আত্মস্নান
মনখারাপ সারানোর ওষুধ তো জানা আছে তোর,
তবুও আবার বলি–
আগে ধরনটা নির্বাচন কর,
অবস্থান থেকে নেমে আয় নিচে,
ধরন অনুযায়ী হাঁটতে থাক পথ৷
রেললাইনের ধার দিয়ে, ঝুপড়ির পাশ দিয়ে,
রুগণদের খিদে ছুঁয়ে ছুঁয়ে, কষ্ট ছুঁয়ে ছুঁয়ে,
কান্না ছুঁয়ে ছুঁয়ে, হাঁটতে থাক
স্টেশনে বসে থাকা পঙ্গু, অন্ধ, বোবাদের
আত্মার কোলঘেঁষে৷
হাঁটতে থাক শ্মশানে দাহ হতে থাকা পরিজনদের
আত্মবেদনাকে ঘিরে৷
সমানুভূতির অনুতাপে পুড়ে যাবে মনখারাপের কারণ৷
পড়ে থাকবে গ্লানিধোয়া নিষ্পাপ আনন্দ,
একেই বলে আত্মস্নান৷
ভুলে যাওয়া ভাল, তবে ভালটা ভোলা ভাল না৷
কথা ছিল, নিজেই নিজের ত্রাতা৷
মনখারাপের দিনে গাছের বুকে মাথা রেখে
ছায়াপান করে বলেছিলি, ওঁ শান্তি।
আত্মনির্দেশ
হাসিটুকু ঢেকে রাখে তোর লাজুক মেঘ,
লজ্জাবশত শুকিয়ে যায় শ্রাবণের খেত৷
আলো একটা নাম, অন্ধকার একটা নাম,
তুইও একটা নাম, তোর
অনুচ্চারিত সত্ত্বার কোনও নাম নেই৷
কিছু নামহীন নৈঃশব্দ্য ভেসে আছে অলৌকিক বাতাসে,
কোনও কোনও ধ্যানস্থ মহাত্মা ওই অনন্তে জোনাকি৷
তুই তো সামান্য অনুভূতিমাত্র,
নিষ্পাপ ভালবাসা রেখেছিস নদীর চরে,
নরম ঘাসে, পথের ধারে ফুটে থাকা জংলি ফুলে,
মাড়িয়ে চলে লোকে, মরিস না, এটা অহংকার৷
অহংকার মহত্ব ও মহাত্মার ফোটা ফুল৷
তোকে আচ্ছন্ন করতে অনন্তের পাঠে শিখে নিচ্ছি–
একটি গাছের ভালবাসার নাম মায়া,
মেয়েটির উপেক্ষার নাম মায়া,
ঝড়ে ভেঙে পড়া সম্বলটুকুর নাম মায়া,
বুকে আগলে রাখা উপহারটির নাম মায়া,
পূর্ণ কলস ঢালতে ঢালতে দিগন্তে লীন হওয়ার নাম মায়া,
জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে প্রবাহমান পথটুকুর নাম মায়া৷
তোকে আচ্ছন্ন করতে যে ধারণা জন্মাবে তার নাম পুণ্য৷
একটু আগে যে কথাটা হারিয়ে গেছে
তাকে আর খোঁজার দরকার নেই,
সব হারানো নির্মল নিঃস্বতার নাম সত্য,
শুধু সত্যটাকে হারাস না কখনও৷
জ্যোৎস্না রাতের ঘুম
নগ্ন লক্ষ্মীর চারিপাশে
কালো মেঘ হওয়ার কথা ছিল তোর,
বলেছিলি, পোড়াকপালের খেতে বৃষ্টি হবি৷
অর্ধেক গল্প লিখে গুঁজে রাখলি রুগণ চালের বাতায়,
অর্ধেক কবিতা লিখে রেখে দিলি ভেজা বালিশের তলায়।
ভেবেছিলি মেঠো পথ, গাছপালা, নদী, পশুপাখি,
নৌকা, একখানা সাইকেল তোর সংসার৷
সুখকল্পে সূর্যে ছিল জাগা, চাঁদে ছিল ঘুম৷
এখন নাটকের মঞ্চ থেকে আলো এসে
বাঁকা শিস দেয় তোর শূন্য বারান্দায়, ব্যথা পাস৷
সারাদিন হাতড়ে বেড়াস! আর–
ইট, কাঠ, বালি, পাথর, লোহার কামড় খেয়ে
ফিরে আসিস আত্ম অন্ধকারে৷
বলেছিলি, সংগ্রাম হবে নিজের ভেতর খুঁড়ে
প্রাণপণ নিজেকে উপড়ে আনা৷
ওরে পাগল! তুই যে তোর না, সেটাই জানিস না৷
মনের সাথে আত্মার সম্পর্ক নষ্ট করেছে ঈপ্সিত সংশয়৷
কোনও মৃত্যুই যে মুক্তি নয়!
মুক্তির সন্ধানে আধ্যাত্মিক ধ্যানে
আত্মায় মিলিয়ে দিতে হয় অস্থির অহম্।
কালের খাতায় কে রয়েছে কেউ জানে না৷
বলেছিলি, একটা চিঠি লিখবি৷
প্রত্যাশা নয়, অভিযোগ নয়, দুঃখ নয়, আনন্দও নয়, শুধু এক জ্যোৎস্না রাতের ঘুম৷
এখনও লিখিসনি যখন, আর কিছুদিন ধৈর্য্য ধর৷
জীবনের ধারাপাত
আমি আমার সাথে গল্প করতে করতে হেঁটে চলেছি
আমাদের ছোট্ট পৃথিবীর কল্পিত নির্জন পথে৷
কোথাও আগুন জ্বলছে, কোথাও বৃষ্টি,
কোথাও বা বরফ পড়ছে, কোথাও ঝড়৷
পরিবেশ থেকে কিছু দূরে
হৃদয়ে বারুদ ঠুকে পুড়িয়ে দিচ্ছি
যত সব অবাঞ্ছিত অভিমান, দুঃখ, ক্ষোভ, ভয়,
নির্মল ভালবাসাটুকু রেখে দিচ্ছি অলিন্দ নিলয়ে৷
কী হে সপ্তর্ষিবাবু! ঠিক করছি তো?
নিজেকে কী ভাবছিস?
ওভাবে নাক সিটকোচ্ছিস কেন?
পথ চলতি দুর্গন্ধ টের পাচ্ছিস ?
পথচলতি মেয়েটাকে সদ্য ফোটা ফুল ভাবছিস?
এ তোর সুস্থ জীবনের ধারাপাত৷
একে ভালবাসা দিয়ে জড়িয়ে রাখ কলিজায়৷
একটি জীবন একটি পথ, তাড়াহুড়ো নয়,
প্রতিটা কণার স্পর্শ নিতে নিতে চল,
পথের অনুগত না হয়ে পথকে অনুগত করে চল৷
শূন্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে লাভ নেই রে পাগল,
নিজের আয়ু নিজে যত্ন করে রাখ৷
অমৃত সর্প
লেখারও বিষ আছে,
লেখককে সে দংশায়৷
ছটফট করতে থাকে লেখক,
ভুলে ভুলে ছিন্ন হতে থাকে স্বাভাবিক যাপন।
অন্তঃসত্ত্বা পশুর মত খুঁজতে থাকে গহ্বর,
নির্জন পৃথিবীর কোণ, গাছের আড়াল৷
ঝগড়াঝাটি, বকুনি, তিরস্কার শেষে,
প্রসব শেষে বিষ জন্মায় অমৃত হয়ে৷
অমৃত পান করে ঋদ্ধ হয় পাঠক,
একমাথা খোলা আকাশ হয়ে ভেসে যায় লেখক৷
এসো এসো, আরও আরও দংশন করো!
আহা! লেখা এক অমৃত সর্প, অমৃত সর্প৷
” লেখা এক অমৃত সর্প” অপূর্ব। এত সহজিয়া চলনের মধ্যে গভীর বোধ… চুপটি করে বসে ওম নিতে ইচ্ছে করছে।
শুভঙ্কর সাহা।