Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

লিটল বুদ্ধ

পেমিয়াংসি মনাস্ট্রির সিঁড়িতে বসেছিলাম। মাথার ওপর বিছিয়ে আছে ঝাপসা রোদের আলো। তারই কিছু রঙে নিচের বনভূমিকে আরও গাঢ় দেখাচ্ছে।

অসমতল পাথুরে রাস্তায় ধূসর ধুলোর দিকে ঝুঁকে আছে বাঁশঝাড়, এলাচ গাছের সারি আর রডোডেনড্রন। সমস্ত পশ্চিম সিকিমটা রাজার মত শাসন করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা।

শ্যুটিং এর কাজ চলছে, আমি পালিয়ে এসে ফাঁকি মারছি।

ঠান্ডা পাথরের মেঝেতে বসে দুটো অমনোযোগী বাচ্চা সাধু প্রেয়ারের মাঝখানে নিজের মধ্যে ফিসফাস করছে। এই মনাস্ট্রি ছাত্রাবাসও বটে।
নেড়ামাথা শ্রমণদের মধ্যেও ফোটোক্রোমাটিক চশমা পরা অমরেশ পুরির মত হাবভাব এক বুড়ো পাশের বুড়োর সঙ্গে লাস্ট বেঞ্চে বসা ছেলেদের মত ক্রমাগত কথা বলে চলেছে। মন্ত্রফন্ত্র কিছুই বলছে না। টোটাল ফাঁকিবাজ।

কাঞ্চনজঙ্ঘা, পান্ডিম রেঞ্জের দিক থেকে বরফ মেশানো ঠান্ডা হাওয়ায় পত পত করে উড়ছে বাঁশের ঝান্ডায় টাঙানো সাদা কাপড়ের টুকরো।

বুদ্ধের নিজেরই পুজোফুজোয় মন নেই। থাঙ্কার সামনে চালের ওপর রাখা পাথছম মিন্তো ফুলের পাতলা ডানার দিকে তাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মনাস্ট্রির সর্দার রাঁধুনি ইয়াপচুঙ বাঁশের মত সোজা, ঢ্যাঙা, সরু, কোথাও বাঁকেনি-চোরেনি-ঢেউ খেলেনি, গোঁপখানাই যা একটু দেখার। মোটা কড়িকাঠের শতাব্দীর ধোঁয়া অন্ধকার ঠেলে, বাঁশের চোংয়ে বানানো দুধ মাখন নুন দেওয়া টেমি চা দিয়ে যাচ্ছে। ছেলে বুড়ো বাচ্চা, মোটা মোটা নেপালি বুড়িরা জপযন্ত্র ঘোরাতে ঘোরাতে ছিপি খোলা ভসভসে সোডার মত হাসছে।

আড়াই হাতি শিঙা, পেতলের বিশাল করতাল, গুরুনিনাদে ড্রামের শব্দের মধ্যে স্থানুবৎ বসে আছে পরবর্তী রিম্পোচে।

এ তো বলিউডের হিরো! এ এখানে কী করছে! টকটকে আলোর মত রং ছড়িয়ে বছর কুড়ির এই যুবক কী অসীম ঔদাসীন্যে শুকনো কাষ্ঠবৎ প্রাচীন বয়োবৃদ্ধদের মধ্যে বসে আছে!

শ্যামনগরে গঙ্গার ধারে এক সহজিয়া সাধকের মুখে দেখেছলাম, এইরকম মরমী নির্লিপ্তি, কিন্তু সে তো পোড়খাওয়া,অনেক দিনের কৃষ্ণপথিক।

ক্যামেরা সেট হয়েছে। ওরা, ডাকছে আমায়! আগুন ঘিরে নাচছে বীভৎস মুখোশ পরা মঙ্করা। নিচে গড়ানো খাদ থেকে উঠেছে বড় বড় হাতির কানের মত কী যেন গাছ।

রোল ছাম, সানাগ ছাম, দূর ছাম, সাও ছামের ধীর কণ্ঠে ব্যাখ্যা চলছে। গুরু ড্রাকমা ছাম (নৃত্য) একমাত্র এখানেই হয়। হইহট্টগোল অবশ্য ফুটতে থাকা খইয়ের মত এ সবের ধর্মব্যাখ্যায় গুলি মেরে এন্তার খাবারদাবার সাঁটিয়ে যাচ্ছে। সশব্দ বায়ু নিঃসরণও চলছে।

মুঠো করে কি হাওয়া ধরা যায়? আনন্দ কবে নিয়মের ধার ধেরেছে? মৃত্যুশয্যায় প্রিয় শিষ্য যখন বুদ্ধকে প্রশ্ন করেছিল, ‘‘আপনার মৃত্যুর পর কোন পথে চলবে সংঘ বলে দিয়ে যান।’’ বুদ্ধের বয়ে গেছে নিয়ম বলতে, আচারে ধর্ম মেলে না। বলেছিলেন, ‘‘আত্মদীপ ভব, আত্মশরণ ভব, অনন্যোশরণ ভব। নিজে নিজের পথ খোঁজ।’’

এই যে গায়ে গায়ে বাঁচা, গরিব পরিশ্রমী মানুষের একটু আমোদের মুহূর্ত এর চেয়ে বড় ধর্ম কীসে? নরুনচেরা চোখ আর চ্যাপ্টা ঠোঁটে একটাই হাসি। ‘‘মো তুমরো মায়া গরচু।’’ (আমি তোমায় ভালবাসি)।

লোকজন ভরপুর শীতের রোদে ভরা মাঠে চেঁচামেচি আর গণ্ডগোলের মধ্যে ঝুপ করে দুচারটে মেঘ এসে বিকেল ডেকে নিয়ে চলে গেল। প্রাচীন মনাস্ট্রির দেওয়াল ঘিরে প্রদীপের ছায়া কাঁপে। প্রধান মঙ্কের সামনে রেকাবিতে ফল, স্যাক্স, সব নেতিয়ে পড়েছে।

একটু পরে সন্ধ্যা নামবে। সিকিমিজ বস্তি থেকে আসবে ছাঙ। বাঁশের টুঙবায় গরমজলে ভিজবে মিলেট, রাগি, কেদো, মকাই। বাঁশের নল দিয়ে টেনে নেবে টকচে অ্যাসিটিক স্বাদ।
মনাস্ট্রির বাইরের চত্বরে একটামাত্র দেওয়ালের ব্যবধানে বাঁশের খুঁটির ওপর প্লাস্টিকের চাল চাপিয়ে অস্থায়ী দোকান দিয়ে পুরো সিকিমিজ পরিবার নেমে পড়েছে টু পাইস রোজগারে।
ভাই হিলিহিলে রোগা ড্রাগন টেইল চুলের কাট। বিফ সসেজ স্লাইজ করছে। চিঙ্কি বোন বসেছে ক্যাশে।

সিকিমি আর ভাঙা হিন্দি মিশিয়ে বলছে, ‘‘বিফ পর্ক, সোব মিলেগা আইয়ে।’’

মাঝবয়সী বাবা গ্যয়াথুক নুডুল সেদ্ধ করছে কাঁচা হাতে। মাঝে মাঝে পায়ের তলায় পোঁটলাপুঁটলি ঘেঁটে কী খুঁজছে! কিছু একটা হারিয়েছে নির্ঘাত।
ওপাশ থেকে পর্দা ঠেলে ঢুকল বড়ছেলে, পুরো জ্যাকি চ্যাং! উয়াওউ করে এই বুঝি সাতটা টালি ভেঙে ফেলল।

মুখ বন্ধ বাঁশের চোঙে নিভু আঁচে পর্ক ভাপানো হচ্ছে। বড়ছেলের স্যোয়াগ কী! তিনটে মেয়ে ওকে দেখে হাসিতে খান খান হচ্ছে। জ্যাকি দেখি জ্যাকেটের ওপরের দুটো বোতাম খুলে দিল।

Advertisement

নড়বড়ে টেবিলের তলা থেকে পায়ের ওপর উঠছে হিলহিলে পাথুরে ঠান্ডা। টেবিলে গরম লাল চিলি পর্ক থেকে ভাপ উঠছে। বাষ্পের ওপর দিয়ে জ্যাকির চোখ মাঝের মেয়েটার দিকে পালক বুলিয়ে চলে গেল। এত সুন্দর মাখন চোখের কাজ জ্যাকির। থুকপার ওপর ভাসছে চর্বি।

বাইরে পাহাড়ের ওপর বাড়িগুলোতে জ্বলে গেছে জরি আলো। ওপারে মনাস্ট্রিতে নিরামিষ মোহি, সেল রুটি, সিমি আচার, রাই শাক আর এপারে রকসির (রাইস বেস ডিস্টিলড অ্যালকোহল) সবুজ নেশায় জ্যাকি তার ভাইয়ের ব্রাউন চামড়ার জ্যাকেট জ্বলছে। পেতলের বোতাম ঠিকরে দিচ্ছে আলো। অসমতল পাথুরে ঢালু পথ বেয়ে বুদ্ধের দূত হয়ে স্বয়ং বেশরম প্রেম এসে বসেছে ভাঙা বেঞ্চে।

ওদিকে প্রবৃত্তির বলি হচ্ছে পাতলা প্রতীকী কাপড়ে আগুন ধরিয়ে। উন্মত্ত নাচ, ধোঁয়া উঠছে মনাস্ট্রির ছাদ ছাড়িয়ে আকাশে। ক্যামেরা লো অ্যাঙ্গেল ধরেছে।

ছোট পাহাড়ি গ্রাম। সারা অঞ্চলে একটাও ওষুধের দোকান নেই। নেই ডাক্তার। যেতে হবে পাঁচ কিলোমিটার নীচে গেজিং-এ। ছোটছেলে দর্জি সারাদিন পর বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। সারাদিন অদ্ভুত আগ্রহে শ্যুটিং দেখেছে, উদ্ভট ভাষায় প্রশ্ন করেছে।
ও এখানে পড়তে আসে।

গলায় একটুকরো পাথর মাদুলির মত বাঁধা। অসুখ হলে ওটাই পুড়িয়ে শুঁকে নেয়। দিব্বি চড়াই পথে নামছে উঠছে সবাই। হাসছে। এত হাসে কেন? দুটো করে র‍্যানট্যাক দিলে সিল হয়ে যাবে। ব্যাস! এই তো! আর কী!

চিত্র: গুগল

কচুরি

সাধু

কারখানা বিরিয়ানি

বাংলা আওয়াজ

শেরপা

সবুজ মিডাসের ছোঁয়া

ঘুষ

জুতো

মাদারি কা খেল

সিঁড়ি

ইসবগুল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

3 × 3 =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »