[পঞ্চম পর্বের পর…]
তৎকালীন ভারতে নৃত্যচর্চা
১৯৩০ সালকে কেন্দ্র করে সংক্ষেপে আলোচনা করব বিষয়টি বোঝবার সুবিধের জন্য। এর কিছু আগে থেকেই শিক্ষিত ভদ্র অভিজাত ব্রাহ্মণ পরিবারগুলিতে নাচের চর্চা বাড়তে শুরু করে। বালা সরস্বতী, পারিবারিক দেবদাসী ধারা বহন করে নৃত্যচর্চা করেছেন। দেবদাসী প্রথা রদ হওয়ার পর বালা সরস্বতীই সম্ভবত প্রথম, যিনি দক্ষিণ ভারতের বাইরে নৃত্য পরিবেশন করতে শুরু করলেন ১৯২৫ সাল থেকে। ১৯৩৪-এ তিনি প্রথম কলকাতায় নৃত্য প্রদর্শন করেন। এরপর পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, পৃথিবী জুড়ে নৃত্য পরিবেশন করেন তিনি।
রাগিণী দেবী, জন্মসূত্রে যিনি আমেরিকান, বিবাহ করেন ভারতীয় পদার্থবিদ রামলাল বাজপায়ীকে এবং ভারতে এসে নৃত্যশিক্ষা করেন দেবদাসী মেল্লাপুর গৌরী আম্মার কাছে। আমেরিকায় ‘হাইক্লাস ওরিয়েন্টাল ওম্যান’ হিসেবে পরিচিত রাগিণী দেবী ‘হিন্দু নৃত্য’ পরিবেশন করেন এবং আমেরিকা-ইউরোপে এই নৃত্যকে জনপ্রিয় করে তুলতে চেষ্টা করেন। পরবর্তীকালে তাঁর কন্যা ইন্দ্রাণী, যিনি বিবাহ করেন ভারতীয় স্থাপত্যবিদ হাবিব রহমানকে, তিনিও ভরতনাট্যম, ওড়িশি, মোহিনীয়াট্টম নৃত্য পরিবেশন করেছেন দেশে-বিদেশে। এই সময়ে ভারতীয় নৃত্যের নামকরণগুলো নৃত্য প্রচারকদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয়। ‘হিন্দু নৃত্য’ ‘ওরিয়েন্টাল ডান্স’ ‘এথনিক ডান্স’ ইত্যাদি। ক্লাসিকাল শব্দটি আরও কিছু পরে যুক্ত হবে।
এতকাল যে নৃত্য ছিল মন্দিরের ভেতরে শুধুমাত্র দেবতার নামের আড়ালে ব্রাহ্মণদের জন্য প্রদর্শিত, সেই নাচকে নিয়ে আসা হল মন্দিরের বাইরে শিক্ষিত বিত্তশালী সমাজের সংস্কৃতির আসনে বসানো হল তাকে। প্রাথমিক কারণ দেবদাসী প্রথা রদ। দেবদাসী প্রথার আড়ালে যথেচ্ছ বেশ্যাবৃত্তি চলছে, শহুরে শিক্ষিতদের এক অংশের এই অভিযোগ এবং মামলার ভিত্তিতেই এই আইন প্রণয়ন করে ব্রিটিশ সরকার। অন্য আর এক শ্রেণি শহুরে শিক্ষিত ও ধনবান, অবশ্যই ব্রাহ্মণ্যবাদী, যারা ব্রিটিশ রাজত্বেই গড়ে ওঠা নানা নতুন পেশায় ও ব্যবসায়ে প্রভূত উন্নতি করেছে, তারাই উদ্যোগী হল শাস্ত্রীয় নৃত্য গঠন ও প্রসারে।
আমার অনুসন্ধানে এর কারণ মূলত দুটি। এক, ব্রাহ্মণ এবং শিক্ষিত পরিবার থেকেই যখন মেয়েরা নাচ করতে আসবে, তখন তা সমাজে স্বাভাবিকভাবে ন্যূনতম সম্মান অধিকার করবে। দুই, মন্দিরের ভেতরের নাচ না দেবদাসী প্রথা আসলে বেশ্যাবৃত্তির সামিল নয়, বরং দেবতার কাছে আত্মনিবেদন একটি পরমসৌভাগ্যের বিষয়, এটা প্রতিষ্ঠা করার বাসনা। তাই যদি না হত তবে ব্রাহ্মণ বা রাজা নিজের নিজের মেয়েদের এই বৃত্তিতে আসতে দিতেন না, ভাবটা খানিক এইরকম। ভাব থাকতেই পারে কিন্তু এর সঙ্গে সত্যের আসলেই কোনও সম্পর্ক নেই। কন্যাসন্তান এদেশে যে কত কাঙ্ক্ষিত আর তার কত সম্মান, তা বোধ হয় আলাদা করে উল্লেখ করার প্রয়োজন হবে না। ব্যতিক্রমী মানুষ অবশ্যই আছেন কিন্তু তা স্বাভাবিকভাবে ধরার কোনও কারণ নেই।
আরও একটি বড় উদ্দেশ্য সাধিত হল, তা হল এই নৃত্যের আধারে ব্রাহ্মণ্যবাদী ও নিবেদনের সংস্কৃতির বহুল প্রচার ও প্রসার। কে না জানে যে, পুরুষতন্ত্রের সবচেয়ে বড় রক্ষাকর্তা ঘরের মেয়েরা। মেয়েদের ধাঁচে ঢেলে খানিক মহান করে তুললেই সে তারই শোষণযন্ত্র পুরুষতন্ত্র ও ব্রাহ্মণ্যবাদকে মাথায় করে রাখবে, হলও তাই। উপরি পাওনা হল বিদেশেও নব্যগঠিত শাস্ত্রীয় নৃত্যের বাজার তৈরি হল, যা ভারতীয় সংস্কৃতির পরিচয় হিসেবে তুলে ধরল তথাকথিত হিন্দু সংস্কৃতিকে, আধ্যাত্মিকতা যে সংস্কৃতির মূল উপজীব্য। দৈনন্দিন জীবনে যত সমস্যাই থাকুক না কেন আধ্যাত্মিক সাধনাই হল মুক্তিলাভের একমাত্র উপায়। প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, বিপ্লব থেকে শত যোজন দূরে ঠেলে দেবে মানুষকে যে সংস্কৃতি, নিজের দুরবস্থার জন্য নিয়তির ওপর দায় ঠেলে দেবতার ভজনা করে যাবে মানুষ, মুক্তিলাভের আশায়।
সামান্য হলেও আরও একরকম প্রচেষ্টা কিন্তু শুরু হয়েছিল এই সময়ে। ভারতীয় আধুনিক নৃত্যের ধারা, সাধনা বসু, বুলবুল চৌধুরী, উদয়শংকর প্রমুখ সাধারণ মানুষের জীবন ও যাপন নিয়ে নানান লোকনৃত্য, মূকাভিনয় সংযুক্ত একধারা প্রবর্তন করলেন বাংলায়, যা জনপ্রিয়ও হয়েছিল। উপভোগ ও ধর্মীয় বৃত্তের বাইরে শিল্প হিসেবে নৃত্যচর্চার সূচনাও হল এই একই সময়ে। রবীন্দ্র নৃত্যধারার বাইরেও নতুন এই ধারা গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল কলকাতা তথা বাংলায়। ফরাসি দেশের এক আধুনিক নৃত্যশিল্পী এসেছিলেন একবার শান্তিনিকেতনে। তাঁর নৃত্যের বিষয় ছিল মানুষের জীবনসংগ্রাম। শান্তিদেব ঘোষের ভাষ্যে পাই যে, এই রকম নৃত্যপদ তৈরি করতে বলেছিলেন তাঁকে রবীন্দ্রনাথ। নানারূপ প্রভাব থাকা সত্ত্বেও বিশেষভাবে দু’টি নৃত্যপদ্ধতি গৃহীত হল শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারায়, এর একটি কারণ অবশ্যই এই দুই ধারা তখন পর্যন্ত একটু বেশি সংহত এবং নৃত্যের মাধ্যমে তাদের দর্শন প্রচারের কাজে বৈষ্ণবরা অন্যান্যদের থেকে অনেক এগিয়ে।
নৃত্যের বাজার অর্থনীতি
নৃত্যের কি কোনও অর্থনীতি নেই, থাকলে তা কখন গড়ে উঠেছে? এ বিষয়ে না হয় পৃথকভাবে আলোচনা করব কখনও। আপাতত এতটুকু বোঝা দরকার যে, শিল্পের যে অর্থনীতি শিল্পী ও তার পৃষ্ঠপোষক রাজা বা মন্দির, এই বৃত্তের মধ্যে চরকিপাক খেত, তা এবার কিছুটা পরিবর্তন হল। ব্রিটিশ শাসনের প্রথম পর্যায়ে রাজারা মূলত পুতুল রাজা হয়ে পড়ল, ক্রমে রাজপাঠ ধনসম্পত্তি প্রায় দখল করতে শুরু করল ব্রিটিশ। ফলত একশ্রেণির শিল্পীগোষ্ঠী যারা রাজার পৃষ্ঠপোষকতা পেত তাদের জীবিকা অনিশ্চিত হল। অন্যদিকে আইন করে দেবদাসী প্রথা বন্ধে মন্দিরের ওপর নির্ভরশীল শিল্পীগোষ্ঠীর জীবনজীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। এই দুই ক্ষেত্রের শিল্পীদের জন্য লাগবে নতুন ক্ষেত্র নতুন অর্থনীতি। যা সৃষ্ট হল দেশ বিদেশের সামাজিক পরিসরে। এক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষক হলেন হিন্দুত্ববাদী দর্শনের প্রচারক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী। স্বাধীনতার পর ‘সংগীত নাটক একাডেমী’ স্থাপন হবে, ভারত সরকারের শিল্প সংস্কৃতির দপ্তর হবে, যারা এই উচ্চকোটির মানুষদের সংস্কৃতিকে আর্থিক সাহায্য দেবে, এর প্রচার ও প্রসারের স্বার্থে।
বাংলায় এসবের ব্যতিরেকে একটি অন্য পরিসর তৈরি হল শিল্পের অর্থনীতিতে, যা স্বাধীনতার বেশকিছু বছর পর ধীরে ধীরে সম্পূর্ণত উপরোক্ত ধারায় মিশবে। এই অন্য পরিসর গড়ে ওঠার কারণ শুধুমাত্র শান্তিনিকেতনের নৃত্যচর্চা নয়, সামগ্রিকভাবে বাংলার শিল্পসংস্কৃতি ও নাট্যচর্চার ভিন্নতর পরিবেশ। নবনাট্য ও গণনাট্য আন্দোলন যেভাবে বাংলায় গড়ে উঠেছে এবং প্রভাব বিস্তার করেছে তাতে বাংলার শিল্পচর্চা শুধুমাত্র পৃষ্ঠপোষকের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেনি, বরং মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে মানুষের কথা বলেছে। তাই বাংলার নৃত্যচর্চাকে যতই একই ধাঁচে বেঁধে ফেলার চেষ্টা হোক না কেন তা সম্পূর্ণ সফল হয়নি।
আরও একটি মজার বিষয় হল লোকশিল্পীদের কিন্তু তখনও সামগ্রিকভাবে পৃষ্ঠপোষকের দরকার পড়েনি। তারা তাদের শিল্প নিজেদের কৌমগোষ্ঠীর মধ্যেই নিজেদের জন্য নিজেদের মত করে উদযাপন করেছেন। স্বাধীনতার পর যদিও সরকারিভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষক হবে ভারতের সরকার এবং তাদের শিল্প সংরক্ষণের চেষ্টাও হবে।
উপসংহার
একশো শতাংশ হিন্দু জাতীয়তাবাদী নন রবীন্দ্রনাথ, বরং তার সমালোচক। একশো শতাংশ ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কারাচ্ছন্ন দলের মধ্যেও পড়েন না তিনি। রবীন্দ্রনাথ তো কল্পনার মুক্তির কথা বলেছেন। তাঁর দেবতা যে ভক্তের দুয়ারে আপনি এসে হাজির হয়, দেবতা ভক্তের সাথে মিলনের জন্য অভিসারে বাহির হয়। “আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরানসখা বন্ধু হে আমার।” তাহলে নৃত্যক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কেনই সেই ধর্ম আশ্রিত নৃত্যগুলিকে সমন্বিত করছেন? এর উত্তর পেতে আর একবার পিছন দিকে তাকাব। কারণগুলো খুঁজব—
এক) জাতীয় বিদ্যালয়ের কথা বললেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশ্রয়েই ছিল শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় পরে বিশ্বভারতী। ব্রিটিশ বড়লাট ছোটলাটদের অভ্যর্থনাও করেছেন শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতীতে। সরকারের কুনজর পড়েছিল একবার এবং বিদ্যালয় বন্ধের যোগাড় হয়েছিল।
দুই) নিজে বক্তৃতা দিয়ে অর্থ যোগাড় করা ছাড়াও ত্রিপুরার রাজা সহ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী থেকে নানান মহলের মানুষের অর্থসাহায্য লেগেছে শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় তথা বিশ্বভারতীতে। কমবেশি তাদেরও প্রভাব পড়েছে বিদ্যালয়ের কাজে।
তিন) নাচ সংক্রান্ত যে বিরুদ্ধ মনোভাব ছিল বিশ্বভারতীর অধ্যাপক মহলে তা খানিক অনুকূলে আনতে রবীন্দ্রনাথকে বিস্তর প্রযত্ন করতে হয়েছে। মেয়েদের মণিপুরী নাচ শেখানোর পর গোপনে বয়ষ্ক অধ্যাপকদের দেখানোর কথা মনে করলে বোঝা যাবে সে ছিল একপ্রকার অনুমতি সংগ্রহ। বয়ষ্ক বর্ণশ্রেষ্ঠ অধ্যাপকরা যখন দেখছেন বৈষ্ণব ধর্মের আধারে নিবেদনমূলক নৃত্য তখন আর আপত্তির কারণ থাকে না। এইভাবেই মণিপুরী নাচ গৃহীত হয়েছিল বিশ্বভারতীতে। ধর্মের প্রলেপ থাকলেও নাচটা অন্তত চালু হল। আঙ্গিককে ভেঙে জুড়ে নিজের ভাব অনুযায়ী সাজিয়ে নেবেন এমনটাই সম্ভবত ভেবেছিলেন তিনি। যে কারণে বার বার গানের ভাবের ওপর জোর দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। গান রচনা করেছেন, নৃত্যনাট্য রচনা করেছেন যেখানে ধর্মের চেয়ে প্রেমের ভাবই অধিক। বিষয় দিয়ে কি ভরে দিতে চেয়েছিলেন আঙ্গিকের অসম্পূর্ণতা? আবার নানা আঙ্গিককে ভেঙেচুরে এবং জুড়ে যে নতুন নৃত্যভাষা নৃত্যপদ তৈরি হতে পারে তারও একরকম পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখিয়ে দিলেন।
চার) অতিরিক্ত ইউরোপীয় কায়দা যেমন অপছন্দ করেছেন তেমনই আবার ছেলে-জামাই সবাইকে পড়িয়েছেন বিদেশে। প্রতিমা দেবী বারাবার বিদেশযাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন তাঁর। নাচ সম্বন্ধে তাঁর যে আগ্রহ তাও প্রথমবার বিদেশযাত্রার ফলশ্রুতি তাই ইউরোপীয় প্রভাব কাজ করেছে নিঃসন্দেহে।
ফলত, রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি শাস্ত্রীয় নৃত্যের গুরুদের এ বড় অপছন্দের বিষয়। একজন শ্রদ্ধেয় নৃত্যগুরুর সঙ্গে আলাপচারিতায় শুনেছি, তাঁদের ছোটবেলায় তারা যে মণিপুরী নাচ শিখেছেন, তা নিতান্তই ভুল ও অশুদ্ধ, পরে মণিপুরে গিয়ে শুদ্ধনৃত্য শিখেছেন। এই শুদ্ধ অশুদ্ধ কে ঠিক করবেন? মণিপুরের নৃত্যগুরুরা। তাঁরা বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী, ধর্মের আধারে নৃত্যের শুদ্ধতা নির্মাণ করেছেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের এমন কোনও দায় ছিল না। বরং তিনি নতুন নৃত্যপদ নৃত্যভাষা তৈরি করতে বেশি আগ্রহী ছিলেন এবং তা করেওছেন।
আমাদের ছোটবেলায়ও যখন নাচ করতে শুরু করেছি মফস্বল অঞ্চলে খুব বেশি শুদ্ধ ও অশুদ্ধ বাছতে দেখিনি নৃত্যশিক্ষকদের। রবীন্দ্রনাথের গানে নিজের ভাব অনুযায়ী হাত-পা নেড়ে চলে ফিরে নাচ করা যায়। এ একরকম মুক্তির স্বাদ দেয়। নিজের শরীরের মাধ্যমে নিজের ভাব প্রকাশের এক নির্মল আনন্দ দেয়। এর মধ্যে বেশিরভাগই হয়ত উন্নত শিল্প হয়ে ওঠেনি কিন্তু শিল্পের যে আনন্দ তা তো পাওয়া গেল। চলতে চলতে জানতে বুঝতে অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার যখন ভরে ওঠে তখন নৃত্যপদও পরিণত ও শিল্পসম্মত হয়ে ওঠার অবকাশ থাকে এক্ষেত্রে। চারপাশে গণ্ডি কেটে নেচে যাওয়ার থেকে এ বরং অনেক বেশি আনন্দের।
ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদর্শনের প্রভাব শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারার থাকলেও নতুন নৃত্যপদ গড়ে নেবার সক্ষমতাও তৈরি হয়েছিল নিঃসন্দেহে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় বার বার তাঁর লেখায় নৃত্যে শরীরের মনের ভাবের যে মুক্তির কথা রেখে গেলেন তা কি পরের প্রজন্মের কথা ভেবেই? যে কাজ সম্পূর্ণত তিনি করতে পারলেন না নৃত্য সম্পর্কিত লেখায় তার দিকনির্দেশ দিয়ে গেলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতন বা বিশ্বভারতী কি সেই নির্দেশ নিল, নাকি চারপাশে গণ্ডি কেটে রবীন্দ্রনৃত্যের শুদ্ধতা রক্ষায় প্রবৃত্ত হল? দ্বিতীয়টাই ঘটল, তাও একরকম আমাদের সকলেরই জানা। তবু এর বাইরেও একটা পরিসরে শিল্পীরা নতুন করে ভাবনার অবকাশ পেলেন। ফলত একশ বছর পর বর্তমানে রবীন্দ্রনৃত্য, রবীন্দ্রগান আশ্রিত নৃত্য, এমন যত ট্যাগলাইনই তৈরি হোক না কেন রবীন্দ্রগানে কবিতায় শিল্পী তাঁর নিজস্ব কল্পনা ফুটিয়ে তুলতে পারেন।
বাঙালি মিশ্রজাতি এতে যেমন কোনও সন্দেহ নেই তেমনই তার শিল্পসংস্কৃতিতে এই মিশ্রধারাই প্রাধান্য পাবে তাও নিশ্চিত। যতই তাকে একের গণ্ডিতে বাঁধতে চাও না কেন তা বাঁধা পড়েনি আজও। তাই সমস্ত শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রচার প্রসার সত্ত্বেও শান্তিনিকেতন ঘরানার নিগড় সত্ত্বেও গণনৃত্য নবনৃত্যের সৃজনশীল নৃত্যের ধারা সমান গতিতে বয়ে চলেছে বাংলার নৃত্যশিল্পের পরিসরে। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ শিল্পীদের বোধ ও জ্ঞান ও সৃজনশীলতার ওপর যেমন নির্ভর করছে নৃত্যশিল্পের ভবিষ্যৎ চলন, তেমনি নির্ভর করছে রবীন্দ্রনাথের গানে নৃত্যের চলন। [সমাপ্ত]
চিত্র: জাভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]
রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]
রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]