Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

লুভুর্ভা অরণ্যের এক সংবাদ

মনোজ দাস

ভাষান্তর: তরুণ সিংহ মহাপাত্র

সম্পাদক মহোদয়, আপনি আমার ওপরে যে দায়িত্বভার ন্যস্ত করেছিলেন আমি আমার সাধ্যমত পরিশ্রম ও নিষ্ঠা সহকারে তা সম্পন্ন করেছি। অনুসন্ধানের বিবরণী নিম্নে প্রদান করলাম।

লুভুর্ভা অরণ্যে প্রবেশ করে প্রথমে আমি হতচকিত হয়ে পড়লাম। সেই সময় অরণ্যব্যাপী উদ্দাম উৎসব চলছিল। কয়েকটি তরুণ গর্দভ প্রবল উল্লাসে সঙ্গীত পরিবেশন করছিল। গান্ধর্ববিদ্যায় গর্দভদের অটল আত্মবিশ্বাস সম্পর্কে আমি পূর্ব থেকেই অবহিত থাকায় তাদের মোহভঙ্গের নিমিত্ত যেকোনও উদ্যম ব্যর্থ হবে বুঝে নীরব র‌ইলাম। কিন্তু কতিপয় বন্য শূকরীর ব্যবহার আমাকে ব্যথিত করল। তারা নাচছিল আর আমার কাছ থেকে তারিফ আশা করে আমার দিকে বারংবার অর্থপূর্ণ দৃষ্টিপাত করায় আমি বললাম, ‘তোমাদের উদ্যম প্রশংসনীয়, তবে নৃত্যের লালিত্যের জন্য, কটিদেশ নামক এক অঙ্গের একান্ত প্রয়োজন। তোমরা বরং অন্য কোনও কলাচর্চায় মনোনিবেশ করো।’

তারা খুব উত্তেজিত হল। তাদের নৃত্যগুরু আমাকে বলল, ‘তোমার মতো সাংবাদিকের কাছে আমরা এই রকম অগণতান্ত্রিক মন্তব্য আশা করিনি। আমাদের সংবিধানে নৃত্যাভ্যাসের অধিকার সবাইকে দেওয়া হয়েছে।’

আমি বাধ্য হয়ে বললাম, ‘অধিকার এক কথা, বিবেক আর এক কথা।’

তারা জবাব দিল, ‘আমাদের পেট নির্মল বিবেকে ভরপুর। তুমি বুদ্ধু। তবে তোমার ভাগ্য ভাল, তুমি আমাদের সংস্পর্শে এসেছ। আমরা তোমার মধ্যে কিছু কলাবোধের উদ্রেক করে দিতে পারব।’

এরপর আমাকে ঘিরে তারা নাচ করতে লাগল। প্রায় তিন ঘণ্টা আটকে থাকার পর আমি কাতর কণ্ঠে বললাম, ‘আমার উন্নতি হয়েছে। এই রকম সারগর্ভ টুইস্ট নৃত্য আমি পূর্বে কখনও দেখিনি।’

আমাকে লিখিতভাবে এ বিবৃতি দিতে হল। তারপর মুক্তি পেয়ে আমি আমার পূর্বপরিচিত শৃগালপ্রবর-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম। লুভুর্ভা অরণ্যে যে তিনদিন কাটালাম, তার মধ্যে আমাকে বারংবার অনুরূপ অবস্থার সম্মুখীন হতে হল। যদিও আমি এক নির্দিষ্ট ঘটনার তদারক করতে গিয়েছিলাম, বর্তমানে লুভুর্ভা অরণ্যব্যাপী সর্বজনীন স্তরে কীরকম স্বাধীকারপ্রমত্ত পরিবেশ বিরাজমান, তার‌ই পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে এই দৃষ্টান্তটি দিলাম ।

শৃগালপ্রবর-এর অগ্রজ শৃগালপুঙ্গব বর্তমানে লুভুর্ভার একমাত্র অস্থায়ী মন্ত্রী (এরপর আমি তাদের কেবল প্রবর ও পুঙ্গব বলে অভিহিত করব)।

