Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

প্রকৃতিপাঠ: স্নিগ্ধ ছায়ার তমাল গাছ

‘তুমি আমার পূর্ব বাংলা/ একগুচ্ছ স্নিগ্ধ অন্ধকারের তমাল/ অনেক পাতার ঘনিষ্ঠতায় একটি প্রগাঢ় নিকুঞ্জ।’
ছোটবেলায় ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে আমার মামার বাড়িতে তমাল গাছ দেখেছি। মামাবাড়ি যে পাড়ায় সেই পাড়ার একটি বাড়িতে রাধাকৃষ্ণের রাসযাত্রা ও রাসপূজা হত। তাঁরা মামাবাড়ি থেকে তমাল গাছের ডাল কেটে নিয়ে যেতেন পূজার ঘর সাজানোর জন্যে।

তমাল গাছ মাঝারি আকারের বৃক্ষ। এটি বনগাব, মহেশকাণ্ড ইত্যাদি নামেও পরিচিত। এর ইংরেজি নাম Mottled Ebony। তমাল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Diospyros montana, এর সমনাম Diospyros cordifolia, এটি Ebenaceae পরিবারভুক্ত। এটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চিন, ক্রান্তীয় অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে জন্মে।

বৈষ্ণব কবিতা, লোকগীতিতে তমাল মর্যাদার সঙ্গে আসীন। তমাল গাছের বাকলের রং কালো আর কৃষ্ণের গায়ের রংও কালো, তাই তমাল শ্রীরাধারও প্রিয়। ‘না পুড়াইয়ো রাধার অঙ্গ/ না ভাসাইয়ো জলে,/ মরিলে বাঁধিয়া রেখো/ তমালেরই ডালে।’

তমালের কাণ্ড খাটো, ঘনকালো গিঁটযুক্ত। এর শাখা-প্রশাখা ছড়ানো এবং ছত্রাকৃতি। উদ্ভিদ চিরসবুজ, পত্র ঘন। এর পাতা একান্তর, ৩.৮-১৪ সেন্টিমিটার লম্বা, ডিম্বাকার বা উপবৃত্তাকার, পাতার গোড়ার দিকটা গোলাকার। তমালের পুরুষ ফুল ১ সেন্টিমিটার লম্বা, স্ত্রী ফুল ১.৩ সেন্টিমিটার লম্বা, একক। ফল গোলাকার, ২.৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা, পাকলে লালচে বাদামি রঙের তমাল ফল বিষাক্ত। কাঠ লালচে হলুদ, দৃঢ়।

ভারতের কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মূলের বাকল চুর্ণ তেঁতুলের সঙ্গে মিশ্রিত করে আমাশয়ের চিকিৎসায় ব্যবহার করে।

তমাল দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চিন, ক্রান্তীয় অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে জন্মে। ঢাকার রমনা পার্ক ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে কয়েকটি অপরিণত গাছ আছে। বাংলাদেশের  বেনাপোলের পাঠবাড়ি আশ্রম, ঠাকুরগাঁওয়ের গোবিন্দজিউ মন্দির, দিনাজপুরের রাজবাড়ি কালিয়া কান্তজিউ মন্দির প্রাঙ্গণে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে, ময়মনসিংহের কাচিঝুলিতে বনবিভাগের বিভাগীয় কার্যালয়ের উলটো দিকে এবং ব্রহ্মপুত্র তীরের জয়নুল আবেদীন পার্কের প্রধান ফটকের সামনে তমাল গাছ রয়েছে। তমালের ছবি ময়মনসিংহ শহরের ব্রহ্মপুত্র তীরের জয়নুল আবেদীন পার্কের প্রধান ফটকের সামনে থেকে গত ২৭ মার্চ ২০১৮ তারিখে তুলেছিলাম। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-৪ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। এটি একটি মহাবিপন্ন (Critically endangered) উদ্ভিদ।

তমালের কাঠ হালকা ধূসর বর্ণের, মাঝারি মানের শক্ত, মজবুত, টেকসই। ঘরের খুঁটি ও আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। তমালের প্রতিটি অংশ তেতো। এর বাকলে ট্রাইটারপিনস এবং মিথানল থাকে, যা যকৃৎ-এর সমস্যায় ও আমাশয় রোগে ব্যবহৃত হয়। তমালের ফল জলে সিদ্ধ করে লালচে কালো রং তৈরি করা যায়। এই রং সুতা কাপড়, সুতা এবং পাট রং করতে ব্যবহৃত হয়। ভারতের কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মূলের বাকল চুর্ণ তেঁতুলের সঙ্গে মিশ্রিত করে আমাশয়ের চিকিৎসায় ব্যবহার করে।

তমালের ফলের মণ্ড ও পাতার চূর্ণ মাছের জন্য বিষ। ভেষজ চিকিৎসায় এর নানাবিধ ব্যবহার আছে। জ্বর, ডায়ারিয়া, নিউমোনিয়া, প্রস্রাবে সমস্যা, নিউরালজিয়া, প্লুরিসি, মিনোরেজিয়া, প্রসব-পরবর্তী জ্বর, বিষাক্ত মাকড়সার কামড় ইত্যাদিতে তমাল গাছের নানান অংশ ব্যবহৃত হয়। এছাড়া এর ছালের নির্যাসে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টি-পাইরেটিক গুণ আছে। এর অ্যালকোহলিক নির্যাসে ইঁদুরের ক্যানসার নিরাময়ের ক্ষমতা আছে বলে পরীক্ষায় প্রমাণ পাওয়া গেছে।

চিত্র : গুগল/ লেখক

প্রকৃতিপাঠ : বিলুপ্তপ্রায় কর্পূর গাছ

প্রকৃতিপাঠ: দৃষ্টিনন্দন ও সুগন্ধী নাগলিঙ্গম

প্রকৃতিপাঠ: খইয়ে বাবলা ফলের গাছ

প্রকৃতিপাঠ: চিনেবাদাম চিনে নিন

প্রকৃতিপাঠ: রসময়ী খেজুর গাছ

প্রকৃতিপাঠ: তাহার নামটি রঞ্জনা

প্রকৃতিপাঠ: উপকারী সোনাপাতা

প্রকৃতিপাঠ: বসন্তের শ্বেত শিমুল

প্রকৃতিপাঠ: পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় বৃক্ষ ছাতিম

প্রকৃতিপাঠ: এখন অশোক ফোটার দিন

প্রকৃতিপাঠ: ফলসার বহুবিধ গুণ

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব

আমাদের খেলা করা দরকার, তাই আমাদের কয়েকজন ছেলে মিলে ক্লাব তৈরি করতে হবে। কোথায় করা যায়? — অমুক জায়গায় — ওই জায়গাটা পড়ে আছে, তা যাদের জায়গা তারা বললেন, “ওই তো ওখানে জঙ্গল হয়ে আছে, তা যদি তোমরা জঙ্গল-টঙ্গল পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে ক্লাব তৈরি করতে পার তো করো।” আমাদের আর পায় কে — আমরা মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলে। উদ্ধার করলাম। উদ্ধার-টুদ্ধার করে এর বাড়ি থকে চারটে বাঁশ, ওর বাড়ি থেকে তিনটে হোগলা এভাবে যোগাড়-যন্ত্র করে-টরে একটা চালাঘর তৈরি করা হলো। সেই চালাঘরকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে আমাদের নতুন লাইব্রেরী তৈরি হলো। ক্লাবের নাম হলো ‘সেনহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাব’।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো! সেই থেকেই ‘বাগনান’!

ছোট্ট ওই ভূখণ্ডটি বাঘের উপস্থিতির জন্যই তখন ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয় বলে প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরার অভিমত। এই বিষয়ে তিনি আরও জানান, আরবি ভাষা অনুযায়ী ‘নান’ কথার অর্থ হল ‘চরভূমি’। ‘নান’ শব্দের আরও একটি অর্থ হল ‘ছাউনি’। তখন কাছারিপাড়া ছাড়াও নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় ইংরেজ সেনাদের ছাউনি ছিল বলে জানা যায়। যার মধ্যে খাদিনান, পাতিনান, খাজুরনান, বাইনান, চিৎনান, মাছিনান ইত্যাদি জনপদগুলি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু নদীর চরে বাঘেশ্বরী দেবীর পুজো হত, সেই জন্য প্রাথমিকভাবে এলাকাটি ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ‘বাঘনান’ অপভ্রংশ হয়ে ‘বাগনান’-এ পরিণত হয়েছে।

Read More »
আবদুল্লাহ আল আমিন

কবিগান: সমাজবাস্তবতা, বিষয়বৈভব ও রূপবৈচিত্র্য

এমন লোকপ্রিয় বিষয় বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা ভাষা, সঙ্গীত ও সাহিত্যে কবিগান ও কবিয়ালদের অবদানের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগান সংগ্রহ এবং এ বিষয় পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে কবিয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কিংবা কবিগানকে সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক এ গানকে সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই গানের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে লোকায়ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক যার অধিকাংশই অনালোচিত ও অনালোকিত রয়েছে অদ্যাবধি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »
দীপক সাহা

বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়ে ইতিহাসকে লেন্সবন্দি করেছেন সাইদা খানম

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে উপমহাদেশের বিখ্যাত প্রায় সকল ব্যক্তিত্ব— ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী, বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আশাপূর্ণা দেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়— কার ছবি তোলেননি! সেই সঙ্গে রানি এলিজাবেথ, মাদার টেরেসা, মার্শাল টিটো, অড্রে হেপবার্নের মতো বিখ্যাত মানুষদের ছবিও তুলেছেন। এই বিশাল তালিকায় আরও তিনটি নাম যুক্ত করে না দিলে অন্যায় হবে। চন্দ্রবিজয়ী নিল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিনস, মাইকেল কলিন্সের ছবিও তুলেছেন তিনি।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

মামলায় জয়ী হয়ে থোড় কুঁচি দিয়ে কালীর আরাধনা করেন জমিদার-গিন্নি

দেবী কালিকার খড়ের মেড় দেখে মজুমদার গিন্নি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, মামলার রায় যদি তাঁদের পক্ষে যায় তাহলে কলাগাছের থোড় কুঁচো দিয়ে হলেও জগজ্জননী মা মহাকালীর পুজো করা হবে, আর যদি মামলার রায় তাঁদের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে ওই খড়ের মেড় দামোদরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। যদিও সেদিন দুপুরের মধ্যেই আদালত থেকে মজুমদার জমিদার পক্ষের জয়লাভের খবর পৌঁছেছিল থলিয়ার মজুমদার বাড়িতে। মজুমদার-গিন্নিও অক্ষরে অক্ষরে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। মামলায় জয়লাভের খবর পাওয়া মাত্রই জমিদার-গিন্নির নির্দেশে প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দীপাবলি উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে যায়।

Read More »