Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

সিঁড়ি

৩/৪ বিন্ধ্যবাসিনীতলায় নান্টুর দোকানের উলটো দিকের গলিতে একটা সিঁড়ি ছিল। ডাবল ডেকার বাসের মত একদম রাস্তা থেকেই উঠে গেছে। এই সিঁড়ি দিয়ে কারা কারা উঠেছিল?

এই রকম ক্ষুৎকাতর, এবং অবশ্যই হৃদয়সর্বস্ব সিঁড়ি আমি দেখিনি। কবাট একটা ছিল, আড়াল দরজা, কিন্তু তাকে তুমি যতই লাগিয়ে রাখো, সে ঠিক খুলে যাবেই। সিঁড়িটাই চাইত না এসব ফালতু বখেরা। পাড়ার পটলার যেমন ঘোড়ার ল্যাজের মত ঘন ঝালর মন, বাদামি। যেকোনও মেয়ের সামান্য ঈশারায় সে ট্রাপিজের খেলা থেকে শুরু করে ভাঙরা নাচ, এমনকি সাহারায় মুলোর চাষ করে ফেলতে পারে। সেইমত উদার তাকলামাকান পর্যন্ত বিস্তৃত হৃদয় সিঁড়ির দোতলায় আমরা থাকতাম।

সিঁড়িটার কোনও রকম দুর্জ্ঞেয় ভৌতিক কৌশল জানা ছিল। মধ্যরাতে চুপিসারে ও কোনার ব্যাঁকা টিনের দরজাটা খুলে রেখে দিত।

একদিন একটি গোরু উঠে এল। চার ঠ্যাং ছ্যাতড়ানো, লাল চোখ, বদমেজাজি, নাক দিয়ে গরম ফোঁস ফোঁসে নিশ্বাস, এক সাদা গোরু। সে তো গট গট করে উঠল। তাকে নামায় কে! বাবা বাড়ি নেই, সে চাতালে উঠে তার প্রত্যাশিত মহার্ঘ্য কিছু না পেয়ে, ঘুরে গেল। ঘরের দরজার দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে রইল। শুধু তাই নয় দরজার পর্দায় নার্ভাস হয়ে গোবর ছেটাতে লাগল।

নিচে লোক জমে গেছে। দাদু কাকা বলছে, দমকল ডাকো। কেউ কেউ হাম্বা-আ-আ ডেকে ওকে আকর্ষিত করতে গেল। বেলা দুটোয় সব চৌপাট করে, টিন দরজায় টোল খাইয়ে নেমে, সে কাশীনাথদের করমচা গাছের তলায় বসল।

এর পর একদিন একটি রুগণ অসুস্থ, ঘেয়ো, ক্লান্ত শকুন উঠল। নিরীহ প্রাণী। ওই রকম চৌম্বক শক্তিসম্পন্ন, ব্ল্যাক হোলের মত সিঁড়িকে বোধ হয় উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। অমঙ্গল! অমঙ্গল! করে আরতি পিসি তার ওপর গঙ্গাজল, গাঁদা ফুল ছেটালো। চিৎকাতর, ভীত, অদ্ভুত শূন্য রেলিংয়ের মত লম্বা গলা, তাকে একটি বাটিতে মুড়ি দেওয়া হল। অপমানে লজ্জায় স্তম্ভিত হয়ে সে নেমে গেল!

বহু অ্যাডভেঞ্চারে সে অবসন্ন নায়কদের মাথার ওপর উড়েছে, টার্গেট করেছে। তপ্ত মরুতে নায়কদের সঙ্গে তার শেষ চোখাচোখি হয়েছে। আফ্রিকায় সিংহের অদূরে বসে প্রতীক্ষা করেছে। হায়!

এক ভোরে, সাড়ে ছ’টা তখন। ঘুমোচ্ছি, হঠাৎ বড় বড় কাপড় ফালি করার ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ শব্দে ঘুম চটে গেল। ফ্যাঁচ নয় ফর ফর! দেখি ঘরময় মুরগি উড়ছে। তিনটে। একটি খাটের ছত্রিতে বসেছে। অথচ সিঁড়ির দরজা বন্ধ ছিল। তো ওকে তো বিশ্বাস নেই। প্ররোচনাদাত্রী রহস্যময় খিটকেল সিঁড়ি। মহাকাশের সঙ্গে সম্পর্ক আছে ওর। অন্য গ্রহের এজেন্ট। সিঁড়ির ক্যামোফ্লাজে অবজার্ভ করছে।

সন্ধেরাতের দিকে শেয়ালও এল একদিন। “দেকি কী হচ্ছে!” যেন সাবুদানা পাঞ্জাবি আর ধুতি পরা বিয়েবাড়ির কর্মকর্তা। চাঁদাওলারা চাঁদা না পেয়ে নেমে গেল (আমাদের বাড়ি কোনও পুজোয় চাঁদা দেওয়ার রেওয়াজ নেই), তারপরেই শেয়ালটি উঠল। মা বলল, “চাঁদাওয়ালারাই লেলিয়ে দিয়েছে।”

আশ্চর্য! তারা কি শেয়াল ভাড়া করে নিয়ে ঘুরছে?

সুঁচোল মুখ, ঝামর লেজ “যাই একটু হাওয়া খাই” বলে সে ছাদে চলে গেল।

নীল নক্ষত্র জ্বলা আকাশের তলায় তার জ্বলন্ত চোখ স্তব্ধ হয়ে আছে। কাঠচাঁপার ভরপুর গন্ধ, আর অঢেল ফাল্গুনের হাওয়া। ফুরফুরে জ্যোৎস্নায় রঙ্গিলা নটীর মত এক রাত কাটিয়ে সে ভোরে কখন নেমে গেল।

ভাম বিড়াল এসেছিল, গায়ে বিকট গন্ধ। যথেষ্ট হিংস্র হলেও সিঁড়ি চড়ার আনন্দঘন কৌতূহলে গলে গিয়ে সে নিপাট ভদ্রতা করেছিল।

সাধু, ভবঘুরে, ক্ষ্যাপাটে, চিরুনী, ধুপকাঠি বিক্রেতা, নায়িকা রেখার মত দেখতে ডানকুনির ঘুঁটেওয়ালি, ফ্রড, জোচ্চর কে না উঠেছিল। ভবের হাটের সাঁই ফকিরদের মত আখড়া খুলে বসেছিল সেই সাধক সিঁড়ি। চারগাছা ব্রোঞ্জের ওপর সোনা দেওয়া চুড়ির বদলে তিনটে স্টিলের থালা, পাঁচটা চামচ গছিয়ে বাসনওয়ালি খিল্লিতে ডুগডুগি হয়ে ওই ঘুপচি দম চাপা সিঁড়ি দিয়েই নেমেছিল।

সুচিত্রা মিত্র, মান্না দেরাও ওইখানে ঘুরপাক খেয়েছে। সোমার মা আর ভোলার প্রেমালাপ, তাদের পালিয়ে যাওয়ার দিন দুপুরে সিঁড়ি সব দেখেছে নির্বিকার। টোকো করমচা গাছের পাতা উড়ে উড়ে এসে পড়ত বিকেলে, রুনুদার ব্যান্ড পার্টি থেকে বেরিয়ে আসত তাজা মিঠুন। মিঠুন চক্রবর্তী, মাইকেল জ্যাকশন বহু বার উঠেছে ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে। এই সিঁড়িতেই অনিল কুম্বলে, অজয় জাদেজা শালপাতায় ঘুগনি চাটতে চাটতে ডিসিশন নেয়, আন্ডার সিক্সটিনে চান্স পেলে ফাইনাল পরীক্ষা আমার বাপ দেবে শালা!

Advertisement

সিঁড়ির গায়ে চৌকো ঘুলঘুলির প্রজেক্টটার দিয়ে বামুন মাসিমার বাড়ির হরিলুট আর ছাদ পেটানো গান, তাদের যুবতী বউদের ঝগড়া বায়োস্কোপের মত আলোছায়ার বয়ে গেছে সিঁড়ির ভেতর।

আজ অনেক দিন হল ছেড়ে এসেছি সেই সিঁড়ি। হাওয়া, জল আর সম্ভাবনা দিয়ে চাষ করেছিল সে আমাদের।

এখন অন্য সিঁড়ি। দুর্দান্ত, ভয়াল, খাড়া। শ্বাসের শব্দ। গভীর গোপন সোপান। মাঝেমধ্যে ধোঁয়ার রথে চড়ে ঈশ্বর এসে বসে। বলে দু-একটা পাগল দে, নিয়ে যাই। সৃষ্টিকাজে ক্ষ্যাপা কম পড়লে মুশকিল।

চিত্র: গুগল

কচুরি

সাধু

কারখানা বিরিয়ানি

লিটল বুদ্ধ

বাংলা আওয়াজ

শেরপা

সবুজ মিডাসের ছোঁয়া

ঘুষ

জুতো

মাদারি কা খেল

ইসবগুল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

6 + twelve =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »