Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

গৌড়-পাণ্ডুয়া: সাবেক বাংলার জোড়া রাজধানীতে

‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি…’। কবির মত করে এই বাংলাকে কতজনই বা আর দেখেছেন। নিজের কথা বলতে পারি। বাংলার ইতিহাসের তাপ-উত্তাপ ও তার সাহচর্য যে খুব একটা পাইনি, এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত। রাজধানীর রাজপথে দিনের পর দিন ইতিহাসের গল্পকথাদের খুঁজে ফিরেছি, অথচ নিজের রাজ্যকে দীর্ঘকাল সে অর্থে নতুন করে দেখার চেষ্টা করা হয়ে ওঠেনি। এ হয়তো আমার চিরকালীন ভারতীয় ‘ডিএনএ’-রই প্রভাব।

বলা হয়, ভারতীয়রা কোনওদিন নিজের ইতিহাস লেখেননি। আর তাই খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ থেকে খ্রিস্ট-পরবর্তীকালের ইতিহাস আমরা মূলত জেনেছি পর্যটকদের মাধ্যমে। কিন্তু সে বিস্তৃত আলোচনার জন্য এই কথামালা নয়। আজকের গল্প নেহাতই বাংলার পোড়ামাটির। কিংবা আরও ভাল করে বলতে গেলে গৌড়বঙ্গের গল্পকথা।

জীবনের একটা বড় অংশ বাংলায় থেকেও আমার ‘গৌড়’-দর্শন হয়নি। এত বছর প্রবাসে আছি। তবু তার মধ্যেই সাম্প্রতিক কলকাতা ভ্রমণে আচমকাই দিনকয়েকের ছুটি মেলায় ‘উঠল বাই তো কটক যাই’-এর মত আমার গৌড়-দর্শন অবশেষে সম্ভব হল। সেই অর্থে করোনা-পরবর্তী সময়ে সম্ভবত আমার এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে দূরের সফরও।

করোনাকালে সমস্ত ট্রেনের নামধাম বদলে একাকার। তাই টিকিট বুক করতে গিয়ে প্রথমেই থমকে যাওয়া। কারণ ট্রেনের নাম গেছে সব বদলে; যদিও বুক করার সময়ে বোঝা গেল যে সেই আদি ‘গৌড় এক্সপ্রেসের’ টিকিটই কাটা গেছে। তাই রাত্রিবেলা খাওয়াদাওয়া সেরে টু-টায়ারের সিটে গা এলিয়ে (করোনার কারণেই একটু বিলাসযাত্রা কারণ টু টায়ারে লোক একটু হলেও কম) দিলাম।

আদপে কয়েক ঘণ্টার যাত্রাপথ হলেও রাতের ট্রেন, তাই যাত্রা হল এক রাতের। এমনিতে আমার ট্রেনে কোনও কালে ঘুম আসে না। তায় যদি গৌড়ের মত কোনও ঐতিহাসিক জায়গা যাওয়ার ব্যাপার থাকে, তবে চিন্তায় ও আনন্দে ঘুমের বারোটা বেজে যায়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মালদা টাউন নামার আগে ভোররাতে ট্রেনকে পেরিয়ে যেতে হয় বিখ্যাত ‘ফরাক্কা’ ব্রিজ। যদিও রাতের আঁধারে ফরাক্কার রূপ সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না।

তবে এর আগেও দিনের বেলা একাধিকবার ফরাক্কা ক্রস করার কারণে এটুকু বলতে পারি যে, নদীর বিশালতা না পরিমাপ করা সম্ভব, না তাকে বেঁধে ফেলা সম্ভব। এই বিরাট বিপুলা পরিপূর্ণ প্রকৃতির কাছে মানুষ একদিকে যেমন অসহায় আর একদিকে শুধু তার অপরূপ রূপ দেখাই সম্ভব হতে পারে। আমি যখন স্রেফ ফরাক্কাকে আর একটু কাছ থেকে দেখব বলে বাঙ্ক থেকে নীচে নেমে এলাম ঠিক তখন আমার সহযাত্রী বললেন, আগেকার দিন হলে এই সময়ে ঠিক কেউ না কেউ গেয়ে উঠতেন, ‘দেবী ভগবতী সুরেশ্বরী গঙ্গে…।’

গুমটি দরওয়াজা। (আনুমানিক ১৫১২ খ্রিস্টাব্দ) ‘সুলতান হুসেন শাহ কর্তৃক নির্মিত এনামেল টালির দ্বারা অলঙ্কৃত এক গম্বুজ বিশিষ্ট এই তোরণটি গৌড় দুর্গের পূর্বদিকে প্রবেশ পথ ছিল।’

ভোরবেলা মালদা টাউন স্টেশনে নেমে, সকালের উত্তরবঙ্গের ব্যবসা-কেন্দ্রিক শহরের নির্জনতা উপভোগ করতে করতে হেঁটেই পৌঁছে গেলাম নির্দিষ্ট হোটেলে। সকালের খাওয়া-দাওয়া সেরে পরের দিনের গৌড় যাওয়ার ব্যবস্থা করা গেল হোটেলের মাধ্যমেই। তবে ওই যে কথায় বলে ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’ আমারও সেই দশা। আমার বর্তমান প্রফেশনে ওয়ার্ক ফ্রম হোমের সুবিধার জন্য সে কাজ মিটিয়ে, সেদিন দিনের বেলা ওল্ড মালদা টাউন রওনা হলাম।

মালদা শহরটা ব্যবসার জন্য যতটা বিখ্যাত আকারে সেই অর্থে বড় কিছু না। তাই মালদার বিখ্যাত রথবাড়ি স্টপেজ থেকে শেয়ারিং অটো নিয়ে যাওয়া হল ওল্ড মালদা টাউন মসজিদ দেখতে। যদিও প্রথমে গিয়েই ধাক্কা, কারণ মসজিদ বন্ধ। যদিও প্রাচীন এই মসজিদটি বর্তমানেও সচল, এবং কী আশ্চর্য, সেদিন শুক্রবার থাকায় সেদিনই সবাই আসবেন মসজিদে। আমাদের মসজিদের কাছে ঘুরে ছবি তুলতে দেখে এক স্থানীয় বলে ওঠেন, ‘আপনারা দাঁড়ান, আমি মসজিদ খোলার ব্যবস্থা করছি…।’ গলায় ক্যামেরা ঝোলানো একবিংশ শতকের এই মানুষগুলোর প্রতি সেদিন তিনি সদয় না হলে বাংলার ইতিহাসের কম প্রচারের সুন্দর কারুকার্যের সেই মসজিদ অদেখা থেকে যেত।

এই মসজিদের আসল নাম ‘হিন্দ-এ কাবা’।

সেই মসজিদেই দেখা হল সেখ রহমানের সঙ্গে। তিনিই জানালেন এই মসজিদের আসল নাম ‘হিন্দ-এ কাবা’। যদিও বর্তমানে মসজিদটি জামা মসজিদ নামে পরিচিত আর লোকমুখে খ্যাত ওল্ড মালদা মসজিদ বলে। তাঁর কাছ থেকেই আরও জানা গেল যে, কথিত আছে এই মসজিদ আরবের মাসুম সওদাগরের নির্মিত, ব্যবসা করতে এসেই পিতৃ আদেশে তিনি এই মসজিদ নির্মাণ করেন। রহমান সাহেব আমাদের মসজিদের ভেতরে প্রার্থনাস্থলে শুধু যেতে দিলেন তাই নয়, দিলেন ছবি তোলার অনুমতিও। যখন আমাদের দেশে মানুষের চেয়ে তার ধর্মীয় পরিচয়কে বড় করে দেখানোর চেষ্টা চলছে, তখন গ্রামবাংলার এই অতীব সাধারণ মানুষরা যেন আমায় সেই চিরকালীন ভারতবর্ষের সঙ্গে আবার পরিচয় করিয়ে দিলেন।

যদিও আমার সফরের মূল উদ্দেশ্য চোদ্দো ও পনেরো শতকের বাংলার রাজধানী গৌড়, কিন্তু তার চেয়ে তুলনায় বেশ অনেকখানি নবীন এই ‘হিন্দ-এ কাবা’ তার সৌম্য স্বভাবে আমার মনে চিরকালের মত নিজের এক জায়গা বানিয়ে নিল।

একলাখি সমাধিসৌধের ঠিক পাশেই কুতুবশাহি মসজিদ বা ‘সোনা মসজিদ’।

পরের দিন সকালে চললাম গৌড়-দর্শনে। হাইওয়ে দিয়ে যখন গাড়ি ছুটে চলেছে এক সময়ের বাংলার রাজধানীর দিকে, ঠিক তখনই জানতে পারি গৌড়ের আগে আমরা নামব ‘রামকেলি’ গ্রামে। এই রামকেলি গ্রামের মূল খ্যাতি রূপ সনাতন ও শ্রীচৈতন্যের জন্য। রামকেলি গ্রামে নামার আগে একটা কথা বলে রাখা ভাল, গৌড় জায়গাটা ভারত থেকে বাংলাদেশ যাওয়ার পথে। দেশভাগ যেমন আমাদের অনেক কিছুই ভাগাভাগি করে দিয়েছে, তা থেকে রেহাই পায়নি প্রাচীন বাংলার রাজধানীও।

রামকেলি গ্রামে।

মালদা টাউন থেকে ১৪ কিমি দূরে অবস্থিত রামকেলি গ্রাম বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষ অধ্যুষিত। এখানে যে মন্দিরটি আছে সেই মন্দিরের সামনেই চৈতন্যদেব রূপ সনাতনকে দীক্ষা দেন বলে কথিত। সেই সময়ের বাংলা প্রদেশে এই অংশ যে বেশ নির্জন ছিল তা আজও দেখলে বোঝা যায়। দীক্ষাস্থলের একটি গাছের তলাতে একটি লেখা নজরে এল, ‘এই গাছের তলায়ই চৈতন্য রূপ সনাতনকে নিজের শিষ্যত্ব দেন’। তবে গাছটির বয়স অনুমান করে বেশ বোঝা যায় যে, তা বাস্তবের সঙ্গে মেলে না। তবে এটুকু অনুমেয়, এই জায়গাতেই কোনও গাছের তলায় সেই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটেছিল।

এখানে চৈতন্যদেব রূপ সনাতনকে দীক্ষা দেন বলে কথিত ।

সেই গাছের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলে রাধাকৃষ্ণ মন্দিরটি দেখা যায়, যেখানে মহাপ্রভুর সঙ্গে নিতাই ও অদ্বৈত পূজিত হন। আমার গৌড়-দর্শনের আগে এ যেন মূল লক্ষ্যের দিকে ঠিক ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া। এখান থেকে বেরোবার সময়ে দেখলাম, এখন এই অঞ্চলের বাড়িগুলি সব সরকারি অনুমোদনের টাকায় বানানো হচ্ছে। যদিও আমার গাইড ও দলের লোকদের কাছে জানলাম যে, আগে এই অঞ্চলে এই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যযুক্ত গ্রামীণ বাংলার বাড়ি দেখা যেত। বর্তমান আধুনিকতা সেই পুরাতন সাযুজ্যকে কোথাও যেন একটু ধাক্কা দিয়ে যায়।

‘বড় সোনা’ বা ‘বারো দরওয়াজা’ মসজিদ।

গৌড়বঙ্গ নাম শুনলেই যদিও ইতিহাসের পাতায় পড়া ‘গৌড়েশ্বর’ শশাঙ্কর কথা মনে পড়ে। বাস্তবে তাঁর রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ; আর তাঁর গৌড় বলতে পূর্ব ভারতের এক বিরাট অংশ। তবে আমাদের রাজধানী গৌড় আরও বেশ কিছুটা পরের সময়ের, রাজধানী গৌড় হুসেন শাহর সাম্রাজ্যের বাংলা মুলুকের রাজধানী। তবে শুধু হুসেন শাহ না, তারও আগে সেন সাম্রাজ্যের সময়েও বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়, যদিও সেই সময়ের কোনও স্থাপত্যচিহ্ন সম্ভবত বর্তমানে নেই।

গৌড়ের স্থাপত্যগুলির কথা বলার আগে একবার অতি অবশ্যই বলতে হবে এক সাহেব হেনরি ক্রেইটনের কথা, নীলকুঠির কর্মী হওয়া সত্ত্বেও কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি গৌড়ে গিয়ে সেখানকার ভগ্নাবশেষ দেখে ছবি আঁকেন ও কিছু বর্ণনামূলক লেখা লেখেন। তাঁর মৃত্যুর পরে সেই ছবি ও লেখা বই হিসাবে আসে আর আমাদের কাছে থেকে যায় গৌড়ের এক অমূল্য দলিল, ‘দি রুইনস অব গৌড়’।

‘বড় সোনা’ বা ‘বারো দরওয়াজা’ মসজিদ।

প্রাচীন গৌড়ের স্থাপত্যগুলির কথা বলার আগে একবার গৌড় ও পাণ্ডুয়ার বিষয়ে ছোট করে বলে নেওয়া ভাল। ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি নবদ্বীপ থেকে সেন অধিপতি লক্ষণ সেন-কে বিতাড়িত করেন সেন রাজধানী লক্ষণাবতীতে, আর জায়গার নাম দেন লখনৌতি। যা মধ্যযুগে বাংলার মুসলিম শাসকদের রাজধানী ছিল, সেই আজকের গৌড়। যদিও এক সময়ে গৌড়কে বসবাসের অযোগ্য গণ্য করে তুঘলক বংশের সুলতান আলাউদ্দিন আলি শাহ চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি গৌড়ের অনতিদূরের পাণ্ডুয়াতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। প্রায় একশো বছর পাণ্ডুয়া ছিল বাংলার রাজধানী। পরবর্তীকালে ইলিয়াস শাহী বংশের নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি ফের বর্তমান গৌড় নগরীতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন, এবং আরও একশো বছর গৌড় ছিল বাংলার রাজধানী। পরবর্তীকালে বসবাসের অযোগ্য গৌড় থেকে মুঘল আমলে বাংলার রাজধানী স্থানান্তরিত হয় রাজমহলে।

বারংবার রাজধানী বদল, শাসক বদল হলেও সেই সব শাসকদের তৈরি অসাধারণ সব স্থাপত্য ছিল এই গৌড়ে। যদিও সেই সব স্থাপত্যের বেশিরভাগই আজকে শুধুই ইতিহাসের পাতায় বা হেনরি সাহেবের বইতে তাঁর আঁকা ছবির মধ্যে টিকে রয়েছে। কারণ বেশিরভাগ স্থাপত্যকে রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। তবু যেটুকু অস্তিত্ব আছে সেইগুলো নিয়েই বেঁচে আছে বাংলার ইতিহাসের স্থাপত্যকল্পের হাজার গল্পেরা।

লোটন মসজিদ।

ইতিহাসের কচকচানি থেকে বেরিয়ে এবার একটু মন খুলে দেখা যাক সেই সব স্থাপত্যদের। তা রামকেলি গ্রাম থেকে বেরিয়ে যে পথ দিয়ে আমাদের গৌড় ভ্রমণ আরম্ভ হল তার প্রথমেই পড়ে গৌড়ের বিখ্যাত স্থাপত্য ‘বড় সোনা’ বা ‘বারো দরওয়াজা’ মসজিদ। নাম থেকে তার আকারের ইঙ্গিত পাওয়া যায় বটে আর আপনার ক্যামেরা যদি যথার্থভাবে ওয়াইড অ্যাঙ্গেলের ছবি ক্যাপচার করতে না পারে আর আপনি হেনরি ক্রেইটনের মত ছবি আঁকতে না পারেন তবে মনের আয়নায় তার ছবি ধরা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। বিশাল এই মসজিদ চত্বরে দেখা যায় আর্কিটেকচারের সুন্দর নমুনা।

গৌড়ের স্থাপত্যগুলির কথা বলতে গেলে দাখিল দরওয়াজা, লোটন মসজিদ, লুকোচুরি দরওয়াজা, কদম রসুল মসজিদ প্রভৃতির কথা যেমন বলতেই হয়, ঠিক তেমনি বলতে হয় ফিরোজ মিনারের কথাও। সঙ্গে অতি অবশ্যই বলতে হবে গুনমন্ত-র কথা। গৌড়ের বাকি সৌধগুলিতে যত মানুষ যান গুনমন্ত মসজিদে সেই তুলনায় জনসমাগম কিঞ্চিৎ কম। ভারতে গৌড়ের শেষ সীমানার কাছে অবস্থিত লোটন মসজিদের থেকে ডানদিকের এক রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা এগোলে দেখা মেলে ‘গুনমন্ত’-র। কথিত আছে, এক সময়ে এই গুনমন্তের কাছ দিয়েই বয়ে যেত গঙ্গা ও মহানন্দা দুই নদী। পরবর্তীকালে দুই নদীই প্রকৃতির নিয়মে ধীরে ধীরে নিজেদের প্রবাহখাত পরিবর্তন করেছে। গৌড় ধীরে ধীরে বসবাসের অযোগ্য হতে হতে শুধু প্রাচীন এক রাজধানীর নিদর্শন হিসাবে বেঁচে থেকেছে।

গুনমন্ত মসজিদ।

আর এর সঙ্গে বলতে হয় রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের কথা। এটি অবশ্য ‘জাহাজ ঘাটা’ ও ‘চিকা মসজিদের’ কাছেই অবস্থিত। আমবাগানের মাঝখানে ভগ্ন বাড়ির ভিত দেখা যায়। যদিও এটি রাজপ্রাসাদ ছিল, না রাজপ্রাসাদের হামামখানা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। আমি অবশ্য একে মনে মনে রাজপ্রাসাদ হিসাবেই মেনে নিয়েছি।

রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ।

গৌড় থেকে বেড়িয়ে যখন পাণ্ডুয়ার দিকে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে তখন জানতে পারলাম যে হেনরি সাহেবের কুঠিও এই পথেই পড়ে। বড় দল না হলে সেখানে না যাওয়াই ভাল। একে তো গাড়ি বড় রাস্তায় দাঁড় করিয়ে অনেকটা হেঁটে যেতে হবে। আর তার চেয়েও বড় কথা ওই দিকে লোকজন নাকি সুবিধার না, জিনিসপত্র বেমালুম উবে যেতে পারে। ভাবলাম হয়তো হেনরি সাহেব না হলেও বাকি নীলকর সাহেবদের ভারতীয় উত্তরসূরিরাই আছে এই অঞ্চলে আর তাই তাদের মধ্যে হয়তো লুঠতরাজের ‘জিন’ থেকে গিয়েছে। যদিও এ ভাবা ক্ষণিকের মজার ছলে ভাবা, সম্ভবত ওই অঞ্চলের সেই অর্থে বিকাশ না হওয়াই এখনকার মানুষের এই প্রবৃত্তির কারণ।

নীলকুঠি দেখতে না পেলেও হেনরি সাহেবের প্রতি আমার আজীবন অকুন্ঠ কৃতজ্ঞতা থাকবে। তিনি না থাকলে হয়তো আমরা বর্তমান গৌড়কেও খুঁজে পেতাম না।

একলাখি সমাধিসৌধে।

এবার পালা পাণ্ডুয়ার। বাংলার রাজধানীর ইতিহাস বলতে গেলে পাণ্ডুয়াকে বাদ দেওয়া যায় না। যদিও এই পাণ্ডুয়া গৃহনির্মাণের বালির জন্য বিশেষ পরিচিত হুগলির পাণ্ডুয়া না। এই পাণ্ডুয়া মালদাতেই। তবে গৌড় যেমন বাংলাদেশের দিকে, পাণ্ডুয়ার অবস্থান টু ওয়ার্ডস কলকাতা। আগেই বলেছি যে গৌড় থেকে প্রথমবার রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে আসে এই পাণ্ডুয়াতে। পাণ্ডুয়ার ভাগ্যে বাংলার রাজধানী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই একবারই। আর সেই একবারের মধ্যেই সে রাজধানী তালিকায় নিজের নাম চিরকালীন করে রাখতে ভোলেনি।

পাণ্ডুয়ার স্থাপত্যগুলির মধ্যে অবশ্য উল্লেখযোগ্য একলাখি সমাধি ও আদিনা মসজিদ। সঙ্গে এও বলে রাখা ভাল যে, স্থানীয়রা
পাণ্ডুয়াকে আদিনা নামেই ডাকেন।

আদিনা মসজিদ।

একলাখির নাম থেকেই তার নামের কারণ খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। এই সমাধিসৌধ তৈরি করতে তৎকালীন সময়ে প্রায় লাখখানেক টাকা খরচ হয় আর তাই সমাধির নাম ‘একলাখি’। এটি জালালুদ্দিনের সমাধি। আনুমানিক ১৪১২ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ হয়। জালালুদ্দিন আসলে মুসলমান হওয়ার আগে ছিলেন হিন্দু রাজপুত্র। সমাধি চত্বরে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণের বোর্ডেও রয়েছে তার উল্লেখ। গোটা লেখাটি এখানে তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।

‘‘একলাখী সমাধিসৌধ (আনুমানিক ১৪১২-১৫ খ্রীষ্টাব্দ)। বৃহৎ ও উচ্চ গম্বুজ বিশিষ্ট এই বিশাল সমাধিসৌধটি সম্ভবতঃ রাজা গণেশ (কংস) তার ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত পুত্র যদুর জন্য নির্মাণ করিয়াছিলেন। ধর্মান্তরিত হইবার পর যদু জালালুদ্দিন নাম গ্রহণ করিয়া বাংলার সুলতান হইয়াছিলেন (১৪১৫-৩১ খ্রীঃ)। ইহার নির্মাণকার্যে এক লক্ষ টাকা ব্যয় হওয়ায় ইহা একলাকী নামে অভিহিত হয়। এই সমাধিসৌধে পূর্বতন স্থাপত্য নিদর্শন হইতে সংগৃহীত প্রস্তরাদি ব্যবহৃত হইয়াছে এবং বহির্গাত্র কারুকার্য খচিত ইটের সুচারু বিন্যাসে অলঙ্কৃত। ইহার অভ্যন্তরে জালালুদ্দিন, তদীয় পত্নী ও পুত্রের মৃতদেহ সমাধিস্থ আছে। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ।’’

আদিনা মসজিদ।

একলাখি সমাধির ঠিক পাশেই আছে কুতুবশাহি মসজিদ বা ‘সোনা মসজিদ’। এটি ১৫৮২ সালের নির্মাণ। এরপরে আদিনা। ১৩৬৪ থেকে ১৩৭৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এই সুবিশাল মসজিদ তৈরি হয়। এর বিশাল ব্যাপ্তি আজও বিস্ময় জাগরণের জন্য যথেষ্ট। মসজিদের ছাদ সম্পূর্ণভাবে ভেঙে গেলেও এর খিলানগুলি আজও আছে। কিছু অংশে এখনও অল্পবিস্তর ছাদ দেখা যায়।

কুতুবশাহি মসজিদ বা ‘সোনা মসজিদ’।

আমার গৌড়-পাণ্ডুয়া সফরে একমাত্র এখানেই সর্বাধিক জনসমাগম দেখেছি। একই দিনে গৌড় আর পাণ্ডুয়া ভ্রমণ কিছুটা কষ্টসাধ্য। তবু, হাতে সময় কম থাকায় খুব ভোরে বেরিয়ে সেই কষ্টটুকু করা যে ব্যর্থ হয়নি একথা বলতেই হয়।

চিত্র: লেখক
5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Tamal bose
Tamal bose
2 years ago

ইতিহাসকে এভাবে লেখা ও ছবির মাধ্যমে সামনে নিয়ে আসার জন্য অজস্র ধন্যবাদ।

Subrata Sanyal
Subrata Sanyal
2 years ago

চিত্তাকর্ষক তথ্যাবলী, অতিশয় সুখপাঠ্য লেখা।

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »