ঠুনকো আবেগের সমাহারে বেড়ে ওঠা একটা কল্পিত সামাজিক মহীরুহ হল আদর্শ। না যায় তাকে দেখা, না যায় তার ছায়া থেকে বেরনো। প্রয়োজন যখন পিছু নেয় সে তখন পিছন ফিরে দাঁড়ায়। পুরাণে তার উদাহরণ কম নেই। শরীরই অন্তিম তীর্থ, মুখ্য মোক্ষধাম।
ডাক্তারের এই কথাগুলো শুনতে শুনতে আজ বাসবের কথাগুলো বেশ মনে পড়ছে রিয়ার। ড্রিমল্যান্ড নার্সিংহোমের ডক্টরস চেম্বার থেকে বেরিয়ে মনে হল বাইরেটা যেন বসন্তের পাতাঝরা অরণ্য। প্রতিপদে তার পায়ের তলায় শুকনো পাতার মত আর্তনাদ করে উঠছে অধরা মাতৃত্ব।
চাকরি না পেয়ে বিয়ে করবে না— বাবা মারা যাবার পর এই প্রতিজ্ঞা যখন ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে, তখন ব্যাঙ্গালোরে একটা প্রাইভেট কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার ভাস্করের সঙ্গে তার বিয়ে। তার কথা ভাবতে ভাবতে টেনশনেই বাবার প্রেসার দেখা দেয়। তাতেই সব শেষ— ভাবতে গেলেই সময় ও পরিস্থিতির ওপর ভীষণ রাগ হয় ওর। তাও সঙ্গীটা যদি মনের মত হত তাতেও কিছুটা সান্ত্বনা থাকত জীবনে। কিন্তু ভাস্কর যে এমন বেরসিক, তা বিয়ের আগে বুঝতেই পারেনি সে।
তবে তার জন্য ভাস্করকেও পুরো দোষ দেওয়া চলে না, কোম্পানির টার্গেট পূরণ করতে গিয়ে সারাদিন তাকে এত ব্যস্ত থাকতে হয় রিয়াকে সে ফোন পর্যন্ত করার সময় পায় না। সে রোজ রিয়ার কাছে সরি বলে মাফ চায়, আলাপ শুরু করে। পরিস্থিতির চাপে তাদের জীবন এই আপাত স্বদেশি-প্রবাসী আলাপ মেনে নিয়েছে। কিন্তু শরীর? সে তো আর পরিস্থিতির বাধ্য নয়, সে সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির বাধ্য। সে কেবল আলাপ চায় না, আচরণ চায় আলোড়ন চায় উত্তাপ চায়।
বাসবের ফোনে গান বেজে ওঠে, ‘ভালোবেসে সখী, নিভৃতে যতনে…’।
—হ্যালো, কে?
—আমি বলছি।
—আমি কে, আমিটা কোনও পরিচয় নাকি! কলপাড়ে পড়ে যাওয়া বাসনের মত ঝাঁজিয়ে ওঠে বাসব।
—আরে আমি বলছি, রিয়া। নম্বর সেভ নেই আমার?
—ও রিয়া, তাই বল। বেশ লজ্জায় পড়ে গেছে বাসব। মাস ছয়েক আগে রিয়ার একটা প্রচ্ছন্ন হুমকির পরে রিয়ার নম্বর ডিলিট করে দিয়েছিল সে। তবে সুতপার ফোনে হ্যাঁ, না, ঠিক, হুম্ গোছের কিছু কথা হয়েছে এর মধ্যে।
—আমি তো কলেজে, তুই সুতপার ফোনে ফোন কর।
—দরকারটা তো তোমার কাছে।
—আমার কাছে? একটা আলতো অভিমান প্রশ্নের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
—হ্যাঁ তোমার কাছেই। বেশ আর্দ্রতা রিয়ার গলায়।
—কী, বল।
—আমায় ক’দিন সময় দেবে। খাঁচার পাখির ডানা ঝাপটানোর মত একটা অসহায় আর্তনাদ যেন মিনতির স্বরে ভেসে এল।
—মানে!
—মানে বলতে গেলে তো তোমাকেই প্রশ্ন করতে হয়।
—কী, কী প্রশ্ন? বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠছে বাসব।
—আচ্ছা, তুমি টিচার না ডাক্তার?
—কেন রে?
—আজ ডাক্তার দেখাতে এসেছিলাম। তোমার কথার সাথে ডাক্তারের কথা সব মিলে যাচ্ছে। তাই বলছিলাম।
—সময় চাইবি, আবার বান্ধবীকে বলে দেবার ভয়ও দেখাবি। পারিস বটে।
—না না সত্যি বলছি, বলব না। সব চাঁদ যে বৃথা যায় রাধে, আর কবে বুঝিবি… রিয়ার ভিতরে যেন ধ্রুপদী হয়ে উঠছে কথাগুলো।
—গরিবের কথা বাসি হলে কাজে লাগে। আচ্ছা, এখন আমার ক্লাস আছে, পরে কথা হবে।
—আচ্ছা, ঠিক আছে, তবে মাথায় রেখো। বাই…
বাই বলল বটে, কিন্তু মন থেকে বাসবকে দূরে ঠেলতে পারছে না রিয়া। ভাবি সাক্ষাতের মুহূর্তগুলো কেমন হবে সেই ভাবনায় ডানা মেলে তাকে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে ভাস্কর নেই। সে জায়গা তার বড় অচেনা।
বাসব ক্লাসে ঢুকেছে। চেনা মুখগুলোর ওপরে বারবার রিয়ার মুখ ছায়া ফেলছে। মাঝেমাঝে কেটে যাচ্ছে পড়ানোর ছন্দ। অন্যদিনের মত আজ যেন ভিতর থেকে পড়াতে পারছে না সে। ছেলেমেয়েগুলো গুনগুন করতে শুরু করেছে। একসময় তার গলা তলিয়ে গেল ওদের উচ্ছ্বসিত গুনগুনের নীচে।
রিয়া বাসবের স্ত্রী সুতপার বান্ধবী। কলেজের পার্টটাইম লেকচারার হিসাবে জয়েন করার পাঁচ বছর পর সুতপার সঙ্গে বাসবের বিয়ে হয়। তখন সুতপার বয়স তেইশ। এমএ ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। বিয়ের দু’বছরের মধ্যে ছেলে। ছেলের এখন ক্লাস থ্রি। দ্বিতীয় বাচ্চার প্ল্যানিং চলছে। একসঙ্গে তারা একটা দশক পার করে ফেলেছে।
সেই বিয়ের দেখাশোনা থেকে আজ পর্যন্ত রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কটাতেও বেশ অন্য মাত্রার একটা রসায়ন তৈরি হয়েছে। একটু ঠাট্টাতামাসা, হালকা গা গরম করা কথা চলেই আসছিল। কিন্তু বিয়ের পর ভাস্করের বাড়ি না থাকাটা তাদের আলোচনাকে আপাতদৃষ্টিতে সন্দেহের দিকে গড়িয়ে দেয়। রিয়া প্রথমে এটা হালকাভাবে নিত, কিন্তু সামাজিক চোখকে মান্যতা দিতে আর পাঁচটা মেয়ের মত সেও দাঁতনখ বের করে ফেলে। কিন্তু বাসবের কথাগুলো যে ঠিক ছিল, এখন সে বেশ টের পাচ্ছে।
কেরিয়ারের কথা ভাবতে গিয়ে জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রবেশ করতে বেশ দেরি হয়ে গেছে তার। ডাক্তারের কথায় আজ অন্তত সেটাই বুঝল রিয়া। কাঁচাপাকা চুলের ডাক্তারবাবুর কথা বেশ মিষ্টি। বেশ গুছিয়ে বুঝিয়ে কথা বলেন।
—দেখো মা, ন্যায়, নীতি, আদর্শ, ভাল-মন্দ, পাপ-পুণ্য এগুলো মানুষের বানানো। এগুলোর বিচ্যুতি হলে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়, ক্ষমাও করে। কিন্তু প্রকৃতির ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু নেই। তাঁর তিনটি দিক— সৃষ্টি স্থিতি আর প্রলয়। সব মিলেই সে গড, জি ও ডি— জেরারেট, অপারেট অ্যান্ড ডেস্ট্রয়েট। এর মধ্যে ক্ষমার কোনও জায়গা নেই। বুঝলে?
—না, মানে একটু যদি ক্লিয়ার করেন।
—তোমার হাসব্যান্ড কী করেন?
—ও ব্যাঙ্গালোরে একটা কোম্পানিতে কাজ করে। ইঞ্জিনিয়ার।
—বুঝেছি, ছুটি কম। কিন্তু যা চাইছ তার জন্যে যে তার ছুটি নেওয়াটা খুব জরুরি মা।
—তা তো সম্ভব হচ্ছে না। বেশি ছুটি চাইতে গেলেই কোম্পানি রিজাইন দিতে বলছে। এই সময় কাজের যা বাজার, ওটা হবে না ডাক্তারবাবু।
—তবে তুমি তার কাছে গিয়ে থাকো।
—তাও তো হচ্ছে না, শ্বশুর-শাশুড়ি রয়েছেন।
—বিশ্বস্ত বন্ধু কেউ আছে?
—কেন?
—দেখো, এই যে তোমার অনিয়মিত ঋতু সংবাদ। তার কারণ কি জানো?
—না।
—শোনো, প্রকৃতি সৃষ্টি করে তার প্রয়োজনে। তুমি আমি আমরা প্রত্যেকেই তার অধীন। তার নিয়মে চালিত হই। তুমি ঋতুবতী হয়েছ নয় নয় করে কুড়ি বছর। প্রকৃতি তার নতুন অতিথি আনার কাজ তখন থেকে শুরু করে দিয়েছে। নিজের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তাকে অস্বীকার করেছ। এখন প্রকৃতি তার অন্তিম কাজ শুরু করে দিয়েছে।
শুনে রিয়ার বুকটা ধড়াস করে ওঠে।
—এইভাবে অনিয়মিত হতে হতে একদিন সে তোমার কাছ থেকে বিদায় নেবে। ওই যে বললাম না, প্রকৃতি ক্ষমা জানে না। কী জানো মা, আমরা ভাবি, আমাদের জীবন আমাদের ইচ্ছেমত চলে। তা কিন্তু নয়। আমাদের জীবন আমাদের ইচ্ছের দাস নয়। সে প্রকৃতির দাস। ইচ্ছে নয় জৈবরসায়ন। জৈবরসায়নই জীবনের শেষকথা। শরীরই অন্তিম তীর্থ, মুখ্য মোক্ষধাম। তার জন্যেই খাবার খেতে হয়, আবার ওষুধও খেতে হয়। মন নয় মা, হর্মোনই আসল কথা। এখন তোমার ওষুধের চাইতে পুরুষসঙ্গই বেশি প্রয়োজন। আর তার ফলেই খুলে যাবে সমস্ত উৎসগ্রন্থির মুখ। এখন সেই সব গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত অমৃতধারাই তোমাকে, তোমার ঋতু, তোমার ডিম্বাণু- সব— সব কিছুকে রক্ষা করতে পারে। তাই আদর্শ নয় মা, তোমার এখন বন্ধু প্রয়োজন। তবে কি জানো, তুমি একা নও, তোমার মত এমন কেস এখন প্রায়ই আসছে। ডাক্তরি করি বটে, তবে এখন ওষুধ লেখার চাইতে কাউন্সিলিং করতে হচ্ছে বেশি। তুমি বাচ্চার জন্যে এসেছ। অনেকে তো সে পথে হাঁটতেই চাচ্ছে না। ওষুধ দিলাম, পরামর্শটা মাথায় রেখো। এসো।
রিয়া বাড়ি ফিরে স্নান করে নিজের ঘরে। অন্যদিনের মতো স্নানের পরে আজ আর তার সাজতে ইচ্ছে করল না। বিছানায় গড়িয়ে গেল। পুরনো রিয়ার সঙ্গে আজকের রিয়ার তুমুল লড়াই চলছে সেখানে। স্নান করে এসেও আজ নিজেকে মেঘের সম্ভাবনাহীন শেষ হেমন্তের রুক্ষ আকাশ বলে মনে হচ্ছে।
ভাইব্রেট করা ফোনটা ড্রেসিংটেবিলের ওপর মৃদু কাঁপন তুলে দ্রুতপায়ে আদর্শ, লজ্জা, ভয় সব কিছুকে মাড়িয়ে-পাড়িয়ে রিয়াকে কোথাও বের করে নিয়ে যেতে চাইছে। নিশ্চয়ই বাসবের ফোন! উঠে ফোনটা ছুঁতেই মৃদু কম্পনে সারা শরীরে একটা শিরশিরে বিদ্যুৎ যেন ওর সমস্ত গ্রন্থিমুখের কপাট খুলে দিয়ে গেল। ও দেখল কালো অক্ষরে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বাসব নয়, ভাস্কর। আজীবনের অবিচ্ছেদ্য প্রিয়জন, কিন্তু প্রয়োজনের অধরা ঊর্ধ্বলোকে তার অবস্থান। তাই আপাতত কাঙ্ক্ষিত নয়।
—হ্যালো।
—হ্যাঁ, বলো।
—ঘুমাচ্ছিলে?
—না, ওই একটু শুয়েছিলাম।
—ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে?
—হুঁ।
—কী বললেন?
—ওষুধ দিয়েছেন। রিয়া দায়সারা আলাপ সারে।
—বাবা-মা কেমন আছে?
—ভালই তো মনে হয়।
—আমি সামনের সপ্তায় চারদিনের ছুটিতে বাড়ি আসছি।
—এসো।
—আচ্ছা, একটা ফোন রিসিভ করতে হবে, রাখছি, রাতে কথা হবে। ওষুধ খেয়ো, ভাল…
কথা শেষ হবার আগেই ফোনটা নামিয়ে রাখল রিয়া। একটা রুক্ষতা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তাকে। হাতের দিকে তাকাল। আয়নার সামনে গিয়ে মুখের দিকে তাকাল। ভিতর-বাইরে সব জায়গায় কেমন যেন রুক্ষতার আড়ষ্টতা। এখন একমাত্র একটা সন্তানের কোমল স্পর্শ, বুকে দুধের ভার তাকে নতুন করে বাঁচাতে পারে। তার জন্য এখন একটা শরীর চাই। আত্মগত একটা নতুন শরীর নির্মাণের জন্য আর একটা কাঙ্ক্ষিত শরীর। উদ্ভুত প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্তির জন্য বন্ধু চাই তার। সে ভাস্করই হোক বা বাসব বা অন্য কেউ— কোনও ফারাক পড়ে না। এ কাজে বাসব ছাড়া বিশ্বস্ত আর তেমন কেউ নেই। না কথাটা একেবারে সোজাসাপটা এমন নয়। আসলে এ বিষয়টা নিয়ে বাসবের দু’কান করার সম্ভাবনা কম। কারণ সে কলেজে পড়ায়। সেখানে একটা সম্মানের বিষয় যেমন আছে, সুতপাও তেমনি এটা জানলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে ছাড়বে। তাই বাসব। পরকীয়ার প্রিয়তম নয়, প্রয়োজনের প্রিয়জন।
ফোন রেখে আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে একটা আলতো আচ্ছন্নতায় আবিষ্ট হয়ে পড়ে রিয়া। ঠিক ঘুম নয় যেন ঘুমের ছদ্মবেশ। স্বপ্নটাও অনুরূপ।
উল্টোডাঙা থেকে অটো চলেছে সেন্ট্রাল পার্কের দিকে। বাসবের পিঠের দিকে অটোর সিটের ওপর দিয়ে রিয়ার বাম হাতটা লতার মত উঠে গেছে বাসবের বামদিকের কাঁধে। সেখানে কানে চিবুকে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে দু’তিনটে অনুরক্ত আঙুল। নিজের সবটুকু ভার বাসবের ওপর ঢেলে দিয়ে তাকে জড়িয়ে আছে রিয়া। ডান হাতটা বাসবের উরুর ওপর আলতো কুণ্ডলিত হাতদুটোর মধ্যে। রিয়া বুঝতে পারছে হাতটা ঘেমে উঠছে। এক এক করে খুলে যাচ্ছে দীর্ঘদিন অযত্নের আড়ালে থেকে থেকে ক্রমে শুকিয়ে আসা গ্রন্থিসমূহের উৎসমুখ। জিনের অনাবৃষ্টির উত্তর আকাশে মেঘ জমছে আবার। সেন্ট্রাল পার্কের উল্টোদিকে অটো থেকে নামার সময় তার মনে হল, সে যেন আর বছর তেত্রিশের রিয়া নয়। বছর তেইশের এক উচ্ছল নদী। সে আর শুকিয়ে যাবে না। ইহলোকের অলকানন্দার হিমবাহ আবার গলতে শুরু করেছে। এখনি তার মত ভেসে যাবে সব, পিছলে যাবে পথ। সে নামতে ভয় পাচ্ছে।
হঠাৎ শরীরটা দুলে ওঠে। ঘুম ভেঙে গেছে। বুঝল স্বপ্ন। কিন্তু অনেকটাই সত্যি হয়ে উঠেছে এর মধ্যে। মনে পড়ল কলেজে সাইকোলজি ক্লাসে— স্বপ্ন কী তা বোঝাতে গিয়ে সুরঙ্গনা ম্যাম বলেছিলেন— অবচেতনের ভাবনারা সত্যি হয়ে যে বিনে পয়সার সিনেমা দেখায়, তাইই স্বপ্ন। আজ সেটা তার কাছে মোক্ষম। ড্রেসিংটেবিলে ফোনটা আবার নেচে নেচে তার দিকে এগোচ্ছে।