‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’, ‘অশনি-সংকেত’, ‘আরণ্যক’। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় যেন তাঁর পাঠকদের জানাচ্ছেন, ‘দ্যাখো, একটা যুগ ক্ষয়ে যাচ্ছে, একটা সমাজ ক্ষয়ে যাচ্ছে, একদল মানুষ ক্ষয়ে যাচ্ছে’ আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি এও জানাচ্ছেন, ‘দ্যাখো, একটা নতুন যুগ আসছে, একটা নতুন সমাজ আসছে, একদল নতুন মানুষ আসছে’। ইন্দিরা ঠাকরুন সেই পুরনো সমাজের প্রতিনিধি আর অপু নতুনের। হরিহর আর সর্বজয়া যেন সেই পরিবর্তনের মধ্যে দাঁড়ানো জীবন্ত সাক্ষী। সমাজের ভাঙা-গড়ার এই ছবি তাঁর ওই চারটি উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য। প্রধান উপজীব্য মানুষ। মানুষের ক্ষুধা আর ক্ষুন্নিবৃত্তি, মানুষের বাঁচার সংগ্রাম, মানুষের ছোট স্বপ্ন এবং আশা আর নিষ্ঠুর আশাভঙ্গ অথবা ইচ্ছেপূরণ। হতে পারে প্রধান চরিত্রেরা খেটেখাওয়া মানুষ, কৃষক-মজুর নন, তাঁরা নিতান্তই পরজীবী ফলারে বামুন বা অরণ্যের আদিবাসী রাজা। তবু সমাজের রূঢ় বাস্তবের ছবি ফুটে ওঠে।
কিন্তু তাবড় সাহিত্য-সমালোচক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই দিকটি এড়িয়ে গিয়েই যেন স্বস্তি পেয়েছেন। প্রকৃতিপ্রেমী, শিশু মনস্তত্ত্বর কারবারি বা মিস্টিক— এমনই সব তকমা জুটেছে কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণের ভাগ্যে। সেই তকমাতে ভুলেই প্রজন্মর পর প্রজন্ম বাঙালি বিভূতিভূষণ পড়েছেন, সেই তকমার প্রভাবে চাপা পড়ে গেছেন নিশ্চিন্দিপুরের মানুষেরা, বড় হয়ে ওঠে গ্রামবাংলার প্রকৃতির বর্ণনা। অরণ্যর বর্ণনাই হয়ে ওঠে প্রধান, আড়ালে চলে যায় সেই মানুষ যিনি অরণ্যে ফুলগাছ লাগাতেন কিংবা রাজকুমারী ভানুমতী অথবা আদিবাসী রাজা।
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর ‘বিভূতিভূষণ ও কথাসাহিত্যে বাস্তববাদ’ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বেরিয়েছে এপ্রিল ২০২১-এ। বইটি বিভূতিভূষণের ওপরে লেখা রামকৃষ্ণবাবুর বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধের সংকলন। এই সংস্করণে আগের সংস্করণের প্রবন্ধগুলি ছাড়াও আরও কয়েকটি প্রবন্ধ যোগ হয়েছে।
‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’, ‘অশনি-সংকেত’ মূলত এই তিনটি উপন্যাস ধরেই রামকৃষ্ণবাবু আলোচনা চালিয়েছেন। তাতে ক্ষতি কিছু নেই। লেখক জানিয়েছেন, ‘যে কটি রচনা ধরে খুঁটিয়ে আলোচনা করেছি সেগুলিই বিভূতিভূষণের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্বর প্রতিনিধি। আদর্শ হিন্দু হোটেল বা ওই ধরনের বই-এ অবশ্যই বাস্তববাদ আছে। কিন্তু আলোচনায় সেগুলি আনলেও মূল সিদ্ধান্তর ইতরবিশেষ হত না।’’ বিভূতিভূষণের কথাসাহিত্যে বাস্তববাদ নিয়ে লেখা এগিয়েছে ভারি মনোজ্ঞ-সুখপাঠ্য ভাষায়, ছোট ছোট প্রবন্ধে ভাগ করে। কোথাও কোনও না-বোঝার জায়গা বা ধোঁয়াশা নেই। প্রচুর উদাহরণ দিয়ে লেখক প্রমাণ করেছেন বিভূতিভূষণ শুধুই প্রকৃতিপ্রেমী নন, তিনি বাস্তববাদেরও একজন নিখুঁত শিল্পী। বইটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও একবার যেন নতুন করে পড়া হয়ে যায় বিভূতিভূষণের কালজয়ী সৃষ্টিগুলিকে।
রামকৃষ্ণবাবুর চিন্তার মূল সুরটি ধরা পড়ে বইটির এই লাইনগুলিতে, ‘‘মূর্তির পেছনে বড় একটা চালচিত্র রাখাই রীতি। দুর্গা, অসুর, লক্ষ্মী, সরস্বতী ইত্যাদির প্রতিমাকে রাখা হয় তার সামনে। ‘পথের পাঁচালী’-তেও তেমনি হরিহর-সর্বজয়া-দুর্গা-অপুর পেছনে একটা চালচিত্র থাকে— নিশ্চিন্দিপুরের জীবনযাত্রা। সেটি না খেয়াল করলে দেখার ঘাটতি থেকে যায়।
অজস্র ঘটনা ও ছোটখাটো চরিত্র সার বেঁধে এসেছে এই উপন্যাসে। মূল গল্প ও চরিত্রদের সঙ্গে তাদের যোগ নামমাত্র। কিন্তু উপন্যাসের পরিবেশ গড়ে দেয় তারাই। তাদের দৌলতেই উপন্যাসের ব্যাপ্তি আসে। শুধু অপুর বা তার পরিবার নয়— রোজকার জীবনের ছবিও ধরা পড়ে অনেক ছড়িয়ে। অপুর নিজস্ব নিষ্পাপ জগতের ঠিক উল্টো জগৎটা দেখা দেয় খুবই স্পষ্ট চেহারায়। এই দু জগতের দ্বন্দ্বই ‘পথের পাঁচালী’-কে অন্য এক ধরনের মহিমা দেয়।” (পৃষ্ঠা ৭৪)।
বিভূতিভূষণের এই সুরটিকে সঠিকভাবেই ধরেছিলেন সত্যজিৎ রায়। পছন্দ হয়নি অনেক কৃতবিদ্য সাহিত্য সমালোচকের। তাঁদের ধারণার বিভূতিভূষণ যেন গরহাজির এই চলচ্চিত্রে। প্রমথনাথ বিশী লিখেছিলেন, ‘নিতান্ত পরিতাপের বিষয় এই যে পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রে এই (কবিত্ব) গুণটির নিতান্ত অভাব। তাতে দারিদ্র্যের কঙ্কালটাকে ফলাও করে দেখানো হয়েছে… দেহের প্রাণ ও লাবণ্য বাদ দিয়ে শুধু নীরস কঙ্কালটাকে যদি দেহ বলা চলে, তবে পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রটিকে পথের পাঁচালী গ্রন্থ বলা যেতে পারে।” (পৃষ্ঠা ২২)। রামকৃষ্ণবাবু কিন্তু এইসব সমালোচনার বিরুদ্ধে চলচ্চিত্রকারের সঙ্গেই সহমত হয়েছেন। নিছকই ‘কবিত্ব’ করা কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ নন। লেখক স্পষ্ট দেখিয়েছেন, ‘ক্ষুধা আর ক্ষুন্নিবৃত্তি থেকেই তো বিভূতিভূষণের সৃষ্টির সূচনা’। (পৃষ্ঠা ২৩)।
বিভূতিভূষণ নিজে কী ভাবতেন এ ব্যাপারে, সে-কথাও হাজির করা হয়েছে এই বইতে, ‘মানুষের সত্যিকারের ইতিহাস কোথায় লেখা আছে? জগতের বড়ো বড়ো ঐতিহাসিকগণ যুদ্ধ-বিদ্রোহের ঝঞ্ঝনায় সম্রট্ সম্রাজ্ঞী সেনাপতি মন্ত্রীদের সোনালি পোশাকের জাঁকজমকে দরিদ্র গৃহস্থের কথা ভুলে গিয়েছেন। পথের ধারে আম গাছে তাদের পুঁটলিবাঁধা ছাতু কবে ফুরিয়ে গেল, কবে তার শিশুপুত্র প্রথম পাখী দেখে আনন্দে মুগ্ধ হয়ে ডাগর শিশুচোখে চেয়েছিল, সন্ধ্যায় ঘোড়ার হাট থেকে ঘোড়া কিনে এনে পল্লীর মধ্যবিত্ত ছেলে তার মায়ের মনে কোথায় ঢেউ বইয়েছিল দুহাজার বছরের ইতিহাসে সে সব কথা লেখা নেই— থাকলেও বড় কম।… কিন্তু গ্রীসের ও রোমের যব ও গম ক্ষেতের ধারে ওলিভ্ বন্যদ্রাক্ষার ঝোপের ছায়ায় ছায়ায় যে দৈনন্দিন জীবন হাজার হাজার বছর ধরে সকাল-সন্ধ্যা যাপিত হয়েছে— তাদের সুখদুঃখ আশা-নিরাশার জন্ম তাদের বুকের স্পন্দনের ইতিহাস আমি জানতে চাই।’ (পৃষ্ঠা ১২৪)।
গোর্কি, চেখভ, রবীন্দ্রনাথ, প্রেমেন্দ্র মিত্রর সাহিত্যের বাস্তববাদও বিভূতিভূষণকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তিনি লেখেন, ‘আরও সূক্ষ্ম আরও তুচ্ছ জিনিসের ইতিহাস চাই। আজকার তুচ্ছতা হাজার হাজার বছর পরের মহাসম্পদ। মানুষ মানুষের কথা শুনতে চায়।’ (পৃষ্ঠা ১২৫)।
এই যাঁর ইতিহাসবোধ তিনি কি শুধুই প্রকৃতিপ্রেম আর শিশু মনস্তত্ত্ব নিয়ে কবিত্ব করতে কথাসাহিত্য লিখবেন?
এই বইয়ের ‘খিদে ও খাওয়ার পাঁচালি’ প্রবন্ধটি আমার পড়া শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধগুলির একটি। অনেকক’টি মর্মস্পর্শী উদাহরণ হাজির করে রামকৃষ্ণবাবু দেখিয়েছেন ‘পথের পাঁচালী’ শুধুই পথের নয়, খিদে আর খাওয়ার পাঁচালিও বটে। খাবার দিয়েই কীভাবে ধনী-দরিদ্রর তফাত হয় এই সমাজে সে-কথা বিভূতিভূষণ এই উপন্যাসে বারেবারে জানিয়েছেন, কিন্তু নিজে থেকেছেন ভারি নিস্পৃহ। প্রবন্ধটি শেষ হয়েছে এই বলে, ‘পথের পাঁচালী-কে যাঁরা শুধু প্রকৃতিমুগ্ধ একটি সরল নিষ্পাপ শিশুর কাহিনী বলে মনে করেন, এইদিকটি তাঁরা একেবারেই খেয়াল করেন না। অথচ, স্বপ্নর পাশাপাশি রূঢ় বাস্তবকেও বিভূতিভূষণ ধরে রেখেছেন অকরুণভাবে। আর সেই রূঢ়তার একটি দিক হলো: খাবার। যে-খাবার না-পেলে কোনো মানুষই বাঁচে না, আবার যে-খাবারের রকমফের দিয়ে মানুষ মানুষে ফারাকও ধরা যায়।’
ফলারে বামুনের ছেলে অপু কিন্তু শেষমেষ পুরুত ঠাকুর বা টুলো পণ্ডিত হয়নি। সে হয়েছিল কথাসাহিত্যিক। বিভূতিভূষণ অপু চরিত্রটিকে খুব যত্ন করে গড়েছিলেন। ‘পথের পাঁচালী’-তেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অপুর ভবিষ্যৎ সাহিত্যিক হওয়ার উপাদানগুলিকে তিনি হাজির করেছিলেন। সেই নিয়েই লেখা রামকৃষ্ণবাবুর প্রবন্ধ, ‘অপুর পড়া-লেখা’। হতদরিদ্র তবু পড়ুয়া অপুর মনের ওপর কীভাবে সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রভাব ফেলেছিল তার বর্ণনা আছে এই প্রবন্ধটিতে। কী কী বই পড়েছিল অপু সেই ছোট বয়েসে, কীভাবে যোগাড় হয়েছিল সেগুলো, বীজগণিত আর বিলাতযাত্রীর চিঠি কীভাবে নাড়া দিয়েছিল তার শিশু বা কিশোর মনকে— সেসবের বিস্তৃত খোঁজ পাওয়া যাবে প্রবন্ধটিতে।
বল্লারী-বালাই পর্ব ‘পথের পাঁচালী’-র একটি ভাগের নাম। কেন এমন নাম? সেসব নিয়ে আলোচনা আছে এই বইতে। ‘এ কালের সূচনা’ প্রবন্ধটিতে আছে জমিজরিপ নিয়ে নানান কাজের কথা।
‘পথের পাঁচালী’-র চরিত্রদের ছোট ছোট আশা আর স্বপ্ন আর সময়ের অভিঘাতে সেইসব স্বপ্নভঙ্গ নিয়ে একটি প্রবন্ধ আছে এই বইতে। আলাদা করে গুরুত্ব পেয়েছেন ইন্দিরা ঠাকরুন। তিনি শুধুই এক বৃদ্ধা নন, একটি ক্ষয়িষ্ণু যুগের শেষ প্রতিনিধিদের একজন।
বইটির শেষ প্রবন্ধ, ‘অশনি-সংকেত: ইতিহাসের দিকচিহ্ন’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর সময় বাংলার ভয়ংকর তেতাল্লিশের মন্বন্তরের অভিঘাতে লেখা বিভূতিভূষণের এই উপন্যাস। রামকৃষ্ণবাবু লিখছেন, ‘সাম্রাজ্যর বাঁটোয়ারা নিয়ে লড়াই লাগল জার্মান আর ইংরেজে— আর তার ফলে, হাজার হাজার মাইল দূরে, মারা পড়ল বাঙলার পঁয়ত্রিশ লাখ মানুষ। বোমা খেয়ে নয়, কিছুই না খেতে পেয়ে।’ দুর্ভিক্ষ ভারতে নতুন নয়, কিন্তু মানুষের সৃষ্টি এই দুর্ভিক্ষ ছিল সত্যিই অভিনব। বিভূতিভূষণ এক আপমতলবি বামুনকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর এই মন্বন্তরের উপন্যাস। রামকৃষ্ণবাবু দেখিয়েছেন কীভাবে এই উপন্যাসে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে তৎকালীন সামাজিক ইতিহাসের ছবি।
বইটির প্রচ্ছদ সুন্দর। ছাপাও ঝকঝকে। পারলে অবশ্যই বইটি পড়বেন।
বিভূতিভূষণ ও কথাসাহিত্যে বাস্তববাদ ।। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ।। আর বি এন্টারপ্রাইজ ।। ১৮০ টাকা
‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’ বিকৃতি, চার্বাকদের হেয় করতে
সুকুমার অনুরাগীরা প্রবন্ধগুলি পড়লে উপকৃতই হবেন
মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব কোন মাপকাঠিতে শিল্পসাহিত্যকে বিচার করে
ধর্ম কেন নিজেকে ‘বিজ্ঞান’ প্রমাণে মরিয়া
‘গালিলেও-র জীবন’-কে যেভাবে দেখাতে চেয়েছেন বের্টল্ট ব্রেশট্
নবজাগরণের ধারায় পুষ্ট বিভূতি-ভাবনার এই ভিন্ন বিশ্লেষণ বাংলার সাহিত্যধারাকে নবতর জাগরণের পথ দেখাবে এই বিশ্বাস রাখা যায় ।