ভেবেছি, মেয়ে হলে গুনগুন বলে ডাকব। শব্দটা মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। কোনও ব্যাখ্যা যেমন উদাহরণ দিয়ে বোঝালে তা বুঝতে সুবিধা হয়, এই শব্দটাও তেমন। মানে, কাকে গুনগুন বলে, শব্দটার ভার কী, এসবই বুঝতে শিখেছি উদাহরণের মাধ্যমে। তারপর আমার জন্ম চলেছে… হেঁটেছে… ওগো দেবতা আমার, জন্মের পরে মানুষ পরাধীন নয়, অধীন হয়।
বাংলা ভাষাকে আমি মন্ত্রভাষা বলে মানি। সেখানে ছায়া আছে, পাখি আছে, মায়ের থানকাপড়ের গন্ধ আছে, দাদুর নারকেল দড়ির খাটিয়া আছে, ঠাকুরদেব্তার গল্প আছে, তেলমালিশ, ভোরের গান, সাঁঝের গান… তুলসীতলার নিবিড় স্নান— সবই আছে। আর আছে শ্রাবণ মাস, যে মাসে জন্ম আমার। তখন মশারিটা উড়তে চেষ্টা করছিল। মশারিতে খেলছিল আমি নামের ছেলেটা। তার মা তাকে গান শোনাচ্ছিল, ‘এই আসনে তুমি করো আগমন/ বলো কোথায় তুমি/ ওগো নারায়ণ…’। শিশু নারায়ণ; যার দু’টি কান, একটি নাক আর একটিমাত্র মুখ আছে। প্রতিটি অঙ্গই ছিদ্রময়, তেজি এবং প্রখরও বটে। তার বেড়ে ওঠার জন্য তখন ছিদ্রই মুখ্য। হাওয়া-বাতাস, ধূলি-বালি, শব্দ-অক্ষর, গাল-গান, খুসবু-বদবু, স্বরব্যঞ্জনবর্ণ, বর্ণাতীত শব্দ যা কিছু শিশুটির চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে, ওই ছিদ্রগুলির কাছে তাৎপর্য আছে তাদের। এগুলি প্রতিদিন প্রবাহিত, যা চেতনা গড়ার কারিগর। শিশুর সামনে গঞ্জনা করলেও সে তোতাপাখির মত হরবোলা, আবার গুঞ্জন করলেও তা-ই; সহজ অবস্থান।
আমার দিদা একটা ছড়া শোনাত আমায়—
‘যমুনাবতী সরস্বতী, কাল যমুনার বিয়ে।
যমুনা যাবেন শ্বশুরবাড়ি কাজিতলা দিয়ে॥
কাজিফুল কুড়োতে পেয়ে গেলুম মালা।
হাত-ঝুম্-ঝুম্ পা-ঝুম্-ঝুম্ সীতারামের খেলা॥
নাচো তো সীতারাম কাঁকাল বেঁকিয়ে।
আলোচাল দেব টাপাল ভরিয়ে॥
আলোচাল খেতে খেতে গলা হল কাঠ।
হেথায় তো জল নেই, ত্রিপূর্ণির ঘাট॥
ত্রিপূর্ণির ঘাটে দুটো মাছ ভেসেছে।
একটি নিলেন গুরুঠাকুর, একটি নিলেন কে।
তার বোনকে বিয়ে করি ওড়ফুল দিয়ে॥
ওড়ফুল কুড়োতে হয়ে গেল বেলা।
তার বোনকে বিয়ে করি ঠিক-দুক্ষুর বেলা॥’
পরে আবিষ্কার করেছি, এই ছড়ার সংগ্রাহক রবি ঠাকুর। দিদা রবীন্দ্রনাথ পড়েনি। সে সুর করে পাঠ করত এই ছড়া। ত্রিপূর্ণির ঘাট কী জানতে চাইলে বলত আগ্রার যমুনা নদীর কথা। তাজমহলের কথা। তাজমহলের পাশ ঘেঁষে যমুনা বয়ে গেছে। নদীর ধারে শ্মশান ছিল। ওখানে দিদার মাকে দাহ করা হয়েছিল। সীতারামের খেলার কথা জিজ্ঞেস করলে আমায় নিয়ে যেত পাশের বস্তির শিবমন্দিরের কাছে। শ্রাবণে ওখানে কাঠের ঘোড়া করে একজন কোমর দুলিয়ে বেমালুম নাচত, লোকে পয়সা দিত। স্বপ্নের মত লাগত সেইসব। বোম শিব… বাবা তারকনাথের চরণের সেবালাগে… তারকেশ্বর থেকে আসা গামছা গায়ে জড়ানো ভিখারিনী… সবই তো সুর। এমন সুর ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে মামার বাড়ির বেড়ার ঘরে যাবার স্বপ্ন দেখতাম।
মা বলে, আমি যখন মাত্র দেড় বছর, দাদু আমায় চিড়িয়া মোড় থেকে বিরাটি নিয়ে যেত সাইকেলরিকশা করে। আমি নাকি রিকশা দেখলেই আঙুল বাড়াতাম। তাই ‘বেয়ু বেয়ু’ চরৈবেতি… রিকশাওলা প্যাডেলে পা দিতেই প্যাঁচপুঁচ শব্দ, তারপর হাঁসের ডাকের মত সুর করে ডাকতে ডাকতে রিকশা ছুটত। সাঁইত্রিশে এইসব মনে পড়ে। লেখার শুরুতে বলেছিলাম দাদুর নারকেল দড়ির খাটিয়ার কথা। ওখানে আমায় শুইয়ে তেলমালিশ করানো হত। কাঁথা মুড়ে দিয়ে যে বালিশ তৈরি করা হত, সেখানে মাথা দিতাম। তারপর শুরু হত মালিশ আর হরগৌরীর কথা। দিদা পাশ থেকে টিটকিরি কেটে বলে যেত, ‘দেখো, আবার নাতিকে শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর তৈরি কোরো না’।
এভাবেই শুনেছিলাম একান্ন খণ্ড সতীর কথা, গণেশের হাতিমুখো হয়ে যাবার গল্প, সমুদ্রমন্থনের কথা আরও কত কী… আর মা যখন খাওয়াতে বসত, তখন ফন্দিফিকির করে গান গেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বাবাবাছা করে অনেক চেষ্টা করেও সফল হত না যখন, বলত— শেয়ানা ঘুঘুর ছা, ফাঁদে দেয় না পা… হা হা হা… এখন নিজেকে শিকলকাটা টিয়া মনে হয়, যে পোষ মানে না। শিকল ভেঙে গেছে আমার দিদা মরে যাবার পর থেকে। যখন তাজমহল গিয়েছিলাম, শুক্রবার ছিল, মাত্র বারো বছর বয়স। একদল গোল হয়ে বসে অচেনা ভাষায় গান গাইছিল… সুফি… যমুনা পাড়ের শ্মশানের কথা মনে পড়েছিল সেদিন।
দিদা একদিন বলেছিল, ‘আমি মরে গেলে রতনবাবুর ঘাটে পোড়াস, কীর্তন আনিস…।’ সবটাই মহি-মা-র সুর… শতং বদ মা লিখ…