনার ব্যাপারে মাসির একটা সাংঘাতিক দুর্বলতা আছে। আর নেশার মত, এলে সোজা লক্ষ্মী ব্রাদার্স। আমি একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম মাকে, ‘মাসি কি তোমার নিজের বোন?’ সেদিন দু-তিনটে এক্সট্রা হ্যাঙ্গারের বাড়ি বেশি পড়েছিল পিঠে। যাইহোক কেনাকাটার জন্যেই বোধহয় ওরাও খুব খাতির করে শুনেছি। আবার মাসির ভাল নামও লক্ষ্মী। মাসি সেই দোকানে ঢুকতেই বেশ শোরগোল পড়ে গেল।

‘লক্ষ্মীদি আইসে। লক্ষ্মী আইসে।’ আশপাশে যারা ক্রেতা ছিল, তারাও বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গে দেখলে।

তখনও খুব ভিড় নেই দোকানে। ঢুকতেই আমাকে ডাকলে, ‘এই আমার কাণ্ডারী। দিদির ছেলে’, বললে মালিকভাইদের। বয়স্ক দুই ভাই আর তাদের ছেলেরা। আমাদের দেখে একটা কাষ্ঠ হাসি দিলে। দু-চারজন ক্রেতা দাঁড়িয়ে আছে। আমি কোনায় ঠান্ডাঘরের বেঞ্চে বসলাম। মাসি দেখছি চারিদিকে তাকাচ্ছে, আঙুল দিয়ে শো-কেসে গয়না দেখাচ্ছে আর কথা বলছে। ব্যাগ থেকে দেখি সব গয়না বার করছে। তারপর থেকে চলল নানা গয়নার সম্ভার একবার বেরোচ্ছে আবার মাসির অপছন্দের জন্যে ঢুকে যাচ্ছে শো-কেসে। আস্তে আস্তে লোক বাড়তে লাগল। দূরে বেঞ্চে বসে মাসিকে আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে সময় করে দৌড়ে এসে দুটো ক্যালেন্ডার আর দুটো মিষ্টির বাক্স আমার হাতে দিয়ে বললে, ‘হয়ে এল, আসছি দাঁড়া।’

প্রায় একঘণ্টা পরে দোকান তখন থিকথিক করছে ভিড়ে, আর এত লোকের জন্যে এসির হাওয়ায় আর ঠান্ডা লাগছে না। রীতিমত ঘামছি বসে বসে। মাসিকে আর দেখাই যাচ্ছে না। মোবাইল ঘেঁটে ঘেঁটে ব্যাটারি শেষ প্রায়। হঠাৎ করে কিছুটা দেখা দিয়েই নিমেষে ভিড়ে হারিয়ে গেল। অমায়িক গলা পেলাম, ‘দেখি দেখি। এই যে বোনপোর মিষ্টি আর ক্যালেন্ডারটা কোথায়?’ অপ্রস্তুত হবার আর কিছু বাকি রইল না। ধরণী দ্বিধা হও। ওইটুকু দোকানে গুঁতোগুঁতি করে দেখি আরও এক বাক্স মিষ্টি আর ক্যালেন্ডার নিয়ে বিজয়িনীর মত মাসি ফিরলে। ঘেমেনেয়ে স্নান।

বললে, ‘যাক, কাজ শেষ। চল চিত্ত, এখান থেকে। বেরোতেও গুঁতোগুঁতি। দেখলাম গুঁতোগুঁতিতে মাসি বেশ এক্সপার্ট।

যুদ্ধ শেষে গুঁতিয়ে তিনটে প্যাকেট আর বগলে তিনটে ক্যালেন্ডার নিয়ে ফুটপাতে ছিটকে এসে পড়লাম। ক্যালেন্ডার বেঁকে গেছে। মিষ্টির পকেট চিঁড়েচ্যাপ্টা। তা হোক, বেরিয়েই বললে, ‘দিদিও যেমন ঢ্যাঁড়স, তেমনি হয়েছিস তুই।’ ঠান্ডাঘর থেকে বেরিয়েও গলগল করে ঘামছি। এরই মধ্যে আমার হাতে কিছু চালান করে কোমর থেকে রুমাল বার করে মুছে নিলে। খুব মারামারি, চিৎকার করে পরিশ্রান্ত মাসি।

বললাম, চলো, সামনেই বাস স্ট্যান্ড, ওখানে দাঁড়াই।

‘বাস স্ট্যান্ড?’ আকাশ থেকে পড়লে। ‘এখুনি কী?’

‘মানে?’ আমি অবাক। ‘আরও কিছু কেনার আছে? দেখছ কীরকম উত্তাল ভিড়?’

দু-পাটি বেরিয়ে গেল। ‘হি হি, তুই কবে বড় হবি চিত্ত? এখুনি তো সময়। রাস্তায় দরাদরি করার সময়। আয়, আয়।’ আমার করুণ মুখ দেখে মাসি হাত ধরে টানে। ভিড়ের মধ্যে মাসি টানছে, অথচ আমি যেতে পারছি না। ভিড়ে আটকে আটকে যাচ্ছি। দু-দুবার ফুটপাতের উঁচুনীচুতে ঠোক্কর খেয়ে শেষ অবধি হুমড়ি খেয়ে পড়লাম ফুটপাতের এক ঢিপি শাড়ির ওপর। চারিদিকে শুধু আমি নয়, আরও অনেক মহিলা, কেউ উপুড় হয়ে, কেউ বসে পড়ে বাছাবাছি করছে। উঁহু, আসলে টানামানি করছে। ‘এই, এটা আমি ধরেছি, এটা আমার, এটা আমার।’ ‘ধর শালা ধর, ধর।’ ‘এই দিদি ছাড়ুন।’ ‘না ওটা আমি ধরেছি।’ এ যেন মাছধরা চলছে। দুটি রোগা শুটকো বিহারি লোক পিছনে দাড়িয়ে মজা দেখছে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে মাসি চিৎকার করলে ‘চিত্ত ধর, ওটা। ধর।’ এ যেন কাটা ঘুড়ির সুতো চলে যাচ্ছে। একটা গোলাপি রঙের শাড়ি চলে যাচ্ছে সামনে দিয়ে অন্য দিকে। গোলকিপারের মত শুয়ে পড়ে হাত বাড়িয়ে ধরলাম শাড়ির খুঁট। মাসি দৌড়ে ঘুরে চলে এল। ঘাড়ের ওপর দিয়ে হামলে পড়ে বললে, ‘এই তো, হয়েছে। ছাড়ুন, দিদি ছাড়ুন। অনেকক্ষণ আগেই আমি এটা নিয়ে নিয়েছি।’ যিনি ওপর প্রান্ত ধরে ছিলেন তিনি অনেকক্ষণ আগেই নিয়ে নিয়েছি বলাতে একটু থতমত খেয়ে গেলেন। চিন্তান্বিত হয়ে একটু মুঠো হালকা হতেই মাসি লাগালে এক টান। গোলাপি শাড়ি হাতের মুঠোয়। মারামারি, টানাটানি করে মাসি তিনটে শাড়ি নিলে। এই গরমে টানামানিতে দম বেরিয়ে যায় আর কী। আমি পরিশ্রান্ত হয়ে বসে পড়ার মত অবস্থা। এত বছর কারণে অকারণে গড়িয়াহাট এসেছি, এমন বিদঘুটে অবস্থায় পড়িনি। এরা লজ্জাশরম সব ফেলে রেখে এসেছে বাড়িতে। বললাম, ‘এবার যাবে তো বাড়ি?’ শাড়ি, পাঞ্জাবি, পায়জামা, বেডকভার, টেবিল ক্লথ, ক্লিপ, সেফটিপিন, বালিশের কভার, দুজনের হাতেই একাধিক প্যাকেট, আর বগলদাবা করে রাখা যাচ্ছে না।

‘কোথাও একটু বসতে পেলে হয়। তাহলে চলো বাড়ি?’

