Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

[তৃতীয় পর্বের পর…]

বাল্যবিধবা ও নারীশিক্ষা

১৮৫৬ সালে জুলাই মাসে বিধবা বিবাহ আইন পাশ হওয়ার পিছনে ছিল বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আগে থেকে চলে আসা বেশ কয়েকজন মানুষের দীর্ঘ লড়াই। বিদ্যাসাগর মহাশয় বই লিখছেন, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করছেন, সভাসমিতিতে বক্তব্য রাখছেন, বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে জনমত গঠন করছেন, শাস্ত্রোক্ত যুক্তিকে সামনে আনছেন তীব্র তেজে— আগের মানুষদের থেকেও বেশি খাটছেন। বেশি আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। সরকারের সঙ্গে তাঁর বেশি ভাল সম্পর্কও।

ব্রাহ্ম সমাজের প্রথম আচার্য রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ বিদ্যাসাগরের যুক্তি সমর্থন করেন। ১৮৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ‘সমাজোন্নতি বিধায়িনী সুহৃদ সমিতি’-র সভায় হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ, বহুবিবাহ রোধ, বাল্যবিবাহ বর্জন নিয়ে কিশোরীচাঁদ মিত্রের প্রস্তাব আর অক্ষয় মিত্রের সমর্থনের বিস্তারিত প্রতিলিপি ব্রিটিশ লিগাল সেলে পাঠানো হয়েছিল।

এখন প্রশ্ন হল, দেবেন্দ্রনাথ নিজজীবনে এই একটি বিষয়ও পালন করেছেন কি না। ঠাকুর পরিবারে প্রথম বিধবা বিবাহ রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথের সাথে প্রতিমা দেবীর, দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর। দেবেন্দ্রনাথের পাঁচ কন্যার মধ্যে একমাত্র সৌদামিনী বেথুন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন বলে জানা যায় কিন্তু বিবাহ বাল্য বয়সেই হয়। পুত্রদের প্রত্যেকের বিবাহ দিয়ে বালিকা বধূই নিয়ে আসেন ঠাকুরবাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকলেই বালিকা বয়সী কন্যা বিবাহ করেন এবং কেউ বিধবা বিবাহ করেননি। রবীন্দ্রনাথের মেয়েদেরও বালিকা বয়সেই বিবাহ হয়। মাধুরীলতা ও মীরা দেবীর ১৫ বছর বয়সে, রেণুকার ১১ বছর বয়সে বিবাহ দেন তিনি। শান্তিনিকেতনে বালিকা বিদ্যালয় খুলতে রবীন্দ্রনাথ ভয় পেয়েছিলেন তিনি নিজেই লিখছেন চিঠিতে।

১৮২১ সালে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতে নারীশিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিছু সরকারি কিছুটা চার্চ মিশন সোসাইটির সহায়তায় বাংলায়ও নারীশিক্ষার শুরু হয়। পরে লেডি Armhast-এর উদ্যোগে ‘বেঙ্গল লেডিস সোসাইটি’ গঠিত হয় ও উনিশটি স্কুলে প্রায় ৪৫০ জন বালিকা ভর্তি হয়। বেথুন স্কুল স্থাপন হয় ১৮৭৯ সালে। বেথুন স্কুল সোসাইটির প্রথম কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৫১ সালে সৌদামিনীকে তিনি বেথুন স্কুলে ভর্তি করেন কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই তার বিয়ে দিয়ে দেন। নিজের মেয়েদের মধ্যে সচেতনভাবে শিক্ষার প্রসার করলেন না, নাতনিদের মধ্যেও সে রকম আগ্রহ ছিল না। একমাত্র ব্যতিক্রম সত্যেন্দ্রনাথ, যিনি নিজের মতকে প্রাধান্য দিয়ে ইন্দিরাকে সাহেবি স্কুলে পড়িয়েছেন ফরাসি ভাষা শিখিয়েছেন। কিন্তু বাড়ির আর কোনও মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে বড়দের তেমন কোনও আগ্রহ জানা যাচ্ছে না।