প্রবর আমাকে দেখলে সাধারণত ভাববিহ্বল হয়ে আলিঙ্গন করে; কিন্তু এবার সে কেবল চোখ নাচিয়ে ‘কীহে কেমন আছ’ বলে বারবার হাতঘড়ির দিকে তাকাতে লাগল। তবে আমি যখন তাকে বললাম যে, লুভুর্ভায় সম্প্রতি সংঘটিত বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনের ওপরে আমরা এক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করার কথা ভাবছি, তখন সে আমার প্রতি তার পূর্ব অনুরাগের কথা হঠাৎই মনে করতে পারল ও আমাকে আলিঙ্গন করল; তারপর অনুযোগ করল, ‘‘তুমি তো আমাদের ভুলে গেছ। ‘মিনিস্টার’ ও আমার অনেক সময় তোমার বিষয়ে কথা হয়।”

আমি লক্ষ করলাম পুঙ্গব-কে পূর্বের মত ‘ভাই’ না বলে প্রবর ‘মিনিস্টার’ বলছে।

প্রবর-এর সঙ্গে আমি সেদিন সারাদিন ছিলাম ও অনেক তথ্য সংগ্রহ করলাম। পরবর্তী দু’দিনের ভিতরে আমি তিনজন বিশিষ্ট অরণ্য মহিষ, গয়ালসংঘের মুখ্য সঞ্চালক, পেঁচক মহাসংঘের সম্পাদক, নিখিল লুভুর্ভা হরিণ সংসদের সভানেত্রী, নির্বিষ সর্প সভার তথা বিষধর সর্প মহাসভার সভাপতিদ্বয়, ব্যাঘ্র পরিষদের অবৈতনিক কোষাধ্যক্ষ ও সর্বোপরি পরলোকগত শাসন-মুখ্য সিংহশেখরের পি.এ. (বর্তমানে তাকে সাদা পোশাকধারী শ্বাপদেরা নজরবন্দি করে রেখেছে)-র সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। বলা বাহুল্য, দুঃখী পি.এ.-টি ছাড়া অন্য সকলে ঘটনার স্থুল বিবরণী মাত্র দিল। মোটামুটি এই হল ঘটনা ও তার অন্তরালের ব্যাপার—

লুলুর্ভা অরণ্যের মন্ত্রিমণ্ডলের সভাপতিরূপে সিংহশেখর দীর্ঘ কুড়ি বৎসর শাসনারূঢ় ছিলেন। যে অধিবেশনে সিংহশেখর নির্বাচিত হয়েছিলেন, তার পরে আর কোনও দিন মন্ত্রিমণ্ডলের মণ্ডলাকারে বসার কথা জানা নেই। সমগ্ৰ শাসনক্ষমতা বৃদ্ধ সভাপতির হাতে ন্যস্ত ছিল। কেউ কেউ বলে সভাপতি মন্ত্রিমণ্ডলের সদস্যদের সন্তানতুল্য মনে করতেন তাই তাদের ভারাক্রান্ত করতে চাইতেন না। আবার অনেকে বলে, সভাপতির সুশাসন ও ব্যক্তিত্বের প্রভাবে অরণ্যে কোনও রকম জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়নি; ফলে মন্ত্রিমণ্ডলের কিছু করার ছিল না।

সদস্যদেরও কোনও অভিযোগ ছিল না। তারা নিজ নিজ মাইক্রোফোন দণ্ডটি অবলম্বন করে সুখে কালাতিপাত করছিল বলে জানা যায়। উক্ত দণ্ডটি ধারণ করে তারা অরণ্যের এক এক অঞ্চলে গিয়ে বক্তৃতা দিত এবং নিজ কণ্ঠস্বর ও লুভুর্ভা পর্বতশ্রেণির গাত্রে তার প্রতিধ্বনি শ্রবণ করে সম্মোহিত জীবনযাপন করত। দু’-একজন উদ্ভাবনপটু সদস্য স্ব স্ব বচনামৃত অধিক মাত্রায় পান করার উদ্দেশ্যে কানে চোঙা সংযোগ করছিল।

ক্রমে মাইক্রোফোনের নেশা অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হল। বিবাহ, বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে ক্রমে অধিক থেকে অধিক শক্তিশালী অ্যাম্‌প্লিফায়ার যোগে সঙ্গীত বা ঘোষণানামা পরিবেশিত হতে লাগল। অবশ্য শৃগালদের‌ই এই বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী হ‌ওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। সূর্যাস্তের সময় নদীকূলে একত্রিত হয়ে তারা যে কেবল মাইকের সামনে হুক্কা হুয়া করে তা নয়, প্রত্যহ কয়েকজন পৌঢ়শৃগাল অমুক সময়ে অমুক ঝোপের চতুর্দিকে সমবেত হুক্কা হুয়া হবে বলে মাইক্রোফোন সহযোগে তারস্বরে ঘোষণা করতে লাগল।

এক-আধবার সভাপতি সিংহশেখর তাদের বললেন, ‘দেখ, সমবেত হুক্কা হুয়া এক প্রাগৈতিহাসিক অনুষ্ঠান। এটি এমন এক অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা যে প্রাজ্ঞ পূর্বপুরুষেরা এর প্রবর্তন করার দিন থেকে আজ পর্যন্ত এর বক্তব্য ও গায়নপদ্ধতির কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। তাই মাইকের মাধ্যমে পরিবেশন করে অধিক কী আর হবে?’

কিন্তু সিংহশেখরের এমন আবেদন সত্ত্বেও অবস্থার পরিবর্তন হল না। হঠাৎ একদিন সিংহশেখর এক আদেশনামা জারি করলেন। তার সারাংশ— ‘সভ্যতার এক বড় প্রতীক হল পরস্পরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। সেদিক থেকে মাইক্রোফোন দণ্ডটিকে সভ্যতার, বরং অসভ্যতার মানদণ্ড বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রশ্ন হল, আমরা অন্যের আনন্দের জন্য তার সম্মতিক্রমে মাইক ব্যবহার করছি না তার বিরক্তি সত্ত্বেও তার ওপরে আমাদের অহমিকা-প্রণোদিত তথাকথিত আনন্দ চাপিয়ে দিচ্ছি? ইচ্ছুক শ্রোতৃমণ্ডলীর আগ্রহ ব্যতীত মাইকের অযথা ব্যবহার, রাস্তাঘাট বা পশুপদ ভিতরে তার ভীমনাদ, অসহায়ের উপর হিংসাচার ছাড়া আর কিছু নয়। হয়তো হরিণটি অসুস্থ, হয়তো খরগোশটি কবিতা লিখছে, আর কিছু না হোক কেউ হয়তো নীরবতাই পছন্দ করছে— তোমার উল্লাসের স্টিমরোলারে তার মনটিকে নিষ্পেষিত করার অধিকার তোমার নেই।’

এর ফলে লুলুর্ভা অরণ্যে শান্তি ফিরে এল। ঘন বৃক্ষলতার ভিতর থেকে বহুদিন পরে কপোত, কোকিলের কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া গেল।
কিন্তু অশান্তির আগুন জ্বলতে লাগল সদস্যদের ছাতির ভিতরে। আজ পর্যন্ত তারা যে বিষয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি, সে বিষয়ে অর্থাৎ সিংহশেখরকে কীভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়, তা নিয়ে প্রচণ্ড বেগে মস্তিষ্কচালনা করতে লাগল।

স্বনামধন্য মনস্তত্ববিদ জনৈক পেঁচক আমাকে এসম্পর্কে কিছু খবর দিয়ে বললেন, সিংহশেখর যে ক্ষমতালোলুপ হয়ে সভাপতির আসন অধিকার করেছিলেন, তা নয়, বেচারা ক্ষমতা ছাড়ার কথা ভুলে গিয়েছিলেন। পশু-সাধারণ সুখে ছিল— তিনি তাঁর কর্তব্য করে যাচ্ছিলেন— ব্যাস!

