Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

যত মত তত পথ

শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮.০২.১৮৩৬-১৬.০৮.১৮৮৬) বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

একথা কি আমরা ভেবে দেখেছি, জীবনভর সাধনায় পাশ্চাত্যের যে মনীষী মাক্স মিলার সুদীর্ঘ ৫১ (তাঁর জীবিতকালে ৪৯ খণ্ড বেরোয়। বাকি দুটি প্রকাশ করেন ভিন্টারনিৎস) খণ্ডে সম্পাদনা করেছিলেন, যা প্রকাশিত হয় ‘The Sacred Books of the East’ নামে, তিনি-ই তাঁর মেধা ও শ্রম নিয়োজিত করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী লিখতে। উনিশ শতকের শেষের দিকে ১৮৯৮-তে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ‘Ramakrishna: His Life and Sayings’। এ-বই প্রতীচ্যে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রথম পরিচিতি ঘটায়। দুজন নোবেলবিজয়ী, রবীন্দ্রনাথ এবং রোমাঁ রোলাঁ, ছিলেন তাঁর প্রতি একান্ত শ্রদ্ধাশীল। রোলাঁ তো মাইকেলেঞ্জেলো, বিটোফেন ও টলস্টয়ের মতো তাঁর জীবনীরচনার তাগিদ থেকেই লিখলেন তাঁকে নিয়ে বই, ‘Life if Ramakrishna and the Universal Gospel’ (1929).

শ্রীরামকৃষ্ণের অনন্যতা কোথায়? তাঁর প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ যে তাঁকে ‘অবতারবরিষ্ঠ’ আখ্যা দিয়েছিলেন, সে কি কথার কথা, না এর পেছনে অন্তর্নিহিত কারণ রয়েছে? একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
সাধারণত দেখা যায়, ধর্মীয় বিষয়ে ভাবুকরা বা সাধকরা নির্দিষ্ট একটি মার্গ-অনুসারী। অতীশ দীপঙ্কর বৌদ্ধ, শ্রীচৈতন্য বৈষ্ণব, রামপ্রসাদ শাক্ত। রামমোহন-দেবেন্দ্রনাথ-শিবনাথ শাস্ত্রীকে যেমন অদ্বৈত ব্রহ্মবাদে বিশ্বাসী হতে দেখি। তেমনই বঙ্কিমচন্দ্র ঘোর সনাতনপন্থী। ব্যতিক্রম শ্রীরামকৃষ্ণ। তিনি জন্মেছিলেন বৈষ্ণব পরিবারে, আর সাধনা করলেন কালীর। যিনি তন্ত্রমতে ঈশ্বরসাধনা করলেন ভৈরবীর কাছে, তিনি-ই আবার তোতাপুরীর কাছে অদ্বৈতের পাঠ নিলেন; যে তোতাপুরী তিনদিনের বেশি কোথাও থাকেন না, দক্ষিণেশ্বরে তাঁর শিষ্যটির জন্য তিনি থেকে গেলেন এগারো মাস! শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি-ই ‘পরমহংস’ নামে ভূষিত করেন। এটি তাঁর বৈদান্তিক লাঞ্ছন। অথচ তিনি মূলত কালীসাধক। আবার তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি, ‘অদ্বৈতের চাবি আঁচলে বেঁধে যথা ইচ্ছা তথায় যা’! সাকার-নিরাকারের সমন্বয় ঘটান তিনি এইভাবে, আবার ব্যাখ্যাতীত হয়ে ওঠে তাঁর চেয়ে আঠারো বছরের ছোট স্ত্রীকে যখন তিনি মাতৃজ্ঞানে ষোড়শীপূজা করেন।

‘পরমহংস’ তিনি একা নন, উড়িষ্যার অভিরাম, কেরলের নারায়ণগুরু, এবং বঙ্গভূমির-ই নিগামানন্দ, বিশুদ্ধানন্দ, দুর্গাপ্রসন্ন প্রমুখ আরও অনেকেই ‘পরমহংস’ ছিলেন। এমনকি মহারাষ্ট্রে তাঁর সমসাময়িক কালে ‘পরমহংস মণ্ডলী’ নামে জাতপাতবিরোধী এক সম্প্রদায় গড়ে ওঠে। কিন্তু একথা মানতেই হবে, শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গেই ‘পরমহংস’ কথাটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। কারণ নিহিত আছে তাঁর জন্মশতবর্ষে প্রধান অতিথির ভাষণে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের উক্তির মধ্যে, ‘’তাঁর ব্যক্তিত্বের বিশালতা বোঝা যায় আপাতবিরোধী সাধনপদ্ধতিগুলির অনুশীলনের মধ্য দিয়ে। আর তাঁর মনের সরলতা (সরলতা না থাকলে কি দেবেন্দ্রনাথকে বলতে পারতেন, বছর বছর সন্তান হয় যাঁর, তিনি কীসের মহর্ষি?) পুরোহিত ও যাজকশ্রেণীর আড়ম্বর ও পাণ্ডিত্যকে চিরকালের জন্য ম্লান করে দিয়েছে।’’

আপাতবিরোধী নয় কেবল, মেরুপ্রতিম ব্যবধানকেও তিনি সাধনার অন্তর্গত করেছিলেন। ১৮৬৬-তে সুফিমতের সাধক গোবিন্দ রায়ের কাছে ইসলামের পাঠ নিলেন, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়লেন। আবার ১৮৭৩-এ শম্ভুচরণ মল্লিক তাঁকে বাইবেল পাঠ করে শোনান। তাঁর ঘরে যিশুর ছবিকে সকাল-সন্ধ্যায় ধূপধুনো দিয়ে আরতিও করতেন এই কালীসাধক! স্কুলে বিশেষ যাওয়া হয়নি, ‘শুভঙ্করী ধাঁধা লাগতো’ যাঁর, সেই তিনি-ই নির্দ্বিধায় মতবিনিময় করেছেন দেবেন্দ্রনাথ, মাইকেল, বঙ্কিম, দয়ানন্দ, বিদ্যাসাগরের সঙ্গে। স্কটিশচার্চ কলেজের হেস্টি ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘The Excursion’ কবিতাটি বোঝাতে গিয়ে ‘Trance’ শব্দের ব্যাখ্যা জানার জন্য ছাত্রদের দক্ষিণেশ্বরে যেতে বলেন। ‘ক্লার্জিম্যান থ্রোট’ ক্যানসারে আক্রান্ত তাঁর চিকিৎসা করতেন পরম নাস্তিক ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। তাঁর ঘরে শোভা পেত শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি। বুদ্ধদেব এবং শ্রীচৈতন্য সন্ন্যাস নেন স্ত্রীকে ত্যাগ করে। শ্রীরামকৃষ্ণভক্ত ঋষি অরবিন্দ-ও তাই। ব্যতিক্রম শ্রীরামকৃষ্ণ, অবতারবরিষ্ঠ!

সাংখ্যের প্রকৃতি (তাঁর কালী), বেদান্তের পরমপুরুষ (তাঁর কাছে শিব) আর বৈষ্ণবের প্রেম (তাঁর কাছে রাধাকৃষ্ণ), এই তিনের সমন্বয়ে তাঁর সাধনা এবং সিদ্ধি। তাঁর যে মাঝেমাঝেই সমাধি লাভ হত, সেটার মনোবিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন রোমাঁ রোঁলা। তাছাড়া সুধীর কক্কর, জে. এস. হল, সুধীরচন্দ্র শীল, অ্যালান রোলান্ড, সোমনাথ ভট্টাচার্য। আর তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ধর্মমত নিয়ে আলোকপাত করেছেন লিও শ্লাইডারম্যান, ওয়ালটার জি. নিভলি, সাইরাস আর. প্যানবর্ন, অমিয় পি. সিং প্রমুখ। এ-সবকিছুর সারাৎসার যেন পাই তাঁকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, ‘বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা/ ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা।/ তোমার জীবনে অসীমের লীলাপথে/ নূতন তীর্থ রূপ নিল এ জগতে।/ দেশ বিদেশের প্রণাম আনিল টানি,/ সেথায় আমার প্রণাম দিলাম আনি।’

চিত্র: গুগল
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

স্বামী বিবেকানন্দ : প্রয়াণদিনে স্মরণ

বিবেকানন্দই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক বাঙালি তথা ভারতীয়। রবীন্দ্রনাথ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ১৯১২-পর্বে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় যাওয়ার পর, এবং তার পরের বছর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। কিন্তু এর প্রায় কুড়ি বছর পূর্বেই বিবেকানন্দ শিকাগো-বক্তৃতা ও আমেরিকা-ইয়োরোপে এক নাগাড়ে প্রথম দফায় চার বছর থাকার সুবাদে আমেরিকার বিদ্বজ্জনমহলে যেমন, তেমনই জার্মানির মাক্সমুলার, ফ্রান্সের রোমাঁ রোলাঁ, রাশিয়ার টলস্টয় প্রমুখের শ্রদ্ধা এবং মনোযোগ আদায় করেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

প্রফুল্ল রায়: ব্রাত্য সময়ের কথাকার

প্রফুল্ল রায় নাকি অতীশ দীপঙ্করের বংশের। দেশভাগের অভিশাপেই দেশছাড়া হতে হয় তাঁকে, ১৯৫০-এ। একটা বিধুর বিষয় আমরা লক্ষ্য না করে পারি না। দেশভাগ সুনীল-শ্যামল-মহাশ্বেতা-শীর্ষেন্দু-অতীনদের কেবল ভূমিচ্যুত করেই ছাড়ল না, এমনকি তাঁদের কারুবাসনাকেও অন্যতর রূপ দেওয়ালো। দেশভাগ না হলে আমরা সুনীলের হাতে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীণ’ বা প্রফুল্ল রায়ের ‘পূর্বপার্বতী’ পেতাম না, যেমন পেতাম না শওকত ওসমানের ‘কর্ণফুলি’ বা হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি।’

Read More »
শৌনক দত্ত

মন্দ মেয়ে ভদ্র অভিনেত্রী: সুকুমারী দত্ত

বিনোদিনী দাসীর বর্ণময় জীবনের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া এই ‘তারকা অভিনেত্রী’-র বহুমাত্রিক জীবনটিও কম রঙিন নয় বরং বিস্মৃত নক্ষত্র এক, যিনি ১২৮২ বঙ্গাব্দের ৩ শ্রাবণ (১৮৭৫ খ্রি., মূল্য ছিল ১ টাকা) ‘অপূর্ব্বসতী’ নাটকটি লিখে বাংলা নাট্যাতিহাসের প্রথম নারী নাট্যকার হিসেবে সুবিদিত হয়ে আছেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস ও কালিদাস

পণ্ডিতেরা তর্ক তুলেছেন, কালিদাস ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ লেখেননি৷ কেননা একেবারে পয়লা আষাঢ়েই যে মেঘ নেমে বৃষ্টি আসবে, তা হয় না। তাঁদের মতে, ওটা আষাঢ়ের শেষদিন, ‘আষাঢ়স্য প্রশম দিবস’ হবে। কিন্তু প্রথম দিবস-ই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং তা এতটাই যে, কালিদাসকে নিয়ে ভারত সরকার যে ডাকটিকিট বের করেছে, সেখানে ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ শ্লোকটি উৎকীর্ণ।

Read More »
রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »