[চতুর্থ পর্বের পর…]
বিশ্বভারতী
বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয় যোগদান করেছিলেন শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে। তাঁর বিশেষভাবে মনে হয়েছিল যে, আমাদের দেশে বহুযুগ ধরে যে নিজস্ব শিক্ষাপদ্ধতি আছে যেমন টোল, চতুষ্পাঠী— এগুলির সম্প্রসারণ দরকার। শুধুমাত্র সংস্কৃত শিক্ষা দিয়ে নয়, এইগুলির মধ্য দিয়েই নতুন যুগের জ্ঞানের ধারা চালিয়ে দিতে হবে। এই ইচ্ছায় তিনি একবার শান্তিনিকেতন ছেড়ে নিজের গ্রামে ফিরে যান কিন্তু নানা বাধায় টোল স্থাপন করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁকে আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, আপনার ইচ্ছা শান্তিনিকেতনেই রূপ পাবে।
এরপরের ঘটনাপ্রবাহ খানিক এইরকম, ১৯১৬ সাল রবীন্দ্রনাথ জাপান হয়ে আমেরিকা যাত্রা করেন। জাপানেও অনেকগুলি বক্তৃতা দেন এবং সেখানে তিনি জাপানের রাজনীতি নিয়েই তাদের সমালোচনা করেন। চীন-যুদ্ধে জয়লাভ করে জাপান যে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে এবং যুদ্ধজয়ের চিহ্ণগুলিকে যেভাবে রক্ষিত করেছে, কবির কাছে তা বর্বরতা, অসুন্দর লেগেছে। এরপর আমেরিকা, সেখানে তিনি রীতিমত পেশাদার কোম্পানির ভাড়া করা বক্তৃতা দেবার লোক। তারা যেখানে যেখানে বক্তৃতার ব্যবস্থা করবেন কবিকে সেখানেই যেতে হবে এবং এর জন্য তিনি নির্দিষ্ট অংকের ডলারও তিনি পাবেন। চুক্তিমত তিনি আমেরিকার বিভিন্ন শহর ঘুরে প্রচুর বক্তৃতা দিলেন। এক-একটি সভায় মানুষ হলে ঢুকতে না পেয়ে ফিরে গেলেন, প্রচুর মানুষকে যেমন পাশে পেলেন তেমনই প্রচুর সমালোচিতও হলেন।
যে বক্তৃতা তিনি গোটা আমেরিকা জুড়ে দিলেন তাকে এককথায় জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অভিযান বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। পরবর্তীতে এই বক্তৃতা ‘ন্যাশনালিজম’ নামে প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হয়। আমেরিকায় থাকাকালীনই তিনি নানা চিঠিপত্রে লিখছেন তাঁর ভাবনার কথা। “স্বজাতিক সংকীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসচে, ভবিষ্যতের জন্যে যে বিশ্বজাতিক মহামিলন যজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে তার প্রথম আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে।’’ বিশ্বজাতিক মহামিলন, সে কি নিজে নিজেই ঘটে ওঠে নাকি ঘটাতে হয়? আমার মতে অবশ্যই ঘটাতে হয় এবং তিনি তা ঘটিয়ে ফেলতে চাইছেন। বক্তৃতায় যেমন দেখাচ্ছেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য কীভাবে দানা পাকিয়ে ন্যাশনালিজম গড়ে উঠছে, তার বর্বর নৃশংস চেহারা দেখিয়ে দিচ্ছেন তেমনই তার বিপরীতে বিশ্বমানবতার কথা বলছেন। “পৃথিবী থেকে স্বাদেশিক অভিমানের নাগপাশ ছিন্ন” করাকেই নিজের শেষজীবনের কাজ বলে মনে করছেন।