রবীন্দ্রনাথও রথীন্দ্রনাথকে বিলাত পাঠাচ্ছেন পড়াশোনার জন্য আর মেয়েদের বিয়ে দিয়ে জামাইকে বিলাত পাঠাচ্ছেন। দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তিনি শান্তিনিকেতনে বালিকা বিদ্যালয়কে প্রশ্রয় দিচ্ছেন কিন্তু চালিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন না। যে দু’বছর শান্তিনিকেতনে বালিকা বিদ্যালয় ছিল তা ছিল কঠোর নিয়মের ঘেরাটোপে। মেয়েরা থাকতেন দেহলী বাড়িতে, বাইরে তাদের স্বাভাবিক যাতায়াতে বাধা ছিল। পৌষমেলা প্রাঙ্গণে তারা যেতে পারতেন না। এইসময় মেয়েদের নিয়ে ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’ নামক একটি নাটকের অভিনয় হয়েছিল যার দর্শকও ছিলেন কেবলমাত্র মেয়েরা। কোনও পুরুষ অধ্যাপক ও ছাত্রকে সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।

প্রথম পর্যায়ের ব্রহ্মচর্যাশ্রম

শান্তিনিকেতনে প্রথম পর্যায়ের ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপনে রবীন্দ্রনাথ, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সাহায্য পেয়েছিলেন। সেই সময় ব্রহ্মবান্ধব কলকাতাতেই নিজের ছেলে ও আরও পাঁচজন ছাত্র নিয়ে একটি বিদ্যালয় পরিচালনা করছিলেন। প্রাচীন বৈদিক আদর্শে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের পরিকল্পনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথও। ব্রহ্মবান্ধব বরাবর শান্তিনিকেতনে থাকেননি কখনও, কিন্তু তার পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য সেখানে ছিলেন তার সহকর্মী রেবাচাঁদ। শান্তিনিকেতনে মূলত ব্রাহ্ম ও উচ্চবর্ণ হিন্দু পরিবার থেকেই ছাত্ররা এসেছিলেন। রেবাচাঁদ সেখানে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য বিভাজন স্পষ্ট করেছিলেন পোশাকের রঙেও। ব্রাহ্মণের ছেলে সাদা, কায়স্থ ও বৈদ্য ছেলেদের লাল, ও বৈশ্য ছেলেদের হলুদ পোশাক নির্দিষ্ট হয়েছিল এবং তারা পৃথক গাছের তলায় বসবেন প্রার্থনা করতে এই নির্দেশ ছিল। বলার বিষয় এই যে, রবীন্দ্রনাথ এই ব্যবস্থা চলতে দেননি। এই বিভাজন এবং ব্রহ্মবান্ধবের কট্টর হিন্দুত্ববাদী বর্ণাশ্রমিক ভাবনা তাঁকে বিব্রত করেছিল। ফলে অল্প সময়েই ব্রহ্মবান্ধবের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে এবং রেবাচাঁদ বিদায় নেন শান্তিনিকেতন থেকে। তাছাড়া আদর্শগতভাবে জাতিভেদ না থাকলেও ফলিত ক্ষেত্রে সেখানেও একদা একপ্রকারের জাতিভেদ কাজ করেছিল, তাও আলোচনা করব।

শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয় চলে মূলত ঠাকুরবাড়ির জমিদারী কালীগ্রামের আয় থেকে। দ্বারকানাথ এই জমিদারী কিনেছিলেন ১৮৩০ সালে। পরবর্তীতে দেবেন্দ্রনাথ মালিক এই জমিদারীর। ব্রাহ্মসমাজের মাথা দেবেন্দ্রনাথের সম্পত্তিতে এমন বিভাজন সম্মিলিত ব্যবস্থা সম্ভব ছিল না। আশ্রম ও বিদ্যালয় সংক্রান্ত প্রথম কার্যপ্রণালীতে যে নিয়মাবলি রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে লিখে পাঠাচ্ছেন সেখানে কিন্তু হিন্দু আচার নিয়মের কথা আছে, ব্রাহ্মণ দ্বারা খাদ্য পরিবেশনের কথা আছে, নিঃশর্ত গুরুভক্তির কথা আছে, গুরুর প্রতি সেবা ধর্মের কথা আছে। তখনও পর্যন্ত তিনিও ব্রাহ্ম হয়েও আরও অনেকের মত বর্ণবাদের সমর্থক।

সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এর আগেই ঠাকুরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছিলেন পিতার সাথে বিরোধের কারণে। রবীন্দ্রনাথের বিবাহের পর দেবেন্দ্রনাথ নানান কাজকর্মে জড়িয়ে খানিক তাঁকে সংসারে বেঁধে ফেলতে চেয়েছিলেন। এই সময়েই আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে, তা তিনি পালন করেন বেশিটাই কর্তব্য পালনের অভিপ্রায়ে। দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর আদি ব্রাহ্ম সমাজের সংস্কারের চেষ্টাও করেন তিনি, কিন্তু তাঁর কর্মজীবনের মধ্যেই আদি ব্রাহ্ম সমাজের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পিতার সঙ্গে সরাসরি বিরোধে যাননি,আদেশ পালন করেছেন,জমিদারী দেখভাল করেছেন। জমিদারীর আয়ে শান্তিনিকেতন গড়ে তুলেছেন, সংসার প্রতিপালন করেছেন, বিদেশ ভ্রমণ করেছেন।

শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের জন্য ত্রিপুরার মহারাজা বার্ষিক হাজার মুদ্রা বরাদ্দ করেছিলেন। মোহিতচন্দ্র সেন এককালীন অর্থদান করেছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যতিরেকে জাতীয় শিক্ষা পদ্ধতি কী হতে পারে, কেমন হতে পারে তার রূপ তা নিয়ে যেমন একটা মতামত গড়ে উঠছিল এবং তার বাস্তব প্রয়োজনীয়তাও ছিল। তেমনই আবার হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারণাও গড়ে উঠছিল। সে কারণেই হয়তো ব্রহ্মবান্ধবের মত মানুষদেরও বিদ্যালয় স্থাপন করতে হয় কিন্তু মনোনিবেশ করে দীর্ঘদিন চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি।

আবার যে সমস্ত বিদ্যালয় থেকে ছাত্র-শিক্ষকেরা বিপুল পরিমাণে স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছিলেন তারা ব্রিটিশ সরকারের কোপে পড়ে গ্রেপ্তার হচ্ছিলেন। কলেজ ও বিদ্যালয়গুলিকে হয় সরকারি আদেশ মানতে বাধ্য হতে হচ্ছিল নচেৎ তা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল। যেমনটা ঘটেছিল সেনহাটি জাতীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক হীরালাল সেনের ক্ষেত্রে। রবীন্দ্রনাথকে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর কবিতার বই হুঙ্কার, রবীন্দ্রনাথকে সে মামলায় সাক্ষী হিসেবে হাজির হতে হয় এবং হীরালালের ছয়মাস জেল হয়। জেল থেকে বেরিয়ে এলে তার চাকরি যায় এবং রবীন্দ্রনাথ প্রথমে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন হীরালালকে। হীরালাল সেনকে শান্তিনিকেতনে রাখার প্রবল ইচ্ছে থাকলেও ব্রিটিশের সঙ্গে দ্বন্দ্বে পেরে উঠলেন না তিনি।

১৯১২ সালে পূর্ববঙ্গ-আসাম গবর্মেন্ট গোপন ইস্তাহার প্রচার করে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে। যার মূল কথা হল শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় তাদের ছেলেদের পড়বার উপযুক্ত স্থান নয়। যা একপ্রকার সরকারি হুমকি যাতে দলে দলে ছেলে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যেতে থাকে। বিদ্যালয় বাঁচাতে তিনি হীরালাল সেনকে শান্তিনিকেতন থেকে সরিয়ে দেন, কালীগ্রামে তাঁর জমিদারীতেই কাজের ব্যবস্থা করেন।