মাসির দমের কোনও শেষ নেই। চারিদিকে চোখ ঘুরছে। শুনতেই পেল না আমার কথা। বললে, ‘চল, চল তোদের সেই সোনার দোকানটা ঘুরে যাই। বেরোবার আগে তোর মা বলে দিয়েছিল।’

‘অ্যাঁ?’ আমি প্রায় কেঁদে দেবার মত অবস্থা। ‘এই অবস্থায়?’

‘শন্টু মন্টু’, বলে থুতনিটা নেড়ে দিয়ে মাসি শিফনের শাড়ি দিয়ে মুখ মুছে গম্ভীর হয়ে বললে, ‘এরকম করে না। তুই না ভাল ছেলে? তোর মা বলে দিয়েছে, ওখানে একবার ঘুরে যেতে।’

‘কখন মা বলল?’ সন্দেহের তির এবার মাসির দিকে। হেসে বললে, ‘‘বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞাসা করিস। আমায় বললে আসবার সময় ‘দুলু, ছোট্ট বোন আমার, একটা কাজ করে দিস। জ্যোতি জুয়েলারি একবার হয়ে আসিস।’ অনেক করে বলেছে। কী করি বল?’’ মুখ ব্যাজার করে মাসি চেয়ে রইল। এরপর না গিয়ে উপায় নেই।

দোকানটা বেশ কিছুটা হেঁটে গিয়ে বালিগঞ্জ স্টেশনের দিকে। আবার উল্টো ফুটপাতে। দুজনের দুহাতেই অনেক প্লাস্টিক ব্যাগ। এত ভিড়ের মধ্যে বাস, অটো, ট্রাম বাঁচিয়ে ওপারে গিয়ে দেখি দোকানের সামনে বিরাট ভিড়। বাইরে গিজগিজ করছে লোকজন।

বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘দেখলে তো কী অবস্থা?’

মাসি কিন্তু বেপরোয়া, বললে, ‘কুছ পরোয়া নেই। তুই বল আমি ঢুকে যাব?’

বলে কী? বললাম, ‘কী করে?’

‘সে আমি বুঝে নেব। কিন্তু আমি তো চিনি না কাউকে।’

দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি বড়ছেলে মোটাসোটা বাবলু ঘেমেনেয়ে একাকার। পাঞ্জাবি সপসপ করছে ঘামে। ভিতরে কাউন্টারে ওর ভাইকেও মনে হল পাশে দেখলাম। কিন্তু দোকানের ভিতরে যাবার কোনও প্রশ্ন নেই। দেখতে পাচ্ছি দোকানের সমস্ত ভিড় ঘামে ভিজে একাকার। এসি বোধহয় চলছে না। বাইরে গুটিকয়েক চেয়ার, সেগুলোও ভর্তি। লোকজন হাতে সরবত, হাঁটুর ওপর মিষ্টির বাক্স। না এখানে হবে না। ঘুরতে যাব, পিছনে দূর থেকে বাবলুর গলা ভেসে এসে এল। হাসিমুখে গলা তুলে বললে, ‘নমস্কার দাদা। এসেছেন। খুব খুশি হয়েছি বসুন।’ এই বলতেই মাসি উল্লসিত হয়। মাসি নিজেই হাত নাড়ে। আমায় বললে, ‘আমি যাই সামনে?’ বাবলুবাবু আন্দাজে বললে, ‘কে? মাসি? পিসি?’

চিৎকার করে বললাম, ‘মাসি।’ ব্যস। মাসি ওই চেঁচামেচি, হট্টগোলের মধ্যেই ঝাঁপ দিল। দেখি দেখি, সরুন সরুন বলে চিৎকার করতে করতে ওই ভিড়ের মধ্যেই নিজের মোটা বেঁটে শরীর নিয়ে গলে যাবার চেষ্টা করতে লাগল। বাবলুবাবু একটু সাহায্য করলেন, উনি সঙ্গত করলেন, ‘দেখি দেখি ওনাকে জায়গা দিন তো।’ আমি দুই স্টেপ নিচে দাঁড়িয়ে দেখছি মাসি মিলিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে। কিছুক্ষণ বাদে কায়দা করে সেই ক্যালেন্ডার, মিষ্টির বাক্স নিয়ে বেরিয়ে এসে বললে, ‘কী অসভ্য লোক দেখ। যেতেই দিচ্ছে না। আমি তেমন দিলাম দুজনের কোমরে ক্যাতুকুতু। ব্যস চিচিং ফাঁক।’ এই বলে আমার হাতে সব তুলে দিতে গিয়ে পাশে চোখ পড়াতে মুখ ব্যাজার হয়ে গেল। কাঁদো কাঁদো স্বর ভেসে এল, ‘আমাদের সরবত?’ ওইখান থেকেই চেঁচাতে লাগল, ‘বাবলুবাবু, বাবলুবাবু সরবত?’

মনে হচ্ছিল ধরণী দ্বিধা হও, ঢুকে যাই। মাকে গিয়ে বলব, আর কোনওদিন এই দোকানে আসা নেই। বাবলুবাবু হাত তুলে দাঁড়াতে বললেন। কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি খেতে খেতে শেষে বিরক্তির শেষসীমায় এসে এক দারোয়ান দুগ্লাস সরবত এনে দিল। আমি রাগে গরগর করছি। কিছু বলতেও পারছি না। একমাত্র মাসি বলে কথা। এরকম লজ্জাশরমহীন মাসি কী করে হতে পারলে? কিন্তু কোনও তোয়াক্কাই করছে না। সরবত খাব না শুনে আমারটাও ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল। একটা বড় ঢেঁকুর তুলে বললে, ‘খুব তেষ্টা পেয়েছিল। বুঝলি, অনেক দিন বাদে আবার নববর্ষের আনন্দ পেলাম। চল, এবার বাড়ি যাই।’

সাতদিন ধরে সমস্ত আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করে কয়দিন সর্দিগর্মিতে ভুগে এক মাস বাদে মাসি দিল্লি চলে গেল। কলকাতায় যতদিন ছিল একদম যেমন-তেমন সুতির শাড়ি, গাউন পরে হৈহৈ করে কাটাল।

চলে যাবার পর মাকে পাকড়াও করলাম, ‘মাসি এমন কেন? এই পঞ্চান্ন বছরে এইসব মানায়? দোকানদাররা কী ভাবল?’

মা হেসে বললে, ‘তুই একবার ওর দিল্লির বাড়ি যা। সব উত্তর পেয়ে যাবি।’

‘কী আছে?’

‘দুই ছেলে বিদেশে। মানব অর্থাৎ তোর মেসোমশাই, দিল্লি হাইকোর্টের নামকরা ব্যারিস্টার। সারাদিন বাড়িতে তিনটে ঘর ভর্তি লোকজন, অফিস। বিশাল দোতলা সেন্ট্রালি এয়ার কন্ডিশন বাড়ি, সঙ্গে রান্নার লোক, মালি নিয়ে পাঁচটা লোক। কিছুই করতে হয় না। মাঝে মাঝে মহিলা কমিশনের কিছু কাজ, এনজিও দেখাশোনা আর মিটিং। সেরকম আত্মীয়ও তো নেই ওখানে। বন্দিজীবন।’

‘বন্দি কেন বলছ? ভালই তো।’

‘আসলে ও চৈত্র মাস পড়লেই উসখুস করতে থাকে। গড়িয়াহাট ওকে টানে নিশির ডাকের মত। ছোট থেকে মার সঙ্গে ওই যেত সেলের কেনাকাটা করতে। সেই থেকে নেশাও বলতে পারিস। ও ভীষণ কথা বলতে, হৈহৈ করতে ভালবাসে। বিয়ের আগে পুজো, চৈত্র সেলে খুব দরাদরি করে বাজার করতে ভালবাসত। কেউ কেউ আছে, পারে। যেমন আমি পারি না।’

এই বলে মা একটু থামলে। ‘‘ও মানুষের সঙ্গে গা-ঘেঁষে থাকতে চায়। কিন্তু দিল্লির জীবনে ও হাঁপিয়ে ওঠে। মেশোমশাইকে বলা আছে, এই সময় এক মাস ছুটি। শুধু আনন্দ, আর পুরনো জীবনকে ছুঁয়ে দেখা। বছরে তাই এই সময় আসে সবার সঙ্গে দেখা করে গল্প করে গড়িয়াহাটের কলেজ জীবনের স্মৃতিকে আবার ঝালাই করে অনেক অক্সিজেন নিয়ে ফিরে যায়। আমি বেশি কিছু বলতে পারি না। সারা বছর বৈভবের, আরামের আতিশয্যে ও কলকাতার এই গা-ঘেঁষাঘেঁষির জীবনকে খুব মিস করে। গড়িয়াহাটের সেলের কেনাবেচাকে মিস করে। ও বলে, ‘এই সময়ই আসতে হয় কলকাতায়। এরকম মন্দিরের ভিড়, বাড়ি বাড়ি দেখাসাক্ষাৎ আর কোথাও নেই।’ কী করবে আর?’’

আমি চুপ করে রইলাম। বৈভব হাঁফ ধরায়। মধ্যবিত্তের জীবন সংগ্রামে হাঁফ ধরার কোনও জায়গা নেই। সামনের বছর তাহলে হাওড়ার মঙ্গলা হাট, খান্না সিনেমার কাছে হরিশা হাটে নিয়ে ফেলতে হবে। কত করবি দরাদরি কর। জীবন তো ওখানেই গান শোনাচ্ছে অবিরাম ঝর্নাধারার মত।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
1 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Rafiqul islam
Rafiqul islam
8 months ago

So good!!!! You made me run with your Dulu Mashi and I became a part of the lovely bargains and New Year’s sweet collections. I was mesmerized..!!!!

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »
শুভদীপ রায়চৌধুরী

শুভদীপ রায়চৌধুরীর দুটি কবিতা

অন্ধকারের তুমি,/ নরম পুঁইমাচার নিচে সবজেটে বহুরূপী/ তোমাকে আলোর কণার ভেতর গড়িয়ে যেতে দেখব বলে/ আমি এই পাগলের পৃথিবী ছেড়েছি/ টিলাপায়ে বাস করি/ নাম, সমুদ্রসম্ভব।/ পাতার ইমারত আছে, আছে/ কিছু দৈনন্দিন কাজ/ মাছ ধরার নাম করে/ বালসাভেলায় অনেকদূর যাওয়া/ যতদূর ভেসে গেলে ঢেউয়ের চুম্বন থেকে/ ছোবলটুকু আলাদা করাই যায় না

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | দ্বিতীয় পর্ব

সকালে চিড়ে নারকেল-কোরা আর গুড় খেয়ে আমি সাইকেলে চেপে ছুটিয়ে দিলাম— আট মাইল রাস্তা ঠেঙিয়ে যখন পৌঁছালাম— তখন গণগণে রোদ্দুর তেষ্টায় গলা কাঠ। ঘন্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে একটা বাড়ি দেখে সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম যদি একটু জল খাওয়া যায়। বাড়ির বারান্দায় একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি বসেছিলেন— তার কাছে উদ্দিষ্ট ঠিকানার কথা প্রশ্ন করতেই তিনি উঠে এসে আমার হাত ধরে আমাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে একটা পাটি পেতে বসতে দিলেন। আমি আবার জল চাইলে বললেন, “দাদাঠাকুর ব্যস্ত হবেন না— ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন।”

Read More »