দু’বৎসর কেটে গেল। সিংহশেখর সমান উৎসাহে শাসন করে চলেছেন। এদিকে মাইক্রোফোন বিহনে সদস্যরা পাগলপারা হয়ে উঠেছিল।
একদিন অপরাহ্নে অন্যতম সদস্য শৃগালপুঙ্গবকে সভাপতি তার সঙ্গে দিবাহারের জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন। প্রথম বারের জন্য সেদিন সভাপতি লক্ষ করলেন যে, পুঙ্গবকে অত্যন্ত ম্রিয়মাণ দেখাচ্ছে। তিনি এর কারণ জানতে চাওয়ায় পুঙ্গব উত্তর দিল, অরণ্যের ভালমন্দ চিন্তা করে তার এরকম স্বাস্থ্যহানি ঘটেছে। বিস্মিত তথা উৎফুল্ল সভাপতি বললেন, ‘প্রীত হলাম পুঙ্গব, প্রীত হলাম। আমি জানতাম না যে অরণ্যের ভালমন্দ বিষয়ে আমার মত অন্যরাও এত চিন্তান্বিত। মাঝে মাঝে আমার আশঙ্কা হত, আমার পরে হয়তো অরণ্যে অরাজকতা বিরাজ করবে; কিন্তু আজ আমার সে চিন্তা দূর হল। বৃদ্ধ হয়েছি। একদিন না একদিন মৃত্যু আসবে। সেদিন নির্দ্বিধায় আমি নিজেকে মৃত্যুর হাতে সমর্পণ করব।’

একদিন সিংহশেখরের মৃত্যু হতে পারে, একথা পুঙ্গব কিংবা অন্য সদস্যরা কস্মিনকালেও চিন্তা করেনি। আজ হঠাৎ এরকম এক সম্ভাবনায় পুঙ্গব পুলকিত হয়ে উঠল ও একনিশ্বাসে এক কলস মদ্য পান করে ফেলল। সভাপতি নিজে পছন্দ না করলেও অতিথির সম্মানে নিজেও মাত্রাধিক মদ্য পান করতে বাধ্য হলেন।

সেখান থেকে বিদায় নিয়ে পুঙ্গব প্রবল উৎল্লাসে গান গাইতে গাইতে অরণ্য প্রান্তস্থ নদীকূলের দিকে ধাবমান হল। ক্রমে এক কলস মদ্যপান জনিত প্রতিক্রিয়া তার ব্যবহারে স্পষ্ট হয়ে উঠল।

যে সময় সে নদীকূলে উপস্থিত হল, তখন সূর্য অস্তগামী। হুক্কা হুয়া অনুষ্ঠানে যোগদান করার জন্য সমগ্ৰ অরণ্যের শৃগালকুল সেখানে যথাশীঘ্র উপস্থিত হল।

পুঙ্গবের চেতনায় মদ্যপান প্রতিক্রিয়ার প্রথম শিকার হল তার কালজ্ঞান। সভাপতি একদিন মরবে, এই পুলকপ্রদ সম্ভাবনাকে ‘সভাপতি মরে গেল’ বলে সে সমবেত শৃগালমণ্ডলীর সামনে ঘোষণা করে ফেলল।

শৃগালেরা কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে র‌ইল। তারপর তারা নিদারুণ শোকোচ্ছ্বাসে অরণ্য প্রকম্পিত করতে লাগল। এই অভাবনীয় দুঃখাতিশয্যে ক্রমে অরণ্যের অন্যান্য জীবজন্তু আকৃষ্ট হয়ে নদীকূলে এসে উপস্থিত হল। পিতৃপ্রতিম সভাপতি ইহলোকে আর নেই, একথা শুনে সকলে স্তব্ধ হয়ে গেল আর তারপর আর্তনাদ করতে লাগল।

অরণ্যের সমস্ত জীব অশ্রুপাত করতে করতে সভাপতির ভবনের দিকে চলল। লুভুর্ভা পর্বতশ্রেণির অনুচ্চ অংশে এক নিরাড়ম্বর গুহায় বৃদ্ধ সভাপতি বসবাস করতেন। সেদিন মাত্রাধিক মদ্যপানের ফলে পুঙ্গব চলে যাওয়ার পরেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন।

অরণ্যের উপর চন্দ্র উদিত হয়েছিল। সেই রহস্যাবৃত পরিবেশে ক্রমে আবালবৃদ্ধবনিতা পশুসমাজ সভাপতির গুহাতলে জড়ো হল। গুহার সামনে এসে তাদের আর্তনাদ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারা কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল।

পুঙ্গব গুহার ভিতরে ঢুকল। ততক্ষণে তার নেশা ছুটে গেছে। সে কী ভয়ানক ভুল করেছে, হঠাৎ তা হৃদয়ঙ্গম করে কাঁপতে লাগল।

এমন সময় হনুকুলসম্ভূত এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী সদস্য একটি উচ্চ শিলাখণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে ‘পরলোকগত’ সভাপতির গুণগান করতে শুরু করে দিল, সমবেত পশুকুলের মধ্যে উঠল ক্রন্দনরোল। সভাপতি হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে পড়লেন। বাইরে দৃষ্টিপাত করে সেই বিরাট সমাবেশ দেখে চমকে উঠলেন আর বিহ্বল দৃষ্টিতে পুঙ্গবের দিকে তাকালেন।

সাহসে ভর করে পুঙ্গব বলল, ‘এ কী সভাপতি, আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন যে আপনি মৃত!’

নেশা ও ঘুমের ঘোরে বৃদ্ধ সভাপতি হতবাক হয়ে তাকিয়ে র‌ইলেন। পুঙ্গব পুনরায় বলল, ‘প্রজাকুল আপনার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করার জন্য বাইরে জড়ো হয়েছে।’

‘আমি মৃত বলে তুমি কি সম্পূর্ণ নিশ্চিত?’— বিমূঢ় সভাপতি প্রশ্ন করলেন।

‘সারা অরণ্যের পশুকুল নিশ্চিত!’— উত্তর দিল পুঙ্গব।

বৃদ্ধ সভাপতি কাঁদো কাঁদো হয়ে নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দিকে বারংবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, ‘কিন্তু সত্যি বলবে পুঙ্গব, আমি নিজে কেন নিশ্চিত হতে পারছি না। বড় দ্বন্দ্বে পড়েছি। উপায় কী?’

‘আপনার মত প্রাজ্ঞ, প্রজাবৎসল সভাপতির পক্ষে এরকম দ্বন্দ্ব শোভা পায় না। আপনি মৃত, এই কথা আপনার মেনে নেওয়া উচিত।’— পুঙ্গব এবার দৃঢ়স্বরে বলল।

কিছুক্ষণ উভয়ে নীরব র‌ইলেন।

গুহার বাইরে পশুকুল ‘মৃত’ সভাপতির উদ্দেশে প্রবল শোকসন্তপ্ত জয়ধ্বনি দিচ্ছে আর গুহাগাত্রে তা এমন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে যে সভাপতি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বারংবার উপর দিকে তাকাচ্ছেন।

তারপর সভাপতি কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘এখন তাহলে আমি কী করব?’

পুঙ্গব বলল, ‘চিন্তা নেই। আমি বলে দিচ্ছি। একটু অপেক্ষা করুন।’

এই কথা বলে পুঙ্গব বাইরে গিয়ে শিলাখণ্ডের উপরে দাঁড়াতে পশুকুল স্তব্ধ হয়ে গেল। পুঙ্গব গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘ভাই ও বোনসকল, আমাদের পিতৃতুল্য দেবোপম সভাপতি মৃত। কিন্তু আমাদের প্রতি অসীম মমতাবশত তাঁর আত্মা স্বর্গ-গমন পথে আমাদের দৃশ্যমান হবেন এবং বিশেষ দ্রষ্টব্য, সেই মহান আত্মা মরদেহটিকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন।’

পশুকুল প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে র‌ইল। পুঙ্গব গুহার ভিতরে ঢুকে সভাপতিকে বলল, ‘শুনলেন তো? আর দেরি করবেন না। আমি বাইরে গিয়ে জয়ধ্বনি করা মাত্র আপনি বিদ্যুৎবেগে বাইরে বেরিয়ে পর্বতের শিখরের দিকে ছুটে যাবেন। তারপর শিখরের অন্যদিকে নেমে এক দৌড়ে অরণ্য পার হয়ে চলে যাবেন। আপনি মৃত কি জীবিত, এখন তা বিচার করার সময় নয়— পরে বিচার করবেন।’