ভারতবর্ষের ধর্ম

১৯০৮ সালে ক্ষিতিমোহন সেন ও বিধুশেখর শাস্ত্রী যোগদান করলেন শান্তিনিকেতনে। ক্ষিতিমোহন যেমন সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিত তেমনই আবার তথাকথিত মধ্যযুগের সন্তধর্মের কবিদের গানের সংগ্রাহকও। তাঁর সংগ্রহ থেকে রবীন্দ্রনাথ আরও বেশি জানতে পারেন এইসব সন্তদের কথা। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, ‘‘ভারতীয় মধ্যযুগের কবিস্মৃতিভাণ্ডার সুহৃদ ক্ষিতিমোহনের কাছ থেকে কবি রজ্জবের একটি বাণী পেয়েছি। তিনি বলেছেন—

সব সাঁচ মিলৈ সো সাঁচ হৈ, না মিলে সো ঝুঁট।
জন রজ্জব সাঁচী কহী ভাবই রিঝি ভাবই রূঠ।।

সব সত্যের সঙ্গে যা মেলে তাই সত্য, যা মিলল না তা মিথ্যে; রজ্জব বলছে, এই কথাটি খাঁটি— এতে তুমি খুশিই হও আর রাগই করো।’’

যে মত বা প্রথার বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিল থাকে না তাকে গলার জোরে ও গায়ের জোরে, উত্তেজনা উগ্রতা মিশিয়ে প্রমাণ করতে হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাবনার জগতেরও বিবর্তন হচ্ছে, বর্ণবাদকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছেন বিশ্বমানবতার দিকে। ক্ষিতিমোহনের বাউল গানের সংগ্রহ থেকে তিনি তুলে নিচ্ছেন কয়েকটি লাইন ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধতে।

জীবে জীবে চাইয়া দেখি
সবই যে তার অবতার—
ও তুই নতুন লীলা কী দেখাবি,
যার নিত্যলীলা চমৎকার।

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

উপন্যাসের চরিত্র গোরা, যে প্রথমে ব্রাহ্ম হলেও ধীরে উগ্র হিন্দুত্ব ও হিন্দু জাতীয়তাবাদকে আশ্রয় করে প্রবল নিয়মনীতি আচার আচরণে নিষ্ঠ হয়ে ওঠে শুধু নয়, হিন্দুয়ানির প্রচারে দল গঠন করে ফেলে। পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লেখে, তর্ক করে, হিন্দুয়ানির প্রচারে যা করণীয় সবকিছু করতে থাকে। এই পর্যন্ত গোরা চরিত্রে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের ছায়া দেখতে পাই। প্রথম জীবনে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে সেই ধর্মপ্রচারে ব্যস্ত উপাধ্যায় পরবর্তীতে উগ্র হিন্দুত্ব ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের পথ ধরেন। ব্রহ্মবান্ধবের জীবন এখানেই শেষ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের চরিত্র এবার বেরয় গ্রামভ্রমণে। দেখতে বুঝতে জানতে চায় আসল ভারতবর্ষকে, যেখানে বাস্তব সত্যের সঙ্গে তার আচার বিচার বর্ণবাদ, জাতিভেদ এসবের দ্বন্দ্ব বাধে। বুঝতে পারে এইসবই বাস্তবে সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেয়, যা এই দেশকে শতধাবিভক্ত করে ফেলছে ভিতরে ভিতরে। ধর্ম যদি মানুষকে ধারণ করতে না পারে তবে তা কীসের ধর্ম। মানুষে মানুষে ভেদ সৃষ্টি করে যা, তা ভারতবর্ষের ধর্ম হতে পারে না। তাই সব শেষে পরেশবাবুর কাছে আসে গোরা সেই দেবতার মন্ত্র চাইতে, ‘‘যিনি হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান ব্রাহ্ম সকলেরই— যার মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে, কোনো ব্যক্তির কাছে, কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না— যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।’’

রবীন্দ্রনাথ নিজেও যে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলেছেন, হিন্দু ও ব্রাহ্মধর্মের ঊর্ধ্বে মানুষের ধর্মে পৌঁছবেন শেষত। [চলবে]

চিত্র: শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »