বইটি চার্বাক দর্শনের একটি আকরগ্রন্থ। প্রাচীন ভারতীয় বস্তুবাদ তথা চার্বাক দর্শনের ওপর যুক্তিনিষ্ঠ ও বহু তথ্যনির্ভর দীর্ঘ পরিশ্রমী গবেষণার ফসল। উনিশ শতকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে ছেপে বের হয় সায়ণ-মাধব রচিত ‘সর্বদর্শন সংগ্রহ’। তারপরে আবার নতুন করে প্রাচীন ভারতের বস্তুবাদ নিয়ে আলোচনা, গবেষণা শুরু হয়। দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী এবং দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বাংলায় চার্বাক দর্শন নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করে গেছেন। বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই চার্বাক দর্শন তথা প্রাচীন ভারতের বস্তুবাদী দর্শন নিয়ে গবেষণা স্বীকৃত একটি বিষয়।
যতই প্রচার করা হোক না কেন যে, ভারত আসলে অধ্যাত্মবাদ-সর্বস্ব একটি দেশ কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই যে সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেও ভারতে বস্তুবাদী অর্থাৎ নাস্তিক, অবৈদিক, আত্মা-পরলোক-পরকালে অবিশ্বাসী দর্শনতন্ত্র ছিল। এবং এই দর্শনতন্ত্র বেশ শক্তিশালীও ছিল। বেদ, উপনিষদ, পুরাণ সব ধর্মশাস্ত্রেই এই দর্শনতন্ত্রর অস্তিত্বের প্রমাণ রয়েছে। আট শতক থেকে বারো শতক— ভারতের দর্শন জগতে মহাবিতর্কর কাল। এই সময়েও বস্তুবাদী দর্শন, চার্বাক দর্শন একটি প্রধান দর্শন হিসেবেই স্বীকৃত। যদিও চার্বাক দর্শনের কোনও প্রামাণ্যগ্রন্থ এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে এই দর্শনের একটি মূলগ্রন্থ ও অন্তত তিনটি টীকার অস্তিত্ব ছিল। চার্বাক দর্শনের কথা অন্যান্য দার্শনিকদের লেখা থেকেই জানা যায়। তাঁরা সকলেই অবশ্য চার্বাকদের প্রতিপক্ষ। খণ্ডন করার জন্যে প্রথমে চার্বাকদের মতামত উদ্ধৃত করা হয়েছে। এবং অবশ্যই খণ্ডনের সুবিধের জন্যে মূল চার্বাকমতগুলোকে হামেশাই বিকৃত করাও হয়েছে।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের নানান নতুন সূত্র থেকে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য বস্তুবাদী দর্শনের কথা খুঁজে বার করেছেন। শুধু উত্তর ভারতে নয়, দক্ষিণ ভারতেও বস্তুবাদের রমরমা ছিল। দুটি তামিল মহাকাব্যের কথা উল্লেখযোগ্য, ‘মণিমেকলাই’ (ছয় শতক) এবং ‘নীলকেসি’ (দশ শতক)। সেখানে বস্তুবাদীদের নাম ভূতবাদী। ভূত মানে বস্তু। ভূতবাদী মানে যাঁরা বিশ্বাস করেন বস্তু থেকেই প্রাণ বা চেতনার সৃষ্টি হয়েছে, কোনও আত্মা, ঈশ্বর, ব্রহ্ম, বা মহাপ্রাণ থেকে নয়। এর থেকেই বস্তুবাদীরা সিদ্ধান্ত করেন দেহ ছাড়া আত্মা থাকতে পারে না, মানে পরলোক, পরকাল, পুনর্জন্ম সবকিছুই অস্বীকার করা হয়। তাই পুজোআচ্চা-শ্রাদ্ধশান্তির বিরোধিতা করা। চার্বাক দর্শন এমন একটি বস্তুবাদী দর্শন। ভূতবাদীরা পঞ্চভূতবাদী। তাঁরা বলতেন, পাঁচটি ভূত বা বস্তুর থেকেই প্রাণের সৃষ্টি হয়— জল, আগুন, হাওয়া, মাটি আর আকাশ। চার্বাকরা চতুর্ভূতবাদী। তাঁরা আকাশ স্বীকার করেন না।
প্রাচীন ভারতে ভাববাদ এবং বস্তুবাদ ছাড়াও উচ্ছেদবাদীরাও ছিলেন। এঁরাই সম্ভবত বস্তুবাদীদের পূর্বসূরি। তবে এরা জগৎ সৃষ্টি নিয়ে সমস্ত ধরনের মত খণ্ডনেরই পক্ষপাতী। সেখানে বস্তুবাদীরা ইতিবাচক। তাঁরা ভাববাদ খণ্ডন করেন, তা কিন্তু কেবল খণ্ডনের জন্যে খণ্ডন নয়, নিজেদের মতামতকে প্রতিষ্ঠা করতেই বিপক্ষের মতামতকে খণ্ডন।
‘চার্বাকচর্চা’-য় ছোট ছোট অধ্যায়ে ভাগ করে চার্বাক দর্শন নিয়ে আলোচনা এগিয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল প্রতিপক্ষদের উদ্ধৃতি থেকে চার্বাকদের সূত্রগুলোকে সংকলিত করা। প্রতিপক্ষরা যা যা বলেছেন সেগুলো নির্বিচারে মেনে না নিয়ে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ক্রস রেফারেন্সের সাহায্যে চার্বাকসূত্রগুলোকে বিচার করেছেন। প্রাচীন ভারতে শুধু নিরীশ্বরবাদীদেরই নাস্তিক বলা হত না, বেদ-বিরোধীদেরও নাস্তিক বলা হত। তাই ব্রাহ্মণ্যধর্মর কাছে বৌদ্ধ, জৈন, বস্তুবাদী— সকলেই নাস্তিক, কারণ কেউই বেদপ্রামাণ্য মানেন না। আবার বৌদ্ধ বা জৈনদের কাছে বস্তুবাদীরা নাস্তিক কারণ তাঁরা পুনর্জন্ম মানেন না। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন যে-সমস্ত শ্লোক চার্বাকদের নামে চলে তার সব ক’টাই চার্বাকদের শ্লোক নয়, কিছু শ্লোক জৈন বা বৌদ্ধদের শ্লোক। আবার বেশ কিছু নতুন উৎস থেকে চার্বাকমতের কথা খুঁজে বার করেছেন তিনি।
চার্বাক বলতে চার্বাক/লোকায়ত কথাটাই বেশি ব্যবহার করা হয়। অনেকেই তাই প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থগুলিতে লোকায়তর উল্লেখ থাকলেই সেখানে বস্তুবাদী দর্শনের উল্লেখ আছে বলে মনে করেন। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য কিন্তু দেখিয়েছেন ‘লোকায়ত’ শব্দটি সময়ের সঙ্গে তার অর্থ বদল করেছে। নানান উৎসের প্রমাণ রেখে তিনি দেখিয়েছেন প্রাচীন ভারতে ‘লোকায়ত’ বলতে তর্কশাস্ত্র বা বিতণ্ডাশাস্ত্রই বোঝাত, মানে তর্ক করার পদ্ধতি। ‘কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র’-য় রাজাকে যেসব বিদ্যা অবশ্যই শিখতে হবে বলে যে ‘লোকায়ত’ মতের কথা বলা আছে তা এই তর্কবিদ্যা, বস্তুবাদ নয়। পরবর্তীকালে লোকায়ত, চার্বাক, বার্হস্পত্যমত প্রভৃতি শব্দ একটি নির্দিষ্ট বস্তুবাদী মত বোঝাতেই ব্যবহার হত।
এই বইতে পুরাণে চার্বাকমত বা বস্তুবাদী মত নিয়ে আলোচনা আছে। বার্হস্পত্যমত কেন চার্বাকমতকে বলা হয় তা বেশ আগ্রহজনক। ‘বিষ্ণুপুরাণ’ ও ‘পদ্মপুরাণ’-এ একটি গল্প আছে। রকমফের থাকলেও গল্পটা এইরকম, দেবতাদের গুরু বৃহস্পতি আর দানবদের শুক্র। দানবদের বিপথে চালিত করতে বৃহস্পতি এক চাল চাললেন। শুক্র কিছুদিন অদৃশ্য হয়েছিলেন। সেই সুযোগে বৃহস্পতি শুক্র সেজে দানবদের মধ্যে যান এবং তাঁদের বেদ-বিরোধী শিক্ষা দেন যাতে তাঁরা সেই শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে অধর্মের পথে যান এবং ধ্বংস হন। ‘চার্বাকচর্চা’-য় বৃহস্পতি দানবদের কী বলেছিলেন সেই নিয়ে ‘পদ্মপুরাণ’-এর ‘সৃষ্টিখণ্ড’-র খানিক অনুবাদ আছে,
“ঐহিক স্বার্থপর নীচ জনেরাই যজ্ঞ ও শ্রাদ্ধকার্য্যের প্রবর্ত্তক… বিষ্ণু হিংসাকার্য্যে নিরত; তিনিই বা কিরূপে মোক্ষলাভ করিবেন? ব্রহ্মা রজোগুণাত্মক, নিজের সৃষ্টিই তাঁহার উপজীবিকা। বৈদিক পক্ষাবলম্বী অন্য যে সকল দেবর্ষি আছেন; তাঁহারাও হিংসাবহুল, ক্রুর, মাংসাশী ও নিত্য পাপকারী, এতদ্ভিন্ন দেব ও ব্রাহ্মণরা মদ্যপায়ী ও মাংসাশী। সুতরাং ইহাদের অবলম্বিত ধর্ম্ম দ্বারা কে কিরূপে স্বর্গ বা মোক্ষ লাভ করিবে? শ্রুতিস্মৃতিবিহিত যে সকল যজ্ঞাদি ও শ্রাদ্ধাদি কর্ম্ম আছে, তাহাতে অপবর্গ (=মোক্ষ) লাভ নাই। এ সম্পর্কে এই প্রকার প্রবাদ শুনা যায় যে যজ্ঞে পশু মারিয়া রুধির কর্দ্দম প্রস্তুত করিয়া স্বর্গে যাওয়া যায়, তবে নরকে যাইবে কে?”
আরও আছে,
“যজ্ঞহত পশুর জন্য যদি স্বর্গপ্রাপ্তি বিহিত হয়, তবে যজমান কেন স্বীয় পিতাকে নিহত করে না? একজন ভোজন করিলে যদি অপরের তৃপ্তি হয়, তবে প্রবাসীর জন্যে শ্রাদ্ধ করিলে কৈ প্রবাসীরা তো তাহা গ্রহণ করেন না।… শমী প্রভৃতি কাষ্ঠ যদি পবিত্র বস্তু হয়, তবে পত্রভোজী পশুও তো শ্রেষ্ঠ।”
‘পদ্মপুরাণ’ থেকে দেখা যাচ্ছে বৈদিক ধর্মের যেসব ত্রুটির কথা বস্তুবাদীরা এবং জৈন-বৌদ্ধরা বলতেন সেগুলো হল,
১. যজ্ঞে পশুহত্যা ও মদ্যপান,
২. কুৎসিত আচার-আচরণ,
৩. দেবতাদের অবৈধ ধর্মাচার।
অথচ মজাটা হল পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ্য দর্শনের পাণ্ডারা চার্বাকদের নামেই ইহসুখবাদ আর সেইসূত্রে অবাধ যৌনতার অভিযোগ তুললেন। চার্বাক শ্লোককে বিকৃত করে নিজেদের বইতে ঢোকালেন। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ‘যাবজ্জীবং সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’ শ্লোকটি। আদতে একটি বিকৃতি, চার্বাকদের অপদস্থ করার জন্যে। কাণ্ডটি ঘটিয়েছিলেন সায়ণ-মাধব তাঁর ‘সর্বদর্শন সংগ্রহ’ বইতে।
মূল চার্বাক শ্লোকটি ছিল:
যাবজ্জীবং সুখং জীবেন্ নাস্তি মৃত্যোর অগোচরঃ
ভস্মীভূতস্য শান্তস্য পুনরাগমন কুতঃ।।
যতদিন জীবন আছে, সুখে বাঁচবেন, মৃত্যুর অগোচর কিছুই নেই। ছাই হয়ে-যাওয়া মৃত লোক কোথায় (বা কোথা থেকে) আবার ফিরে আসে?
চার্বাকদের হেয় করতে, নিতান্ত ইহসুখবাদী তকমা দিতে সায়ণ-মাধব শ্লোকটিতে ‘নাস্তি মৃত্যোর অগোচরঃ’-এর জায়গায় ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’ লেখেন। এই নিয়ে রামকৃষ্ণবাবুর এই বইতে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন বিকৃতির প্রমাণ দিয়ে। আর পুজোআচ্চা যাগযজ্ঞ শ্রাদ্ধশান্তি— এই সবই ব্রাহ্মণদের রোজগারের ধান্দায় তৈরি সে-কথাও চার্বাকরা স্পষ্টই বলেছেন।
বইটিতে চার্বাকদের কথা জানা যায় এমন নানান উৎস নিয়ে আলোচনা রয়েছে। তার মধ্যে যেমন ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ বা জৈনদের দার্শনিক গ্রন্থের কথা আছে, তেমন আছে ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ বা ‘নৈষধচরিত’ ইত্যাদি নাটকের কথাও। আছে ‘কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র’ আর ‘কামসূত্র’-র প্রসঙ্গও।
প্রাচীন ভারতের নাস্তিক ঐতিহ্যর কথা জানতে এই বইটি পড়া জরুরি। ধর্ম না জানলে ভারত আর ভারতীয়দের জানা যাবে না— এমন কথা নেহাতই ফাউ কথা। ভারতে এখন সিরিয়াস অধ্যাত্মবাদের কোনও চর্চা আছে বলে তো মনে হয় না। জনমানসে আছে শুধু আচার-বিচার, পুণ্যস্নান আর পুজোআচ্চার হুজুগ, আজ দুর্গা, তো কাল সন্তোষী মা, তো পরশু বৈষ্ণোদেবী। সব ধার্মিক সবেতেই আছেন, সে কর্ম (যাগযজ্ঞ)-ই হোক বা জ্ঞান (ব্রহ্মোপসনা) কিংবা ভক্তি (ভগবানের সঙ্গে প্রেমপিরিতির সম্পর্ক করা) যা-ই হোক। অথচ এই তিন পথের সম্পর্ক জল-অচলের, কোনওভাবেই মেলে না। যেহেতু পুরো ঈশ্বরবিশ্বাসই অত্যন্ত লঘু, শুধু পাপের ভয়েই যত ভক্তি, তাই কেউ কোনও রিস্ক নেন না। তাই দিব্বি অদ্বৈতবাদীরা অনার্যা কালীর মূর্তি গড়ে পুজো করেন! শাক্ত আর বৈষ্ণব নিজেদের একই পথের পথিক বলেন! অবশ্য ধর্ম এ দেশে বেশ শক্তিশালী রাজনৈতিক হাতিয়ার সেটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। একমাস রেশনে চাল বন্ধ থাকলে কোনও হেলদোল হয় না কিন্তু একদিনের জন্যে ধর্মাচরণে বিঘ্ন ঘটলে প্রাণ দিতে ও নিতে পিছপা হওয়া মানুষের অভাব নেই।
ভারতের ঐতিহ্যর অন্যতম শরিক বস্তুবাদী, নিরীশ্বরবাদী, শুধুই ইহকালে বিশ্বাসী চার্বাক দর্শন। সেই দর্শন সম্বন্ধে জানতে গেল এই বই অবশ্যপাঠ্য।
চার্বাকচর্চা।। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য।। এন বি এ।। ২৫০ টাকা
সুকুমার অনুরাগীরা প্রবন্ধগুলি পড়লে উপকৃতই হবেন
‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’ বিকৃতি, চার্বাকদের হেয় করতে
মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব কোন মাপকাঠিতে শিল্পসাহিত্যকে বিচার করে
শুধুই প্রকৃতিপ্রেমী নন, বাস্তববাদেরও নিখুঁত শিল্পী বিভূতিভূষণ
ধর্ম কেন নিজেকে ‘বিজ্ঞান’ প্রমাণে মরিয়া