“আমাদের দেশে বিদ্যা সমবায়ের একটি বড় ক্ষেত্র চাই, যেখানে বিদ্যার আদান প্রদান ও তুলনা হইবে, যেখানে ভারতীয় বিদ্যাকে মানবের সকল বিদ্যার ক্রমবিকাশের মধ্যে রাখিয়া বিচার করিতে হইবেই।’’ শান্তিনিকেতনকে প্রাদেশিকতা ও সাম্প্রদায়িকতার বাইরে ভারতীয় শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার সংকল্পের কথা জানাচ্ছেন এন্ড্রুজ ও রথীন্দ্রনাথকে (১৯১৮ সাল)। বিশ্বভারতীর অধ্যাপনার কাজ শুরু হয় ১৯১৯ জুলাই মাসে। বিষয় ও অধ্যাপনার দায়িত্ব বণ্টন হয় খানিক এইভাবে:
সাহিত্য: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সাহিত্য সমালোচনা: এন্ড্রুজ
হিন্দুদর্শন: বিধুশেখর ভট্টাচার্য
বৌদ্ধদর্শন: রাজগুরু মহাস্থবির (বৌদ্ধভিক্ষু)
জীবতত্ত্ব: রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পাণিনির ব্যাকরণ: মৈথিলী পণ্ডিত কপিলেশ্বর মিশ্র
ধীরে ধীরে সঙ্গীত চিত্রকলা নৃত্য— সমস্ত বিদ্যা যুক্ত হবে বিশ্বভারতীর পাঠক্রমে। চিত্র বিভাগের (কলাভবন) দায়িত্ব নেবেন সুরেন কর, অসিতকুমার হালদার, নন্দলাল বসু প্রমুখ। বিশ্বভারতীতে ভারতীয় রাগ সঙ্গীত (সঙ্গীত ভবন) শেখাতে এসেছিলেন দুইজন মুসলমান ওস্তাদ, কিন্তু তাঁরা বেশিদিন থাকতে পারেননি। মহারাষ্ট্র থেকে আসেন ভীমরাও হসুরকর। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার বেশ কিছু বছর আগে আগরতলার ডাক্তার রবীন্দ্র কাজির পুত্র শান্তিনিকেতন আশ্রমে আসার কথা হয়েছিল কিন্তু তাঁর থাকাখাওয়া ইত্যাদি নিয়ে তৎকালীন অধ্যাপকবৃন্দের আপত্তি থাকায় তা ঘটে ওঠেনি। এবারে মুসলমান শিক্ষক এলেন কিন্তু বেশিদিন থাকলেন না।
বিশ্বভারতীর বিভিন্ন পর্বে এমন নানা রক্ষণশীলতার বাধা আমরা দেখব এর পরবর্তী পর্যায়েও। রবীন্দ্রনাথ বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু জাতীয়তাবাদ, প্রাদেশিকতা থেকে যেভাবে সরে এসেছেন, নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, প্রস্তুত করতে চেষ্টা করেছেন তা সবাই করে উঠতে পারেননি, তাই বিরোধিতা করেছেন। বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠার সঙ্গে দ্বিতীয়বার মেয়েদের প্রবেশ ঘটবে শান্তিনিকেতনে। এবার ব্যবস্থার বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটবে। একই ঘরে ছেলেমেয়ে সকলে পৃথক দলে সমবেত হবে অধ্যাপকদের ক্লাস করার জন্য। মজা হচ্ছে, সব অধ্যাপকও কিন্তু এরকম ব্যবস্থার জন্য তৈরি নন। জানা যায়, মহাস্থবির বৌদ্ধদর্শন পড়াবার সময় মেয়েদের দিকে পাখার আড়াল করে বসতেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃত অর্থে বিদ্যার উদ্ভাবন কেন্দ্র, বিদ্যাদান এর গৌণ কাজ। এদিক থেকে যে যে বিষয়গুলিতে ‘বিশ্বভারতী’ তার নিজস্ব উদ্ভাবনীশক্তির গৌরব অর্জন করেছে তা মূলত কলাবিদ্যার শাখাগুলিতে; সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ও নৃত্য। ১৯২৩-২৪ সাল থেকেই রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসুর কন্যা গৌরী, ক্ষিতিমোহন সেনের কন্যা অমিতা ও কবি দৌহিত্রী নন্দিতা, সকলকে নিয়ে নৃত্যশিক্ষা ও চর্চার স্থায়ী ব্যবস্থা শুরু করলেন। ১৯২৩ -২৪ সালে ‘কালের মন্দিরা যে’ গানটি রচনা করে তার সাথে নৃত্যছন্দ রচনা করেন। এর আগেই তিনি পশ্চিম ভারত ভ্রমণ করেন, সেখানে কবি ভজনের সঙ্গে খঞ্জনি বাজাবার সময় যে নৃত্যছন্দ জাগে তা প্রত্যক্ষ করেন। নিজের রচিত গানে এবার এই ছন্দ ও ভঙ্গিমা জাগিয়ে তুললেন তিনি।
বাংলার গ্রামীণ জনজীবনে প্রবাহিত নৃত্যগীতের ধারা ও শান্তিনিকেতনের নাচ
বীরভূম জেলার রুক্ষশুষ্ক প্রান্তের এক অংশে গড়ে উঠেছে বাঙালি শহুরে ভদ্রসমাজের শিক্ষাসংস্কৃতির ধারা, যা ভবিষ্যতে অভিজাত বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয় হয়ে উঠবে। সেখানে দেশি-বিদেশি নানা কিছুর মিশ্রণ ঘটবে, শুধুমাত্র সে মাটির আসল ভূমিপুত্রপুত্রীদের সংস্কৃতি ব্রাত্য থাকবে। কারণ? কারণ ওরা অশিক্ষিত, নিম্নবর্ণ, অপরিশীলিত। আমার আলোচনা নৃত্যক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রাখব।
“বাঙালির জনতত্ত্ব নিরূপণের একতম এবং প্রধানতম উপায় বাংলাদেশের আচণ্ডাল সমস্ত বর্ণের এবং সমস্ত শ্রেণীর জনসাধারণের, বিশেষভাবে প্রত্যন্তশায়ী জনপদবাসীদের সকলের রক্ত ও দেহগঠনের বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ, এক কথায় নরতত্ত্বের পরিচয়।”— নীহাররঞ্জন রায়
এত বিস্তৃত কাজ তৎকালীন সময়ে না হলেও সাধারণভাবে কিছু বিষয় নিশ্চিতভাবে প্রত্যক্ষ করা যেত। যেখান থেকেই রবীন্দ্রনাথের নিজেরই কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করা যেতে পারে।
“হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন—
শক-হুন-দল পাঠান মোঘল এক দেহে হল লীন।’’
একথা ভারতের ক্ষেত্রে যেমন তেমনই বাংলার জন্যেও সত্যি। তাই বেঁটে-লম্বা, কালো-ফর্সা, খেঁদা-চোখা নাক বিশিষ্ট বাঙালির সংস্কৃতিও এ তাবৎ গোষ্ঠী মানবের (মুন্ডারি থেকে নিগ্রয়েড, অস্ট্রলয়েড, মঙ্গোলীয় ইত্যাদি-ও রয়েছে ইন্দো-ইরানিয়ান ইন্দো-ইউরোপিয়ান নর্ডিকদের সঙ্গে) বৈশিষ্ট্য সম্বলিত হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন নির্দিষ্ট কোনও অভিমুখে সে সংস্কৃতি চালিত হয়, তখন সংযোজন-বিয়োজন ঘটে সেই উদ্দেশ্য সামনে রেখেই।
উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আগের পর্বগুলিতে বিস্তৃত আলোচনা করেছি, আবার বলা অপ্রয়োজনীয়। এককথায় বলা যায়, নব্য হিন্দু জাতীয়তাবোধই সে সময় শিল্পসংস্কৃতির গতিমুখ নির্ধারিত করছিল। রবীন্দ্রনাথ খানিক তার বাইরে দাঁড়াতে চেষ্টা করেও সম্পূর্ণ সফল হলেন না। তিনি বুঝলেন এই অভিমুখের সংকীর্ণতা, সমালোচনা করলেন, প্রতিবাদ করলেন। কিন্তু নিজের কাজের ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিকের চাপ এড়িয়ে আরও একটু ঋজু হয়ে দাঁড়ালেন না। ফলে আধুনিক বাংলার নাচ থেকে বাদ পড়ে গেল বাংলারই নিজস্ব উপাদান।
১৯৩১-এ ‘বর্ষামঙ্গল’ উৎসবে বর্ষার গানের সঙ্গে কথাকলি আঙ্গিকে নাচ তৈরি করছেন শান্তিদেব ঘোষ। শ্রীমতি দেবী ইউরোপীয় নাচের আঙ্গিকে ‘ঝুলন’ কবিতার সাথে নাচ করছেন। এই উৎসবে একটিমাত্র লোকনৃত্য স্থান পাচ্ছে, তা হল গরবা নাচ। গুজরাতি ব্যবসায়ী মহল যে রবীন্দ্রনাথ ও বিশ্বভারতীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, তা পাঠকদের জানা এবং আমিও আগে উল্লেখ করেছি। কিন্তু বাংলার নিজস্ব লোকনৃত্য সান্থাল, ধামাইল, বউনাচ, ঢালি, পাইক, ছৌ, রণপা, ঝুমুর কখনও শান্তিনিকেতনে শেখানোর, অন্তত দেখানোরও ব্যবস্থা হয়নি। অথচ মজা হচ্ছে, দেশের অন্যান্য যে অংশগুলিতে তথাকথিত শাস্ত্রীয় নৃত্য গঠনের কাজ চলছে সেখানে সেই সেই অঞ্চলের লোকনৃত্য, স্থানীয় বৈশিষ্ট্যযুক্ত আচার, সঙ্গীত ও নৃত্যভঙ্গিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। বাংলায় একমাত্র একটি নাচ তৈরি হচ্ছে যা তথাকথিত শাস্ত্রীয় নয় কিন্তু ভিন্ন বৈশিষ্ট্যযুক্ত শাস্ত্রীয় নৃত্যগুলির নৃত্যভঙ্গি তাতে যুক্ত করা হচ্ছে। একবার-দু’বার শান্তিদেব ঘোষের চেষ্টায় রায়বেঁশে জারি সারি ও বাউল নাচের ঝলক এসেছে সেই সময়ের নাচে কিন্তু সে সবের স্থায়ী চর্চা ও অন্তর্ভুক্তি হয়নি রবীন্দ্রনাথের নৃত্যভাবনায়। এখানে আবার একটি প্রশ্ন আসে। রবীন্দ্রনৃত্য কি শুধুই রবীন্দ্রনাথের চিন্তার ফসল? উত্তর অবশ্যই না। তাই কলকাতা জুড়ে যখন রবীন্দ্রনৃত্য শব্দের জনপ্রিয়তা বাড়ছে তখন শান্তিদেব ঘোষ তার বিরোধিতা করেছেন।
প্রথম আগল খুলে গেলে মূলত প্রতিমা দেবীর নেতৃত্বেই শান্তিনিকেতনের নৃত্যচর্চার বাড়বাড়ন্ত। রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনীয় উপাদান ও বিষয় যোগান দিয়েছেন। মণিপুরি নাচ শেখানো হচ্ছে কিন্তু ধর্মীয় আঙ্গিকে তার উপস্থাপনা হচ্ছে না। মণিপুরী নৃত্যভঙ্গি দিয়ে সাজানো হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের গান, কাব্য, গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য। প্রতিটি বাঁকেই ভিড় করে আসছে নানা প্রশ্ন। গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য প্রসঙ্গেও অন্যথা হচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ প্রথম গীতিনাট্য লিখছেন বাল্মীকি প্রতিভা, বিদেশ থেকে ফিরে অপেরা আঙ্গিকে। তার আগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বিদেশি সুরে বাংলা গান রচনার চেষ্টা করছিলেন। আবার জাভা বালি ভ্রমণের সময় রবীন্দ্রনাথ নৃত্যনাট্য রচনার অনুপ্রেরণা পেলেন। জাভাযাত্রীর পত্র-তে তিনি নাচ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করছেন। কেন? বাংলায় গীতিনাট্য নৃত্যনাট্যের কোনও আদর্শ কি ছিল না কখনও?
চর্যাগীতিতে বুদ্ধনাটকের কথা আছে, যা নৃত্যগীতের মাধ্যমে কাহিনি বর্ণনার একটা মাধ্যম। আবার চর্যাগীতিতেও তৎকালীন গার্হস্থ্য জীবনযাত্রার ছবি আছে, এ সবই বস্তুত নৃত্যগীতের মাধ্যমে বর্ণিত কাহিনি। দরিদ্র গ্রামীণ মানুষের জীবনে অভাব বেশ প্রকট থাকলেও তাদের আদিম কৌমগত যৌথ নৃত্য গীত বাদ্য ও গ্রামীণ পূজা ও পালাপার্বণই ছিল তাদের আনন্দের উৎস। এছাড়াও পালাগান, আলকাপ, কবিগান, যাত্রা সকলই তো নৃত্যগীত ও অভিনয়ের মাধ্যমে কাহিনিই ব্যাখ্যা করছে, যা বাঙালির একান্ত নিজস্ব আঙ্গিক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নৃত্যনাট্যের অনুপ্রেরণা পেলেন জাভা বালি দ্বীপে নৃত্যের মাধ্যমে কাহিনি বর্ণনার অভিজ্ঞতা থেকে। বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্যবাদের যে ধারা জাভা বালি দ্বীপে বহু আগে গিয়েছে এবং মিশে গিয়েছে— তাদের ধারার সঙ্গে তা প্রাচীন স্বীকার করেও মুগ্ধতা বর্ণনা করছেন জাভাবলির পত্রে!
তাহলে কি সেই প্রাচীনত্ব, সেই আর্য সংস্কৃতির প্রভাব ইত্যাদিতে তাঁর মন বারংবার প্রভাবিত হচ্ছে? বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে? প্রশ্নটা তোলাই চলে, উত্তর স্পষ্টত আশা করা যায় না। কেন না, এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজে অথবা অজস্র রবীন্দ্র গবেষকদের মধ্যে কেউই কোনও আলোকপাত করেননি।
আবার ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি মেনে নিতে পারছেন না গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদ ও হিন্দু জাতীয়তাবাদ, যা বারবার তাঁর উপন্যাসে (গোরা, ঘরে বাইরে) তিনি প্রকাশ করছেন। শান্তিনিকেতনে প্রচলিত উৎসবগুলি খেয়াল করলেও দেখা যাবে নির্দিষ্ট কোনও ধর্মীয় উৎসব সেখানে পালিত হচ্ছে না। উৎসবগুলি মূলত হচ্ছে প্রকৃতির সাথে যোগ রেখে— ঋতুরঙ্গ, গীতোৎসব, মাঘোৎসব, বসন্ত উৎসব। ১৯৩১ সালে উত্তর ও পূর্ব বাংলার বন্যাত্রাণের অর্থসংগ্রহের জন্য কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় গীতোৎসব ও শিশুতীর্থ একসাথে। এখানে একটু শান্তিদেব ঘোষের কথা তুলে দেব। “শান্তিনিকেতনের মেয়েদের মণিপুরী প্রধান মিশ্র নাচ, বাসুদেবের নাচ, শ্রীমতি দেবীর নাচ, কথাকলি, বাউল, রায়বেঁশে এবং হাঙ্গেরীয় ছাত্রীটির নিজস্ব নাচে এবারের অনুষ্ঠানটি খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ ও চিত্তাকর্ষক হয়েছিল।’’ যে কথা বলছিলাম, বাংলার লোকনৃত্য ব্যবহারের চেষ্টা অল্প হলেও হয়েছিল কিন্তু তা টিকতে পারল না। ক্রমে কথাকলি আর মণিপুরী প্রাধান্য বিস্তার করল শান্তিনিকেতনের নৃত্যাঙ্গিকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাসুদেব দক্ষিণ ভারতীয় একজন ছাত্র, যিনি চিত্রকলা শিক্ষার জন্য এসেছিলেন শান্তিনিকেতনে। ভরতনাট্যম নৃত্যের আদলে নিজের তৈরি নাচ করতেন তিনি, যা রবীন্দ্রনাথের পছন্দের ছিল।
‘শিশুতীর্থ’-কে নৃত্যাভিনয়ের রূপ দেবার পরিকল্পনা করেছিলেন প্রতিমা দেবী। ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘চাইল্ড’ কথিকাটিকে নৃত্যাভিনয়ে রূপ দিতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তখন রবীন্দ্রনাথ কথিকাটিকে বাংলায় রূপান্তরিত করে ১০টি সর্গে সাজিয়ে নাম দিলেন ‘শিশুতীর্থ’। এখানেও সেই ইউরোপীয় ব্যালের প্রভাবই কাজ করল। ‘নটির পূজা’, ‘তাসের দেশ’ সবক্ষেত্রেই প্রথম পরিকল্পনা ছিল প্রতিমা দেবীর। লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, প্রতিমা দেবী ইউরোপীয় ব্যালে নৃত্য শিখেছেন এবং একপ্রকার ইউরোপীয় কায়দায় গড়ে তুলছিলেন নিজেকে।
বাংলার একটি মাত্র লোক আঙ্গিক রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনে স্থায়ীভাবে গৃহীত হল, তা হল বাউল। বাউল গান ও শিল্পীদের নৃত্যসহ উপস্থাপনা রবীন্দ্রনাথ ও পরবর্তীকালে শান্তিদেব ঘোষদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা তথা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়। আবারও লক্ষ্য করতে হবে যে, শুধুমাত্র গান ও তা প্রদর্শনের আঙ্গিক জনপ্রিয়তা পেল, তাদের দর্শন নিয়ে চর্চা ততটা হল না। বরং সামান্য অংশ বাদে বাকিটা নিম্নপ্রকারের দর্শন বলে ক্ষিতিমোহন সেন থেকে রবীন্দ্রনাথের দ্বারাও অবহেলিত হল। বাউলের সুরে, বাঙালি জীবনের আদি ধারা-মিশ্রধারার সুরগুলি যেভাবে অন্তর্লীন হয়ে আছে, তা রবীন্দ্রগানেও এক অন্যধারা যোগ করল। বাউল গান জনপ্রিয় হওয়ার দরুন সাধনা ও দর্শন ব্যতিরেকে গানই হয়ে উঠল মূল আকর্ষণ। গায়ক বাউল নাম যশ অর্থ ক্রমে সবই পেল শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথের কল্যাণে শুধু দর্শনচর্চায় ফাঁকি পড়ল, অথবা বলা যায় প্রান্তধর্ম স্বীকৃত প্রাতিষ্ঠানিকতার দিকে এককদম এগোল সেই সময়।
যেমনভাবে ব্রাহ্মধর্ম তথাকথিত হিন্দু-সমাজে গৌণ ধর্ম হয়েই ছিল বলে তার ক্রমে হিঁদুয়ানির দিকে যাত্রা, বাউল-ফকিরদের দর্শনকেও সেই দিকেই কি টানা হল না খানিক? একদা বৈষ্ণবেরা একে গ্রাস করার যে চেষ্টা শুরু করেছিলেন, শান্তিনিকেতনে সেই প্রচেষ্টাই কি আবার লক্ষিত হচ্ছে না দর্শন (জীবনযাপন ও চর্যা, যা ওঁদের ধর্মীয় অনুষঙ্গে আসে) বাদ দিয়ে গানের চর্চায়? ফলে বাউল নৃত্যাঙ্গিক আদিতে কী ছিল তার চিহ্নও কোথাও থাকছে না। শুধু পায়ের তাল, হাতের সামান্য মুদ্রা আর ঘুরে ঘুরে মাঝে মাঝে বাঁক (যা সুফী দরবেশী থেকেও আসতে পারে) এইতেই আটকে রইল। শান্তিনিকেতনে এত সব প্রাচীন পুঁথি ও ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কার নিয়ে কাজ হল, এ নিয়ে হল না। তাই নেপালের তরাই অঞ্চলের চর্যানৃত্য-ও আমাদের ধারণার বাইরে থেকে গেল, যার থেকে বাউলাদি নৃত্যের শুরু ও বিকাশ হয়তো হতেও পারে। জানা গেল না সেকথা আর।
আরও একটা বিষয় লক্ষ্যনীয়, এ যাবৎকালে রবীন্দ্রনাথ ধর্ম সম্বন্ধে তাঁর চিন্তাভাবনাকে আরও স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন করার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। যার শেষে তিনি ‘মানুষের ধর্মে’ উত্তীর্ণ হবেন। এই ভাবনার পিছনে ভক্তি আন্দোলনের সন্তদের প্রভাব যেমন রয়েছে তেমনই বাউলের প্রভাবও ছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজে পৌঁছে গেলেন মানুষের ধর্মে, মানবতাবাদে কিন্তু তাঁর চারপাশের মানুষজন, বিশ্বভারতী, সর্বান্তকরণে গ্রহণ করল সেই ধর্ম?
উত্তর বোধহয় সকলেরই জানা। তা হল না। সে চেষ্টা যাঁরা করলেন তাঁদেরই বরং সরে যেতে হল বিশ্বভারতী থেকে। সে জায়গায় প্রগতিশীল ব্রাহ্মণ্যবাদের জায়গা হল বিশ্বভারতী। আবার নতুন এক ব্রাহ্মণ্যবাদ জন্মও দিল বিশ্বভারতী। “আমরা বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রী, তাই রবীন্দ্রসঙ্গীত ও রবীন্দ্রনৃত্য বিষয়টা আমরাই ভাল বুঝি।’’ এরপর কপিরাইট, যার বেড়াজালের বিরুদ্ধে তাবড় শিল্পীদের লড়তে হয়েছে সারাজীবন। [চলবে]
চিত্র: জাভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]
রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]
রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]
খুব ভালো লাগলো, কতো সুন্দর ও যত্ন করে উপস্থাপনা করা হয়েছে, বোঝা যাচ্ছে এই সঠিক তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে কতটা পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমি আন্তরিক ভাবে এর সাফল্য কামনা করি, সাথে এও বলি- বহু পাঠক এই তথ্যগুলো জেনে উপকৃত হবেন। অনেকের খুব কাজেও লাগবে।