শক্ খেয়ে মাথার চুলগুলো সব খাড়া হয়ে গেছে— এমন ফটো আমরা অনেকেই দেখেছি। আজকাল টিভির বিজ্ঞাপন আর গুগলের দৌলতে এমন সব নানা ধরনের ছবি নাকের ডগাতেই বলা যায়। কিন্তু সত্যি সত্যি ‘Live-wire’ নিয়ে কারা deal করে জানো? বাবা-মায়েরা! এক-একটা বাচ্চা, এক-একটা live-wire! আর সে বাচ্চা যত ছোটই হোক না কেন!
আমরা যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। মা-কাকিমার কাছে শুনেছি, একবার কোনও এক আত্মীয়ের বাড়ি গিয়ে, আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই, বাড়ির লোকদের বেজায় লজ্জিত করেছিলাম। ব্যাপারটা এইরকম: আত্মীয় নানারকম খাবার থালায় পরিবেশন করেছেন। যথাযথ সম্মান জারি রয়েছে। গরম গরম বেগুনভাজা উনি থালায় দিতে যাবেন, এমন সময় মা আর কাকিমা দুজনেই প্রায় একইসঙ্গে বলে উঠেছিলেন, ‘না, না ওদের (ইঙ্গিত আমার আর খুড়তুতো ভাইয়ের প্রতি) দেবেন না। ওরা বেগুনভাজা খায় না। মিছিমিছি নষ্ট হবে।’
বাড়ির রোজকার অভিজ্ঞতা থেকেই ওঁরা কথাটা বলেছেন। কিন্তু ওঁরা কী করে বুঝবেন, বাচ্চারা অভিযানে বেরিয়েছে! এখানে সেট রুটিন ফেল! আমি আর খুড়তুতো ভাই নাকি সমস্বরে বলে উঠেছিলাম, ‘না, না আমরা বেগুনভাজা খাই। খুব খাই। দিন।’ মা-কাকিমার তখন কী অপ্রস্তুত অবস্থা হয়ে থাকবে, আজ তা খুব বুঝতে পারি! বাড়ির লোকেদের কাছে আরও শুনেছি, আমি নাকি ছোটবেলায় ঘরের বাইরের বাগানে দাঁড়িয়ে, যেকোনও লোককে বলতাম, ‘ও কাকু, ও কাকিমা, আসুন না, আমাদের বাড়িতে একটু চা খেয়ে যান।’ অনেক সময় আবার নাছোড়বান্দা হয়ে কাউকে কাউকে বাড়িতে প্রায় টেনে নিয়ে আসতাম। তখন আমার বয়স নাকি বছর চারেকের বেশি নয়! বাড়ির লোকে এমনও বলে, ‘আধা কলোনির লোকের সঙ্গে তো তোর সূত্রেই আলাপ! সবাই নাকি তোর কোনও কাকু-কাকিমা!’
এই ক’বছর আগের কথা। আমার বাড়িতে, একবার আমার বন্ধুর দুই ছেলে এসেছে। তাদের বয়স তখন পাঁচ আর সাত। ওরা চিঁড়ে ভাজা খেতে খুব ভালবাসত। দুজনেই খাচ্ছে। হঠাৎ করে ছোট ছেলেটি একমুঠো চিঁড়ে ভাজা নিয়ে, ঘরের সিলিংয়ের উপর ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘হোলি হ্যায়!’ আমার সাধের কার্পেট, সোফা সব ততক্ষণে চিঁড়ে ভাজা নামক আবির মেখে হোলি খেলেছে!
আরও একবার এই বাচ্চাটিই তার প্রিয় ‘পার্লে-জি’ বিস্কুট খাচ্ছে। আমার মনে আছে, এই বাচ্চাটির কথা মনে রেখেই আমি ‘পার্লে-জি’ বিস্কুট আনিয়ে রাখতাম তখন। বাচ্চাটি জলে ডুবিয়ে ‘পার্লে-জি’ বিস্কুট খেত। বাড়িতে এসেই বলত, ‘আন্টি, পানি বিস্কিট দিজিয়ে।’ তারপর যত মনোহারী বিস্কুটই তুমি দাও না কেন, ‘পার্লে-জি’ বিস্কুট দেখলে, তা হাতে তুলে নিয়ে বলত, ‘আরে বাহ! ‘পার্লে-জি’…ই তো হমরা পুরা দেহ মে ভরল হ্যায়!’
আমার ছেলের বয়স তখন বছর আড়াই হবে। নতুন জায়গায় শিফ্ট করেছি সবে। ফার্স্ট ফ্লোরে ফ্ল্যাট। আমার ফ্ল্যাটের ব্যাংগ অপোজিটে যারা থাকেন, তাঁদেরও এক ছেলে। তার বয়স বছর পাঁচেকের বেশি নয়। কোনও একদিন নিচে খেলার সময়, ওদের আলাপ হয়ে থাকবে। একদিন ওই বাড়ির মহিলা আমার সঙ্গে গল্প করছিলেন। ওঁর কোনও তুতো বোনের বিয়েতে যাবার জন্য প্রস্তুতির কথা বলছিলেন। কথা বলতে বলতে উনি আমায় বললেন, আপনি তো আমাদের রীতি-রেওয়াজ সবই জানেন দেখছি। তাহলে আপনার বুঝি অন্য ধর্মে বিয়ে হয়েছে? আমি প্রশ্নটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। উনি সেটা বুঝিয়ে বললেন, ‘না মানে, ওই যে আপনার ছেলে সেদিন বলল, ওর নাম পিটার… কী যেন… তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।’
এটা শুনতেই আমি বুঝে গেলাম, কী ব্যাপার। আমি হেসে বললাম, ‘কী নাম বলেছে? পিটার পার্কার? যথার্থ…।’ মহিলাটি বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ এটাই বলেছে।’ আমার ছেলে স্পাইডারম্যান-পাগল। সে তার নিজের নামের আগে ‘পিটার পার্কার’ জুড়ে দিয়েছে বুঝলাম। তার নিজস্ব নাম পিছনের সারিতে থাকায়, মহিলাটির শুধু পিটার মনে ছিল, আর ‘পার্কার’ তিনি বিস্মৃত হয়েছেন। তার পরের অক্ষরগুলি তার মনে ঠাঁইও পায়নি। যত্নে রাখা নামটিকে যখন নামধারকই পাত্তা দেয়নি, তখন মহিলাটি আর ও নাম মনে রাখার দায় সামলাতেন কী করে? ছায়ের নাম চয়ন, মাকে একটু হলেই অজ্ঞান করেছিল আর কী! আমার কথা শুনে ভদ্রমহিলা হেসে কুটিপাটি!
এটাও ক’বছর আগের কথা। আমার ছেলের স্কুলে ওপেন হাউসে গেছি। খাতাপত্র দেখে বেরোব, এমন সময় ওর এক বন্ধুর মা আমাকে ডাকলেন। উনি তখনও ওঁর ছেলের খাতা দেখছেন। আমাকে ডেকে বললেন, ‘জারা দেখিয়ে একবার। ইয়ে লারকা ক্যা গুল খিলায়া হ্যায়।’ বাচ্চা তখন ক্লাস ফোর-এ পড়ে। আমি দাঁড়িয়ে আছি। ছেলের পরীক্ষার খাতার একটা পাতা উল্টে উনি ওনার ছেলের উদ্দেশে বললেন, ‘অউর ই কাহে নহি লিখে? ইয়েবালা তো জানতে থে না?’ ওঁর বাচ্চা গম্ভীরভাবে, জিজ্ঞাস্য প্রশ্নের দিকে নজর দিল। তারপর বলল, ‘লিখা তো থা।’ মা বললেন, ‘তো ফির টিচার মিটা দি হ্যায় ক্যা?’ বাচ্চা সরপট বলল, ‘লাগতা তো ওহি হ্যায়।’ মা প্রথমে আমার দিকে নজর দিয়ে বললেন, ‘দেখ রহী হ্যায়? এইসা হ্যায় ইয়ে।’ তারপর বাচ্চাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘চলো আজ ঘর তুম। মিটাতি হু তুমকো!’ কোনওরকমে আমি ওখান থেকে আগেভাগে কেটে পড়লাম! এমনতর উদাহরণের শেষ নেই। অভিভাবক আর বাচ্চাদের মধ্যে সম্পর্কটা যে ঠিক কী রকম, তা এককথায় বলা মুশকিল। নানা রঙের পরত থাকে তাতে!
আর এক বছরের কথা। রাজস্থান ভ্রমণে বেরিয়েছি আমরা। বাই রোড। উদয়পুরে পৌঁছনো হল ২৪ ডিসেম্বর সন্ধেতে। আমার ছেলে হঠাৎ করে বলল, ‘এবছর স্যান্টা আমায় গিফট দিতে পারবে না। স্যান্টা তো বাড়ি এসে আমায় খুঁজেই পাবে না!’ বললাম, ‘স্যান্টা পরে কখনও গিফট দিয়ে দেবেন।’ কিন্তু আমি খুব বুঝছিলাম, ক্রিসমাসের সকালে মোজার ভেতর কিছু আবিষ্কার না করার দুঃখ তার মনে বেশ চেপে বসেছে। আমি সেবছর এসব ভাবার একদম সময় পাইনি। তাই নিজের একটু খারাপ লাগলেও সেটাকে আর প্রশ্রয় দিলাম না। ছেলেও ডিনারের পর লোকাল পেস্ট্রি শপে গিয়েই খুশি হয়ে গেল। পরের দিন পঁচিশে ডিসেম্বর। ছেলে বিছানায় বসে খেলছে। আমরা হোটেল থেকে বেরোনোর জন্য তৈরি হচ্ছি। বাই রোড ট্রিপে কিছু ক্যাশ টাকাপয়সা রাখতে হয়। সব জায়গায় কার্ড চলে না। তাই বেশ কিছু টাকা আমি বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় লাগেজের মধ্যে, জামাকাপড়ের ব্যাগে রেখেছিলাম। পুরো সুটকেস খুঁজেও তার হদিস পেলাম না।
মনে মনে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছি। বাড়ির লোক বলছে, ‘এখন থাক না। পরে ঠিক পাওয়া যাবে।’ আমার মন তবু খটখট করছে। আনমনা হয়েই সুটকেস বন্ধ করলাম। তখনই ছেলে খুশিতে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘ইয়েএএএ… স্যান্টা গিফট দিয়ে গেছে! স্যান্টা হ্যাজ ফাউন্ড মাই অ্যাড্রেস!’ সাত বছরের ছেলে কীসে এত আত্মহারা, তা দেখতে গিয়ে দেখলাম, সে লাল-সাদা স্যান্টা টুপিটা পরতে গিয়ে, তার ভেতর ক্যাশ টাকা আবিষ্কার করেছে। আর সে নিশ্চিত, টুপির ভেতর স্যান্টাই টাকা রেখে গেছে! ততক্ষণে আমার মুখেও হাসি ফুটেছে।
পরে উদয়পুর দর্শনের সময় ছেলে আমাকে বলল, ‘মা, স্যান্টা দেখেছে, আমরা বাইরে আছি। তাই গিফট না দিয়ে টাকা দিয়ে গেছে। যাতে আমরা পরে ওই দিয়ে নিজেরাই গিফট কিনে নিই। এখানে গিফট দিলে ক্যারি করতে প্রবলেম হতে পারে তো তাই।’ আমি আমার আগামী গচ্চার হিসাব করে নিলাম! মনে মনে স্যান্টাকে ধন্যবাদও দিয়ে দিলাম। সেবারের ক্রিসমাস গিফটটা স্যান্টা আমাকেই দিয়েছিল! মনে মনে ‘ছা’-কে বললাম, ‘কার স্যান্টা কে!’