বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী বা স্বদেশী আন্দোলন বিশ্লেষণের কিছু চেনা ছক আছে:
১. অতিজাতীয়তাবাদী প্রবণতা— এই আন্দোলনের সীমা-স্ববিরোধ না দেখে শুধুই পুজোর মত করে ভক্তিমূলক বিশ্লেষণ।
২. কংগ্রেসপন্থীদের কাছে এই আন্দোলন কংগ্রেসেরই অবদান। মহাত্মা গান্ধীও এমন কথা বলেছেন।
৩. একদল নিম্নবর্গ-সচেতন মানুষের কাছে এই আন্দোলন নিছকই শিরোমণি, এলিট বা ‘ভদ্রলোক’-দের আন্দোলন তাই অবজ্ঞার যোগ্য।
৪. তথাকথিত সেকুলারদের কাছে এই আন্দোলন কেবলই হিন্দু সাম্প্রদায়িক আন্দোলন আর তাই কল্কে পাওয়ার মত কিছু নয়।
বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন নিয়ে তথ্যর অভাব নেই, সেই তথ্য দুর্লভও নয়, কিন্তু এই আন্দোলন নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের অভাব প্রকট। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য-র ‘বঙ্গভঙ্গ : স্বদেশী : বিপ্লববাদ’ বইটি সেই অভাব অনেকটাই পূরণ করে। সাহেবানুজীবীদের বাদ দিয়ে প্রত্যেক বাঙালির কাছেই এই বই অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। রামকৃষ্ণবাবু দেখিয়েছেন সমস্ত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বাঙালি জাতি তথা বাংলাভাষার ওপর বিরাট ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল আর প্রমাণ করেছেন উপরে উল্লেখ করা ওই আন্দোলনের চেনা ছকগুলি শুধু একপেশেই নয়, একেবারেই ভুলভাল। বইটি একটি দ্বিভাষিক বই। মোট অধ্যায় ১৬টি, তার মধ্যে চারটি ইংরেজিতে লেখা। আর অত্যন্ত মূল্যবান পরিশিষ্ট আছে ৪টি। অধ্যায়গুলি আলাদা প্রবন্ধ হিসেবে বিভিন্ন ছোট পত্রিকায় আগে প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়াও দুটি ইন্ডেক্স আছে, নাম ও বিষয়ের।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনই হল একমাত্র উল্লেখযোগ্য সফল আন্দোলন। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই আন্দোলনের চাপে ইংরেজ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য হয়। রামকৃষ্ণবাবু দেখিয়েছেন এই আন্দোলন নিছকই এক সাংস্কৃতিক কিংবা ভাষা আন্দোলন ছিল না, তা ছিল একটি পুরোদস্তুর সাম্রাজবাদ-বিরোধী রাজনৈতিক গণআন্দোলন। এই আন্দোলন গণআন্দোলনের চেহারা পেয়েছিল বলেই ১৯০৫-এর অক্টোবর থেকে ১৯০৮-এর শুরু পর্যন্ত লাগাতার চলতে পেরেছিল।
ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন লাইটহাউসের কাজ করেছিল। প্রথমত এই আন্দোলনের বাঙালি নেতারাই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলেন, কোনও স্বায়ত্তশাসন বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস নয়, পূর্ণ স্বাধীনতা। প্রায় আড়াই দশক পরে কংগ্রেস সেই দাবি তুলেছিল। রামকৃষ্ণবাবু দেখিয়েছেন পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রাম যেসমস্ত ধারায় চলেছিল তার সবক’টিই ব্যবহার হয়েছিল এই আন্দোলনে। সশস্ত্রবিপ্লবী আন্দোলন (ব্যক্তিহত্যা কিংবা বাহিনী গড়ে লড়াই, দুই-ই), বিদেশি পণ্য বয়কট, স্বদেশীয় শিল্পবাণিজ্য এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, অহিংস নীতি, প্যাসিভ রেজিস্টেন্স বা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ— এই সবক’টি পথেই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। গান্ধীজির অনেক আগে বিপিনচন্দ্র পাল এই অহিংস নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের নীতি প্রথম প্রচার করেছিলেন। অহিংসার পথে তিনি আপস করতে রাজি হননি। অরবিন্দ ঘোষ সেই সময়ে ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকায় ‘নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের তত্ত্ব’ নামে একগুচ্ছ প্রবন্ধ লিখেছিলেন, যদিও সশস্ত্র সরকারি আক্রমণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের পথে তাঁর কোনও আপত্তি ছিল না। গান্ধীজির সত্যাগ্রহ ছিল এই নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধেরই গুজরাতি সমার্থক শব্দ। তাঁর সত্যাগ্রহর ব্যাপারে বাংলার ঋণের কথা গান্ধীজি নিজেও স্বীকার করেছেন। কিন্তু খুব পরিকল্পিতভাবে বাঙালিদের এই অবদানকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। প্রচারের চেষ্টা হয়েছে গান্ধীজিই প্রথম অহিংস অসহযোগের পথ ভারতে আমদানি করলেন। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাই একবার আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘হায় দুর্ভাগা বাঙ্গলা দেশ। রাজনীতিতে তাহার সমস্ত কর্ম, অপরের মৌলিক কৃতিত্ব বলিয়া ক্রমাগত জাহির করা হইতেছে এবং ভারতের রাজনীতিক ইতিহাস বইতে তাহার সমস্ত অবদান মুছিয়া ফেলা হইতেছে।’— এ কথা একেবারে একশো শতাংশ সত্যি। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যর ভাষায়:
“দুঃখের বিষয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোনও বিশ্বকোষ বা হালের উপনিবেশ বা উপনিবেশ-উত্তর চর্চার কোনও বই-এ বিপিনচন্দ্র ও অরবিন্দর নামও থাকে না, রবার্ট জে. সি. ইয়ং-এর বইটি (২০০৩) আমার দেখা একমাত্র ব্যতিক্রম। ভারতের কথা উঠলেই নাম করা হয় গাঁধির। যেন চরকা-খদ্দর আর কুটির শিল্প দিয়ে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার সূচনা তিনিই করলেন, তার আগে আর কেউ এ-নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেননি।”
অথচ গান্ধীজি ভারতে আসার একদশক আগেই একটি সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন এই বাংলায় শুরু হয়েছিল ব্যাপকভাবে।
বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে কংগ্রেসের প্রায় কোনও ভূমিকাই ছিল না। নরমপন্থী নেতারা তো বাঁহাতে মনসাপুজোর মত করে সমর্থন জানিয়েছিলেন এই আন্দোলনকে। মূলত সশস্ত্র বিপ্লবীরা বাংলার শহরে গ্রামে বয়কট আর স্বদেশী আন্দোলন গড়ে তুলতে সংগঠকদের কাজটা করেছিলেন, পাশাপাশি চালিয়ে ছিলেন নিজেদের সশস্ত্র সংগ্রামের কাজ। এই সময়তেই ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর বোম আর আলিপুর বোমার মামলা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। সিপাহী বিদ্রোহের পরের অপবাদ মুছে বাঙালি বিপ্লবীরা গোটা দেশে বীরের আসন গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন তাই সশস্ত্র বাঙালি বিপ্লবীদের এক বিরাট কীর্তি হিসেবে চিহ্নিত হওয়া উচিত।
এই আন্দোলনের রেশ গিয়ে পড়েছিল বাংলার বাইরেও। বিশেষত বোম্বাই এবং মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের বাংলার বাইরের প্রভাবের কথা বলতে গেলে ‘মরহাট্টা’ পত্রিকা আর সাভারকরের নাম বলতেই হবে। ‘‘The Swadeshi Movement through the Eyes of ‘The Marhatta’ 1905-07” নামের একটি অধ্যায় এই বইতে আছে। সাভারকরের ভূমিকা নিয়ে বলতে গিয়ে লেখক প্রথমে অবিনাশ ভট্টাচার্যর বই থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দিয়েছেন, “১৯০৫ সালের বঙ্গের অঙ্গচ্ছেদ উপলক্ষে উদ্ভূত স্বদেশীয় বন্যা বিস্তৃতি লাভ করিয়া বোম্বাই পর্যন্ত প্লাবিত করল। পুণায় সাভারকরপন্থীগণ বিলাতীবস্ত্রের বহ্ন্যুৎসব করিলেন; ফলে ধীরপন্থী [মডারেট] কংগ্রেসীগণ আতঙ্কিত হইলেন। কলেজের অধ্যক্ষ আর. পি পরাঞ্জপে শ্রীসাভারকরকে কলেজের ছাত্রাবাস হইতে বহিষ্কার করিলেন এবং দশ টাকা অর্থদণ্ড করিলেন।”
এরপর রামকৃষ্ণবাবু যোগ করেন:
“১৯০৮-এর ১৬ অক্টোবর লন্ডন-এ বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী তৃতীয় স্মৃতিবার্ষিকী পালনের উদ্যোক্তা ছিলেন সাভারকরই। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ, বিপিনচন্দ্র, খাপার্দে, করণ্ডীকর, লাজপত রায় প্রমুখ। ২০ ডিসেম্বর ১৯০৮-এ ফ্রী ইন্ডিয়া সোসাইটি-র উদ্যোগে এক জাতীয় সম্মেলন ডাকা হয় লন্ডন-এই। স্বরাজ বিষয়ে মূল প্রস্তাব উত্থাপন করেন আনন্দ কুমারস্বামী। সাভারকর বলেন, ‘স্বরাজ বলতে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা বোঝায়। এটি পুরোপুরি জেনে আপনারা এই প্রস্তাবে সম্মত হচ্ছেন।’ এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মাদাম কামা, জ্ঞানচাঁদ বর্মা, ভি ভি এস আয়ার, আগা খাঁ প্রমুখ। পরে এই সাভারকরই সাম্প্রদায়িকতা প্রচারক হয়ে দেখা দেন। কিন্তু বিশ শতকের গোড়ায় তাঁর দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা অনুচিত। এই সবকিছু নিয়েই গবেষণা হওয়া দরকার।” (পৃ. ৫)
পৃথিবীতে বয়কট আন্দোলনের সূচনা, ভারতের বাইরেও সে আন্দোলনের ইতিহাস ইত্যাদি নিয়ে একটি তথ্যসমৃদ্ধ পরিশিষ্ট আছে বইটিতে আর স্বদেশীর কথায় এসেছে ভারতীয় বুর্জোয়াদের কথা। জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি বলতে তখন বাংলায় কিছু ছিল না, ছিল মহারাষ্ট্রে। তাই স্বদেশী আন্দোলনের সময় সিদ্ধান্ত হয়, যতদিন না জাতীয় কাপড় কল তৈরি হচ্ছে ততদিন বোম্বাই-এর মিল থেকে কাপড় এনে বিক্রি করতে হবে। বোম্বাইয়ের মিলের কাপড়ের চাহিদা তাতে বাড়ল আর সেই সুযোগে সেখানকার মিলমালিকরা কাপড়ের দাম দিলেন বাড়িয়ে। বাংলা থেকে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধিরা গেছিলেন তাঁদের বোঝাতে। তাদের জবাব ছিল:
“ভাবাবেগের বশে বাঙালি স্বদেশী কাপড় কিনতে চায় কিনুক; কিন্তু মুনাফার মওকা তাঁরা ছাড়বেন না। নির্ভেজাল বানিয়ার লজিক।” (পৃ. ৭)
ইংরেজ সরকার শুধু বাংলা প্রদেশকেই ভাগ করতে চায়নি, চেয়েছিল বাংলা ভাষাকেও ভাগ করতে। তাই বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন হয়ে উঠেছিল বাংলা ভাষারও এক লড়াইয়ের ক্ষেত্র। লেখকের মতে, বাংলা গদ্যর গণতন্ত্রীকরণ ঘটেছিল স্বদেশী আন্দোলনের সময়, তাতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল ‘সন্ধ্যা’ আর ‘যুগান্তর’ পত্রিকা। বাংলা ভাষার ইতিহাসে এ এক যুগান্তকারী সন্ধিক্ষণ। এই সময়তেই ইংরেজির বদলে রাজনৈতিক আন্দোলনের ভাষা হয়ে ওঠে বাংলা। রামকৃষ্ণবাবু লিখছেন:
“বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাংলা ভাষা হয়ে উঠল গণ-রাজনীতির ভাষা। শুধু আক্ষেপ বা ব্যঙ্গবিদ্রূপ নয়, প্রতিবাদ জানিয়ে বসে থাকা নয়, প্রতিরোধের ব্যবস্থাও হল নানাভাবে: বিলিতি মাল বয়কট, জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, দেশীয় শিল্পবস্তু তৈরি ও বিক্রি। এই নানামুখী কর্মসূচি প্রচারের বাহন হল বাংলা পত্রপত্রিকা, নতুন নতুন দৈনিক-সাপ্তাহিক; বিলি হল অজস্র ইস্তাহার (হ্যান্ডবিল), ছাপা হল ছোট-বড় বই ও পুস্তিকা। এসবের ফলে নতুন মোড় নিল বাংলা গদ্য, উত্তরোত্তর গণতন্ত্রীকরণের দিকে।” (পৃ. ১৮)
এ প্রসঙ্গেই আসে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় সম্পাদিত ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার কথা। বাংলা পত্রপত্রিকার ভাষায় ব্রহ্মবান্ধব যেন এক বিপ্লব আনলেন।
“১৯০৪-এ সান্ধ্য দৈনিক ‘সন্ধ্যা’-য় প্রথম শোনা গেল আপসহীন জাতীয়তাবাদের চড়া স্বর। ব্রহ্মবান্ধব লিখতেন সাধু কোড-এ কিন্তু নিচু বা সাদামাটা রীতিতে। খাঁটি বাংলা বাগ্ধারা (ইডিয়ম) এবার লাগল রাজনীতির কাজে। শুধু ভাষার গুণেই ‘সন্ধ্যা’-র সম্পাদকীয় গ্রাম-শহরের সাধারণ বাঙালির মন জয় করল। সম্পাদকীয়গুলোর শিরোনাম ছিল চমৎকার: ‘এখন ঠেকে গেছি প্রেমের দায়ে’, ‘কোনোকালে নেই মনসাপূজা, একেবারেই দশভুজা’, ‘গোদা পায়ের ভোঁতা লাথি’, ‘ছিদিসনের হুড়ুম দুড়ুম ফিরিঙ্গির আক্কেল গুড়ুম’ [ব্রহ্মবান্ধব ইংরেজদের তাঁর লেখায় অবমাননাসূচক ‘ফিরিঙ্গি’ বলেই উল্লেখ করতেন], ‘দে কালীবাড়ির একশ পাঁঠা’, ‘ভূপেন দেখালে অষ্টরম্ভা, আমি দেব বাম্বু লম্বা’ (ভূপেন্দ্রনাথ দত্তর কারাদণ্ড উপলক্ষ্যে সম্পাদকীয়), ‘ভেড়ার গোয়ালে ধোঁয়া, ফিরিঙ্গি করে ওঁয়া ওঁয়া…’। এর আগে পর্যন্ত অন্তঃপুরে রাজনীতি ঢোকেনি। ‘সন্ধ্যা’-র কল্যাণে হেঁশেলবন্দি মেয়েরাও বয়কট ও স্বদেশীর ডাকে সাড়া দিলেন।” (পৃ. ১৮)
‘সন্ধ্যা’ ছাপা হত হাজার হাজার। মফস্সল ও গ্রামের জন্যে তার অর্ধ সাপ্তাহিক সংস্করণও বেরত। স্বদেশী আন্দোলনে ব্রহ্মবান্ধবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে নানান আলোচনা বইটিতে অনেক জায়গায় এসেছে।
‘যুগান্তর’ ছিল তরুণ বিপ্লবীদের কাগজ। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ ছিলেন নানান সময়ের সম্পাদক। লেখায় সিডিশনের ঝাঁঝ ছিল খুব। অনেক বাধাবিপত্তি কাটিয়ে ‘যুগান্তর’ সেই সময় ধীরে ধীরে বাংলার মানুষদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছিল। একসময় কাটতি উঠেছিল কুড়ি হাজার পর্যন্ত। ‘যুগান্তর’ শুধু এক পত্রিকা নয় হয়ে উঠেছিল এক আবেগ। সম্পাদক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত গ্রেপ্তার হওয়ার পরেও ‘যুগান্তর’ বেরচ্ছে দেখে ছোট লাট নাকি হুমকি দিয়েছিলেন, ‘যুগান্তর’-এর সবক’টা সম্পাদককে জেলে পুরব। তার জবাবে অরবিন্দ ঘোষ ‘যুগান্তর’-এই লিখেছিলেন “‘মিথ্যার পূজা’। অরবিন্দ ছিলেন অকপট:
“যুগান্তরের আবার সম্পাদক কে? যুগান্তর তো জাতীয় ভাবসমষ্টি মাত্র। লোকের প্রাণের ভিতর দিয়ে যে ভাবস্রোত ছুটিয়াছে তাহার এক একটা কণা মাত্র যুগান্তরে আসিয়া ধাক্কা লাগে। সম্পাদক ত তাহা অভিব্যক্তির যন্ত্র মাত্র। যন্ত্রকে ধরিলে যন্ত্রী তো ধরা পড়ে না।” (পৃ. ২৩)
ব্রহ্মবান্ধব আর অরবিন্দ দুজনেই জোর দিতেন জাতীয়-বিজাতীয় তত্ত্বর দিকে। তাঁদের মতে, ঔপনিবেশিক ইংরেজ শক্তি শুধুই দেশকে গোলাম বানায়নি। দেশের মানুষের মগজেও গোলামখানা বানিয়েছে। ভারতবাসী ডি-ন্যাশনালাইজড হয়েছে। সময় এসেছে ভারতবাসীর মধ্যে আবার জাতীয়তাবোধ গড়ে তোলার। রি-ন্যাশনালইজড-এর কাজ শুরু করতে হবে। ব্রহ্মবান্ধব বলেছিলেন ফিরিঙ্গি নয়, প্রধান শত্রু হলো ফিরিঙ্গিপনা। স্বদেশী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় বিজাতীয় বিষয়ে বেশ খানিকটা আলোচনা আছে রামকৃষ্ণবাবুর এই বইটিতে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতেও সে-আলোচনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
পত্রপত্রিকা ছাড়াও ইস্তাহার বা হ্যান্ডবিল স্বদেশী আন্দোলনের প্রচারে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন ফেলেছিল ‘সোণার বাঙ্গলা’ ইস্তাহারগুলি। বাংলার বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া এই ইস্তাহারগুলি ইংরেজ শাসকদের মনে বেশ ভয় ধরিয়েছিল। কোনওভাবেই জানা যাচ্ছিল না কারা এই ইস্তাহার প্রকাশ ও প্রচারের সঙ্গে যুক্ত। সরাসরি সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দেওয়া হয়েছিল এই ‘সোণার বাঙ্গলা’ ইস্তাহারগুলিতে। এই বইতে রামকৃষ্ণবাবু একটি দীর্ঘ অধ্যায় লিখেছেন এই ইস্তাহার নিয়ে, “একটি ক’রে ইস্তাহারের জন্যে: ‘সোণার বাঙ্গলা’।’’ সহজে পাওয়া যায় না এরকম নানান সরকারি বেসরকারি তথ্যর ভিত্তিতে অধ্যায়টি লেখা। ওই ইস্তাহারগুলি সম্বন্ধে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সংবাদপত্রগুলির মতামত, পুলিশি তদন্তর গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি বিশদে আলোচিত হয়েছে এই অধ্যায়ে অত্যন্ত সুখপাঠ্য ভাষায়। এই অধ্যায়টি বইটিতে একটি বাড়তি পাওনা। ‘সোণার বাঙ্গলা’ ইস্তাহারটি থেকে খানিকটা উদ্ধৃত দিলে ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধে হবে:
“বাঙ্গালি, বন্দুক নাই বলিয়া ভয় পাও কেন? পৃথিবীর যেসব দেশ সংগ্রাম করিয়া স্বাধীনতা লাভ করিয়াছে; তাহারাও প্রথমে নিরস্ত্র ছিল; কুড়ুল, বর্ষা [বর্শা], তরবারীই তাহাদের প্রধান উপকরণ ছিল। পরে শত্রুর হস্তের অস্ত্র নানা প্রকারে কাড়িয়া লইয়া কার্য্যোদ্ধার করিয়াছিল । তোমার দেশে অনেক অস্ত্র আছে, তাহা লইয়াই কার্য্য আরম্ভ করিতে হইবে।” (পৃ. ৫০)
“হে ভারতবাসী ‘পাঞ্জাবীর’ প্রতি যে অত্যাচার হইয়াছে তাহা বিবেচনা কর। ভারতবাসী স্বাধীনতার জন্য পণ কর। অস্ত্র শস্ত্র লও, পল্টন বাঁধো। গুপ্ত সভা স্থাপন কর। পরে ক্রমশঃ সমস্তই পাওয়া যাইবে। তোমাদের দেশে অনেক অস্ত্র শস্ত্র আছে। সে কাড়িয়া লও এবং অত্যাচারীদের দেশ হইতে দূর করিয়া দাও। বন্দে মাতরম্।” (পৃ. ৪৯)
অনুশীলন সমিতির কর্মীরাই যে এই ইস্তাহারগুলি লিখতেন এবং প্রচার করতেন এ বিষয়ে এখন আর ঐতিহাসিকদের সন্দেহ নেই। আর অন্তত একটি ইস্তাহারে যে ব্রহ্মবান্ধবের হাত ছিল তা-ও বেশ স্পষ্টই বোঝা যায়।
বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম চালিকাশক্তি কি হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা? রামকৃষ্ণবাবু এই অভিযোগকে একেবারে খারিজ করে দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, হ্যাঁ, ধর্মকে ব্যবহার করেই রাজনীতি করা হয়েছিল, তার কুফলও সেই আন্দোলন ভুগেছে কিন্তু সে-আন্দোলন কখনওই সাম্প্রদায়িক ছিল না। ‘যুগান্তর’-এ পরিষ্কার বলা হয়েছিল, “আমাদের দেশের রাজনীতিকে ধর্ম্ম হইতে পৃথক করিলে জনসাধারণের মধ্যে আদৃত হইবে না তাহাও অনেকে বুঝিল।” পুরো চেষ্টাটাই ছিল মানুষকে আন্দোলনে টানতে ধর্মর ব্যবহার। কোনও ধর্মগুরু নয়, এই কাজ করেছিলেন রাজনীতির মানুষেরা। মনে রাখতে হবে হিন্দু পুরনো ধর্মীয় সংগঠনগুলো কখনওই দেশপ্রেমের ধার ধারেনি আর রামকৃষ্ণ মিশনের মত নতুন সংগঠনগুলোর তো আবার রাজনীতির নামে গায়ে ফোস্কা পড়ত।
আজ হয়তো আমরা রাজনীতিতে ধর্ম ব্যবহারের সমর্থক নই কারণ গত একশো বছরের বেশি সময় ধরে রাজনীতিতে ধর্মর ব্যবহারের কুফলের কথা আমরা জানি। কিন্তু ১৯০৫-এ এমন ধারণা করা প্রায় অসম্ভব ছিল। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জনগণকে জাগাতে ব্যবহার করা হয়েছিল ধর্মকে। ঐতিহাসিক ঘটনা কিংবা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে দেখতে হয় সমসময়ের নিরিখে। ২০২২ সালের চশমা পরে ১৯০৫-এর আন্দোলনকে দেখতে বসলে দেখা আর বোঝার ভুল হবেই। আর সেই ভুলই একদল অবিরত করে চলেন।
বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের নেতারা মুসলিমদের আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে চাননি। তাঁদের সেই আন্দোলনে আনতেও চেয়েছিলেন। এমনকি ‘যুগান্তর’ পত্রিকার মাস্টহেড-এ তরবারি ইত্যাদির সঙ্গে চাঁদ-তারার ছবিও থাকত। মুসলমান সমাজের কিছু মানুষ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধেই ছিলেন যেমন হিন্দুদের একটা অংশ ছিলেন বঙ্গভঙ্গর পক্ষে। মুসলমান তাঁতিরাও (মোমিন) বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গান বেঁধেছিলেন, যেমন ‘রাম রহিম না জুদা করো’ ইত্যাদি। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধীরা যে-মুসলিমরা বঙ্গভঙ্গর সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। আন্দোলন চলাকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের তিনটি সভা করা হয়েছে পূর্ববঙ্গে যাতে সেখানকার সংখ্যাগুরু মুসলিমদের আন্দোলনে যুক্ত করা যায়। কিন্তু তবু ধর্ম নিয়ে রাজনীতির কুফল এড়ানো যায়নি। মন্দির মসজিদ আক্রমণ, মূর্তিভাঙা সব কিছু ঘটেছে। তথাকথিত সেকুলাররা যেভাবে স্বদেশী আন্দোলনে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা খুঁজে বার করার চেষ্টা করেন তা নিছকই কুৎসার জন্যে কুৎসা করা। এঁরা কিন্তু সেসময়ের মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে একেবারেই নীরব থাকেন। এই বইতে মুসলিমদের নামে প্রচারিত কুখ্যাত ‘লাল ইস্তাহার’ থেকে কিছু অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক উদ্ধৃতি দেওয়া আছে। মুসলিমদের পরিচালিত ‘মিহির’, ‘সুধাকর’ ইত্যাদি পত্রিকাও যে খামোখাই ‘যুগান্তর’-এর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ করত তার উল্লেখও বইতে আছে। রামকৃষ্ণবাবু স্পষ্টই বলেছেন:
“আমাদের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মেলানোর চেষ্টা বারে বারে হয়েছে। খিলাফত-কে কেন্দ্র করে গাঁধিও সে-চেষ্টা করেছেন। সাঁওতাল-মুণ্ডা ইতাদি বিদ্রোহে ধর্মর ভূমিকা খুবই বড়। কিন্তু তার জন্যে সেসব আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক বলে মার্কা মারা হয়নি। স্বদেশী আন্দোলনের ক্ষেত্রে সেই একই ঘটনাকে তাহলে সাম্প্রদায়িক বলে দাগানো হবে কেন?” (পৃ. ৭৩)
স্বদেশী আন্দোলনে ধর্মর মত একই যুক্তি খাটে জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রেও। সময়ের নিরিখে দেশকে ভক্তিভাবে মাতৃরূপে পূজা করা, প্রতীকের ব্যবহারে কোনও দোষ নেই। বারেবারেই মনে রাখতে হবে স্বদেশী আন্দোলন ছিল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের শুরু সেখানে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।
বইটির দুটি পরিশিষ্ট আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে, ‘জাতিভেদ ভাঙার সূচনা’ এবং ‘প্রসঙ্গ: ভদ্রলোক’। স্বদেশী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলার কিছু শহরে গ্রামে জাতিভেদ ভাঙার একটা উদ্যোগ দেখা দিয়েছিল। এটা অস্বীকার করার মত কোনও যুক্তি বা তথ্য নেই যে নবজাগরণ, স্বদেশী আন্দোলন আর বাম আন্দোলনের জন্যে বাংলায় জাতপাতের তীব্রতা ভারতের অন্য অংশগুলোর থেকে এখনও অনেকটাই কম।
আর বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের এলিটীয় বদনামকে ধোয়া হয়েছে ‘প্রসঙ্গ: ভদ্রলোক’ পরিশিষ্টে । রামকৃষ্ণবাবু লিখছেন:
“স্বদেশী আন্দোলন নিয়ে হালের কিছু লেখাপত্র পড়ে মনে হয়: বর্ণহিন্দু হয়ে জন্মানোটা ভয়ঙ্কর অপরাধ। নিজের জন্মর ওপর কারুরই হাত নেই। দু-চারজন বিদ্বান তবু মনে করেন: বর্ণহিন্দুরা কোনও আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকলে সে আন্দোলন যথেষ্ট বিপ্লবী হয় না। আর সেই বর্ণহিন্দুরা যদি তথাকথিত উঁচুজাতের হন, তবে তো সে পাপের কোনও প্রায়শ্চিত্ত নেই। তেমন মানুষ যা-ই করুন, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে যদি প্রাণও হারান, বর্ণহিন্দু হওয়ার কলঙ্ক কিছুতেই মোছার নয়।” (পৃ. ১৫৫)
রামকৃষ্ণবাবু দেখিয়েছেন সেই স্বদেশী আন্দোলনের প্রধান সংগঠক সশস্ত্র বিপ্লবীদের বেশিরভাগ অংশই মোটেও আলালের ঘরের দুলাল ছিলেন না। অভাব অনটনের মধ্যেই তাঁরা বড় হয়েছিলেন। হ্যাঁ, তার মধ্যেও তাঁরা শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন আর তাই উঠে আসতে পেরেছিলেন আন্দোলনের সামনের সারিতে। এটা ঠিকই যে শ্রমিক কৃষকরা ব্যাপকভাবে সে আন্দোলনে যোগ দেননি। তার জন্যে ইতিহাসকে বুঝতে হবে। লেখকের কথায়:
“ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রথম পর্বে কৃষক ও শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে যোগ দেননি— এতে আশ্চর্যর কিছু নেই। তার উপযোগী চেতনা তখনও তাঁদের মধ্যে আসেনি। আপনা-আপনি সে-চেতনা আসে না। শোষণের অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট নয়, লড়াই-এর দিশা ঠিক করতে ‘মননগত বিকাশ’ও লাগে। মার্কস-এঙ্গেলস তা-ই মনে করতেন। আর এই মননগত বিকাশের কাজে সাহায্য করবেন কারা? যাঁরা আগেই তত্ত্বশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন, একমাত্র তাঁরাই পারেন সেই চেতনার সঞ্চার করতে। তার প্রভাবেই কৃষক-শ্রমিকরা জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও শ্রেণীসংগ্রামে যোগ দেন— এটাই ইতিহাসের সত্য। জাতীয় বিপ্লবীদের একটি অংশ কারাগারে ও বন্দীনিবাসে বসে নিজেদের পথ খুঁটিয়ে দেখার অবসর পেয়েছিলেন; মার্কসীয় বইপত্তর পড়ে তাঁরা পেয়েছিলেন নতুন পথের সন্ধান। বাংলার শ্রমিক-কৃষক ও কমিউনিস্ট আন্দোলনে শক্তি জোগান এঁরাই।
তার আগেও, স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে জাতীয় ভাবধারা প্রচারে ভূমিকা নিয়েছিলেন ছাত্ররাই। তার থেকে শিক্ষা নিয়ে ছাত্র ও তরুণদের মধ্যে সমাজবাদ প্রচার ও হাতেকলমে কৃষক-শ্রমিক সংগঠন গড়ায় উদ্যোগী হয়েছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। এর তাৎপর্য বুঝতেন সোমনাথ লাহিড়ী। ভদ্রলোক-বিরোধী সায়েব বা দিশি আধা-সায়েব সমাজবিজ্ঞানীরা সেই তাৎপর্য বোঝে না।” (পৃ. ১৫৯)
নিম্নবর্গ-সচেতনতা ভাল জিনিস, কিন্তু নিম্নবর্গ-অন্ধতা অন্যান্য অন্ধতার মতই বিষবৎ পরিত্যাজ্য।
“How Macaulay’s Plan Miscarried: A Study of Aurobindo Ghose as a Publicist” অধ্যায়টি স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে অরবিন্দ ঘোষের রাজনৈতিক চিন্তা নিয়ে। অরবিন্দ ঘোষ ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান বুঝতে গেলে প্রবন্ধটি ভীষণ কাজে লাগবে। শুধুই পূর্ণ স্বাধীনতা নয়, স্বাধীন ভারতের শাসনব্যবস্থা কেমন হবে তার কথাও সেসময়ে অরবিন্দ বলেছিলেন। সমাজতন্ত্রর পক্ষেই সওয়াল করেছিলেন তিনি। ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকার সেপ্টম্বর ২২, ১৯০৭ সালের সংখ্যায় অরবিন্দ পরিষ্কার ঘোষণা করেছিলেন:
“Our correspondent accused us of attempting to corrupt society with the intrusion off the European ideas of Socialism. Socialism is not an European idea, it is essentially Asiatic and especially Indian. What is called Socialism in Europe is the old Asiatic attempt to effect a permanent solution of the economic problem of society which will give man leisure and peace to develop undisturbed his higher self. Without Socialism democracry would remain a tendency that never reached its fulfilment, a rule of the masses by a small aristocratic or monied class with the consent and vote of the masses, or a tyranny of the artisan classes over the rest. Socialistic democracy is the the only true democracy, for without it we cannot get the equalised and harmonised distribution of functions, each part of the community existing for the good of all not struggling for its own separate interest, which will give humanity as a whole the necessary conditions in which it can turn its best energies to its higher development.’’ (পৃ. ১০৫)
বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলন আসলে বাঙালি জাতি আর বাংলা ভাষার আত্মপরিচয়ের এক অধ্যায়। মুষ্টিমেয় কিছু সাহেবের পাপোশ-মার্কা বাঙালির কথা আলাদা। লর্ড কার্জন ছিলেন এক ভয়ংকর সাম্রাজ্যবাদী যিনি বাংলা, বাঙালি, বাংলা ভাষাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্ত ওই মুষ্টিমেয় সাহেবানুজীবী বাঙালি একশো বছর আগেও রাজভক্তিতে কার্জনের তৈরি স্মৃতিসৌধ নিয়ে গদগদ হয়ে পড়তেন, যেমন বর্ধমানের মহারাজ (আসলে বড় জমিদার)। আজও আনন্দবাজার আর তার পোষা বুদ্ধিজীবীরা একই যুক্তি দিয়ে কার্জনের ইমেজকে চুনকাম করতে চান।
বইটির প্রচ্ছদ ও ছাপা বেশ ভাল। প্রচ্ছদ এঁকেছেন বাবুল দে।
বঙ্গভঙ্গ : স্বদেশী : বিপ্লববাদ।। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য।। কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানি
সুকুমার অনুরাগীরা প্রবন্ধগুলি পড়লে উপকৃতই হবেন
‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’ বিকৃতি, চার্বাকদের হেয় করতে
মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব কোন মাপকাঠিতে শিল্পসাহিত্যকে বিচার করে
শুধুই প্রকৃতিপ্রেমী নন, বাস্তববাদেরও নিখুঁত শিল্পী বিভূতিভূষণ
ধর্ম কেন নিজেকে ‘বিজ্ঞান’ প্রমাণে মরিয়া
‘গালিলেও-র জীবন’-কে যেভাবে দেখাতে চেয়েছেন বের্টল্ট ব্রেশট্