Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

প্রকৃতিপাঠ: এখন অশোক ফোটার দিন

অশোক মাঝারি আকৃতির চিরসবুজ বৃক্ষ। অশোক গাছের আদি নিবাস ভারতের দাক্ষিণাত্য মালভূমির কেন্দ্রীয় অঞ্চল। এছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের পশ্চিমঘাটের মধ্যবর্তী অংশে বেশি দেখা যায়। অশোক গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Saraca asoca, এটি Fabaceae গোত্রের Caesalpinioideae উপগোত্রের বৃক্ষ। অশোকের অন্যান্য নাম অঞ্জনপ্রিয়া, অপশোক, কঙ্গেলি, কর্ণপূরক, কেলিক, চিত্র, দোষহারী, নট, পল্লবদ্রুপ, প্রপল্লব, পিণ্ডিপুষ্প, বঞ্জুলদ্রুম, বিচিত্র, বিশোক, মধুপুষ্প, রক্তপল্লবক, রাগীতরু, শোকনাশ, সুভগ, স্মরাধিবাস, সীতা অশোক, হেমপুষ্প, হিমাপুষ্পা ইত্যাদি।

অশোক গাছ পঁচিশ থেকে তিরিশ মিটার উঁচু হয়। পাতা যৌগিক, একটি পাতায় দশটি পত্রক থাকে, পাতার রং গাঢ় সবুজ। লম্বা, চওড়া ও বর্শা ফলকাকৃতির। কচিপাতা নরম, ঝুলন্ত ও তামাটে। বসন্তকাল ফুল ফোটার সময়। আষাঢ়ের শুরু পর্যন্ত গাছে ফুল থাকে। ফুলগুলি ছোট, মঞ্জরীতে অনেক ফুল থাকে। পুংকেশর দীর্ঘ। অশোক বৃক্ষের ডালপালা ঘন পল্লবময়। কাণ্ডের গা থেকেও মঞ্জরীদণ্ড উৎপন্ন হতে পারে এবং তা থেকে ফুল ফোটে। ফুলের রং কমলা থেকে লাল। ফল শিম জাতীয়, মাংসল ও লাল। ফলে বেশ কিছু খয়েরি রঙের বীজ থাকে। অশোকের অনেক ভেষজ গুণও রয়েছে। শুকনো ফুল রক্ত আমাশয়ে এবং বীজ মূত্রনালির রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

ভারতীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং পুরাণে অশোক গাছের তাৎপর্য রয়েছে। রামায়ণের কাহিনি পড়া প্রায় প্রত্যেক ভারতীয় ‘অশোক বন’ বা ‘অশোক বটিকা’ সম্পর্কে জানেন, যেখানে রাক্ষসরাজ রাবণ সীতাকে বন্দি করে রেখেছিলেন। সীতাকে হরণের পর রাবণ অশোক কাননেই রেখেছিলেন। কারণ, সীতা রাবণের প্রাসাদে থাকতে অস্বীকার করেছিলেন এবং অশোক বনে থাকার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন। এখানেই একটি অশোক গাছের নীচে রামভক্ত হনুমান সীতার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সেই অশোক কাননটির অবস্থান নাকি বর্তমান শ্রীলঙ্কায় সিথা এলিয়া নামক অঞ্চলের হাকগালা বোটানিক্যাল গার্ডেনে।

গৌতম বুদ্ধের জীবনের সঙ্গে বিভিন্ন গাছের সম্পর্ক সর্বজনবিদিত। বুদ্ধদেবের জন্ম ৫৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। একটি অশোক বৃক্ষের ছায়াতেই গৌতম বুদ্ধের জন্ম। এটি নিশ্চিত করেছিলেন মহান চিনা পর্যটক হিউয়েন সাং, যিনি ভারতে এসেছিলেন (৬৩০-৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর বর্ণনাতেও গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান সম্পর্কে প্রচলিত তথ্যটির সমর্থন রয়েছে। সবমিলিয়ে অশোক গাছ হিন্দুদের পাশাপাশি বৌদ্ধদের কাছেও অত্যন্ত পবিত্র এবং বিভিন্ন বৌদ্ধবিহারে এই গাছের দেখা মেলে।

প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে, বিশেষত, ধর্মীয় এবং প্রণয়কাব্যে প্রায়শই অশোক গাছের উল্লেখ পাওয়া যায়। সংস্কৃত সাহিত্যে কমপক্ষে ১৬টি ভিন্ন নামে অশোক গাছ বা অশোক ফুলের উল্লেখ রয়েছে। বিখ্যাত সংস্কৃত নাট্যকার ও কবি কালিদাস তাঁর ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম’ নাটকে এই গাছটিকে অমর করে রেখেছেন, যেখানে অনূঢ়া নারীর পদস্পর্শে অশোক গাছে ফুল ফোটে। এছাড়াও, পুরাণ বর্ণিত কামদেবের পঞ্চশরের অন্যতম শর এই অশোক ফুলে সজ্জিত।

অশোক ফুল ফুটলে মিষ্টি গন্ধে চারপাশ ভরে যায়। শারদীয় দুর্গাপুজোয় অশোক গাছের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। অশোকের শাখা ছাড়া দুর্গাপূজার নবপত্রিকাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া যায় না। চৈত্র মাসের শুক্লা ষষ্ঠীতে মায়েরা পুত্রের মঙ্গলকামনা করে অশোক ফুল দিয়ে ‘অশোক ষষ্ঠী’ পূজা করেন। কাব্য-সাহিত্যে অশোক-বন্দনা রয়েছে বিস্তর। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক কবিতায় ফিরে ফিরে এসেছে অশোক। তার একটিতে যেন মহাকবি কালিদাসের বয়ানেরই প্রতিচ্ছবি: আসত তারা কুঞ্জবনে/ চৈত্র-জ্যোৎস্না-রাতে,/ অশোক-শাখা উঠত ফুটে/ প্রিয়ার পদাঘাতে।’

চিত্র : গুগল

প্রকৃতিপাঠ : বিলুপ্তপ্রায় কর্পূর গাছ

প্রকৃতিপাঠ: স্নিগ্ধ ছায়ার তমাল গাছ

প্রকৃতিপাঠ: দৃষ্টিনন্দন ও সুগন্ধী নাগলিঙ্গম

প্রকৃতিপাঠ: খইয়ে বাবলা ফলের গাছ

প্রকৃতিপাঠ: চিনেবাদাম চিনে নিন

প্রকৃতিপাঠ: রসময়ী খেজুর গাছ

প্রকৃতিপাঠ: তাহার নামটি রঞ্জনা

প্রকৃতিপাঠ: উপকারী সোনাপাতা

প্রকৃতিপাঠ: বসন্তের শ্বেত শিমুল

প্রকৃতিপাঠ: পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় বৃক্ষ ছাতিম

প্রকৃতিপাঠ: ফলসার বহুবিধ গুণ

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সোমেন চন্দ: এক বহ্নিময় কথাকার

মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন, যদিও তা অসমাপ্ত থাকে। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘বন্যা’। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি অসমাপ্ত-ই থেকে যায়। আরও দুঃখের বিষয়, এর বৃহদংশ হারিয়েও গেছে। আজ যে সোমেন চন্দের লেখককৃতির জন্য আমরা তাঁকে স্মরণ করি, তা হল তাঁর বেশ কিছু অসামান্য ছোটগল্প। সংখ্যায় খুব বেশি নয়, মাত্র চব্বিশটি। আরও কিছু গল্প লিখলেও তা কালের ধুলোয় হারিয়ে গেছে। গল্পের সংখ্যা সামান্য, তবে অসামান্যতা রয়েছে সেগুলির রচনার পারিপাট্যে, বিষয়বস্তু চয়নে, শিল্পিত প্রকাশে ও লেখনীর মুনশিয়ানায়। এছাড়া তিনি দুটি নাটিকাও লেখেন, ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রস্তাবনা’। লেখেন কিছু প্রবন্ধ। তাঁর ছোটগল্পগুলি এতটাই শিল্পোত্তীর্ণ ছিল যে, তাঁর জীবিতকালেই একাধিক ভাষায় তা অনূদিত হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »