সেদিন বিকেলে এতটুকুও ভাল লাগছিল না। বসন্ত এসে গেছে, এ ছন্দ পুরনো হতে চলেছে। গ্রীষ্মও মাঝপথে। বাড়ি থেকে বেরোনোর উপায় নেই এ বছর। তাই জানালার পর্দা, শাটার সব সরিয়ে দিয়ে জানলাটাকেই ব্যালকনি বানালাম। জানলার সামনে দূর দূর পর্যন্ত দেখা যায় সবুজের গালিচা। দেখতে দেখতে নজর গেল, জানলার খুব কাছের শিরীষ গাছটাতে। আরে! গাছের পাতাগুলো কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে, ভাবলাম আমি। তবে পাতাগুলো ঝিমিয়ে পড়াতে বেশ কিছু গোলাপি ঝিরঝিরে পাপড়িওয়ালা ফুল দেখা যাচ্ছে গাছটাতে। ফুলগুলোকে সকালে তো দেখিনি! এবার দেখি, তিনটে খুব ছোট ছোট পাখি, এ ফুল থেকে ও ফুল করে বেড়াচ্ছে। একটা পাখির পিঠ কালো আর পেটটা সাদা। বাকি দুটোর পিঠ বাদামি আর পেটটা সাদা। ইঞ্চি দুয়েক ওদের মাপ হবে। মেরেকেটেও আড়াই ইঞ্চি পেরবে না। পাখি তিনটে খুব দুরন্ত। এ ফুল ও ফুল করে চলেছে। কিছুক্ষণ পর ওরা ফুড়ুৎ করে দূরের রাধাচূড়া গাছে উড়ে গেল। আবার আমি শিরীষে ফিরে এলাম।
পাতাগুলো এমন ঝিমিয়ে পড়াতে গাছটাকে ন্যাড়া দেখাচ্ছে। গাছের ভেতরের শক্তপোক্ত ডাল সমেত বাইরের দিকের ডালপালাগুলোও সব দেখা যাচ্ছে। আমি মন দিয়ে গাছটাকে দেখছি। একটা ডালে এসে আমার নজর আটকে গেল। একটা কাকের বাসা। বাসার ভিতরে দুটো খুব ছোট কাকের বাচ্চা। এমন ধূসর তাদের রং, একেবারে বাসার সঙ্গে মিশে গেছে। শুধু যখন ওদের মা, বাবা খাবার দেয় সেই সময় ওদের চেনা যায়। কারণ ওরা মুখ খুললেই মুখের ভেতরের লালচে কমলা রং প্রকট হয়ে ওঠে। আমি ওদের ইনস্ট্যান্ট ভালবেসে ফেললাম। মা কাক খাবার খুঁজতে গেলে, বাবা কাক বাচ্চাদের পাহারায় থাকে। আর বাবা কাক গেলে, মা কাক থাকে পাহারায়। সন্ধের আগে বাচ্চাদের পেটপুরে খাইয়ে দিতে হবে। তাই মা কাক আর বাবা কাকের যাওয়া-আসা লেগেই থাকে।
সেদিন মন খুশিতে ভরে গেল। পরের দিন সকাল সকালই জানলা দিয়ে দেখতে গেলাম বাচ্চা কাকদের। ও মা! কে কোথায়? কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শিরীষের গাঢ় সবুজ পাতাগুলো তরতাজা হয়ে উঠেছে। পুরো গাছটাকে ঝাঁকালো চুলে ভরা মাথা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছটাতে, আর একটা কাক আর তার কাকিনী বসে আছে। সারাদিন নানা কাজে ব্যস্ত ছিলাম। বিকেলবেলা খাস সময় বের করে জানালায় বসে গেলাম। আজ লক্ষ্য করলাম, সূর্যাস্তের সঙ্গে শিরীষের পাতাগুলো নুইয়ে পড়ে। আর সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে তারাও জাগরিত হয়। ‘ওয়াও’ বলব বলব করছি, আবার সেই তিনটে পাখি শিরীষের এ ফুল ও ফুল করা শুরু করেছে। বুঝলাম, সকালবেলা তরতাজা পাতার আড়ালে থাকে ওই কাকেদের বাসা। বিকেলে, পাতা নুইয়ে পড়লে তবে তাদের ঘর দেখা যায়। ঠিক যেন মনে হল, ওরা পর্দা সরায়, তবেই আমি ‘পিপিং টম’ হই!
মা আর বাবা কাক নিজেদের ঠোঁট, বাচ্চাদের মুখের ভেতর ঢুকিয়ে ওদের খাবার খাওয়ায়। খাওয়ানোর পর, গাছের ডালে খুব করে নিজেদের ঠোঁটটা ঘষে নেয়। তারপর আবার খাবার আনতে যায়। মা কাক, ওই ছোট্ট বাসাটার সাফ-সাফাইও করে। বাচ্চা দুটো বাসার মাঝখান থেকে ধারে চলে এলে, এদিকে আমার বুক ধড়াস করে ওঠে। ওদিকে হয় বাবা কাক, নয় মা কাক অনায়াসে ঠোঁট দিয়ে বাচ্চা দুটোকে টেনে বাসার মাঝখানে নিয়ে আসে। কখনও কখনও বাবা কাক, মা কাক আর দুটো বাচ্চা, ওই ছোট বাসাটায় একসঙ্গে বসে কতই না কাজ করে!
একটা করে দিন যায়। বাচ্চাগুলোকে রোজই আগের দিনের থেকে একটু বড় হয়েছে বলে মনে হতে থাকে। মাটি থেকে প্রায় ষাট-সত্তর ফুট ওপরে এই কাকেদের বাসা। একদিন দেখি, শিরীষের যে ডালটা পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছের প্রায় গা-ঘেঁষে আছে, সেই ডালে ওই কাক আর কাকিনী, যাদের আমি প্রথম দিন দেখেছিলাম, তারা বাসা বাঁধা শুরু করেছে। কাক সরু কাঠি, নানারকম পাতলা শুকনো গাছের ডাল আনছে, আর কাকিনী তা শিরীষের ডালে ‘সেট’ করছে। কখনও কখনও দুজনে মিলে, পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছের শুকনো কাঠি ঠোঁট দিয়ে টানাটানি করে, ঘরের জন্য কাঁচামাল যোগাড় করছে। কাক মাঝেমাঝে অনতিদূরের নারকেল গাছে উড়ে যাচ্ছে। সেখান থেকেও ডাবের শুকনো কাঠি আনছে।
কাক একেবারে আমাদের ঘরের লোকগুলোর মত! স্পষ্ট দেখছি, কাঠি আনতে যাবার নাম করে, খুব এদিক-ওদিক চক্কর কাটছে! কখনও বা বাস ডিপোর ছাদে, জলের ট্যাঙ্কে গিয়ে বাকি বন্ধুদের সঙ্গে ‘কা-কা কি-কি’ (হা-হা হি-হি!) করছে। তারপর টুপ করে একবার নারকেল গাছে গিয়ে, একটা কাঠি নিয়ে কাকিনীর কাছে হাজির। ভাবটা এমন, ‘দেখো না কত ঘুরে ঘুরে তবে এই কাঠি পাওয়া গেল।’ কাঠি বাসাতে লাগানোর আগেও মহাচর্চা চলছে। ‘এটা কি মানাবে? এটা নিচের দিকে বসবে না ওপর দিকে?’ এসব হাজারো আলোচনার পর বাসায় একটি একটি করে তিনকা জোড়া হচ্ছে। অবশেষে এক বিকেলে দেখলাম, কাক-কাকিনীর বাসাও তৈরি হয়ে গেছে।
এরপর থেকে আমার নজর একবার ওই মা কাক, বাবা কাক আর তাদের দুটো বাচ্চা আর-একবার কাক, কাকিনীর বাসায় ঘোরাফেরা করতে থাকল। রোজ বিকেলে বসে বসে ওদের কাণ্ডকারখানা দেখতে ভারি ভাল লাগে। বাচ্চারা বড় হচ্ছে। খুব দুরন্ত হয়েছে। মা কাক আর বাবা কাক আরও সচেতন হয়ে গেছে। বাচ্চারা বাসা থেকে ঝুঁকে ঝুঁকে নিচে দেখতে যায়। আর হয় মা কাক নইলে বাবা কাক, ওদের টেনে মাঝখানে আনে। দুটো বাচ্চাকে বরাবর খাওয়ায়। বাচ্চাগুলোর পলাশরাঙা মুখের ভেতরের রং বারবার দেখা যায়।
পঁচিশে মে। তারিখটা মনে আছে! কাক-কাকিনীর বাসায় দেখলাম একটা ডিম। ‘উউউউউউ, সো সুইট’ মনে হল আমার। আকাশী রংয়ের ছোট্ট ডিমটা কবে ফুটবে, তার অপেক্ষা সেদিন থেকেই মনে মনে শুরু হল। সাতাশে মে। আরও একটা ডিম দেখলাম বাসায়। ডবল বোনাঞ্জা! কাকিনী বেশিরভাগ সময় বাসায় বসে থাকে। ডিমে তা দেয় নিশ্চয়ই। কাক খাবার আনে। কাকিনী বাসা থেকে একটু বাইরে বের হতে চাইলে ‘কা-কা’ করে। আর তখনই যত দূরেই থাকুক না কেন, কাক ঠিক হাজির হয়ে যায়। কাক বাসা পাহারা দেয়। কাকিনী একটু আড়িমুড়ি ভেঙে আবার বাসায় এসে বসে পড়ে।
আশেপাশে খুব কোকিল ডাকছে আজকাল। ভাবলাম, এইজন্যই কাকের বাসায় এত কড়া পাহারা! জুন মাসের সতেরো তারিখ। সকালবেলা একটা ডালের ওপর কাককে বসে থাকতে দেখলাম। মুখে একটা ডিমের খোলার ছোট টুকরো। ভাবলাম, ডিম ফুটে গেছে। বাচ্চা দেখতে পাব আজ বিকেলে। শিরীষের পাতা না নোয়ালে ওদের বাসা দেখার সাধ্য কারও নেই। তাই বিকেলের জন্য মনে মনে অপেক্ষা শুরু করলাম। দুপুরে বাড়ির লোক বলল, বিল্ডিংয়ের নিচে একটা ছোট ডিমের খোসার টুকরো পড়ে থাকতে দেখেছে। বুঝলাম, বাড়ির লোকেরাও মনে মনে এই কাক-কথায় উৎসাহী হয়ে উঠেছে! একটু আগে থেকেই জানলায় এলাম। মা কাক, বাবা কাক বাচ্চাদের এ ডাল ও ডাল ঝাঁপানোয় তদারকি করছে। হাওয়ায় গাছ বেশি দুললেই, বাচ্চা দুটো ঠোঁট দিয়ে গাছের পাতা চেপে ধরার চেষ্টা করছে। ব্যালেন্স করছে নিশ্চয়ই। এক জায়গায় যখন বসছে, তখনও গাছের পাতা ঠোঁট দিয়ে ধরার চেষ্টা করছে। তবে বাসা থেকে বেশি দূরে যাবার হুকুম তাদের নেই।
সারা সকাল তাদের গাছের ডালে কোথাও দেখা যায় না। মানে, তারা বাসাতেই থাকে। বিকেল হলে তাদের হালকা-ফুলকা ট্রেনিং শুরু হয়। বাচ্চারা এখনও পুরোপুরি উড়তে শেখেনি। তাই লাফ দিয়ে দিয়ে এ ডাল ও ডাল করে। লাফানোর সময় একটু পাখনা নাড়িয়ে ওড়ার চেষ্টা করে। এসব দেখছি, ততক্ষণে শিরীষের পাতা নোয়াল। তাড়াতাড়ি কাক-কাকিনীর বাসা দেখলাম। কাক-কাকিনী নেই। বাচ্চাও নেই। শুধু একটা ডিম পড়ে আছে। এই ডিমটাকেও কেমন যেন শুকনো গোছের মনে হল। এতক্ষণে কাকের মুখে সকালে দেখা ডিমের শুকনো খোলা আর বিল্ডিংয়ের নিচে পড়ে থাকা ডিমের খোলার ব্যাপারটা স্পষ্ট হল। শুনেছিলাম, পাখিরা যদি বুঝতে পারে ডিম নষ্ট হয়ে গেছে বা ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোনোর কোনও চান্স নেই, তারা নিজেই ডিম ফাটিয়ে দেয় বা নষ্ট করে দেয়। এতদিন ধরে বসে থাকার পর ডিম ফুটবে না, কাকিনী কিছুতেই এটা মানতে চাইছিল না। তাই কাক সুযোগ বুঝে ওই ডিম ফেলে দিয়েছে।
একটু পরে কাকিনী ফিরে এল। কাক বাসার কাছে আসতেই, তাকে ভীষণভাবে আক্রমণ করে উঠল। কাক তাড়াতাড়ি একটু দূরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর সে আবার ফিরে এল। কাকিনী এখনও বাসায় ওই শুকনো ডিমের ওপর বসে আছে। সে এবার আর কাককে আক্রমণ করল না। দেখলাম, কাকটা বাসার পাশের ডালে চুপচাপ বসে আছে। সন্ধে নেমে এল। মনটা আমার খারাপ লাগছিল। বেচারি কাকিনী এতগুলো দিন ধরে প্রায় আধপেটা খেয়ে, বৃষ্টিতে ভিজেও ওই বাসা থেকে একটুও নড়েনি। বলতে ভুলে গেছি, জুনের প্রথম সপ্তাহেই দিনদুয়েক খুব বৃষ্টি হয়েছিল। মাঝরাতে সেদিন যখন বৃষ্টি হল, কাকগুলোর জন্য মনকেমন করেছিল আমার। আরও দিন দুয়েক ওই শুকিয়ে যাওয়া ডিমের উপর বসার পর কাকিনী প্রায় বুঝে গেল, ও ডিমের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। যদিও সে পুরোপুরি ‘তা’ দেওয়া বন্ধ করল না। তবে একটু-আধটু অনাসক্তি চোখে পড়ছে।
এমন সময়, এই… বেলা পাঁচটা নাগাদ চোখ গেল কৃষ্ণচূড়ার ডালে। ঠিক দেখেছি! দুটো কাক, একটা বাচ্চা কাককে ট্রেনিং করাতে নিয়ে এসেছে! বাচ্চা কাকটা এত ভীষণ মিষ্টি, যে ওকে দেখতে দেখতেই ওর নাম দিয়ে ফেললাম টুনু। আর টুনুর নামকরণ হতেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিরীষ গাছের বাচ্চা কাকদুটোরও নামকরণ হয়ে গেল গুনু আর পুনু। গুনু একটু বেশি সাহসী। সে টুক করে গাছের মগডালে চলে আসে। এদিক-ওদিক দেখে, আবার বাসার কাছে গিয়ে বসে। পুনু বাসার কাছেই ওড়াউড়ি করে। ওদের বাবা-মা বেশিক্ষণ ওদের বাসায় বসে থাকতে দেয় না। আসলে বাসায় বসারও ফিক্সড টাইম আছে। সকাল এগারোটার পর থেকে তিনটে সাড়ে তিনটে পর্যন্ত বাচ্চারা বাসায় থাকে। বাসা থেকেই এদিক-ওদিক দেখাদেখি করে। তবে কড়া নিয়ম। এই সময়ে ওরা বাসা থেকে কোথাও যায় না।
আগেই বলেছি শিরীষের ঝাঁকালো মাথা দিয়ে দিনে ওদের বাসা দেখা দায়। আমি অনেক কষ্ট করে, জায়গা বদলে, কখনও বা হাওয়ার দৌলতে এই সময়টায় ‘পিপিং টম’-গিরি করতে পেরেছি! কিন্তু একটু রোদ পড়লেই বাচ্চাদের এ ডাল ও ডাল করা শুরু হয়। তখন বসলে চলবে না। ওড়াউড়ি প্র্যাকটিস করতেই হবে। মা-বাবা সন্ধে পর্যন্ত এই ওড়াউড়ির মাঝেই বাচ্চাদের খাবার খাওয়াবে। সকালেও তাই। ছ’টা-সাড়ে ছ’টা থেকেই বাচ্চাদের পলাশরঙা মুখে খাবার তুলে দেবে মা আর বাবা কাক। গুনু, পুনু, টুনু সবারই প্র্যাকটিস চলছে। নজর করে দেখলাম, কৃষ্ণচূড়া গাছের পাশের সুপারি গাছটায় টুনুদের ঘর। টুনু ‘একা’ বাচ্চা। সিঙ্গেল চাইল্ড! গুনু, পুনু শিরীষ গাছের ডালে খুনসুঁটি করে, মা-বাবা খাবার আনতে গেলে দুজনে মিলে সময় কাটায়। কিন্তু টুনুর সে সুযোগ নেই। সে একাই সুপারি গাছের বাসা থেকে বেরিয়ে, কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে এসে চুপচাপ বসে থাকে। মা-বাবা খাবার এনে তাকে খাওয়ায়। মা-বাবা দুজনের খাবার খাওয়ানোর ঠেলায় টুনু জেরবার!
একদিন বিকেলে দেখলাম, অনেকক্ষণ কাকুতি-মিনতির পরও যখন টুনু ওড়া প্র্যাকটিস করছেই না, ওর বাবা-মা দুজনেই গেল রেগে। কা কা করে তেড়েমেড়ে গেল ওর দিকে। ভাবটা এমন, ‘সারাদিন বসে থাকছিস। ওড়ার চেষ্টা কর। এখনই কর। দেখা আমাদের, আজ সারাদিন তুই কী প্র্যাকটিস করেছিস।’ টুনু তার বাবা-মায়ের এই রূপ আগে দেখেনি। ভয় পেয়ে কোনওরকমে ঝটপটিয়ে কৃষ্ণচূড়ার একদিক থেকে অন্যদিকের ডালে উড়ে গিয়ে বসল সে। মনে হল, বাবা-মা দুজনেই খুশি। ওরা টুনুর মাথায় ঠোট দিয়ে আদর করতে থাকল।
ওদিকে, গুনু, পুনু ভালই এ ডাল ও ডাল, মগডাল করছে। পাতলা ডালে বসে দোল খাচ্ছে। ছোট তিনটে পাখির আসা-যাওয়াও চালু আছে। গুনু, পুনু ভারি ডিসিপ্লিনড। তারা শিরীষ গাছেই ওড়া প্র্যাকটিস করে। মস্ত বহরওয়ালা শিরীষ গাছের এ পার ও পার, সে পারের কোনও একটা জোন বেছে নিয়ে, তাদের প্র্যাকটিস আর ট্রেনিং চলে। সেদিন হঠাৎ দেখলাম, টুনু কৃষ্ণচূড়া গাছের ডাল ছেড়ে, সামনের আমগাছ পেরিয়ে, বাস ডিপোর পাশের নারকেল গাছ পর্যন্ত উড়ে গেল। ওখানে বসা একটা কাক, ঝেঁটিয়ে বিদায় করার ভঙ্গিতে টুনুকে তাড়া করল। টুনু কোনওরকমে টালমাটাল করতে করতে কৃষ্ণচূড়া গাছে ফেরত এল। আমার মনে হল, টুনু নিজে নিজেই দূর পর্যন্ত ওড়া প্র্যাকটিস করতে চাইছে। কিছুক্ষণ পর ওর বাবা-মা ফেরত এল। ওদের মধ্যে কী কথা হল জানি না, তবে এরপর টুনুকে আর একা একা এদিক-ওদিক করতে দেখিনি। সে কৃষ্ণচূড়া গাছেই ওড়াউড়ি জারি রেখেছে।
এরমধ্যে আমি একদিন ওই নারকেল গাছে নজর দিলাম। এর জন্য আমায় জানলা বদলাতে হল। শোবার ঘরের জানলা দিয়ে নারকেল গাছগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। টুনু যে গাছটা থেকে তাড়া খেয়েছিল, সেই গাছে দেখি দুটো কাকের ছোট একটা বাচ্চা আছে। বাচ্চাটা খুবই ছোট। এখন টুনুর কৌতূহলের কারণটা বুঝলাম। আর এবার ওই কাকের তাড়া করার কারণও পরিষ্কার হল। এ বাচ্চারও নামকরণ হয়ে গেল, ঘুনু। পাশের নারকেল গাছটায় আরও দুটো বাচ্চা কাকের ওড়াউড়ি প্র্যাকটিস চলছে দেখলাম। এরাও সব ভবিষ্যৎ বন্ধু হিসেবে যথারীতি ফুনু আর বুনু নামে পরিচিত হল। এ প্রসঙ্গে বলি, আমার ছেলের এই টুনু, গুনু, পুনু, ঘুনু, ফুনু, বুনু— এইসব নাম মোটেও পছন্দ হল না। তার মনে হল, এগুলো সব ডাকনাম। তাই তখনই সে এদের একটা করে ভাল নামও দিয়ে ফেলল। যার মধ্যে নুবি, গোকু, কেফলা, নারুটো আরও কী সব জাপানি নাম সামিল ছিল আমার মনে রাখা দুষ্কর!
টুনু কাকের ঘরটাকে আমি প্যালেস বলি। লম্বা সুপারি গাছের শক্তপোক্ত পাতার আড়ে টুনু কাকের ঘর। ঘর থেকে কৃষ্ণচূড়া গাছে পৌঁছনোর জন্য একটা লম্বা সুপারি গাছের পাতার রাস্তা। ঠিক মনে হয় সবুজ রঙের কার্পেট পাতা আছে। ওই সবুজ কার্পেট রাস্তার ওপর দিয়ে টুনু কাকের মা, কৃষ্ণচূড়া ডাল থেকে প্রায় হেঁটে হেঁটেই সুপারি গাছের বাসায় পৌঁছে যায়। টুনু মায়ের পেছনে পেছনে খুব সাবধানে লাফিয়ে লাফিয়ে বাসায় যায়। টুনু কাক লাল কৃষ্ণচূড়া ফুলের কোমল কলি টেনে চিবোতে থাকে মাঝেসাঝে। যতই দেখছি, বুঝছি যে, বাচ্চা কাকেদের ট্রেনিং খুব জোরদার শুরু হয়েছে। ওদের বাবা-মায়েরা খুব স্ট্রিক্টলি সব তত্ত্বাবধান করছে। ছটফটে বাচ্চাগুলোকে যখন ওরা খাওয়ায় আমার দেখতে খুব ভাল লাগে।
একদিন রাতে দেখি, কাকের ঘরের সামনে দিয়ে যে একটা তার গেছে, তার ওপর টুনু বসে আছে। আমার বড় ভয় হল। টুনুটাকে গাছের ডালে বসা অভ্যাস করানোর জন্য আজ রাতভর বাসা থেকে বের করে দেয়নি তো? ওদের জগৎ, ওদের নিয়ম। আমাদের তাতে ঢুকে পড়ার কোনও লাইসেন্স নেই। তবু যেন জড়িয়ে পড়ি! কতকটা কৌতূহলের বশে, আর কতকটা অনেকখানি ভাল লাগার জন্য! যাইহোক, বাড়ির লোকসব বলল, ওটা টুনু নয়। তারে বসে আছে ওর বাবা। কোনও কারণে আজ সামনে বসেই বাসা পাহারা দিচ্ছে। রাত তো কাটল আমার এদের কথায় ভরসা করে। ভোর ভোর উঠেই জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালাম, চোখ চালালাম। অন্ধকার। টুনু, গুনু, পুনু কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। আরও একটু অপেক্ষা করতে হল।
আলো ফুটেছে। সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। শিরীষের পাতা তখনও সব জাগেনি। টুনু কাককে তার মা ঘুরে ঘুরে খাওয়াচ্ছে। কারণ সে এ ডাল ও ডালে নেচে বেড়াচ্ছে। বেশ বুঝলাম, সারারাত বাবা কাকই তারে বসেছিল। ছানা কাক বাসায় বসে দিব্বি ঘুমিয়েছে। নইলে সকাল সকাল এত ফুর্তি আসত কোথা থেকে? ওদিকে গুনু, পুনু লক্ষ্মী হয়ে বসে আছে। তাদের একজনকে বাবা খাওয়াচ্ছে, অন্যজনকে মা। কখনও আবার মা-ই দুজনকে খাওয়াচ্ছে।
এক বিকেলে দেখলাম, কাক আর কাকিনী পুরনো বাসার পাশের ডালে নিবিষ্টমনে ঘোরাফেরা করছে। মনে হল, কাকিনী নতুন বাসা বাঁধার জন্য মনঃস্থির করেছে। পরে একদিন দেখলাম, কাকিনী পুরনো বাসাতেও মাঝেসাঝে এসে বসছে। ভাবলাম পুরনো বাড়ির মালিকানা সে মোটেও ছাড়তে রাজি নয়। সবচেয়ে মজা লাগল, যেদিন দেখলাম, কাকিনী পুরনো বাসা থেকে কাঠি টানার চেষ্টা করছে। হয়তো, কাকিনী কাককে বলে থাকবে, ‘যে নতুন মেটিরিয়াল আনছ আনো। আমি দেখি পুরনোটা দিয়ে যদি কোনও কাজ চালানো যায়।’ আমার মনে হল, এই ছোট্ট প্রাণীরাও কেমন করে বাঁচতে হয় সেটা জানে। ওদের ডিম দুটো নষ্ট হয়ে যাবার পরে, ওরা আবার করে নতুন আশ বেঁধেছে। আমরা কেন তবে যেকোনও দুঃখেই এমন করে ভেঙে পড়ি, যে মনে হয় আর উঠতেই পারব না? কেন আমাদেরই মধ্যের কিছু জন, জীবনটাকেই ‘গুডবাই’ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে? আসলে একটা সময় আমরা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি না বা দেখার কথা ভুলেই যাই।
বৃষ্টি এল। সেদিন বিকেলে বৃষ্টি আসতেই দেখলাম, মা, বাবা, ছানা, জোয়ান, বুড়ো সব কাক আশপাশের সব গাছের মগডালে উঠে পড়েছে। আর আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, ওরা ঘাড় বেঁকিয়ে গাছের পাতা থেকে ঝরে পড়া তাজা জল খাচ্ছে। সে দৃশ্য কোনওদিনও ভোলার নয়। জুলাই মাস পড়েছে। বাচ্চা কাকগুলো বড় হচ্ছে। মা-বাবার সঙ্গে ওরাও উড়তে যায় এখন। বিকেলবেলা ঠিক নিজেদের বাসার আশেপাশে চলে আসে। বেশিরভাগ কাকেদের বাসা গায়েব হবার পথে। ওরা গাছের ডালে বসে রাত কাটাতেও শিখে গেছে। বাচ্চাগুলোর মুখের ভেতরটা এখন সেই পলাশরঙা থেকে হালকা পিচ্ রঙা হতে শুরু করেছে। মা কাক, ছা-দের এখনও বিকেলবেলা আদর করে এটা-ওটা খাইয়ে দেয়। বাবা কাক ঠোঁট দিয়ে বাচ্চার পিঠে সুড়সুড়ি দেয়। বিকেল হলেই অন্য অন্য গাছ থেকে কাকেরা নিজেদের বাচ্চাদের বাস ডিপোর ছাদে নিয়ে আসে। বাচ্চারা খুব হুটোপাটি করে মিলেজুলে। আর হঠাৎ করে আসা বৃষ্টি দেখলেই, সবাই মিলে জলের ট্যাংকের নিচে গা-ঢাকা দেয়।
সময় চলতে থাকে। এখন আমারও আর রোজ জানলায় বসা হয়ে ওঠে না। জীবন কি আর সব সময় জিরোতে দেয়? তবে সারাদিনে কখনও একবার সময় পেলেই, আমি এই কাকেদের দুনিয়ায় নজর দিয়ে নিই। শুধু তো কাক নয়, চড়াই, শালিক, বুলবুল, কোকিল, টিয়া, পায়রা আর বেশ কিছু প্রজাপতিও আছে আমার পর্যবেক্ষণের তালিকায়। আর হ্যাঁ, আজকাল এক-আধটা কাক, আমার হাত থেকেও বিস্কুট নিয়ে যায়। টুপ করে জানালার গ্রিলে এসে বসে, কা কা করে ডাক দেয়। তারপর টপ করে আমার হাত থেকে বিস্কুট নেয়। তবে সব কাক সমান সাহসী নয়। ওরা এত কাছে আসে না। গ্রিলের নিচে যে জায়গা আছে, তাতেই ওদের খাবার দেওয়া হয়। এক এক সময় পায়রাগুলো কাকগুলোকে তাড়া করে। পরে আবার মিলেমিশে নেচেকুঁদে বেড়ায়। সেই ছোট্ট দুই ইঞ্চির পাখিও, খুব ভোরে, আমার গ্রিলের নয়নতারা ফুলের মধু খেতে আসে। বসে শিস দেয় কিছুক্ষণ। ওদের নিয়মে ওদের দুনিয়া চলতে থাকে। আমাদের দুনিয়া, সেই কতকাল থেকে সত্যিই একটা নিয়ম খোঁজার চেষ্টা করছে, তা নেই বলেই আমাদের দুনিয়াতে যত ব্যতিক্রম!!