পুঙ্গব বাইরে বেরিয়ে জয়ধ্বনি করল। সহস্র কণ্ঠে তা পুনরুচ্চারিত হল। তার মধ্যেই পশুকুল চমৎকৃত হয়ে দেখল, চন্দ্রালোকে সুবর্ণতির সম তাদের প্রিয় সভাপতির আত্মা শরীরটি বহন করে পর্বত শিখর অতিক্রম করে স্বর্গাভিমুখে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সম্পাদক মহাশয়! পরবর্তী ঘটনা আপনার সুবিদিত। সেদিন রাত্রির অন্ধকারে আমাদের শহরে হঠাৎ বৃদ্ধ সিংহটির আবির্ভাব; ফায়ারব্রিগেড ও পুলিশবাহিনীর সাহায্যে তার সংহার— সেই ঘটনার এটিই পৃষ্ঠভূমি।

আপাতত লুভুর্ভা অরণ্যে পুঙ্গব‌-ই শাসনকর্তা। সে বিনয়বশত সভাপতি শব্দটি ব্যবহার না করে তাকে ‘মিনিস্টার’ বলতে বলে। আমি যখন অরণ্য থেকে বেরিয়ে এলাম, সেই সময় সারা অরণ্য মুখরিত করে একশত অ্যাম্‌প্লিফায়ারের সাহায্যে পুঙ্গব তার শাসননীতি সম্পর্কে ভাষণ দিচ্ছিল।

চিত্রণ: মুনির হোসেন

লেখক পরিচিতি

মনোজ দাস (২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৪— ২৭ এপ্রিল, ২০২১) আধুনিক ওড়িয়া তথা ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা। ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপক। কথাসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। ভূষিত হয়েছেন ‘পদ্মশ্রী’ ও ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে। তাঁর ‘লক্ষ্মীর অভিসার’ (পরিমার্জিত নতুন মুদ্রণ, ২০২০) গ্রন্থ থেকে বর্তমান গল্পটি অনূদিত হল।

মনোজ দাসের আরও গল্প…

কলিকাতা–দর্শন

উত্তর উপত্যকার বৃদ্ধরা

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
দীপক দাস
দীপক দাস
2 years ago

অনুবাদে শ্লেষ যথাযথ প্রকাশ পেয়েছে বলে মনে হয়েছে। যদিও মূল কাহিনি আমার পড়া নেই এ কথা স্বীকার করতে হবে।

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »
শুভদীপ রায়চৌধুরী

শুভদীপ রায়চৌধুরীর দুটি কবিতা

অন্ধকারের তুমি,/ নরম পুঁইমাচার নিচে সবজেটে বহুরূপী/ তোমাকে আলোর কণার ভেতর গড়িয়ে যেতে দেখব বলে/ আমি এই পাগলের পৃথিবী ছেড়েছি/ টিলাপায়ে বাস করি/ নাম, সমুদ্রসম্ভব।/ পাতার ইমারত আছে, আছে/ কিছু দৈনন্দিন কাজ/ মাছ ধরার নাম করে/ বালসাভেলায় অনেকদূর যাওয়া/ যতদূর ভেসে গেলে ঢেউয়ের চুম্বন থেকে/ ছোবলটুকু আলাদা করাই যায় না

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | দ্বিতীয় পর্ব

সকালে চিড়ে নারকেল-কোরা আর গুড় খেয়ে আমি সাইকেলে চেপে ছুটিয়ে দিলাম— আট মাইল রাস্তা ঠেঙিয়ে যখন পৌঁছালাম— তখন গণগণে রোদ্দুর তেষ্টায় গলা কাঠ। ঘন্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে একটা বাড়ি দেখে সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম যদি একটু জল খাওয়া যায়। বাড়ির বারান্দায় একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি বসেছিলেন— তার কাছে উদ্দিষ্ট ঠিকানার কথা প্রশ্ন করতেই তিনি উঠে এসে আমার হাত ধরে আমাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে একটা পাটি পেতে বসতে দিলেন। আমি আবার জল চাইলে বললেন, “দাদাঠাকুর ব্যস্ত হবেন না— ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন।”

Read More »