কর্নাটকের হৈসল প্রাচীন মন্দিরের সূক্ষ্ম ভাস্কর্যে কৃষ্ণও রয়েছেন। এই হৈসল মন্দির থেকে শুরু করে মহাবলিপুরমের গুহা পর্যন্ত হিন্দু পুরাণের অন্যতম ‘রোমান্টিক’ দেবতা যেভাবে দক্ষিণ ভারতকে মুগ্ধ করেছেন, তা কিন্তু অদেখা রয়ে যাওয়া অসম্ভব। ভুলে গেলে চলবে না ভক্তি আন্দোলনের শিকড় ভারতের তামিলভাষী অঞ্চলেই। এখানেই রচিত হয়েছিল বিখ্যাত শ্রীমদ্ভাগবতম। শঙ্করাচার্য, শ্রী রামানুচার্য এবং মধ্বাচার্যও দক্ষিণ ভারতেরই। আলওয়ারের সাধুরা কৃষ্ণের প্রশংসায় রচনা করেছিলেন অসাধারণ সমস্ত চরণ। কবি আণ্ডালের (অপর নাম গোডাদেবী, নচিয়ার ও কোতাই) ‘তিরুপ্পাভাই’ আজও প্রতিটি বৈষ্ণব মন্দিরে গাওয়া হয়। যদিও এরজন্য ধন্যবাদপ্রাপ্ত দক্ষিণ ভারতের মানুষরাই। তাঁরাই দক্ষিণের রাজ্যজুড়ে সঙ্গীত, নৃত্য এবং নাটকের মাধ্যমে সংস্কৃতির এই দিকটাকে জীবিত রেখে দিয়েছেন। অতি আধুনিকতার দোহাই দিয়ে তাঁরা তাঁদের সংস্কৃতির ইতিহাসকে দূরে ঠেলে দেননি। দক্ষিণের বেশ কিছু বিশিষ্ট কবি ও দার্শনিক, বিশেষ করে তেলেগু বংশোদ্ভূত যেমন বল্লভাচার্য, রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী, গোপাল ভট্ট উত্তরে চলে এসে সমগ্র অঞ্চলে পুষ্টিমার্গী ও বৈষ্ণব শিক্ষা ছড়িয়ে দেন।
কর্নাটকে বৈষ্ণবধর্মের প্রসারের জন্য কবি ও লেখকদের অনেক সম্প্রদায়ের ভূমিকা রয়েছে। মধ্বাচার্যের অনুসারীরা, যাঁরা দ্বৈত বেদান্ত বা বিম্বপ্রতিবিম্ববাদের প্রস্তাবক, এই অঞ্চলজুড়ে একাধিক মঠ স্থাপন করেছিলেন তাঁরা। এই চিন্তাধারার মধ্যেই বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের গুরু ব্যাসতীর্থ দীক্ষা দিয়েছিলেন শ্রীনিবাস নায়ককে (১৪৮৪-১৫৬৪)। তিনি যে সন্ন্যাসী প্রথা অনুসরণ করেছিলেন, সেই অনুসারে তাঁর নামকরণ করা হয়েছিল পুরন্দর দাসা। কৃষ্ণের ভক্তিতে তিনি চার লক্ষ পঁচাত্তর হাজারেরও বেশি পদ ও গান রচনা করেছেন। একে অসাধ্য সাধনও বলা যেতে পারে। কন্নড় এবং সংস্কৃত ভাষায় লেখা কয়েকশো গান আজও টিকে আছে। গানগুলি গাওয়া হয় বিভিন্ন সংগীতানুষ্ঠানে। কর্নাটকী সঙ্গীতের ‘পিতামহ’ হিসাবে সমাদৃত তিনি। মিয়া তানসেনের শিক্ষক স্বামী হরিদাসের ছাত্র হওয়ার কথা ছিল পুরন্দর দাসার। তাই তিনি উত্তর ভারতেও শ্রদ্ধেয়। ২০ শতকে তাঁর গান হিন্দুস্তানি এবং কর্নাটকী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত উভয় ক্ষেত্রেই সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পণ্ডিত ভীমসেন যোশির মত হিন্দুস্থানি কিংবদন্তিরা তাঁর সৃষ্টি গেয়েছিলেন। এম এস সুব্বলক্ষ্মীর মত কর্নাটকী সঙ্গীতজ্ঞরা তাঁদের নিজ নিজ ঘরানায় পুরন্দরের গান জনপ্রিয় করেছিলেন।
কেরালায় কৃষ্ণের সবচেয়ে বিখ্যাত মন্দির গুরুভায়ুর মন্দির। মন্দিরটিকে বলা হয় ‘ভূলোক বৈকুণ্ঠ’ বা মর্ত্যস্থিত বৈকুণ্ঠও। এই মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের যে মূর্তি পুজো হয় তা চতুর্ভুজ। তাঁর চার হাতে পাঞ্চজন্য শঙ্খ, সুদর্শন চক্র, কৌমোদকী গদা ও পদ্ম। কৃষ্ণ অবতার গ্রহণের সময় বাসুদেব ও দেবকীর কাছে প্রকাশিত মহাবিষ্ণুর প্রতীক একটি দিব্য তুলসী মালা দেবতার গলদেশে লম্বমান। এই কারণে এই মন্দিরটিকে দক্ষিণ ভারতের দ্বারকা বলা হয়। শ্রীকৃষ্ণও এখানে নানা নামে পরিচিত। যেমন— কান্নান, উন্নি-কান্নান (শিশু কৃষ্ণ), উন্নি-কৃষ্ণন, বালকৃষ্ণন ও গুরুভায়ুরাপ্পান। বিষয় হল, গুরুভায়ুর মন্দির কবি মেলপাথুর নারায়ণ ভট্টাথির (১৫৫৮-১৬৪৩) সঙ্গে সম্পর্কিত। তিনি বিখ্যাত মহাকাব্য ‘নারায়ণিয়াম’ লিখেছিলেন। নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণদের একটি পরিবারে জন্মগ্রহণকারী ভট্টাথির ছিলেন গণিত ও যুক্তিবিদ্যা এবং তর্ক ও ব্যাকারণে বিশেষজ্ঞ। কৃষ্ণভক্তিই তাঁকে দিয়ে ‘নারায়ণীয়ম’-এর ১০৩৬টি সংস্কৃত শ্লোক লিখিয়ে নিয়েছিল। এই ‘ম্যারাথন’ কবিতা রচনা করার সময় তাঁর বয়স তিরিশ বছরও হয়নি। এটাই তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রতিভা। যদিও তিনি কেরালার প্রথম কবি নন, যিনি কৃষ্ণভক্তিকে এত আবেগপূর্ণভাবে পরিচালিত করেন। তাঁর বহু শতাব্দী আগে, দ্বাদশ শতাব্দীর কবি বিল্ব মঙ্গলা ‘শ্রীকৃষ্ণ কর্ণামৃতম্’ রচনা করেছিলেন। তিনিও উত্তরে চলে আসেন। বাকি জীবন বৃন্দাবনের উপকণ্ঠেই কাটিয়ে দেন। ২০ শতকে চেম্বাই বৈদ্যনাথ ভাগবতার এবং তাঁর ছাত্ররা ‘নারায়ণিয়াম’-এর গানগুলি গেয়ে কর্নাটকী সঙ্গীতে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।
ভেঙ্কট সুব্রহ্মণ্যম (১৭০০- ১৭৬৫) তামিলনাড়ুর তাঞ্জাভুর জেলার পাপানাসাম তালুকে এক স্মার্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। জায়গাটি একটি সমৃদ্ধশালী ভাগবত মেলা নৃত্য-নাট্য ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। এখানকার কৃষ্ণের প্রাচীন মন্দিরটি ‘কলিঙ্গ নর্তানা’ নামে পূজা করা হয়। মন্দিরের ইতিহাস বলে, ভিতরে পূজিত মূর্তিটি ‘স্বয়ম্ভু’ বা স্বয়ং উৎপন্ন। প্রাচীন এই মন্দিরকে বেষ্টিত করে থাকে শহর, সঙ্গীতজ্ঞ এবং মহান পণ্ডিতরা। এই ভেঙ্কট সুব্রহ্মণ্যম শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাঁর ভক্তিতে অসংখ্য গান রচনা করেন। বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি তামিল ও সংস্কৃত উভয় ভাষায় পাঁচ শতাধিক সঙ্গীত রচনা করেছেন, যার মধ্যে কয়েকটি অবশিষ্ট। উথুকাডু গ্রামে বসতি স্থাপনের পর তিনি উথুকাডু ভেঙ্কট সুব্বাইয়ের এবং উথুকাডু ভেঙ্কটা কবি নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। কবিতা ও গান ছাড়াও তিনি ভজনও রচনা করেন। বিশ শতকে নীদামঙ্গলম কৃষ্ণমূর্তি ভাগবতার তাঁকে আধুনিক কর্নাটকী সঙ্গীতে দীক্ষিত করেন। সাম্প্রতিক সময়ে চিত্রবীণা এবং গোটুবাদ্যম শিল্পী রবি কিরণ উথুকাডু কবির কাজ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে একটি অসাধারণ কাজ করেছেন। কর্নাটকী কণ্ঠশিল্পী অরুণাসাইরাম তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত ‘কলিঙ্গ নর্তানা থিল্লানা’ জনপ্রিয় করেছেন।
এগুলি ছাড়াও আরও কয়েকজন, যেমন নারায়ণ তীর্থ (১৬৫০-১৭৪৫), অন্ধ্রের কারভেরিনগরমের সারঙ্গপানি (১৭ শতক), কর্নাটকের কনকদাসা (১৫০৯-১৬০৯) প্রমুখ কৃষ্ণভক্তিতে পদ এবং গান রচনা করেছেন। ভরতনাট্যম, কুচিপুড়ি, মণিপুরী এবং যক্ষগণ-এর মত কর্নাটকী সঙ্গীত এবং নৃত্যের প্রসারের জন্য তাঁদের একটি বড় অংশ একটি ‘জীবন্ত ঐতিহ্য’ হিসাবে রয়ে গিয়েছেন। যদিও এই গানগুলির বেশিরভাগই স্থানীয় ভাষা এবং আঞ্চলিক উপভাষায়। ভারতের একটি বৃহৎ অংশে তা গ্রহণযোগ্য হতে পারেনি। তার অন্যতম কারণ হিসাবে হিন্দিভাষার আধিপত্যের কথা বলা যেতে পারে। তবে একটা কথা, কৃষ্ণ অনুরাগে দক্ষিণ ভারত কিন্তু কোনও অংশে কম নয় উত্তর ভারতের চেয়ে।
তথ্যঋণ: ফোর এনসিয়েন্ট পোয়েটস অফ ডিফারেন্ট সাউথ ইন্ডিয়ান লাঙ্গুয়েজেস হু ইমমর্টালাইসড লর্ড কৃষ্ণা – বিজয় সাই