Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

রাশিয়ার চিরকুট

পর্ব ১ 

লেফ্ট সাইড ডাইভিং

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। তাই সেখানকার মানুষ যে সাঁতার জানবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে স্বাভাবিকতার মধ্যেই তো অস্বাভাবিকতা থাকে। কেউ কেউ সাঁতার জানে না, আবার কেউ কেউ জানলেও সেটাকে সাঁতার না বলে হাত-পা ছোড়া বলা যায়। আমি ছিলাম সেই তৃতীয় দলে। তবে সেটা বুঝতে আমাকে তিন যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছে আর পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক সাগর-নদী-পাহাড়।

আমাদের বাড়ির পাশেই কালীগঙ্গা নদী। আর দুদিকে দুটো খাল— ছোট খাল আর বড় খাল। পাড়ার ছেলেমেয়েরা বলতে গেলে এখানেই সাঁতার কাটতে শেখে। ছোটবেলায় ছেলেমেয়েদের এক বাটি দুধে বেশ কিছু পিঁপড়া ছেড়ে পান করতে দেওয়া হয়। সবার বিশ্বাস, পিঁপড়া যেহেতু সাঁতার কাটতে জানে তাই যে কেউ পিঁপড়া সহ দুধ পান করলে অটোম্যাটিক্যালি সাঁতার শিখে যাবে। আমিও সাঁতারের হাতেখড়ি নিয়েছিলাম পিঁপড়া দুধ পান করেই। তবে দুধ আমার কখনওই সহ্য হয় না। পুরোটা গিলতে পারিনি। আবার হতে পারে ওই পিঁপড়েরা ছিল ফাঁকিবাজ অথবা ভেজাল ছিল দুধে অথবা দুই–ই— আমি বড় বা ছোট কোনও খালেই সাঁতার শিখতে পারিনি। এরপর আমাদের পুরানো বাড়ি যেখানে তখন সুতা রং করার কারখানা ছিল বলে রংখোলা নামে পরিচিত ছিল। তার পাশে একটা পুকুর মত কাটা হয় বাড়িতে মাটি তোলার জন্য। সেটা করা হয়েছিল যুদ্ধের আগে আর সেখানেই হয় আমার সাঁতার শেখার হাতেখড়ি। এরপরে বড় খালে আর ছোট খালেও সাঁতার কেটেছি, তবে কখনওই অন্যদের মত পটু ছিলাম না। যখন নদীতে সাঁতার কাটতে শুরু করি বন্ধুরা এসে এই পা ধারে টানে তো ওই চোখে জল দেয়। আবার কখনও কুমির কিংবা ‘চুল প্যাঁচানি’-র ভয় দেখায়। ফলে সাঁতারটা কখনওই ভাল করে শেখা হয়নি। মস্কো-জীবনে মাঝেমধ্যে জলে নেমেছি ঠিকই তবে সেটাও সতর্কতার সঙ্গে অল্প জলে। আর কৃষ্ণসাগরে যত না সাগরে স্নান করেছি, তার চেয়ে বেশি স্নান করেছি রোদের কড়া আলোয়। অ্যাড্রিয়াটিক সাগরেও অনেকটা একই অবস্থা, মোটামুটি গলাজলে সাঁতার কেটে এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে যাওয়া। এককথায়, আমার সাঁতার কাটার দৌড় ছিল বুকজল বা গলাজল পর্যন্ত।

১৯৯৯ সালে ইতালি থেকে ফিরে দেখি গুলিয়া বড় ছেলেমেয়ে আন্তন আর মনিকাকে আর্কিমিডিস সুইমিং পুলে সাঁতার কাটতে পাঠিয়েছে। ও নিজে সাঁতার কাটতে জানে না। তাই দায়িত্ব পড়েছে আমার ওপর, ওখানে ওদের দেখভাল করার। ওরা অনায়াসে সাঁতার কাটে আর আমি সুইমিং পুলের অর্ধেকটা গিয়ে ফিরে আসি। এ জায়গায় জল কম কিনা তাই। না, আমি ওদের বুঝতে দেই না যে, আমি সাঁতারটা ঠিক জানি না। ওদের ধারণা, আমি একটু দূরে থেকে ওদের দেখভাল করি। নিজেকে ফাঁকি দিতে আমরা বরাবরই সিদ্ধহস্ত। তবে মনে মনে একধরনের অস্বস্তি অনুভব করি। হয়তো তার জের হিসেবেই এক রাতে স্বপ্নে দেখলাম আমি যেন আমাদের গ্রামের নারায়ণ সাহার বাড়ির বিশাল পুকুরে সাঁতার কাটছি। পুকুরটা ছিল বেশ বড় আর তা নিয়ে অনবরত কেস চলত। ফলে যত না এর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর গভীরতার জন্য তার চেয়ে বেশি খ্যাতি সে পেয়েছিল অন্তহীন মামলার কারণে। যতই গভীরে যাচ্ছি পুকুর যেন ততই শুকিয়ে যাচ্ছে। যাতে কাদাজলে না পড়ি কোনও রকমে শেষশক্তি দিয়ে দ্রুত সাঁতরাতে শুরু করি আর শেষ পর্যন্ত পুকুর পার হই।

ঘুম ভাঙতেই ঠিক করলাম যত কষ্টই হোক পরের বার সুইমিং পুলের একমাথা থেকে অন্য মাথায় যাবই যাব। এভাবেই শুরু হল ধীরে ধীরে সাঁতার কাটা। খেয়াল করলাম আমি যখন সাঁতার কাটি সুইমিং পুলের সবাই আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবি, এখানে আমি একমাত্র রঙিন মানুষ। হয়তো তাই সবাই এভাবে তাকিয়ে থাকে। সময় কাটতে থাকে। আমি যথারীতি চারিদিকে জল ছিটিয়ে পুলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাই। একদিন বরাবরের মতই সাঁতার কাটছি। আমার পেছন পেছন সাঁতার কাটছেন এক ভদ্রমহিলা। উনি আমাদের ল্যাবরেটরিতেই কাজ করেন। তাই তার দিকে তাকিয়ে হেসে শুভেচ্ছা জানালাম। উনি সাঁতরে আমার কাছে এসে বললেন,
—যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলব।
—অবশ্যই। মনে করার কী আছে?
—আপনি যেভাবে সাঁতার কাটেন তা দেখে মনে হয় এই বুঝি ডুবে যাবেন।

আমি একটু হেসে ‘স্পাসিবা’ (ধন্যবাদ) বলে চলে গেলাম। সত্যি বলতে কী, এমন কথা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। মানসচক্ষে সামনে ভেসে উঠল উপরে দাঁড়ানো লোকজনের মুখ। অনেকদিনের পাজলের সমাধান হল। বুঝলাম কেন সবাই আমাকে দেখে হাসে। এর একটা বিহিত করা দরকার। যেন কিছুই হয়নি এভাবে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে চলে গেলাম আমাদের ট্রেইনার ভ্লাদিমির ফিওদরভিচ নিকিতিনের কাছে। বললাম,
—আমাকে সাঁতার শেখান।
—তুমি তো সাঁতার জানই।
—মনে হয়, খুব একটা ভাল জানি না।
—তাহলে যা জান সেটা ভুলে যেতে হবে আর নতুন করে সব শিখতে হবে।
—যা করতে বলেন তাই করব, তবুও আমাকে সাঁতার শেখান।

এরপর শুরু হল দম নিতে শেখা। মনিকা, আন্তন প্রথমে এসব করত, তাই কমবেশি জানাই ছিল। জলে নেমে প্রথম দশ-পনেরো মিনিট দম নেওয়া শিখতাম। তারপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন ধরনের সাঁতার। কোনও রকম তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই, আসল কথা সঠিকভাবে সাঁতার কাটার টেকনিক রপ্ত করা। এটা লেখা, হারমনিয়াম বা তবলা বাজানো শেখার মতই। আর সবচেয়ে বড়কথা, সাঁতারটাকে কাজ বা পরিশ্রম হিসেবে না নিয়ে অবসরযাপনের অঙ্গ হিসেবে দেখা।

সুইমিং পুলে যেতে শুরু করার পরে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। শহরে অনেকেই শুভেচ্ছা জানায়। আমি উল্টো উত্তর দিই আর স্মৃতির গভীরে ডুব দিয়ে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি একে কবে কোথায় দেখেছি। কিছুদিন পরে বুঝলাম এদের অধিকাংশের সঙ্গেই আমার পরিচয় সুইমিং পুলে। সেখানে লোকজন থাকে অল্প পোশাকে আর বাইরে যখন স্বাভাবিক জামাকাপড় পরে চলাফেরা করে তখন আমি এদের চিনতে পারি না। রুশ পাসপোর্ট থাকলেও আমার গয়ের রং জোর গলায় বলে দেয় আমার পরিচয়। তাই শহরে ওরা আমাকে চিনলেও আমি চিনতে পারি না।

সাঁতার কম-বেশি রপ্ত করে সামারে যেতে শুরু করলাম ভোলগায়। সাঁতার কাটতে। এখানে খুব বেশি সময় পাওয়া যায় না নদীতে সাঁতার কাটার। জুনের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের মাঝামাঝি, তাও যদি তাপমাত্রা ভাল থাকে। আমি সাধারণত তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রির উপরে থাকলে সেখানে যাই। বাকি সময় সুইমিং পুলে।

আমি সাধারণত ব্রাস বা ক্রল স্টাইলে সাঁতার কাটি, কখনও আবার স্রেফ চিৎ হয়ে ধীরে ধীরে সাঁতরাই। এরকমই এক দিনের কথা। আমি চিৎ হয়ে আপন মনে সাঁতার কাটছি, হঠাৎ মাথায় দুম করে এক আঘাত। তাকিয়ে দেখি এক পরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে হেড-টু-হেড কলিশন। উনি জলের নিচে মাথা ডুবিয়ে সাঁতার কাটছিলেন, আমাকে খেয়াল করেননি। খুব একটা যে ব্যথা পেয়েছি তা নয়, তবে ওনার মাথায় লেগেছে। আমি দুঃখপ্রকাশ করলাম। তারপরেও একটু রাগত স্বরেই উনি বললেন,
—লেনের ডান দিকে সাঁতার কাটতে হয় সেটা জান না?
—জানই তো আমি বাংলাদেশ থেকে। আমাদের দেশে সব কিছু চলাচল করে বাঁ দিকে।

আশপাশে বসা সবাই হো হো করে হেসে উঠল। উনি আর কথা না বলে পুল থেকে উঠে চলে গেলেন। আমিও একটু পরে গেলাম সাউনায় স্টিম বাথ করতে। বন্ধুরা আমার উত্তর নিয়ে আরও একপশলা হাসল।

চিত্র: লেখক

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ২

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৩

Advertisement

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৪

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৫

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৬

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৭

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৮

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ৯

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১০

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১১

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১২

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৩

রাশিয়ার চিরকুট পর্ব ১৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × 4 =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »