Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

‘সর্বশক্তিমান’ আর ‘পরম সত্য’-র ধারণা কি মার্কসবাদে স্বীকৃত

‘মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ ইহা সত্য’— শুধু আমাদের এখানে নয়, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেওয়ালে দেওয়ালে একসময় এমন কথা লেখার চল হয়েছিল। কিন্তু এমন ‘সর্বশক্তিমান’ আর ‘পরম সত্য’-র ধারণা কি মার্কসবাদে স্বীকৃত? বেদ, কোরান কিংবা বাইবেলের মতই কি মার্কস-এঙ্গেলসের রচনাবলি অভ্রান্ত আর পবিত্র? দুটো প্রশ্নর উত্তরই এককথায়, না। একেবারেই নয়।

মার্কসবাদ আসলে কী এবং মার্কসবাদ আসলে কী কী নয় সেই নিয়েই রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর বই, ‘মার্কসবাদ জিজ্ঞাসা’।

মার্কসবাদের একটা ব্যবহারিক দিক আছে। মার্কসবাদীরা নৈরাজ্যবাদী নন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে প্রথমে সমাজতন্ত্র ও পরে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠাই তাঁদের লক্ষ্য। একটা সমাজ, যেখানে সবাই সাধ্য অনুযায়ী দেবে আর প্রয়োজন অনুযায়ী নেবে। কী পাবে সেখানকার সমস্ত মানুষ তা ঠিক করবে সমসময়। ২০২২ সালে কোথাও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে ২০২২ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের বেঁচে থাকা সহজ করতে যা যা উৎপাদন করছে সমাজের সকলেই সেগুলো যথেষ্ট পরিমাণে যৌক্তিক ভোগ করবে— এই হল মার্কসীয় সমাজবাদের মূল কথা। কোনও কৃচ্ছ্রসাধনের সমাজতন্ত্রর কথা বা কোনও আইডিলিক সমাজের কথা মার্কসবাদীরা ভাবেন না। ওগুলো মধ্যযুগের খ্রিস্টীয় ধারণা। ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার’-এই এমন সমাজতান্ত্রিক ভাবনার সমালোচনা আছে।

এ তো গেল ব্যবহারিক দিক। কিন্তু তত্ত্বর দিক থেকে মার্কসবাদ আসলে কী? রামকৃষ্ণবাবু এই বইতে পাখিপড়া করে নানান উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছেন মার্কসবাদকে একটা প্রণালী বা সিস্টেম হিসেবে ধরলে সেইটাই হবে সবচেয়ে বড় ভুল। মার্কস-এঙ্গেলস জীবনের একটা বড় সময় সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন, তখন ইউরোপের অনেক দেশেই একটা বৈপ্লবিক জোয়ার এসেছিল। অনেকগুলো ব্যর্থ বৈপ্লবিক চেষ্টার পরে ভাটা নামল বামপন্থী রাজনীতিতে। মার্কস-এঙ্গেলস তখন শুরু করলেন বৈপ্লবিক তত্ত্ব তৈরির কাজ। মার্কস-এঙ্গেলস দুজনেই চেয়েছিলেন একটি পদ্ধতি বা মেথড গড়ে তুলতে। যে পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে অতীত বর্তমান বা ভবিষ্যতের যে কোনও দেশকালে যে কোনও ‘মূর্ত পরিস্থিতির মূর্ত বিশ্লেষণ’ করা সম্ভব হবে। যে কোনও বিষয়েই এই পদ্ধতি ব্যবহার করা সম্ভব হবে। তাই মার্কসবাদ কখনওই কোনও প্রণালী বা সিস্টেম নয়, তা একটি পদ্ধতি বা মেথড।

