নির্মল হালদার লিখেছিলেন:
‘আমার কাছে কোনদিন কিছুই ছিল না
আজও কিছু নেই, শুধু
পথে পথে ঘুরে বেড়াই
ঘুরতে ঘুরতে তার কাছে গেলে সে আমাকে দেয়
মুঠোভরা আমলকী।’
রিমঝিম আমলকী দেয়নি। চৈত্র মাসের এক তপ্ত দুপুরে শালবনের ভেতর রিমঝিম আমাকে এগিয়ে দিল অদ্ভুত এক ঘষামাজার জিনিস। এই দিয়ে কী করব? রিমঝিম তার উত্তর দিল শিশুর ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে, ‘পরিসসকার’।
বউনি হয়ে গেল রিমঝিমের, চলে গেল শালবনের গভীরে। আমি হাতে একটা শব্দ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম: ‘পরিসসকার’। আর একটা নাম ‘রিমঝিম’।
অদূরে, বনের পুকুরডাঙা গ্রামে বাড়ি। বয়স খুব বেশি হলে পাঁচ বছর। ওকে বলতে ইচ্ছে হল, আমি কাল বাড়ি চলে যাচ্ছি রিমঝিম। অনায়াসে বলা যেত। কিছুই বুঝত না হয়তো। তবে বোঝানোর কী প্রয়োজন আমার? আমি তো শুধু বলতে চাইছিলাম, ‘কাল আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি, রিমঝিম।’
রাতের বেলা খেতে গেলাম একটা ঝুপড়িতে। আলু-পটলের তরকারি ফুরিয়ে গেছে আজ। দেরি হয়েছে, তাই শুধু সোয়াবিন। ভাত ঠান্ডা হয়ে গেছে। ডিম ভাজার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে দূর থেকে। মাথা নীচু করে একমনে খেতে শুরু করলাম। মনের ভেতর এক অদ্ভুত প্রশ্ন কেমন পুড়িয়ে চলেছে। কেন যা কিছু এত প্রিয় লাগে তা সবচেয়ে দ্রুত ফুরিয়ে যায়। শৈশব। প্রিয় মানুষ। ভাল লাগার এক একটি জায়গা।
বসন্তের মাতাল হাওয়া পাঞ্জাবির ভেতর থেকে শরীরকে স্নিগ্ধ করে যাচ্ছে। সন্ধে থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। তালতোড়ের অন্ধকারে বসেছিলাম সন্ধের রেলগাড়ি দেখব বলে। দূর থেকে রেলগাড়ির আলো এবং তার ভেতরে কত অপরিচিত মানুষ। কোথায় তাদের বাড়ি? কী নাম? সৃষ্টিকর্তা তাদের কখনও জানাবেন না যে আজ এই যাত্রাপথে দুটি চোখ তাদের লিখে নিচ্ছে ভেতরে। তাদের মুখ, বসার ভঙ্গি এমনকী তাদের ভেতরের আনন্দ, বিষাদটুকু।
ঝুপড়ির দিদি এসে আর একটু ভাত ঢেলে দিলেন পাতে। গরম ভাত। বললেন, ‘পরিসসকার করে খাব্বে।’ ‘পরিসসকার’। মনে পড়ল রিমঝিমের কথা। সে এখন হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ বউনিতে সে আমাকে একটি শব্দ দিয়ে গেছে, ‘পরিসসকার’।
ঝুপড়ির বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের দিদিকে বলতে ইচ্ছে হল, ‘কাল আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি, দিদি।’ বলা হল না। টাকা মিটিয়ে নীরবে নেমে এলাম বনের রাস্তায়।
খালপাড়ের একটা বাড়িতে মৃত্যু এসে দাঁড়িয়েছে সকাল সকাল। চারিদিকে থমথমে মুখ। সকাল থেকে এই পথে অনেকবার যাতায়াত করেছি। প্রত্যেকবার একটি মুখের কাছে দুটো চোখ আটকে গেছে। একটি তেরো-চোদ্দো বছরের মেয়ে। কালো মুখের ওপর অপূর্ব দুটি চোখ, গভীর। গলার কাছে কী ভীষণ একটা কষ্ট যেন দলা পাকিয়ে আছে। চোখদুটি আশ্চর্য নির্লিপ্ত।
তাকে লক্ষ করি। প্রতিবার সেই মৃত্যুর পটভূমিতে বারবার তার ওপরেই চোখ আটকে যায়। একটি তেরো-চোদ্দো বছরের ছিপছিপে মেয়ে। দুচোখ দিয়ে সামনে মৃত্যুর ফেলে যাওয়া পরিবেশকে দেখছে। চারিদিকে কান্নার পরিবেশের মধ্যে তার সেই তেরো-চোদ্দো বছরের শরীর। বনের পথের মত। যে পথে প্রতিদিন রাতের বেলা যাই একটা কিছুর সন্ধানে।
মনে হল সেই সকলের মাঝে গিয়ে বসি। তাদের শোকের মাঝে গিয়ে। আগুন জ্বালিয়ে কোনওক্রমে যা রান্না করেছেন তারা শুধু পেট ভরিয়ে রাখার জন্য, মনে হল গিয়ে খাই। হাতে লেগে থাকুক সেই এঁটো। বলি, সেই তেরো-চোদ্দো বছর বয়সী মেয়েটিকে, ‘কাল বাড়ি ফিরে যাচ্ছি, মেয়ে।’ বলা হল না। কাউকে কখনও বলা হয়ে ওঠে না বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা।
মৃত্যুর সাদা কাপড়ের মত জ্যোৎস্নায় এক বনভূমি থেকে পার হয়ে যেতে থাকি অন্য বনভূমি। এক প্রবাস থেকে অন্য প্রবাস। আর সকলকে বলতে চাই, ‘কাল বাড়ি ফিরে যাচ্ছি,ফিরে যাচ্ছি গো।’
কোথাও ফেরা হয় না আমার। শুধু পথের পর পথ। রিমিঝিমের অস্পষ্ট উচ্চারণে একটা শব্দ কেমন শরীরের ভেতর লেগে থাকে অথবা অপমানিত হয়। ‘পরিসসকার’।
অতিরিক্ত ভাতটুকু গরম ছিল। রিমঝিম হাতে ঘষামাজার জিনিস ধরিয়ে দিয়ে বউনি করল। এক শরীর মৃত্যু নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল একটি তেরো-চোদ্দো বছরের মেয়ে।
এদিকে কবি নির্মল হালদার লিখলেন:
‘আমার কাছে কোনদিন কিছুই ছিল না
আজও কিছু নেই, শুধু
পথে পথে ঘুরে বেড়াই
ঘুরতে ঘুরতে তার কাছে গেলে সে আমাকে দেয়
মুঠোভরা আমলকী।’