Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

প্রকৃতিপাঠ: পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় বৃক্ষ ছাতিম

‘ঊষার ছোঁওয়া জাগায় ওরে/ ছাতিমশাখে পাতার কোলে।’ ছাতিম গাছ নিয়ে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছাতিম গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Alstonia scholaris এবং এই উদ্ভিদটি Apocynaceae গোত্রের সদস্য। এই গণে প্রজাতির সংখ্যা পঞ্চাশ। ছাতিম ইংরেজিতে Blackboard tree, Devil’s tree নামে পরিচিত। ইংরেজি নামের কোনও যৌক্তিকতা অবশ্য পাওয়া যায়নি। চাকমাদের কাছে এটি পরিচিত ‘সেসনা’ নামে এবং গারোদের কাছে পরিচিত ‘বর-চাক-চান’ নামে। ছাতিম গাছের আদি নিবাস চিন। তবে ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার ও শ্রীলঙ্কাতেও পাওয়া যায়।

রবি ঠাকুরের গল্প-প্রবন্ধ-কবিতায় ছাতিমের কথা এসেছে ফিরে ফিরে। যেমন কবিতায় ঠাকুর লিখেছেন, ‘ওই যে ছাতিম গাছের মতোই আছি/ সহজ প্রাণের আবেগ নিয়ে মাটির কাছাকাছি,/ ওর যেমন এই পাতার কাঁপন, যেমন শ্যামলতা,/ তেমনি জাগে ছন্দে আমার আজকে দিনের সামান্য এই কথা।’ আবার ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ প্রবন্ধে লিখছেন, ‘উত্তরপশ্চিম প্রান্তে প্রাচীন দুটি ছাতিমের তলায় মার্বেল পাথরে বাঁধানো একটি নিরলংকৃত বেদী। তার সামনে গাছের আড়াল নেই, দিগন্ত পর্যন্ত অবারিত মাঠ, সে মাঠে তখনো চাষ পড়ে নি।’ গল্পগুচ্ছের ‘ঘাটের কথা’ গল্পে লিখছেন, ‘ছাতিম গাছের শাখায় বাদুড় ঝুলিতেছে। মন্দিরের চূড়ায় বসিয়া পেচক কাঁদিয়া উঠিতেছে। লোকালয়ের কাছে শৃগালের ঊর্ধ্বচীৎকারধ্বনি উঠিল ও থামিয়া গেল।’

সাধারণত ছাতিম গাছ সবার কাছেই পরিচিত। ছাতিমের ডালপালা ছড়ানোর বৈশিষ্ট্যটি কিন্তু অন্য গাছে নেই। এর সরল উন্নত কাণ্ড কিছুদূর উপরে উঠে হঠাৎ শাখা-প্রশাখার একটি ছাতার মত পল্লব সৃষ্টি করে, আবার এক লাফে অনেক দূরে উঠে আবার একটি পাতার আবরণের ধাপ তৈরি করে। এর পত্রবিন্যাস আবর্ত এবং এক আবর্তে ৫-৭টি পাতা থাকে। পাতাগুলি বল্লমাকার ও প্রতিটি পাতা ১০-১৫ সেমি লম্বা এবং ৪ সেমি চওড়া হয়। উঁচু লম্বা চিরসবুজ ছাতিম গাছ দুই বাংলার প্রায় সব জায়গাতেই দেখা যায়। আর ছাতিম ফুল সবুজাভ সাদা বর্ণের, তীব্র গন্ধযুক্ত ও গুচ্ছবদ্ধ। শরৎকাল থেকে হেমন্তকাল পর্যন্ত ফুল ফোটে। ছাতিম ফল প্রায় ৩০ সেমি লম্বা, কিছুটা বাঁকা, চ্যাপ্টা ও ঝুলে থাকে এবং ফল পাকলে ফেটে যায়। এর বীজ সাদা বর্ণের, দুদিক ঠিক পশমের মত।

ছাতিমের নাম সপ্তপর্ণী, সুপর্ণক, মদগন্ধ, সপ্তচ্ছদ ইত্যাদি। কবিগুরু আর তাঁর শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর সঙ্গে ছাতিমের সম্পর্ক বেশ নিবিড়। বিশ্বভারতীর সমাবর্তন সমারোহে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের হাতে ছাতিম পাতা তুলে দেওয়ার রীতি বহুকালের। ঐতিহ্যপূর্ণ সপ্তপর্ণী বিশ্বভারতীর আচার্যের কাছ থেকে পাওয়া অনেকের কাছেই স্বপ্নের। ছাতিম তলা এবং সেখানকার পুরনো ঘণ্টা বিশ্বভারতীর আইকনিক স্থানগুলির একটি। এই ছাতিমতলায় ব্রহ্মোপাসনার মধ্যে দিয়েই শুরু হয় শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যবাহী পৌষমেলা। এই ছাতিম গাছই পশ্চিমবঙ্গের state tree বা জাতীয় বৃক্ষ।

ছাতিম থেকে যে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ তৈরি হয় তার নাম ‘এলস্টনিয়া স্কলারিস’। উদরাময়, আমাশয়, রক্তশূন্যতা রোগে এ ওষুধ ব্যবহৃত হয়। ছাতিমের অনেক ভেষজগুণ রয়েছে। ছাতিম ছাল সেদ্ধ জল মুখের অরুচি ও জ্বর জ্বর ভাব দূর করে। ভালভাবে ছাল সেদ্ধ করে জল হালকা গরম দুধে মিশিয়ে খেলে প্রস্রাবের দোষ থাকে না। ছাতিম গাছের বাকলের নির্যাস উচ্চ রক্তচাপ ও ক্যানসারের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ছাতিমের ছাল ভাল করে সিদ্ধ করে সেই জল দুধ সহ খেলে মায়েদের বুকের দুধ বেড়ে যায়। ছাতিম ফুলচূর্ণ ও পিপুল চূর্ণ দইয়ের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট দূর হয়। ছাতিমের আঠা পাইরিয়া ও ব্রণের মহৌষধ। রাখাইন-রা ছাতিম পাতার আঠা ঠোঁটের ঘা নিরাময়ে ব্যবহার করে। মুরং-রা পোকা কামড়ালে ছাতিম গাছের বাকল পিষে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেয়।

ছাতিম গাছে দুধের মত ল্যাটেক্স আছে। গাছগুলি প্রায় ১৫-২০ মিটার উঁচু হয়। এর বাকল ঘন ধূসর বর্ণের এবং কিছুটা খসখসে। ছাতিমের কাঠ সাদা বর্ণের ও নরম। তবে কাঠ টেকসই নয়। কাজেই ছাতিমের কাঠ চায়ের বাক্স, দেশলাইয়ের কাঠি, পেন্সিল ও কফিন এবং স্লেট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন দেশে ছাতিম গাছের বিভিন্ন অংশ থেকে বেশকয়েকটি অ্যালকালয়েড পৃথক ও সনাক্তকরণ করা হয়েছে, এগুলো হল এসিটামাইন, পিক্রিনিন, স্কলারিন, পিক্রালিনাল, একুয়াস্মিডিন ইত্যাদি। অ্যালকালয়েড ছাড়াও ছাতিম ফুলে আছে এন-হেক্সাকোসেন, লুপিয়ল, বেটা-এমিরিন, উরসেলিক অ্যাসিড এবং পামিটিক অ্যাসিড।

চিত্র : গুগল

প্রকৃতিপাঠ : বিলুপ্তপ্রায় কর্পূর গাছ

প্রকৃতিপাঠ: স্নিগ্ধ ছায়ার তমাল গাছ

প্রকৃতিপাঠ: দৃষ্টিনন্দন ও সুগন্ধী নাগলিঙ্গম

Advertisement

প্রকৃতিপাঠ: খইয়ে বাবলা ফলের গাছ

প্রকৃতিপাঠ: চিনেবাদাম চিনে নিন

প্রকৃতিপাঠ: রসময়ী খেজুর গাছ

প্রকৃতিপাঠ: তাহার নামটি রঞ্জনা

প্রকৃতিপাঠ: উপকারী সোনাপাতা

প্রকৃতিপাঠ: বসন্তের শ্বেত শিমুল

প্রকৃতিপাঠ: এখন অশোক ফোটার দিন

প্রকৃতিপাঠ: ফলসার বহুবিধ গুণ

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনানন্দ দাশের সময়চেতনা: পুরাণ, প্রকৃতি ও আধুনিক নিঃসঙ্গতার নন্দনতত্ত্ব

পৌরাণিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিগত সময়চেতনা তাঁকে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে এক স্থায়ী ও ব্যতিক্রমী মহাকবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শিল্পকর্ম আমাদের শেখায়— দ্রুত ধাবমান জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে চলতে, নীরবতার গভীরে কান পাততে এবং প্রতিটি ক্ষণিকের মাঝে অনন্তের ইশারাকে খুঁজে পেতে। তাঁর সাহিত্য ভবিষ্যতের প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের জন্য আধুনিকতার এক অমূল্য পাঠ হয়ে থাকবে, যা মানুষের জীবনকে শিল্প ও প্রকৃতির একাত্মতায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং প্রমাণ করে দেয়— কাব্যই চূড়ান্ত আশ্রয়, যখন সমস্ত পথ ফুরিয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গা মাঈ কী! জয়!

ঢাকা বা সমগ্র বাংলাদেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুজোর চাঁদা আদায়ের চল খুব একটা নেই। মণ্ডপে এসেই পাড়ার লোক চাঁদা দেন। জবরদস্তি করে চাঁদা আদায়ের যে বীভৎসতা কলকাতা তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে আছে, তা অন্তত ঢাকা আর বরিশালে দেখিনি। পুজোর দিনেও অনেকে এসে প্যান্ডেলের পাশে চাঁদা আদায়কারীদের টেবিলের সামনে এসে চাঁদা দিয়ে যান। পাড়ার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। স্বেচ্ছায় এসে চাঁদা দিয়ে যান। এটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও প্রসঙ্গত

সমসময় তাঁকে চেনেনি। বরং সর্বপ্রযত্নে বানচাল করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে তাঁর প্রগতিশীল কাজকর্মকে। এই সময় ও বাঙালি সমাজ-ও কি চিনেছে তাঁকে? তাঁকে তাই শেষ জীবন কাটাতে হল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী থেকে দূরে সাঁওতাল পরগনায়। শেষ বয়সে উপলব্ধি করেছিলেন তিনি, যাদের জন্য তাঁর এই কাজ, সব অপাত্রে দান!

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: দেড়শো বছরের সূচনায়

তাঁকে অনুবাদ করা হয় ভারতীয় নানা ভাষায় নানা সময়ে। তবুও কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ মূল্যায়িত হননি আজ-ও। বেশ কিছু অনুবাদ ছিল তাঁর, প্রথমজীবনে কলকাতা বাসকালে, হিন্দি থেকে ইংরেজিতে, যা হারিয়ে গেছে চিরতরে। বারো বছর রেঙ্গুন-পেরু পর্বে আগুন লেগে পুড়েছে তাঁর আঁকা ছবি, ‘চরিত্রহীন’-এর পাণ্ডুলিপি, পরে আবার যা লেখেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

শতবর্ষে মহানায়ক উত্তমকুমার

‘মহা’ শব্দটি মহান আর বিশাল, এই দুই অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ‘মহাকাব্য’ বা ‘মহারাজ’। কাব্য আর রাজার চেয়ে তার মাত্রা ভিন্ন, মহিমা অনেক বেশি তাৎপর্যময়। উত্তম বাংলা চলচ্চিত্রের সেই তাৎপর্যময়তার একমাত্র উদাহরণ। যাঁকে শ্রদ্ধাভরে আমরা ‘কিংবদন্তি’-ও বলে থাকি। তাই সত্যজিৎ রায়ের মতো আরেক কিংবদন্তি তাঁকে নিয়ে চিত্রনাট্য লেখেন, ছবি বানান, আর সে ছবির ‘নায়ক’ হন উত্তমকুমার।

Read More »