রামকৃষ্ণবাবু দেখিয়েছেন, অপ্রিয় হলেও সত্যি, যে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বিপ্লবের পরে মার্কসবাদকে একটি প্রণালী হিসেবেই চালানোর একটা চেষ্টা হয়েছিল। কোনও তত্ত্বকে প্রণালী বলে ধরে নেওয়ার অনেক গেরো। ধরে নিতে হবে সব সমস্যার সমাধান বুঝি মার্কস-এঙ্গেলসের লেখাতেই আছে। কোনও সমস্যা এলেই খোঁজো এই নিয়ে তাঁরা কী বলেছেন, না পেলে দেখো তুলনীয় কিছু আছে কি না। তাতেও না পেলে লেনিন, স্তালিন বা মাও-এর লেখা খোঁজা হোক। সেখানেও না পেলে তবে অন্য দার্শনিকদের কাছে হাত পাতো। এখনও কিছু মানুষ তেমনই মনে করে থাকেন। কিছু অতি-সংবেদনশীল সম্প্রতি পুঁজিবাদের বীভৎস চেহারা দেখে এতই বিচলিত হয়ে পড়েছেন যে পুঁজিবাদের সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতাটাকেও বাতিল করার পক্ষে রায় দিয়ে বসেছেন। এঁদের মতামত শুনলে শিবরাম চক্রবর্তীর অনন্যসাধারণ গল্প ‘বিহার মন্ত্রীর সান্ধ্যবিহার’-এর সেই ডাক্তার মেসোমশাইকে মনে পড়ে যায়। রোগ আর রোগী দুটোকেই সেরে দিতে তাঁর জুড়ি ছিল না। কেউ কেউ আবার স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামসমাজে ফেরার মধ্যেই মানুষের মুক্তি লুকিয়ে আছে বলে অভিমত জাহির করেন। এই নিয়ে রামকৃষ্ণবাবু লিখছেন:

“‘স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামসমাজ’ বলে একটি উদ্ভট ধারণা অনেকের মধ্যে চালু আছে। এক-একটি গ্রামের সীমিত চাহিদা মেটানোর মত যাবতীয় বস্তু নাকি গ্রামেই উৎপন্ন হত। তাহলে ধরে নিতে হবে: প্রত্যেক গ্রামে নুন পাওয়া যেত, অথবা সবাই আলুনি খেতেন। দুটোই সমান অসম্ভব। একেবারে প্রাথমিকস্তরে নুন খাওয়ার চল ছিল না। কিন্তু কাঁচা বা ঝলসানো জিনিস ছেড়ে রান্না-করা জিনিস খেতে হলেই নুনের কথা ওঠে। তেমনি ওই কাল্পনিক স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামসমাজে নিশ্চয়ই কেউ সুতির কাপড় পরতেন না, অথবা তেমন প্রত্যেকটি গ্রামেই তুলোর চাষ হত। আবার দুটি অসম্ভব বিকল্প। আর প্রস্তরযুগ ছাড়িয়ে ধাতুর যুগে পৌঁছতে হলে ওই স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামে কী হত? প্রত্যেক গ্রামের মাটির তলায় কি তামা সোনা রুপো লোহা— সবকিছুর অন্তত একটি করে খনি থাকত? পুরোদস্তুর চাষ-আবাদ চালু থাকলে তো আরও সমস্যা। লাঙলের ফলা যদি কাঠেরও হয়, কাস্তেটা কী দিয়ে তৈরি হবে?”

“নুন, সুতো, ধাতু— কিছুটা উন্নত গ্রামজীবনে এই তিনটির চাহিদা অপরিহার্য। কিন্তু কোনও একটি গ্রামের ভেতরে এই তিনটি একসঙ্গে পাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে অনিবার্যভাবেই গ্রামে উৎপন্ন মালপত্তর বিনিময়ে এই তিনটি জিনিস যোগাড় করতেই হয়। সরাসরি বিনিময়ের জায়গায় টাকাকড়ির মাধ্যমে বিনিময় চালু হলেও মূল উদ্দেশ্য একই থাকে: আমার যা আছে তা-ই দিয়ে আমার যা নেই, কিন্তু চাই-ই সেটি যোগাড় করা। এখনকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, হিসেবনিকেশের পদ্ধতি ইত্যাদির যতই চোখ-ধাঁধানো পরিবর্তন হোক, মূল ব্যাপারটি এতটুকু বদলায় না।”

হালে কিছু লেখা চোখে পড়ল যেখানে মুক্তির উপায় হিসেবে স্বাধীন কারিগর শ্রেণি গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে। লেখাগুলো খুবই ভাল এবং বেশ খেটে লেখা, তবে আজ থেকে শ’তিনেক বছর আগে লেখা হলে সেগুলোকে কাজের লেখা বলে ভাবনার অবকাশ ছিল।

মার্কসবাদকে একটি পদ্ধতি বলে ধরে নিলে এইসব সমস্যা এড়ানো সম্ভব। ওই পদ্ধতি অনুসরণ করে নতুন দেশে নতুন কালের নতুন সমস্যার সমাধানের কথা ভাবা যায়। যেসব সমস্যা হয়তো কখনওই মার্কস বা এঙ্গেলস-এর কল্পনাতেও ছিল না। রামকৃষ্ণবাবু জোর দিয়েছেন মার্কসবাদ যে আসলে একটি পদ্ধতি সেটি প্রমাণ করার ওপরে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে এমনকি মার্কস বা এঙ্গেলসের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও তোলা যায়। মনে রাখতে হবে যতই পণ্ডিত হোন না কেন মার্কস-এঙ্গেলস ছিলেন উনিশ শতকের মানুষ, বিজ্ঞান ইতিহাস অর্থনীতি নিয়ে সমসময়ের জ্ঞানই তাঁদের সম্বল। যত প্রতিভাশালীই হোন না কেন মানুষ তাঁর সমসময়ের নিগড়ে বাঁধা। মার্কস-এঙ্গেলসও তাই সবসময় অভ্রান্ত ছিলেন না। রামকৃষ্ণবাবু এই বইতে দুটি উদাহরণ দিয়েছেন।

‘কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার’-এর প্রথম লাইনে লেখা ছিল, ‘‘আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাস শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস।” রামকৃষ্ণবাবু লিখছেন, “কথাটি ভুল, কারণ শ্রেণিসংগ্রাম দেখা দেওয়ার বহু আগে থেকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে হাজার হাজার মানবসমাজ ছিল যেখানে কোনও শ্রেণিভেদ ছিল না। শ্রেণি-পূর্ব সমাজের ইতিহাস শ্রেণিসমাজের ইতিহাসের চেয়ে অনেক বেশি প্রাচীন। এশিয়া ও আফ্রিকায় বহু জনগোষ্ঠী আছে।”

আসলে ১৮৪৭ সালে ‘ইশতেহার’-টি লেখা। তখন প্রাচীন শ্রেণিপূর্ব মানবসমাজ সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানা ছিল না। পরবর্তীতে হাক্‌স্তাথারউজেন, মাউরার প্রমুখরা প্রাচীন মানবসমাজে জমির যৌথমালিকানা ইত্যাদির প্রমাণ দেন। ওই ‘ইশতেহার’ বেরনোর চল্লিশ বছর পরে এঙ্গেলস সেই বইয়ের ইংরেজি সংস্করণের একটি পাদটীকায় ভুলটি শুধরে দেন।

এই প্রসঙ্গেই বইতে এসেছে আর-এক অনুতাপহীন ভারতীয় মার্কসবাদী ডি ডি কোসম্বী-র কথাও:

“ঐতিহাসিক দামোদর ধর্মানন্দ কোসম্বী-ও পদ্ধতি-কেই মার্কসবাদ-এর সারকথা বলে মনে করতেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারত সম্পর্কে মার্কস-এর মতামত তিনি মানতে পারেননি। মার্কস-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করে, আর সেগুলি খণ্ডন করার পরেও তিনি লিখেছেন: ‘এইসব সত্ত্বেও [আমার কাজের] তাত্ত্বিক ভিত মার্কসবাদই রইল— পদ্ধতিটি আমি যেমন বুঝি।’ অর্থৎ মার্কস-এর সঙ্গে বিশেষ ক্ষেত্রে একমত না হয়েও মার্কসবাদী হতে কোনও বাধা নেই। কোনও তাত্ত্বিক ভিত্তি ছাড়া ইতিহাস লেখা যায় না। আর প্রাচীন ও মধ্যযুগের ভারত সম্পর্কে মার্কস-এর অতিসাধারণীকৃত মতের বিরোধিতা করেও মার্কসীয় পদ্ধতিতে ইতিহাস লেখা যায়।”

মার্কসবাদকে অভ্রান্ত আর প্রণালী ধরে নেওয়ার ফলে কেলেঙ্কারিও কম হয়নি। মার্কস ইউরোপকে ভিত্তি করে মানুষের এযাবৎকালের ইতিহাসকে চারভাগে ভাগ করেছিলেন, প্রাচীন শ্রেণিপূর্ব সমসমাজ, দাসভিত্তিক সমাজ, সামন্ত সমাজ, আর পুঁজিবাদী সমাজ। এখন কথাটা হচ্ছে ইউরোপের মত দাসব্যবস্থা ভারতে কখনও গড়ে ওঠেনি। কিন্তু মার্কস যেহেতু দাস সমাজের কথা বলেছেন তাই অনেকেই ভারতের ইতিহাসে দাসভিত্তিক সমাজ খুঁজে পেতে ব্যগ্র হয়েছিলেন। বহু মেধা আর সময় তাতে খানিক অপচয়ই হয়েছিল বলা যায়।

রামকৃষ্ণবাবু পরিষ্কার বলেছেন, মার্কসবাদ কেবলই কোনও অর্থনৈতিক তত্ত্ব নয়। মার্কসবাদের কেন্দ্র হল মার্কসীয় দর্শন আর সেই দর্শনের মূল কথা হল দ্বন্দ্ব বা ডায়ালেকটিকস। এই ডায়ালেকটিকসকে কেন্দ্র করেই মার্কসবাদের পদ্ধতিটি গড়ে ওঠে। সব কিছুই পরিবর্তনশীল, বিপরীতের মধ্যে ঐক্য, প্রতিষেধের প্রতিষেধ (নেগেশান অব দ নেগেশান), পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন— দ্বন্দ্বতত্ত্বর এই সিদ্ধান্তগুলো ব্যবহার করেই মার্কসবাদ দর্শন, অর্থনীতি, প্রকৃতিবিজ্ঞান, মানবসমাজ— এই সব কিছুকেই একটি সুতোয় বেঁধে ফেলতে পারে।

দ্বন্দ্বতত্ত্বকে ভিত্তি করে মার্কসবাদ মানুষের সমাজ, প্রকৃতি আর তাদের পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করে। দ্বন্দ্বর সঙ্গে থাকে বস্তুবাদ এবং লজিক। মার্কসীয় বস্তুবাদ কিন্তু বস্তুসর্বস্ব নয় মোটেই, বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ীকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় এতে। আসলে বিষয়ী না থাকলে বিষয়ের থাকা না-থাকায় কিছু আসে যায় না।

একটা নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থায় আর্থিক বুনিয়াদের ওপরে গড়ে ওঠে সেই ব্যবস্থার আইন, দর্শন, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ন্যায়নীতি। সংস্কৃতি মানে নৃতাত্ত্বিক সংস্কৃতি, জীবনযাপনের যাবতীয় উপকরণ ও অন্যান্য সৃষ্টি। সামন্ততন্ত্র-য় জমিদাররই থাকেন সমস্ত ক্ষমতার শীর্ষে আবার পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় জমিদারির উচ্ছেদ হয়। সামন্ততন্ত্রে সতীদাহ একটি পুণ্যর কাজ, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তা আইনত নিষিদ্ধ। পুঁজিবাদে ব্যক্তিগত সম্পত্তির জয়গান সর্বত্র আবার সমাজতন্ত্র ব্যক্তিগত সম্পত্তির উচ্ছেদ করে। আর্থিক ভিতের ওপরেই গড়ে ওঠে বাকি সব কিছুর ইমারত। রামকৃষ্ণবাবু এই বইতে এবং আরও অনেক লেখাতেই একটা বিষয় কিন্তু স্পষ্ট করে বলেন, মার্কসবাদ যেহেতু দ্বন্দ্বনির্ভর মতবাদ, তাই আর্থিক বুনিয়াদ আর তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ইমারত— এই ব্যাপারটা কিন্তু একমুখী একটা ব্যাপার নয়। অবশ্যই আর্থিক বুনিয়াদই ইমারতকে প্রভাবিত করে। আর্থিক বুনিয়াদ পাল্টালেই তবে ইমারতের পরিবর্তন হয়। কিন্তু এটাও বোঝা দরকার যে ইমারতও একটা সময়ে এসে আর্থিক বুনিয়াদকে প্রভাবিত করে, এবং এক আর্থিক বুনিয়াদকে উচ্ছেদ করে মানুষ আর-এক রকমের আর্থিক বনিয়াদ তৈরি করে। আসলে দ্বন্দ্বর প্রথম নিয়মই হচ্ছে সবকিছু পরিবর্তনশীল। তাই কোনও নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থার আর্থিক বুনিয়াদই অপরিবর্তনীয় থাকতে পারে না। সেইখানেও পরিবর্তন ঘটে চলে। তার অভিঘাতে ইমারতে চালু আর্থিক বুনিয়াদ বদলের ভাবনার প্রকাশ আর প্রসার ঘটে। সামন্ততন্ত্রর আর্থিক বুনিয়াদের মধ্যেই পুঁজিবাদী ভাবনা ও সামন্ততন্ত্র বিলোপের উদ্যোগ তৈরি হয়। আবার পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেই এর বিনাশ ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র গড়ার আদর্শ শক্তিশালী হয়। ধীরে ধীরে সরলরৈখিক পথে এই পরিবর্তন হয় না। চলতে চলতে লাফের পর্ব আসে। বিপ্লব সংঘটিত হয়। আর্থিক বুনিয়াদের ভাবনা আর উদ্যোগে পরিমাণগত পরিবর্তন চলতে চলতে একসময় গুণগত পরিবর্তন ঘটে উল্লম্ফনের মাধ্যমে। তাই ইতিহাসের গতিপথ সরল সোজা নয়, স্পাইরাল। পুরনো উৎপাদন ব্যবস্থাকে সরিয়ে নতুন উৎপাদন ব্যবস্থার বুনিয়াদ গড়ে ওঠে। কিন্তু পুরনোর অনেক কিছুই তার ইমারতে থেকে যায়। তাই কোনও সমাজে নির্দিষ্ট দুটো পরস্পর শ্রেণিই শুধু থাকে না। রামকৃষ্ণবাবুর মতে, সাদা আর কালো, ব্যাপারটা মোটেও এমন নয়। অনেক রঙের শেডই সমাজে বর্তমান থাকে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যেমন মূল দুটো শ্রেণি পুঁজিবাদী আর মজুর, কিন্তু এদের বাইরেও আরও নানান শ্রেণি সেখানে বর্তমান থাকে, তাই সেই ব্যবস্থার বিশ্লেষণে এইসব শ্রেণিকেও অবশ্যই হিসেবে রাখতে হবে। দাসমালিকদের সরিয়ে সামন্তরা ক্ষমতা দখল করে, যারা অন্যশ্রেণিকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল সেই সামন্তদের সরিয়ে আবার পুঁজিবাদ ক্ষমতায় আসে, যে পুঁজিবাদ সামন্ততন্ত্র উচ্ছেদ করেছিল তাকে উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই হল প্রতিষেধের প্রতিষেধ বা নেগেশন অফ নেগেশন। যে এখন নেগেট করছে পরবর্তীতে সে-ও নেগেট হয়ে যাবে। এই হল ইতিহাসের গতি।

ইতিহাসের প্রসঙ্গেই এই বইতে রামকৃষ্ণবাবু অনেক ক’টি কম আলোচিত প্রসঙ্গে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রেখেছেন। সেগুলো সমাজবিজ্ঞানে আগ্রহীদের কাছে অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। ‘ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না’— জাতীয় বাক্য আমাদের মধ্যে অত্যন্ত চালু। ইতিহাস কি নিয়তি বা বিধাতার মত কোনও ধারণা যা কিনা মানবসমাজকে নিয়ন্ত্রিত করে? তার হাতার বাইরে যাওয়ার কোনও উপায় নেই? রামকৃষ্ণবাবু লিখছেন,

“মার্কস-এঙ্গেলস তাঁদের বিশ্ববীক্ষা গড়ে তোলার সময়ে (১৮৪৩-৪৫) এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন:

‘ইতিহাস কিছুই করে না, তার প্রভূত সম্পদ নেই, সে কোনও যুদ্ধ করে না। মানুষ, জীবন্ত মানুষই ওই সব কিছু করে, তারই আছে (সম্পদ) আর সে-ই লড়ে; ইতিহাস কোনও আলাদা একজন ব্যক্তি নয় যে মানুষকে তার নিজস্ব লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যবহার করে; মানুষ তার লক্ষ্যর সন্ধানে যা করে ইতিহাস তা ছাড়া আর কিছুই নয়।’

অর্থাৎ কোনও অদৃশ্যশক্তির নির্দেশ মেনে মানবসমাজের কোনও কিছুই হয় না— সেই অদৃশ্য শক্তিকে ইতিহাস, নিয়তি, বিধাতা বা আর যা কিছুই বলা হোক না কেন। মানুষের ‘ভাগ্য’ মানুষেরই হাতে।’’

ইতিহাস পূর্বনির্ধারিত কিছু নয়, তা কার্যকারণ সম্পর্কে নির্ধারিত। এ নিয়ে বইতে খুব কাজের আলোচনা রয়েছে।

এই প্রসঙ্গেই এসে মার্কসবাদে মানুষের পরিচয় কেমন তা নিয়ে আলোচনা। রামকৃষ্ণবাবু মানুষের আলাদা তিনটি সত্তার কথা উল্লেখ করেছেন:

১. ভৌত সত্তা। “গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডর জড় পদার্থগুলি যেসব অণুপরমাণুর সমবায়ে তৈরি, মানুষের দেহ সেই একই উপাদানে গড়া। এই হলো মানুষের ভৌত সত্তা।”

২. জৈব সত্তা। “কোনো স্রষ্টা ছাড়াই যেমন ভৌত জগতের অভিব্যক্তি ঘটেছে তেমনই অভিব্যক্তির প্রক্রিয়া প্রথমে এককোষী ও পরে বহুকোষী জীব দেখা দিয়েছে। মানব প্রজাতির দ্বিতীয় সত্তা এই জৈব সত্তা। অন্যান্য সজীব প্রাণীর মত মানবপ্রজাতিও এই স্তরে লক্ষ লক্ষ বছর থেকেছে।”

৩. মানবিক সত্তা। “হাতিয়ার তৈরি করতে শেখার পর দেখা যায় তার তৃতীয় সত্তা। সেটি একান্তভাবেই মানবিক সত্তা। এই তিনটি সত্তার কোনওটিকেই অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন মানুষ যে পর্যায়ে আছে তার মধ্যেও ভৌত ও জৈব সত্তা পুরোপুরি বহাল।”

জৈব সত্তার চাহিদাগুলো মিটলেই তবে মানুষের মানবিক সত্তা বিকাশের পথ তৈরি হবে। কিন্তু শ্রেণিবিভক্ত সমাজে তার কোনও সম্ভাবনা নেই। আজকের পুঁজিবাদী ব্যবস্থাতেও প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষকেই কেবল কোনোরকমে খেয়েপরে বেঁচে থাকার বাইরে আর কিছু করে ওঠার সুযোগ দেওয়া হয় না। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন নিজেদের জৈব সত্তা টিকিয়ে রাখতেই কেটে যাচ্ছে। তাঁরাও মানুষ কিন্তু মানবিক সত্তার সঙ্গে তাঁদের অনন্বয় বা অ্যালিয়েনেশন ঘটে যায়। আর এইখানেই সমাজবাদের লক্ষ্যর কথা আসেন। রামকৃষ্ণবাবু লিখছেন:

“মনে রাখতে হবে: সকলের দরকার মেটানোই কমিউনিস্ট সমাজের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। উল্টে বলা যায়: মানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের এটি পূর্বশর্ত মাত্র। মার্কস ভেবেছিলেন: শ্রেণিসমাজে বাস করার দরুণ মানুষ তার প্রকৃত সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে; শ্রেণিহীন সমাজে সেই বিচ্ছেদ কাটিয়ে সে তার প্রকৃত সত্তা ফিরে পাবে। খাওয়া-পরার অভাব মেটা— শুধু কয়েক জনের নয়, গোটা সমাজের সেই উদ্দেশ্যে পৌঁছনোর জন্যে দরকারি একটা ধাপ। কিন্তু সেই ধাপেই মানুষ দাঁড়িয়ে থাকবে না। শ্রেণিভেদ উঠে যাওয়ার পরে সমাজ ও ব্যক্তিমানুষের মধ্যে আবার যথার্থ যোগ বা অন্বয় গড়ে উঠবে। একমাত্র তখনই দেখা দিতে পারে অনন্বয় (অ্যালিয়েনেশন)-এর মুক্ত মানুষ।”

রামকৃষ্ণবাবু স্পষ্টতই জানান, মার্কসবাদে সরল আশাবাদের কোনও জায়গা নেই। সমাজতন্ত্রর পথে এগোতে গেলে অবশ্যই আশা থাকবে, কিন্তু সে-আশা সরল নয়। পিছিয়ে আসার ঘটনাও ঘটতে পারে দ্বন্দ্বর তত্ত্ব অনুযায়ী, তখন হতাশ হলে চলবে না। আর-একটি আলোচনাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্কসবাদ কখনওই সুখবাদ নয়, প্রত্যেকের জীবনধারণ আর ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্যে প্রয়োজনীয় বৈষয়িক উপকরণ সমাজের প্রতিটি সদস্যই পাবেন। সেখানে যেমন কৃচ্ছ্র বা ত্যাগের গল্প থাকবে না তেমনি অযৌক্তিক কোনও ভোগও প্রশ্রয় পাবে না। কর্মক্ষম মানুষ কাজ না করলে খেতে পাবে না। যথেচ্ছ ভোগ করার সুযোগ মার্কসবাদে স্বীকৃত নয়, কিন্তু যথেষ্ট ভোগের ব্যবস্থা অবশ্যই তার লক্ষ্য।

সমাজতন্ত্র কায়েম হলেও কিন্তু রোগ, জরা আর মৃত্যুর হাত থেকে মানুষ মুক্তি পাবে না, এটাও বুঝে নিতে হবে। তবে সুস্থ শরীরে আয়ুর বৃদ্ধি, রোগের কষ্ট দূর করার চেষ্টা অবশ্যই করা হবে।

মার্কসবাদের মূল উপজীব্য মানুষ আর প্রকৃতি। মার্কস যখন মানুষের সভ্যতার বিকাশের কাজ করছেন এঙ্গেলস তখন ব্যস্ত ছিলেন প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা লেখার তথ্য সংগ্রহের কাজে। মানুষ আর প্রকৃতির সম্পর্কও আসলে মিলন আর সংঘাতের সম্পর্ক।

বইটির শেষে বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনার পর সব মিলিয়ে একটি ছোট পর্যালোচনা আছে। যা বইটির বিষয়গুলিকে বুঝতে বিশেষ সাহায্য করে।

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য।। মার্কসবাদ জিজ্ঞাসা।। অবভাস।। ২০১৬ এবং ২০১৮
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »
শুভদীপ রায়চৌধুরী

শুভদীপ রায়চৌধুরীর দুটি কবিতা

অন্ধকারের তুমি,/ নরম পুঁইমাচার নিচে সবজেটে বহুরূপী/ তোমাকে আলোর কণার ভেতর গড়িয়ে যেতে দেখব বলে/ আমি এই পাগলের পৃথিবী ছেড়েছি/ টিলাপায়ে বাস করি/ নাম, সমুদ্রসম্ভব।/ পাতার ইমারত আছে, আছে/ কিছু দৈনন্দিন কাজ/ মাছ ধরার নাম করে/ বালসাভেলায় অনেকদূর যাওয়া/ যতদূর ভেসে গেলে ঢেউয়ের চুম্বন থেকে/ ছোবলটুকু আলাদা করাই যায় না

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | দ্বিতীয় পর্ব

সকালে চিড়ে নারকেল-কোরা আর গুড় খেয়ে আমি সাইকেলে চেপে ছুটিয়ে দিলাম— আট মাইল রাস্তা ঠেঙিয়ে যখন পৌঁছালাম— তখন গণগণে রোদ্দুর তেষ্টায় গলা কাঠ। ঘন্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে একটা বাড়ি দেখে সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম যদি একটু জল খাওয়া যায়। বাড়ির বারান্দায় একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি বসেছিলেন— তার কাছে উদ্দিষ্ট ঠিকানার কথা প্রশ্ন করতেই তিনি উঠে এসে আমার হাত ধরে আমাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে একটা পাটি পেতে বসতে দিলেন। আমি আবার জল চাইলে বললেন, “দাদাঠাকুর ব্যস্ত হবেন না— ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন।”

Read More »